Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রবীন্দ্রনাথ কি কোয়ান্টামতত্ত্ব পূর্বানুমান করেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ কি কোয়ান্টামতত্ত্ব পূর্বানুমান করেছিলেন? | দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

দেবাশিস্ভট্টাচার্য

 


কোয়ান্টামতত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নাকি তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো সংগ্রহ করেছিলেন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ থেকে! বেদের বাণী নাকি তাঁকে সরবরাহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, যখন হাইজেনবার্গ এ দেশে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন! কেন্দ্র সরকারের মন্ত্রীসান্ত্রীদের সঙ্গে কিছু বিজ্ঞানীরাও যখন এসব বলেন তখন একটু খতিয়ে দেখতে হয় বইকি

 

পাঠক নিশ্চয়ই শিরোনামটা পড়েই অবাক হয়ে ভাবছেন, সেকি, রবীন্দ্রনাথ তো বিজ্ঞানী নন, মহান কবি, তাহলে তিনি কীভাবেই বা একটা ভয়ঙ্কর জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আবিষ্কার আগে থেকে আঁচ করবেন, আর খামোখা সে চেষ্টাই বা করতে যাবেন কেন, কী দায় পড়েছে তাঁর? যদি পাঠকের মনে এ প্রশ্ন জেগে থাকে তাহলে বলি, আজ্ঞে ঘাবড়াবেন না, এ প্রশ্ন তো আমারও। অবশ্য এও জানি যে, এ আশ্বাসে পাঠক সন্তুষ্ট হবেন এমন সম্ভাবনা যৎসামান্য। তিনি হয়তো আবারও জানতে চাইবেন, ধুর মশায়, নিজেই জানেন না তো কলম বাগিয়ে উদ্ভট সব জিনিসপত্তর লিখতে বসলেন কেন? সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই হাবিজাবি না লিখলে বুঝি পেটের ভাত হজম হয় না আপনার?

কেন যে লিখতে বসলাম, সেই কথাটাই তবে বলে নিই সবার আগে। আসলে, হোমরাচোমরা ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন ধরেই কথাটা বলে আসছেন। যেমন ধরুন, এই তো কয়েক বছর আগে আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) রাজনাথ সিং প্রকাশ্যে লিখিত বিবৃতি দিয়ে বলে বসলেন, কোয়ান্টামতত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নাকি তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো সংগ্রহ করেছিলেন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ থেকে![1] তা, হাইজেনবার্গ কীভাবে পারলেন সেটা? তিনি কি নিবিড়ভাবে বেদপাঠ করেছিলেন? নাঃ, তেমন কোনও খবর নেই। তবে, বেদের বাণী নাকি তাঁকে সরবরাহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, যখন হাইজেনবার্গ এ দেশে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন! তা সে যাকগে, বাদ দিন। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসান্ত্রীদের সঙ্গে বিজ্ঞানবোধের সম্পর্ক যে আদায়-কাঁচকলায়, সে আর কে না জানে! কিন্তু স্বনামধন্য বিজ্ঞানবেত্তারাই যদি এমন বলেন, তখন? যেমন ধরুন, কলকাতার প্রখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র ‘সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’-এর প্রাক্তন কর্ণধার বিকাশ সিংহ মহাশয়? স্বনামধন্য কোয়ান্টামতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর হোম? ‘দ্য তাও অফ ফিজিক্স’ গ্রন্থের বিশ্বখ্যাত লেখক ফ্রিৎজফ কাপ্রা? এমনকি, নোবেলজয়ী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং ইলিয়া প্রিগোজিন? এঁরা যদি এমন কথা বলেন, তা কি সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায়? উঁহু, না। তখন তো বিষয়টাকে খতিয়ে দেখতেই হয়!

