আহমাদ মাযহার
বাংলাদেশি কবিতায় ভিন্ন সাংস্কৃতিক মানসের অন্তর্ভুক্তি তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান চিহ্নায়ক। তাঁর সাম্প্রতিক কবিতাবলি এই নিজস্বতারই সারাৎসার। বাংলাদেশের কবিতার বহির্বিশ্বসম্প্রসারিত ভূগোলের আদি দ্রষ্টা হিসেবে একদিন শামস আল মমীনকে যদি চিহ্নিত করা হয় তবে তা হয়তো অত্যুক্তি হবে না
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের পঞ্চাশ বছর সময় পরিসরে বাংলা ভাষার কবিতাপ্রয়াসীদের কথা বিবেচনায় রাখলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে জেগে-ওঠা বাংলা ভাষার সাহিত্যিকের খোঁজ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে নিজেদের জাতীয়তার চিহ্ন নিয়ে অন্য যে দেশে স্থায়ীভাবে বাস করে চলেছেন তাঁরা এখনও সেসব দেশের সাংস্কৃতিকতাকে নিজেদের উৎস সাংস্কৃতিকতার সঙ্গে এমন সংশ্লেষ ঘটাতে পারেননি যা তাঁদের মানসপ্রবণতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে। প্রসঙ্গত যে দু-চারজনের নাম মনে আসতে পারে তাঁদের প্রায় সকলেরই চর্চার সূচনা ঘটে গিয়েছিল তাঁদের বাংলাদেশে বসবাসকালেই, এবং তাঁদের প্রায় সকলেরই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে বাসকালে সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দ্বারা গড়ে-ওঠা। ফলে তাঁদের সংস্কৃতিচর্চার মানসভিত্তিতে যে দেশে তাঁরা বসবাস করছেন সেখানকার উপলব্ধির উল্লেখযোগ্য প্রকাশ দেখা যায় না। অর্থাৎ বাংলাভাষী এমন সাহিত্যপ্রয়াসী এখনও খুবই দুর্লভ যাঁদের সাহিত্যমানসের নৃতাত্ত্বিক উৎস প্রধানত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হলেও মনোভঙ্গিটি গড়ে উঠেছে যে দেশে তাঁদের বসবাস সে দেশের সাংস্কৃতিকতার আবহে ও প্রভাবে।
উপর্যুক্ত সিদ্ধান্তটি সাহিত্যপ্রয়াসীদের মধ্যে চালানো কোনও পদ্ধতিগত গবেষণার ফল নয়, অনির্দিষ্ট সাধারণ পাঠ থেকে পাওয়া উপলব্ধি। আমার অনুমান পদ্ধতিগত গবেষণা থেকেও এর অন্যথা পাওয়া যাবে না। তবে শামস আল মমীনের কবিতায় যে আবহটি আমার পাঠকতায় সাড়া দিয়েছে অন্তত তার ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলা যেতে পারে, আমার পাঠ অভিজ্ঞতায় তিনি বাংলা ভাষার এমন একজন কবি যিনি একদিকে বাংলাদেশের কৃষিপরম্পরার উত্তরাধিকারী, অর্থাৎ কৃষিপরম্পরা যাঁর মানসভিত্তির উৎস— আবার এরই সমান্তরালে আমেরিকার পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিকতাও ততটাই তাঁর চৈতন্যে ক্রিয়াশীল। বাংলাভাষার কবিতাসৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের জীবনবোধ যতটা অন্তঃশীল হয়েছে পঠনপাঠন সূত্রে, তার তুলনায় জীবনযাপনসূত্রে প্রভাবিত হয়েছে অনেক ক্ষীণ ধারায়। কিন্তু শামস আল মমীন এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ দীর্ঘকালীন জীবনযাপনসূত্রে ‘আমেরিকান’ এবং ‘বাঙালি’ দুটো শব্দই তাঁর মানসক্রিয়ায় সমান তাৎপর্যপূর্ণ। এর মূলে রয়েছে কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে তাঁর মার্কিন দেশে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়তে চলে আসা। আশির দশকের প্রথম ভাগে, ১৯৮২ সালেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। পড়াশোনা শেষে আর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাংলাদেশে ফেরা হয়নি।