কাজেই, চলুন একবার ভাল করে দেখে নেওয়া যাক এ বিষয়ে কে কী বলতে চেয়েছেন। প্রথমেই ধরা যাক পরমাণু-বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ মহাশয়ের কথা। তাঁর ‘কৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি’ বইয়ের অন্তর্গত অন্তত তিনটি প্রবন্ধে— ‘বিশ্বকবি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’, ‘কেউ দেখছে, তাই আকাশে চাঁদ আছে’, এবং ‘বাদ পড়ল কবির বিজ্ঞানচেতনা’— তিনি এমন ধরনের বক্তব্য পেশ করতে চেয়েছেন। এই একই অভিমুখে, যদিও আরও অনেক বেশি জটিল, অ্যাকাডেমিক ও ক্রিটিক্যাল চিন্তাসূত্র ধরতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রবীন্দ্র-বিশারদ অ্যান্ড্রু রবিনসন এবং স্বনামধন্য কোয়ান্টামতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর হোম, তাঁদের “Einstein and Tagore: Man, Nature and Mysticism” শীর্ষক যৌথ গবেষণাপত্রে। অস্ট্রীয়-মার্কিন কণা-পদার্থবিদ ফ্রিৎজফ কাপ্রা তাঁর ‘Uncommon Wisdom’ বইতে দাবি করেছেন, বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের সঙ্গে তাঁর একান্ত কথোপকথনের সময়ে হাইজেনবার্গ স্বয়ং নাকি তাঁকে বলেন, কোয়ান্টামতত্ত্ব-সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত বৈপ্লবিক আবিষ্কার তিনি করেছেন, তার মূল ধ্যানধারণাগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য নাকি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন হিন্দু দর্শনের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে, এবং হিন্দু দর্শনের ধ্যানধারণাগুলো তাঁকে ব্যাখ্যা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এবং তাতে হাইজেনবার্গের প্রভূত উপকার হয়েছিল। ওপরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহোদয়ের যে অত্যাশ্চর্য উক্তিটি উল্লেখিত হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উৎস সম্ভবত কাপ্রাসায়েবের এই বইটিই (বিজ্ঞান ও ধর্মের খিচুড়ি রন্ধনে যাঁরা অত্যুৎসাহী, তাঁদের অধিকাংশেরই প্রধান অবলম্বন এই বহুল প্রচারিত গ্রন্থটি)। হাইজেনবার্গ ছাড়া আর যে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী-দার্শনিকের নাম এই সূত্রে উঠে আসে, তিনি হলেন বেলজিয়ামের ইলিয়া প্রিগোজিন। উপরোক্ত লেখকেরা সকলেই কোনও না কোনওভাবে তাঁর এবং হাইজেনবার্গের নাম নিয়েছেন এই সূত্রে।

কে ঠিক কী বলেছেন সেটা নির্দিষ্ট উদ্ধৃতি দিয়ে সবিস্তারে দেখাতে পারলে নিশ্চয়ই ভাল হত, কিন্তু এ ক্ষুদ্র নিবন্ধে সে পরিসর নেই, আর মোদ্দা কথাটা বোঝাতে গেলে বোধহয় এখুনি তার দরকারও নেই। পরে প্রয়োজন হলে দু-একটি উদ্ধৃতি হাজির করা যেতে পারে। কিন্তু আপাতত এটুকুই বলা যাক, উপরোক্ত লেখকদের সবার বক্তব্য, ভঙ্গি ও গভীরতা এক না হলেও, একটা কেন্দ্রীয় ঝোঁক সবারই আছে, হাইজেনবার্গ ও প্রিগোজিন বাদ দিলে (শেষের দুজনের কথায় পরে আসছি, আর বাকিরা সকলেই এঁদেরকেই শেষতক সাক্ষী মেনেছেন)। সে ঝোঁকের ভেতরকার মোদ্দা কথাটা অনেকটা এই রকম। সপ্তদশ-অষ্টাদশ-উনিশ শতক জুড়ে জগৎ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রামাণ্য সত্যজ্ঞানের মর্যাদা পেয়ে আসা নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা ছিল কট্টর বস্তুবাদী, সেখানে বাস্তব জগতের স্থান বরাদ্দ ছিল পুরোপুরি মনের বাইরে, কাজেই মন তাকে শুধু জানতে পারত, বাস্তবতার অস্তিত্ব নির্ধারণে আদৌ কোনও ভূমিকা নিতে পারত না। কিন্তু বিশ শতকের গোড়া থেকেই, এবং দ্বিতীয়ার্ধ থেকে খুব বেশি করে, আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টামতত্ত্বের মতো নতুন ধারার পদার্থবিদ্যার চাপে নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার আধিপত্য হঠাৎই ভেঙে পড়তে থাকে। পদার্থকণার মধ্যে তরঙ্গসুলভ আচরণ, পদার্থকণার বেগ ও অবস্থান পরিমাপের প্রশ্নে মূলগত অনিশ্চয়তা, ‘ওয়েভ ফাংশন কোলাপ্‌স্‌’ ও ‘ননলোক্যালিটি’ জাতীয় আনকোরা অদ্ভুত ধ্যানধারণার উদ্ভব, এইসব অনস্বীকার্য ঘটনার মুখে দাঁড়িয়ে ‘বাস্তবতা’ সংক্রান্ত পুরনো ধারণা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বস্তুর অস্তিত্ব মাপজোক্ করতে গিয়ে আমাদের মন ও চেতনাই তাকে বানিয়ে তুলছে কিনা, তখন সে প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াল (দার্শনিকদের একাংশ যদিও এ প্রশ্ন বহু প্রাচীনকাল থেকেই তুলে আসছেন)। ফলে বস্তুবাদের প্রতাপ কমে গিয়ে ভাববাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে, মন ও আত্মার গুরুত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়। ষোড়শ শতক থেকে জাঁকিয়ে বসা যে দাপুটে ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ এতদিন মানুষের আবেগ-অনুভূতি-ধর্মবিশ্বাসকে পাত্তা দিতে চাইত না, ‘জ্ঞান’ হিসেবে গণ্যই করত না, সেই কঠোর যুক্তি ও গণিত-নির্ভর বিজ্ঞানই শেষ পর্যন্ত মানুষের আবেগ-অনুভূতি-ধর্মবিশ্বাসকে এক নতুন মর্যাদার আসনে বসাল। যখন এই নতুন উপলব্ধির ধাক্কায় পশ্চিমি সাবেকি যুক্তিবাদ হতভম্ব ও বিহ্বল, তখনই নজর গেল পূবের দিকে, ডাক এল পশ্চিমি চিন্তার ধাঁচা ছেড়ে প্রাচ্যীয় মরমিয়াবাদের শরণ নেওয়ার। চিন্তাবিদরা ভেবে দেখতে চাইলেন, হিন্দু মায়াবাদ এবং চৈনিক তাওবাদী-বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বের মধ্যে এ নতুন সঙ্কটের সমাধান লুকিয়ে আছে কিনা।