নিতান্ত কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে তিনি আমেরিকার এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়তে আসেন যে-বিশ্ববিদ্যালয়টি এমন এক রাজ্যে অবস্থিত যেখানে বাংলাভাষী মানুষ ছিল বিরল প্রাণীবিশেষের মতো। ফলে জীবনোপলব্ধির পরিগ্রহণ ঘটেছে এই বিসাংস্কৃতিকতাতেই। বাংলা কোনও টেক্সট পড়া তো দূরের কথা ইংরেজির ভাষা সম্পর্কিত কোনও প্রতীক ছাড়া বছর চারেক তাঁর মনোভঙ্গি প্রকাশের অনুশীলন চলবার অবকাশও প্রায় ছিল না। অর্থাৎ তাঁর এই সময় পরিসরের যাপিত জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে সম্পূর্ণভাবে বাঙালি সংস্কৃতির সংস্পর্শশূন্য থেকেই। তরুণতর বয়সে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর চিন্তনক্রিয়া ও পঠনভাষা মার্কিনি ইংরেজি পরিমণ্ডলের হওয়ায় তাঁর ধারণাকল্প গঠনে ও ভাষিক প্রকাশক্রিয়াতেও ঈষৎ পরিবর্তন ঘটেছে। পরে আশির দশকের গোড়ায় তিনি নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে এলে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয় ও বাংলা ভাষার টেক্সটের সঙ্গে ক্রমশ গড়ে ওঠে মানসিক সম্পর্ক। কিন্তু তারপরও তাঁর চিন্তন প্রক্রিয়ার অনুশীলনে মার্কিনবাসের অভিজ্ঞতার ক্রিয়াশীলতা তাঁর বিষয়াবধারণে স্বাতন্ত্র্য গড়ে দিয়েছে।
পেশাগত জীবনেও তিনি ছাত্রদের পড়িয়েছেন ইংরেজিই। কবিতা তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্র বলে কবিতা পড়েছেনও বেশি। বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও বাংলাদেশে বসবাসকালে তিনি কবিতা লিখতেন না। তখন বরং বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার জাতীয় দৈনিক অবজারভারে গদ্য লিখতেন। ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনেও ইংরেজি ভাষাই বাহন হয়ে ওঠায় এবং ব্যক্তিগত আগ্রহে সমকালীন মার্কিনি কবিতায় ধারাবাহিক অবগাহনে ও চর্চায় যে অনুশীলিত রুচি গড়ে উঠেছে তা-ই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ও ভাষাকেও প্রভাবিত করেছে।
কিশোর বয়সেই তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক রচনা পাঠেও বিশেষ আগ্রহ ছিল; এর প্রভাবও প্রভাবিত করেছে তাঁর সাহিত্যিক জীবনকে। বিদ্যায়তনিক লেখাপড়া শেষে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার অনেক পরে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। মার্কিন দেশে বসবাস শুরু করবার পর কিন্তু দেশের সঙ্গে সুদীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও বাংলা কবিতার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিন্ন হয়নি কখনও। যে যুগে ইন্টারনেট ছিল না সে যুগেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিকের সাহিত্য পাতা আর সাহিত্য বিষয়ক পত্র-পত্রিকা নিয়মিত সংগ্রহ করে পড়তেন। ফলে বাংলা কবিতাচর্চায় ভাষা ও মননের জলবায়ুর ঘাটতি পড়েনি তাঁর মনোজগতে। উপরন্তু বসবাসসূত্রে যোগ হয়েছে আমেরিকান জীবনযাপনের মনন। নিতান্ত কৈশোরোত্তীর্ণ তারুণ্যের কালে শুরু করে তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভাষিক ও বিজাতিক দেশে বসবাস করেও বাংলাভাষায় ধারাবাহিকভাবে কবিতা লেখার প্রেরণা অর্জন করা ও তার লালন করা সহজ ব্যাপার নয়। কারণ তাঁর কবিতা লেখার শুরুই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে আসবার বেশ কিছু পরে। তিনি যদি বাংলাদেশে থাকাকালেই কবিতা লিখতেন তাহলে তাঁর কবিতা লেখার প্রেরণাগত দিকের উৎস অনুভব করা যেত। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে অনুধাবন করা যাবে এত অল্প বয়সে বাংলা অঞ্চল থেকে এমন দূর দেশে বসবাস শুরু করে বাংলা কবিতা সৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত হওয়া কতটা দুরূহ ব্যাপার!