আধুনিক পদার্থবিদ্যার উদ্ভব এবং তার সাংস্কৃতিক-দার্শনিক অভিঘাতের এই নাটকীয় বয়ানটি যথার্থই ইতিহাস-সম্মত কিনা, সে প্রশ্ন ভিন্ন, সে প্রশ্নটি বিজ্ঞান-ইতিহাসের সত্যিকারের ভারিক্কি পেশাদার বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়ে করলে সম্ভবত তাঁরা বাঁকা হাসি হাসবেন। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এরকম একটি বয়ান যে চালু আছে এবং বিশ শতকের শেষপাদে এসে তা যে যথেষ্ট প্রতিপত্তি অর্জন করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফ্রিৎজফ কাপ্রার ‘দ্য তাও অফ ফিজিক্স’ এবং গ্যারি জুকভের ‘দ্য ড্যান্সিং য়ু লি মাস্টার্স’ জাতীয় বইয়ের অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা ও ব্যবসায়িক সাফল্য এ প্রক্রিয়ারই অঙ্গমাত্র। কোনও কোনও ভারতীয় বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ একে ভারতের ‘অতীত গৌরব’ পুনরুদ্ধারের ইস্যু হিসেবে দেখেন, যেখানে অর্বাচীন পাশ্চাত্য নতজানু হয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী ভারতবর্ষের কাছে, এবং এই পরিসরেরই কোনও এক সুবিধাজনক স্থানাঙ্কে রবীন্দ্রনাথকে বসাতে চান। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী ছিলেন না, গণিত এবং যন্ত্রপাতি আদৌ তাঁর দক্ষতার ক্ষেত্র ছিল না, তবু তিনি তাঁর সুগভীর কবি-মনন এবং আর্ষপ্রজ্ঞা দিয়ে বাতলাতে পেরেছিলেন পশ্চিমি সঙ্কটের প্রাচ্যীয় দাওয়াই, এভাবে ভাবতে এবং ভাবাতে পারলেই তাঁদের সুখ ও তৃপ্তি। সত্তর-আশির দশকের মার্কিনি ‘কাউন্টার-কালচার’ আন্দোলনের অন্যতম আইকন ফ্রিৎজফ কাপ্রার অভিপ্রায় কেন যে এই একান্ত ভারতীয় আকাঙ্ক্ষাটির সঙ্গে সমাপতিত হয়, সে গল্প অবশ্য আলাদা। তা সে যাই হোক, এ আকাঙ্ক্ষাপূরণে তাঁদের সকলেরই হাতিয়ার মূলত এই চারটি জিনিসের একটি বা কয়েকটি— ১. রবীন্দ্র-আইনস্টাইন সংলাপ, যেখানে পশ্চিমি বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের মহাপ্রতিনিধি আইনস্টাইনকে রবীন্দ্রনাথ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন সাবেকি বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদের খামতি; ২. ‘আমি’ এবং ওই জাতীয় রবীন্দ্র-কবিতা যাতে কবি ঘোষণা করছেন, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে” ইত্যাদি, যেখানে চেতনা দিয়ে বাস্তবতাকে ‘নির্মাণ’ করার দাবি করা হচ্ছে; ৩. হাইজেনবার্গের সাক্ষ্য; এবং শেষত ৪. ইলিয়া প্রিগোজিনের সাক্ষ্য। এই শেষের দুই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর ভাষ্য এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এঁরা উভয়েই অনায়াসে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায় পড়বেন। অন্য যে বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কথা বলেছেন তাঁরা বিজ্ঞানী হিসেবে এঁদের সমকক্ষ নন, এবং তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো ভীষণভাবেই এঁদের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই, প্রথম দুটি বিষয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক হলেও, এ ক্ষুদ্র নিবন্ধে আমি মূলত এই দুই বিজ্ঞানীর সাক্ষ্যই নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চাইব। তাঁরা ঠিক কী বলেছিলেন? যা বলেছেন তার অর্থ কি আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছি? ফ্রিৎজফ কাপ্রা ও অন্যান্যরা তাঁদের বক্তব্য বলে যা তুলে ধরেছেন তা কতখানি গ্রহণযোগ্য? তাঁরা যা বলেছেন সে সম্পর্কে অন্যেরা কেউ কিছু বলেছেন কি? অন্যান্য স্বাধীন উৎস থেকে এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্যগুলো আলাদাভাবে যাচাই করার কোনও উপায় আছে কি? যা তাঁরা সত্যি সত্যি বলতে চেয়েছেন, তার অন্তর্বস্তুর যৌক্তিকতা ও যাথার্থ্য নিয়ে অন্যান্য যোগ্য বিজ্ঞানীরা কি কিছু বলেছেন? এইসব কথাগুলো এখানে আমরা একটু খুঁটিয়ে বিচার করার চেষ্টা করে দেখতে চাইব।