শামস আল মমীন বয়সের দিক থেকে বাংলাদেশের শেষসত্তরের কবিদের সমসাময়িক। আশির দশকে বাংলাদেশে যখন লিটল ম্যাগাজিন-কেন্দ্রিক কাব্যপ্রয়াস সূচিত হয় তখনও তিনি বাংলা কবিতা থেকে বহুদূরবর্তী মানুষ! ফলে তিনি নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কবিতা লেখা শুরু করলেও বাংলা কবিতার দশক নির্দেশিত মানচিত্রে নব্বইয়ের দশকে উত্থিত কবিদের কাতারেও তাঁকে ফেলা যায় না। কারণ তাঁর কবিস্বভাব এর বাইরের ব্যাপার। আবার বাংলা ভাষায় কবিতাচর্চা করেছেন বলে বাংলা ভাষার কেন্দ্র ঢাকাতেই তাঁর কবি পরিচিতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সহ অভিজাত পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হওয়ায় কবি হিসেবে গড়ে উঠেছে তাঁর এই পরিচিতি। তাহলে কোথায় তাঁর অবস্থান? এই নাতিদীর্ঘ রচনাটি শেষ করব সেই কথা দিয়েই। তবে তার আগে তাঁর ও তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়ের ঠিকুজি একটুখানি দিয়ে নিই!
দুই.
নব্বইয়ের দশকে শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা সূত্রে তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। পরে ‘প্রথম আলো’তেও তাঁকে অনুবাদ ও স্বরচিত কবিতা নিয়ে সাজ্জাদ শরিফ-ব্রাত্য রাইসুর সম্পাদনাকালে উপস্থিত হতে দেখি। তখনও বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর কবিতা পড়েছি। একবিংশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে ব্রাত্য রাইসু তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন তাঁরই সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘আকার ইকার’ সহযোগে। আরও পরে তাঁর অনূদিত ‘সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা’ প্রকাশিত হলে আরেক যুক্তরাষ্ট্রবাসী ফকির ইলিয়াস বইটির একটি সমালোচনা লিখে পাঠালে তা আমি আমার সম্পাদিত ‘বইয়ের জগৎ’ পত্রিকায় প্রকাশ করি। ফলে শামস আল মমীনের সাহিত্যিক ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আমার এক ধরনের অবহিতি আগেই ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানতেই হবে নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে আসার আগে সে পাঠ ছিল কিছুটা আবছায়া, অমনোযোগী।
তিন.
সাহিত্যিকতাকে আমি জীবনযাপনের পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে থেকে দেখতে পারি না। ফলে একজন কবিকে আমি বিচ্ছিন্নভাবে শুধু কয়েকটি কবিতার মধ্যে খুঁজি না। শামস আল মমীনকেও আগে সামগ্রিকতায় সেভাবে আমার খুঁজে দেখা হয়নি। সে অর্থে প্রকৃতপক্ষে ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে বসবাস করতে এসেই প্রধানত তাঁর সাহিত্যিক সত্তার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ পরিচয়।
নিউ ইয়র্কে আসবার পরে যে দু-একজনের সঙ্গে আমার নিয়মিত সাহিত্যিকতায় কাটানো সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে শামস আল মমীন সর্বাগ্রগণ্য। কারণ তাঁকে দেখেছি আমি তাড়াহুড়োহীন সাহিত্যিক বৈষয়িকতাপূর্ণ জীবনযাপন করতে। ফলে নিউ ইয়র্কে এসে মূলত তাঁর সঙ্গেই কেটেছে আমার সাহিত্যিক জীবনযাপনের ভাববিনিময়। আমার আমেরিকান জীবনযাপন অনুসন্ধানে পেয়েছি তাঁর কার্যকর সহযোগ। নানা বৈষয়িকতা নিয়ে অনেক আড্ডা ও ফোনালাপ হয়েছে আমাদের; তবে সবকিছুর মোহনা শেষ পর্যন্ত থাকে কবিতায় বা সাহিত্যিকতায়। তাঁকে আমার সাহিত্যের ব্যায়ামবীর মনে হয়নি, মনে হয়নি দ্রুত খ্যাতির শিখরে চড়ে বসার প্রয়াস চালাতে উদ্যমী। লক্ষ্য তাঁর দূরে, গন্তব্য হয়তো অলক্ষ্য। কিন্তু দীর্ঘ ও ধারাবাহিক যাত্রায় থাকার প্রস্তুতি রয়েছে। কবি হিসেবে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতকে একটু নিবিড়ভাবে অনুভব করা সম্ভব হয়েছে আমার নিউ ইয়র্ক বাসের ফলে; পাঠ করা সম্ভব হয়েছে আগের তুলনায় গভীরতর ও অন্তরঙ্গভাবে। তবু আমি বলব না যে তাঁর কবিতা আমার পক্ষে পুরোপুরি মন্থন করা সম্ভব হয়েছে। গভীরভাবে একজন কবিকে আত্মস্থ করতে হলে পাঠককেও তার পাঠযাত্রার নানা পরিক্রমায় ফেলে দেখতে হয়। সেইরকম সম্পন্ন পাঠ এখনও আমার হয়ে ওঠেনি বলে তাঁর কবিতা নিয়ে সমগ্রধর্মী কোনও রচনা আমি এখনও লিখে উঠতে পারিনি। অতি অদূর ভবিষতে লিখে ফেলতে পারবই এমন আস্থা এখনও নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারি না।
কিন্তু তাঁর দিনযাপনে ‘কবিজীবনে’র যে আঁচ পাই তার আলোকে তাঁকে নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দু-এক কথা লেখা হয়ে ওঠে। বর্তমান রচনা তাঁর কবিতার পরিচয় কেবল নয়, খানিকটা আভাস তাঁর ‘কবিজীবনেরও’।
চার.