প্রথমে হাইজেনবার্গের কথা ধরা যাক। ফ্রিৎজফ কাপ্রা তাঁর ‘আনকমন উইসডম’ বইয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন, তাঁর পূর্ববর্তী গ্রন্থ ‘দ্য তাও অফ ফিজিক্স’-এ তিনি যে এতখানি ‘সফলভাবে’ ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মেলাতে পেরেছিলেন, সেটা সম্ভব হয়ে উঠেছিল কাদের অনুপ্রেরণা, সহমর্মিতা ও সাহচর্যে। এ প্রসঙ্গে যে সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে মোলাকাতের কথা তিনি বলেছেন, তার মধ্যে হাইজেনবার্গ অন্যতম প্রধান। ‘আনকমন উইসডম’ বইটির তেতাল্লিশ পাতায় তিনি যা বলেছেন, তার বাংলা তরজমা মোটামুটি এইরকম— “১৯২৯ সালে হাইজেনবার্গ ভারতে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আতিথ্যে, তখন উভয়ের মধ্যে বিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। তিনি আমাকে বললেন, ভারতীয় চিন্তার সঙ্গে এই পরিচয় ঘটে যাওয়াটা তাঁকে ভীষণ স্বস্তি দিয়েছিল। তিনি তখন বুঝতে শুরু করলেন যে, এই যে আজ আপেক্ষিকতা, সবকিছুর সঙ্গেই অন্য সবকিছুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক-বাঁধন, নশ্বরতা, এইসব বিষয়গুলোকে ভৌত বাস্তবতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে, যেগুলো কিনা এতদিন তাঁর এবং তাঁর সহকর্মী পদার্থবিদদের কাছে এত কঠিন ছিল, সেগুলোই আসলে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ভিত্তি।” এইটুকু বলেই কাপ্রা হাইজেনবার্গ-কে সরাসরি উদ্ধৃত করছেন— “টেগোরের সঙ্গে এই সংলাপের পর, যে সব ধ্যানধারণা এতদিন পাগল পাগল লাগত, সেগুলোই সহসা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল। এতে ভীষণই উপকার হয়েছিল আমার।” এই কথার পরই কাপ্রা হাইজেনবার্গ-কে জানান, তিনি অনেকদিন ধরেই আধুনিক পদার্থবিদ্যার সাথে প্রাচ্যীয় ধর্ম-দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। শুনে নাকি হাইজেনবার্গ বলেন, তিনিও ওভাবেই ভাবেন, কারণ, তিনি ও কাপ্রা আসলে নাকি একই ধরনের বিজ্ঞানী! তবে কিনা, যতদিন না বিজ্ঞানীসমাজ এইসব বুঝতে পারছে, ততদিন তাঁদেরকে সকলের সঙ্গে তালে তাল দিয়েই চলতে হবে।[2] স্বভাবতই, এসব কথা ভীষণ তৃপ্তি দিয়েছিল কাপ্রাকে।

এখন, হাইজেনবার্গ যদি এইসব বলে থাকেন, তো তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, সত্যিই কি সেদিন তিনি এইসব বলেছিলেন ফ্রিৎজফ কাপ্রাকে? এ নিয়ে কঠিন প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তিবাদী গবেষক আশীষ লাহিড়ী, তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ: মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান’ শীর্ষক বইয়ের একটি অধ্যায়ে। প্রথমত, ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হাইজেনবার্গের সাক্ষাৎ হলেও, সে সময়ে যে ওই ধরনের একটি অতি উল্লেখযোগ্য কথাবার্তা হয়েছিল, তেমন দাবি পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ বা হাইজেনবার্গ কারও তরফ থেকেই আসেনি। উভয় তরফেই এ নীরবতা যারপরনাই অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু ঘটে থাকলে হাইজেনবার্গ তা নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গেই বলতেন বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসুকে, যিনি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগ্নে এবং স্বয়ং খ্যাতিমান পদার্থবিদ। হাইজেনবার্গের ওই কলকাতা সফরে তাঁর ওপরই তো ছিল হাইজেনবার্গের দেখভালের ভার! হাইজেনবার্গ যে শ্রীবসুকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলেননি, এমন কিন্তু মোটেই নয়। তবে, তিনি বলেছিলেন ‘যেন প্রাচীনকালের কোনও ঋষি’ জাতীয় কিছু অতিপরিচিত কথা, যা কিনা প্রায় সব অতিথি বিদেশিই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলতেন। কিন্তু লক্ষণীয়, আলোচ্য প্রসঙ্গে তিনি কোনও কথাই শ্রীবসুকে ঘুণাক্ষরেও বলেননি। এও এক অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। এবং তৃতীয়ত, ও সবচেয়ে মোক্ষম, হাইজেনবার্গের স্ত্রী এলিজাবেথ পরবর্তীকালে খুব পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তাকে হাইজেনবার্গ মোটেই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে করেননি। শ্রীলাহিড়ীর প্রশ্ন হয়তো কাপ্রার কানে পৌঁছয়নি, কিন্তু পশ্চিমি বিদ্বজ্জনমহলেও সম্ভবত এ নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠেছিল। স্বনামাঙ্কিত একটি ওয়েবসাইটের এক ছোট্ট লেখায় ২০১৪ সালে কাপ্রা লিখেছেন, হাইজেনবার্গের কথা হয়তো তিনি তখন পুরো বুঝতে পারেননি, হাইজেনবার্গ হয়তো আসলে তাঁকে বলতে চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে ওইসব দার্শনিক উপলব্ধি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসেনি, এসেছিল ধীরে ধীরে, অনেক পরে। কিন্তু, এ ধরনের কৈফিয়তে আসলে সমস্যা মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে। একে তো হাইজেনবার্গের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় ১৯২৯ সালে, যার বহু আগেই হাইজেনবার্গ তাঁর মূল বৈপ্লবিক আবিষ্কারগুলো সবই সেরে ফেলেছেন, ফলত হিন্দু-চৈনিক দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে তিনি বিজ্ঞানকে নতুন দিশা দেখাবেন এরকম কোনও সম্ভাবনারই অস্তিত্ব ছিল না। তার ওপর, এর ওপর ভর করে পরবর্তীকালে তিনি কোনও মৌলিক আবিষ্কার করেছেন, এমন কোনও দাবি তিনি স্বয়ং বা কাপ্রা কেউই তোলেননি।