যে কথা ছোট্ট করে বলব বলে রচনাটি শুরু করেছিলাম তা এখানে পরিষ্কার করি। বাংলা কবিতার দশকী ট্রেনের যাত্রী তাঁকে করা না-যাওয়ার কারণ তাঁকে চলমান দেখতে হবে ‘আমেরিকান বাংলা কবিতা’র স্বতন্ত্র বাহনে। এই বাহনে আরও কেউ কেউ হয়তো আছেন তাদেরও খোঁজ হয়তো আমরা করব। সে প্রসঙ্গে বারান্তরে কথা বলা যাবে। আপতত ‘আমেরিকান বাঙালি কবি’ শামস আল মমীনকে কতটা চেনা যায় এই রচনায় তার অকিঞ্চিৎকর চেষ্টা করতে পারি।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কীভাবে তিনি কবিতায় যুগপৎ ‘আমেরিকান’ ও ‘বাঙালি’ হয়ে দেখা দিলেন? এর উত্তর সন্ধান করতে গেলে অনুভবে ধরা পড়ে যে, বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিকতার বাইরে ভিন্ন পরিমণ্ডলে অভিবাসন এখন এক বাস্তবতা। আশির দশকের প্রথম ভাগে সদ্য কৈশোর পেরোনো কাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রবাসী কবি শামস আল মমীন এই বাস্তবতারই একজন প্রতিনিধি। নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে প্রকাশিত নিজের লেখা কবিতার ৫টি ও আমেরিকান কবিতার একটি বাংলা অনুবাদ-সঙ্কলন তাঁর দীর্ঘ কবিতানিমগ্নতারই পরিচায়ক। প্রায় চল্লিশ বছরের বহির্বাস সত্ত্বেও বাংলাদেশের কবিতার সব সময়ের গভীর ও অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ চলমান রয়েছে তাঁর। অন্যদিকে নিউইয়র্কের মতো আন্তর্জাতিক ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মহানগরীর বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিকতায় জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কবির চৈতন্য তো এই বাস্তবতা থেকেই গ্রহণ করেছে তার সার ও সুধা! মার্কিনদেশে বসবাস, এখানকার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রত্ব এবং শিক্ষকতা সূত্রে সমকালীন মার্কিন কবিতার ধারাবাহিক অন্তরঙ্গ আস্বাদন তাঁর কবিচৈতন্যকে দিয়েছে স্বতন্ত্র এক মাত্রা! এক কথায় বাংলাদেশি কবিতায় ভিন্ন সাংস্কৃতিক মানসের অন্তর্ভুক্তি তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান চিহ্নায়ক। তাঁর সাম্প্রতিক কবিতাবলি এই নিজস্বতারই সারাৎসার। বাংলাদেশের কবিতার বহির্বিশ্বসম্প্রসারিত ভূগোলের আদি দ্রষ্টা হিসেবে একদিন শামস আল মমীনকে যদি চিহ্নিত করা হয় তবে তা হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
পাঁচ.