আর, যদি কাপ্রা এমন বুঝিয়ে থাকেন যে, সরাসরি মৌলিক আবিষ্কার না করলেও, হিন্দু-চৈনিক ধর্মতত্ত্বের সাহায্যে হাইজেনবার্গ তৎকালীন পদার্থবিদ্যাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে এক সংহততর দার্শনিক বোধে পৌঁছতে পেরেছিলেন, বালি সে গুড়েও। হাইজেনবার্গের পরবর্তী লেখাপত্রে তারই বা প্রতিফলন কোথায়? তিনি সে ধরনের বৈজ্ঞানিক ছিলেন না, যাঁরা শুধু ‘টেকনিক্যাল’ বিষয় নিয়েই কথা বলেন এবং দার্শনিক চিন্তাকে রেখে দেন নিজের ভেতরে। মোটেই তা নয়, হাইজেনবার্গ ধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে বারবারই সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। কোথায় সেখানে প্রাচ্যীয় ধর্মতত্ত্বে প্রভাবিত হওয়ার চিহ্ন? রবীন্দ্রসাক্ষাৎ-পরবর্তীকালে ১৯৩৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারের বক্তৃতা দিয়েছেন, ১৯৫২ সালে ‘পজিটিভিজ্‌ম্‌, মেটাফিজিক্স অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নামের প্রবন্ধে (পরবর্তীকালে ‘ফিজিক্স অ্যান্ড বিয়ন্ড’ প্রবন্ধ সঙ্কলনের অন্তর্গত) সহকর্মী প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শন নিয়ে মগ্ন চর্চায় মেতে ওঠবার সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন, এবং ১৯৫৮ সালে লিখেছেন ‘ফিজিক্স অ্যান্ড ফিলজফি’ নামে এক গোটা বই, যে বিখ্যাত বইটি পরবর্তীকালে বহু পুনর্মুদ্রণ ও সংস্করণের মধ্য দিয়ে গেছে। এই শেষোক্ত গ্রন্থে হাইজেনবার্গ আধুনিক পদার্থবিদ্যার দার্শনিক শিকড়, তার অভ্যন্তরীণ টেকনিক্যাল সমস্যা, তার মধ্যে বাস্তবতার এক নতুন চেহারার ইঙ্গিত, পুরনো পদার্থবিদ্যার সঙ্গে তার ধারণাগত অসঙ্গতি ও ফলত ভাষায় প্রকাশ করার সমস্যা, তার সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অভিঘাত, এই সবকিছু নিয়েই খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু, উঁহু, নাঃ! কোত্থাওই তো প্রাচীন হিন্দু-চৈনিক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কোনও ইঙ্গিতের চিহ্নমাত্র নেই, এবং সেইহেতু নেই সে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কোনও সম্ভাব্য ভুমিকার কথাও! উপরোক্ত রচনাগুলোর একটিতেও রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয়নি একবারও, এমনকি অন্য কোনও প্রসঙ্গের খাতিরেও। কাপ্রা-কথিত রবীন্দ্রস্পর্শধন্য প্রাচ্যপ্রজ্ঞামুগ্ধ পশ্চিমি মহাবিজ্ঞানীপ্রবরের গল্পটি, তাহলে, শেষপর্যন্ত ঠিক কতটা দৃঢ় ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর গিয়ে দাঁড়াতে পারল?

রবীন্দ্র-কোয়ান্টাম জল্পনাপ্রসঙ্গে আরেক যে আইকন বিজ্ঞানী-দার্শনিকের কথা উচ্চারিত হয়েছে হাইজেনবার্গের চেয়েও অনেক বেশিবার, তিনি হলেন ১৯৭৭ সালের নোবেলজয়ী ভৌত-রসায়নবিদ ইলিয়া প্রিগোজিন। তাঁর বিখ্যাত বই ‘অর্ডার আউট অফ ক্যাওস’ থেকে উঠে আসা একটি পংক্তি আজ শিক্ষিত রবীন্দ্রপ্রেমী ভারতীয়ের ঘরে ঘরে পৌঁছেছে— ‘Curiously enough, the present evolution of science is running in the direction stated by the great poet,’ অর্থাৎ, বিজ্ঞান আজ চলেছে তেমনভাবেই, যেমনটি বলেছিলেন মহান কবি!!!  কবির বিজ্ঞানবোধের সপক্ষে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কীই বা হতে পারত! পরমাণুবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ ও দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, কোয়ান্টামতত্ত্ববিশারদ দীপঙ্কর হোম, প্রখ্যাত রবীন্দ্রজীবনীকার কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিনসন, এবং আরও অনেকেই প্রিগোজিনকে উদ্ধৃত করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচিন্তা প্রসঙ্গে, এবং বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের বিখ্যাত সংলাপের প্রসঙ্গে। এঁরা প্রায় সকলেই বলতে চান, সেই সংলাপে আইনস্টাইন যেহেতু নিউটনপন্থী সাবেকি বস্তুবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতা করেছিলেন, এবং আইনস্টাইনের অবস্থান পরবর্তীকালে সমসাময়িক বিজ্ঞানীমহলে খারিজ হয়েছিল, অতএব সেদিন পশ্চিমি যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদ পরাস্ত হয়েছিল ভারতীয় ভাববাদ ও মরমিয়াবাদের কাছে। এবং, রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাঁর কবি-প্রজ্ঞা ও ঔপনিষদিক চেতনা দিয়ে আঁচ করেছিলেন বিজ্ঞানের এই অবস্থান-পরিবর্তন, স্বয়ং অবিজ্ঞানী হয়েও। ফলত, বিশ্বাসী অত্যুৎসাহীদের কাছে প্রিগোজিনের উদ্ধৃতিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমি যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মায়াবাদের যুদ্ধজয়ের সার্টিফিকেটস্বরূপ। এ ধরনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিক কাঠামোটা আসলে এমনিতেই ভুল। কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে আইনস্টাইনের আপত্তি খারিজ হয়েছিল পদার্থবিদ্যার নিজস্ব ‘টেকনিক্যাল’ কারণে, আর রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের বিরোধিতা করছিলেন নন্দনতাত্ত্বিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কাজেই দুটোর মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক নেই।