শামস আম মমীন দুই ভাষাতেই কবিতা লেখেন। নিউ ইয়র্ক মহানগরীতে বসবাস করার সুবাদে এই নগরীর বিভিন্ন কবিতা পাঠের আসরে তিনি মাঝে মাঝে ইংরেজি ভাষাতেও নিজের লেখা কবিতা পড়েন। একই বিষয়বস্তু ও আবেগকে তিনি দুই ভিন্ন ভাষাসংস্কৃতিতে প্রকাশ করেন। তাঁর দুই ভাষার কবিতাই পড়া ও শোনার মধ্য দিয়ে দুই ভাষার প্রকাশে যে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা তাঁর কবিচৈতন্যকে ধারণ করে থাকে তা-ও আমার ব্যক্তি-অনুভবে ধরা দিয়েছে।
দুই ভাষাসংস্কৃতির ভিন্নতাকে তাঁর কবিতা পৃথকভাবে উভয় ভাষায় ধারণ করলেও এক ভাষা আবার অন্য ভাষাকে প্রভাবিতও করেছে। আলাদাভাবে এখানে উল্লেখ্য, বাংলা কবিতার বিষবস্তু নিরূপণ ও ভাষাসংগঠনে তাঁর কবিতা যে সূক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছে তা দু-একবারের পাঠে চটজলদি হয়তো অনুভব করা নাও যেতে পারে। কিন্তু বারংবার পাঠে ও শ্রবণে এই স্বাতন্ত্র্য অনুভবনীয়।
ছয়.
লক্ষ্যণীয়, বাঙালি জাতীয় সত্তার বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বজ্ঞানকে আত্মস্থ করতে চেয়েছে বাঙালি তার নিজের সমৃদ্ধির জন্য! এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘কেন্দ্রাভিগ বাংলাবোধ’ নামে সংজ্ঞায়িত করলে বোধ করি ভুল হবে না। এই যে, বাংলাদেশের ভেতর থেকে যারা বিশ্বের দিকে তাকান তাঁরা সম্পূর্ণত ‘বাংলাদেশের মানুষ’!
কিন্তু গত বিশ পঁচিশ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে মানুষ এমনভাবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে যে এর বড় একটা অংশের হয়তো কোনওদিনই আর বাংলাদেশে ফেরা হবে না। কিন্তু আলাদা বাস্তবতায়, ভিন্ন সংস্কৃতিতে তাদেরও যে-মানসবিকাশ ঘটছে তাও তো বাংলাদেশবাসীর ঐতিহ্যজাগরিত সত্তারই সম্পদ! এই নতুন পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক সত্তাকেই তো সমৃদ্ধ করবে; ক্রমশ বাড়তেও থাকবে বহির্বাসীদের এই সংখ্যা। এই ধরনের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘কেন্দ্রাতিগ বাংলাবোধ’ নামে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গির মানুষেরাই হচ্ছেন ‘বাংলাবিশ্বের মানুষ’! এই দুই বোধেরই সংশ্লেষই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের অভিমুখ! শামস আল মমীন বাংলা কবিতার এই ভবিষ্যমুখিতারই অগ্রবর্তী একজন।
শামস আল মমীনের কবিতার আলোচনায় আসবার আগে পরিপ্রেক্ষিতকে এটুকু পরিসর দেওয়ার কারণ পূর্বোক্ত পর্যালোচনা থেকেই অনুমেয়!
সাত.
বাংলাদেশের কবিতা যতটা মোটা দাগের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মার্কিনি ইংরেজি কবিতার অবস্থান তার চেয়ে অনেক দূরে। বাংলাদেশের কবিতার ভাষা এখনও সাধারণভাবে অতিকথা-অলঙ্কৃত হয়ে চলে। সরলভাবে দেখতে গেলে বাংলা ভাষার কবিতায় তিরিশি আধুনিকতা বিষয়বস্তু ও ভাষাগত দিক থেকে রোমান্টিকতা ও ভাবালুতাকে অনেকটা সরিয়ে আনার পরেও এখনও বাংলাদেশের কবিতার ভাষিক উচ্চারণে রবীন্দ্রস্বভাবিত ধ্বনিগত প্রস্বর প্রধান হয়ে মুর্চ্ছনা তোলে। এক ধরনের সংগ্রামী আবেগ বহুলাংশে প্রস্বরিত হতে চায় যেন বাংলাদেশের কবিতায়! বলা চলে, অন্তরের উচ্ছ্বসিত আবেগের ধ্বনিত ও ছন্দিত সুর যেন অন্তর্লীন মন্দ্রস্বরে বেজে চলে। হয়তো এ অঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম অনুশীলনের উপজাত এই সুর বাংলাদেশের কবিতার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ স্বভাবও।
কিন্তু সমকালীন আমেরিকান ইংরেজি কবিতার ভাষা অধিকাংশতই আটপৌরে, দৈনন্দিনতা ও সাধারণতা-নির্ভর; বাংলাদেশের কবিতা ততটা সাধারণত্বে উত্তরণের জন্য অনুশীলিত হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। হয়তো দৈনন্দিন পাঠেই সাম্প্রতিক আমেরিকান ইংরেজি কবিতার বিষয়বস্তু উপস্থাপনের ধরন তাঁকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। সেই সূত্রেই হয়তো বাংলা কবিতার বাহ্যিক সুরেলা স্বভাব শামস আল মমীনের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিব্যঞ্জিত সুরকে লুপ্ত করে সুরব্যক্তিত্ব-নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়! দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা তাঁর ‘দেশে দেশে’ কবিতাটি পাঠ করতে পারি।
নিউইয়র্কের আইল্যান্ডগুলো সারারাত
নিবে জ্বলে, কিন্তু
বহু বহু দেশে
এবং বাংলাদেশে,
এইক্ষণে চারিদিক ফর্শা হয়ে আসে
টেবিলে টেবিলে উষ্ণ রুটি, কমলার রস,
মেলামাইনের মায়াবী প্লেটে গোল গোল সব
ডিমের কুসুম
স্বাগত জানায়
সুপ্রভাত, হে সুসময়। কিন্তু
দেশে দেশে
ফেরিঘাটে
স্টেশনের প্লাটফর্মে
কুলিদের লাল লাল জামার ভেতর থেকে
সকালের সুশোভিত আলো
নদীভাঙ্গা উদ্বাস্তুর
ম্লান মুখ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসা
বিড়ির ধোঁয়ার মতো
আস্তে আস্তে
মিশে যায় গ্রাম ও শহর।
টাইম স্কয়ারে ছটফট করা আলোর ঝলক দেখতে দেখতে
কখন যে একটি বালক
হঠাৎ পিছলে পড়ে মিরপুরে, সাভারের
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার ফটকে
মালিবাগ মগবাজারে
রেললাইনের উপর
হাঁটু গেড়ে বসে থাকা বৃদ্ধের বিষণ্ন চোখে।
অনেক রাত জেগে থাকার পর
বিদেশফেরত দম্পতির স্ফীত অনুদানে
উলিপুর, তিস্তা, কুড়িগ্রামে
চকচক করে ওঠে মাদ্রাসার ঢেউটিন।
বস্তির অস্থির শীতে জড়সড় শিবু কাকা
রিলিফের কম্বল হাতে
ফোকলা দাঁতের বিষণ্ন হাসিতে আনন্দ ছড়ায়
মঙ্গাপীড়িত উলিপুরে…
এইসব দুপুর রাত্রি এবং
নীরব সকাল
ঘুরেফিরে আসে;
আমরা জানালা খুলে দেখি
কলতলে ভিড়,
ঝাড়ু হাতে রঘুনাথ ফুঁ দেয় গরম চায়ে,
আর
স্টেশনের প্লাটফর্মে
পাগলিটা…
তখনো গভীর ঘুমে।—’দেশে দেশে’, অনেক রাত জেগে থাকবার পর, পৃষ্ঠা-৪৮
এই কবিতায় বাংলাদেশের প্রতি আবেগ আছে, কিন্তু নেই আবেগ প্রকাশের উচ্ছ্বাস! কবিতার বাকভঙ্গিতে নেই ধ্বনিগত প্রস্বর! এই কবিতার রচয়িতা যে বাংলাদেশেরই মানুষ, বাংলাদেশ থেকে বহু দূরের দেশে তাঁর বাস তা বোঝা যায়। অন্য একটা পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাংলাদেশের মানুষের মনোজগৎকে কবিতায় ছুঁয়ে গেছেন। আমেরিকাবসী বাঙালি কবির পক্ষে যেমন মস্তিষ্কের নিউরন থেকে বাংলাদেশকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, তেমনি উপেক্ষা করা সম্ভব নয় আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে। ফলে একজন দীর্ঘকালের আমেরিকাবাসী কবির ভাবজগতে একটা স্বতন্ত্র সংশ্লেষ ঘটবারই কথা। কিন্তু বাংলাভাষী কবিদের অভিবাসিত জীবনে তা খুব একটা ঘটেনি। সামান্য ব্যতিক্রম থাকলেও তা সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার স্বভাবের সঙ্গে মিশে থেকে যাপিত জীবনের চিহ্নায়ক হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু শামস আল মমীনের কবিপ্রবণতা ভিত্তি পেয়েছে বাংলার দেশীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে আমেরিকাবাস সূত্রে পাওয়া জীবনোপলব্ধিকে অবলম্বন করে! ফলে তাঁর কবিতার ভূগোল নিছক ভূগোলের উল্লেখজনিত সাধারণ সঙ্কেত হয়ে থাকে না, জীবনযাপনের স্থান হিসেবেই উপলব্ধ হয়। তাঁর এই মনোভঙ্গির গভীর প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, ‘আমার বাড়ি’ কবিতায়—
আমার বাড়ি যে রংপুরে, আমি কি ভুলে গেছি?