কিন্তু তার ওপর, প্রিগোজিন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওই কথাটা ঠিক কোন প্রসঙ্গে এবং কেন বলেছিলেন, সেটা খুঁটিয়ে নজর করলে আরও কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার নজরে আসে। আসলে, প্রিগোজিন রবীন্দ্রনাথের ওই উদ্ধৃতিটি দেবার সময়ে মোটেই কোয়ান্টামতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছিলেন না, তিনি আলোচনা করছিলেন ‘নন ইকুইলিব্রিয়াম থার্মোডিনামিক্স’ নিয়ে। বিজ্ঞানের এই নবীন শাখাটির বিষয়বস্তু হল প্রকৃতির মধ্যেকার স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন, বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জটিল শৃঙ্খলার জন্ম, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর একমুখিনতা, ইত্যাদি। আমরা যে ক্রমশ বুড়ো হয়ে যাই, ফল যে ক্রমশ পেকে উঠে পচে গিয়ে ঝরে পড়ে, অতীত দিনগুলো যে আর কখনও ফিরে আসে না, সুন্দর চিনেমাটির কাপটা হাত থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো হয়ে যায় অথচ ভাঙা টুকরোগুলো কোনওদিনই কোনও দুর্ঘটনার ফলে নিজে থেকে জুড়ে গিয়ে গোটা একটা কাপ হয়ে যায় না— এসব ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ‘থার্মোডিনামিক্স’ বা তাপগতিবিদ্যার অন্তর্গত ‘এনট্রপি’ বলে একটা ধারণার সাহায্যে। এই ধারণা অনুযায়ী, জগতের ‘এনট্রপি’ সব সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়তে থাকে, এবং জগৎ ক্রমশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তে থাকে। কাজেই, যে কোনও জিনিসকে শৃঙ্খলায় সাজাতে বাইরে থেকে শক্তি খরচা করতে হয়, সেটা কখনও নিজে থেকে হয় না। কিন্তু, শ্রোয়েডিঙ্গারের মতো বিজ্ঞানী প্রশ্ন তুলেছিলেন, জীববিবর্তনের ফলে এই যে ক্রমশ আরও বৃহৎ জটিল উন্নত প্রাণ সৃষ্টি হতে থাকে, সে তো আপনিই হচ্ছে, কেউ চেষ্টাচরিত্র করে করছে না— সেটা তবে ঘটছে কীভাবে? তারই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ইলিয়া প্রিগোজিনের ‘নন ইকুইলিব্রিয়াম থার্মোডিনামিক্স’ তত্ত্বের সাহায্যে, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তো, সেই স্বনামধন্য প্রিগোজিনের অভিযোগ, আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্বে জগতের যে ছবি এঁকেছেন তাতে ‘সময়’ ব্যাপারটার আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই, এবং অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে বিরাট কোনও তফাত নেই। অথচ, বাস্তবে কিনা সময় জিনিসটা আসলে একমুখী, চলে যাওয়া সময় আর কখনওই ফিরে আসে না। কাজেই, তাঁর বইতে এসেছে আইনস্টাইনের বিরোধিতা, এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথের কথাও। আর, এখানেই লাগে খটকা। এখানে যে কারণে তিনি আইনস্টাইনের বিরোধিতা করছেন, সেই একই কারণে তো তিনি কোয়ান্টামতত্ত্বেরও বিরোধিতা করতে পারেন (করেছেনও), কারণ সেখানেও সময় একমুখী নয়, সেখানেও অতীতের থেকে ভবিষ্যতের কোনও গুরুতর পার্থক্য নেই। তো তাই যদি হয়, তবে আর কেন এর মধ্যে খামোখা রবীন্দ্র-আইনস্টাইন সংলাপের প্রসঙ্গ টেনে আনা? সত্যি, এ এক ধাঁধা বটে! তবে, একটু খোঁজখবর করলে হয়তো এ সমস্যার সমাধানের একটা ইঙ্গিত মিললেও মিলতে পারে। আসলে, ‘অর্ডার আউট অফ ক্যাওস’ বইটির রবীন্দ্রনামাঙ্কিত ওই বিশেষ অনুচ্ছেদটি হুবহু তুলে নেওয়া হয়েছে প্রিগোজিনেরই ১৯৮২ সালে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ‘ওনলি অ্যান ইল্যুশন’ শীর্ষক বক্তৃতা থেকে (বইতে রবীন্দ্রনাথের নাম ওই একবারই এসেছে, আইনস্টাইনের এসেছে অসংখ্যবার)। বক্তৃতাটির লিখিত সংস্করণে অসংখ্য বই ও প্রবন্ধের রেফারেন্স থাকলেও, শেষে আপাতদৃষ্টিতে কোনও কারণ ছাড়াই জুড়ে দেওয়া হয় গোটা রবীন্দ্র-আইনস্টাইন সংলাপটিই, এবং একমাত্র ওটিই! খুব ভাল লেগেছিল, তাই দিয়ে দিলাম, প্রবন্ধের মধ্যে বলেছেন প্রিগোজিন। আরও একটি আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ে ওই অনুচ্ছেদে। প্রিগোজিন সেখানে বলছেন, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে তার ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা শূন্যমনে হয় না, তার জন্য আগে থেকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো লাগে, এবং তার সমর্থনে হাজির করছেন ভারতীয় বিজ্ঞানী দৌলত সিং কোঠারির একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি। কেন? এমন কথা তো টমাস কুন থেকে শুরু করে কার্ল পপার পর্যন্ত কতশত তাবড় বিজ্ঞান-দার্শনিকই বলেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে হঠাৎ কোঠারি মহাশয়ের রেফারেন্স দিতে হল কেন? সন্দেহ হয়, বক্তৃতাটি যেহেতু ভারতে হচ্ছে, তাই স্রেফ একটি স্থানীয় প্রেক্ষিত সরবরাহ করার জন্য রেফারেন্সে ঢুকে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও কোঠারি, কোনও সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক কারণ ছাড়াই। এবং, পরে অসতর্কভাবে সেটাই হুবহু ঢুকে পড়ছে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের মধ্যেও, এবং আরও পরে ওটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতীয় মায়াবাদের বিজয় অভিযানের বিজ্ঞানী-প্রদত্ত সার্টিফিকেট!