আনিস আমার বন্ধু ছিল, আমি কোনদিন ভুলে যাব?
গ্রাম্যপথে গাড়ির চাকার আঁকাবাঁকা দাগ
শ্মশানের চারপাশে পোড়া কাঠখড়ি
ছড়ানো-ছিটানো হাড় আমি কি
ভুলে গেছি?
আমি কি ভুলে গেছি বদরগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়,
ডাকবাংলার কিচিরমিচির আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা পাখিদের ছায়া, হক সাহেব
মমিন চৌধুরী আর মিজান স্যারের নীরব স্নেহের কথা?
আমি কি ভুলে গেছি ডালে ডালে বসে থাকা
হলুদ পাখিটার কথা, কেন যে আমাক দেখলেই
পাখিটা উড়াল দিত?
আমি কি ভুলে গেছি, ঘন বরষায় মাথা উঁচু করে থাকা
সোনালি আঁশের ক্ষেত, মাইক বাজিয়ে ঘাটিয়ালের হালখাতা,
আমি কি ভুলে গেছি, কোন মাসে সরস্বতী পূজা?
আমি কি ভুলে গেছি যাত্রানায়কের রকমারি জামা, আর
শেষরাতে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাবের শেষ আর্তনাদ?
আমি তো দেখেছি সারি সারি পিঁপড়ার দল
কি অলীক ঐক্যে উঠে গেছে ঢিবির উপর!
আমার তো মনে আছে পায়রাবন্দর, বেগম
রোকেয়ার বাড়িঘর
আমার তো মনে আছে তাজহাট জমিদারবাড়ি,
‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’।
আমার তো মনে আছে ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা
আমার তো মনে আছে নূরলদীনের কথা।
তোমরা সবাই লেখি রাখেন বাহে
মোর বাড়ি বদরগঞ্জ
জেলা রঙ্গপুর।—‘আমার বাড়ি’, অনেক রাত জেগে থাকবার পর, পৃষ্ঠা-৪৮
সূত্র হিসেবে তাঁর এই মনোভঙ্গি এই দুই কবিতায় যেমন আছে সর্বত্র হয়তো এতটাই স্পষ্ট ভাবে অনুভব করা যায় না, কিন্তু তাঁর অন্তঃশীল বোধে এই দুই ভুবনের অন্তরঙ্গ অনুষঙ্গ প্রবাহিত থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে। দুই ভুবনের এই যৌথ বোধই তাঁর কবিতার ‘আমেরিকান বাঙালি সত্তা’!
আট.
শামস আল মমীনের এই ‘আমেরিকান বাঙালি সত্তা’ অর্জন সম্ভব হওয়ারও পটভূমিতে ক্রিয়াশীল তাঁর সাহিত্যিক বৈষয়িকতা। অনেকেই স্বীকার করবেন, ‘সাহিত্যিক’ এবং ‘বৈষয়িকতা’ শব্দদুটি যেন পরস্পরবিরোধী অনুষঙ্গ হিসেবেই বাংলাসমাজে বিবেচিত হয়। কিন্তু একজন লেখকের সত্তাকে সার্বক্ষণিক সক্রিয় রাখতে হলে নিজের জীবনটাকেও যে ‘লেখকতার বৈষয়িকতা’য় বিন্যস্ত করতে হয় সে ব্যাপারে অনেকে সচেতন থাকেন না! যাঁরা লেখক হিসেবে এতটাই জনপ্রিয় যে কেবল লেখাকেই জীবিকা জ্ঞান করতে পারেন তাঁদের কথা আলাদা; লেখালিখির সঙ্গে বৈষয়িক সম্পর্ক তাঁদের যাপিত জীবন প্রক্রিয়াতে আপনা আপনিই গড়ে ওঠে। কিন্তু যে লেখকের লেখা থেকে আসা অর্থে জীবনযাপনের ব্যয়ভার চালানো সম্ভব নয় তাঁকে তো লেখকীয় বৈষয়িকতা অনুশীলন করতেই হবে; তা না হলে জীবন ও জীবিকার ঘূর্ণাবর্ত কখন যে লেখকসত্তাকে তার পথ থেকে ছিটকে ফেলবে তা লেখক নিজেও জানতে বা বুঝতে পারবেন না। অনেক প্রতিভাবান লেখকসত্তাকে আমরা জীবন ও জীবিকার পাঁকে পড়ে এভাবেই হারিয়ে যেতে দেখেছি।
শামস আল মমীন নিজের মধ্যে যখন ক্রমশ কবিসত্তার জাগরণ অনুভব করতে থাকেন তখন থেকেই নিজের যাপিত জীবনকেও লেখকতার সঙ্গে সমন্বিত করে নিয়েছেন। আমেরিকার মতো বাংলা সাংস্কৃতিক প্রবাহ বর্জিত দেশে সঙ্কীর্ণ বাংলা সাংস্কৃতিকতায় বাস করে বাংলা কবিতা লেখার প্রেরণাকে সজীব রাখতে হলে যে নিজের মধ্যে এই সংক্রান্ত করণীয়কে সনাক্ত করতে হবে, যাপন করতে হবে এসবের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সমন্বিত একটি জীবন— এমন বোধকেই ‘সাহিত্যিক-বৈষয়িকতা’ বা ‘লেখকীয়-বৈষয়িকতা’ শব্দযুগলে আমি চিহ্নিত করতে চাই। তাঁর সঙ্গে আলাপসূত্রে জেনেছি যে কালে ইন্টারনেটে বাংলা পাঠসামগ্রী সুলভ ছিল না সেই সময়ে এক দশকেরও বেশি কাল ধরে সমকালীন বাংলা কবিতার সঙ্গে হালনাগাদ থাকবার জন্য দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিকীগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করে পড়তেন। এ তো গেল সাংস্কৃতিকতার মধ্যে থাকবার তাঁর দুরূহ প্রয়াসের কথা; অন্যদিকে আর্থিক উন্নতির হাতছানি ত্যাগ তাঁর আর এক সাহিত্যিক বৈষয়িকতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত! লক্ষ্যণীয়, তিনি নিউ ইয়র্ক বোর্ড অব এডুকেশনের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালেই নিউ ইয়র্কে বাংলা কোচিং সেন্টারগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে। শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচিং ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার হাতছানি তাঁরও ছিল। অর্থিক বৈষয়িকতার হাতছানিতে শুরুও করেছিলেন একটি টিউটোরিয়াল সেন্টার পরিচালনা। কিন্তু যখন অনুভব করলেন এই কাজ তাঁর যাপিত জীবনকে অন্য খাতে নিয়ে যাচ্ছে, প্রতিকূল হয়ে উঠছে কবিতার প্রতি মনোযোগের, তখনই তিনি ত্যাগ করলেন বাড়তি উপার্জনলক্ষ্যী লোভনীয় সেই প্রয়াস। অর্থাৎ ‘অর্থোপার্জনের বৈষয়িকতা’র চেয়ে তিনি অগ্রাধিকার দিলেন ‘লেখকতার বৈষয়িকতা’কে।
এভাবে কবিতা ও জীবনকে একই এককের আওতাভুক্ত করে নিতে পারেন বলে তাঁর কবিতা সীমিত থাকেনি কেবল ডায়াস্পোরিক স্মৃতি-কণ্ডুয়নে, কিংবা পড়ে থাকেনি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় হালনাগাদ না হওয়া জীবনানুভূতির ভাষ্য হয়ে! সম্ভবত তাঁর এই ধরনের দ্বিমুখী অনুশীলনই বাংলাদেশ ভিত্তিক উত্তর কালের বাংলা কবিতায় বৈশ্বিকতার স্বতন্ত্র ব্যাপ্তিতে ভুমিকা রাখবে। শামস আল মমীনকে আমি এই ধারার পথিকৃতের স্থানেই রাখতে চাই!