কিন্তু, এইসব ভুয়ো সার্টিফিকেট হাজির করে আদৌ বাড়ে কি কবির সম্মান, তাঁর দেশের সম্মান, তাঁর দেশবাসীর সম্মান?


[1] স্মরণ করুন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার প্রতি নিক্ষিপ্ত সেই ঢাকানিবাসী অবিজ্ঞানী এবং অ-বেদজ্ঞ আইনজীবীর আত্মবিশ্বাসী উক্তি, “ব্যাদে সব আসে”!
[2] হাইজেনবার্গ ব্যবহার করেছিলেন একটি জার্মান বাগধারা— ‘নেকড়েদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকতে হবে।’

 

যে সব বই প্রবন্ধের সাহায্য নিয়েছি, প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে:

  1. সৃষ্টি কৃষ্টি : বন্ধনহীন গ্রন্থি, বিকাশ সিংহ, আনন্দ, ২০১২
  2. Einstein and Tagore : Man, Nature and Mysticism, by Dipankar Home & Andrew Robinson, Journal of Consciousness Studies, 2, No. 2, 1995, pp. 167-179
  3. রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস, ২০১১
  4. Rabindranath Tagore : The myriad-minded man, by Krishna Dutta & Andrew Robinson, Rupa & Co., 1995
  5. রবীন্দ্রনাথআইনস্টাইন : এক অমীমাংসিত সংলাপ, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় (সম্পাদক), সাহিত্য সংসদ, ২০১৪
  6. The Tao of Physics, by Fritjof Capra, Flamingo, 1991
  7. Uncommon Wisdom, by Fritjof Capra, Bantam Books, 1991
  8. Physics and Philosophy, by Werner Heisenberg, Penguin Books, 1990
  9. Order Out of Chaos, by Ilya Prigogine & Isabelle Stengers, Flamingo, 1985
  10. Only an Illusion, by Ilya Prigogine, The Tanner Lectures on Human Values, Delivered at Jawaharlal Nehru University, December 18, 1982
  11. Heisenberg and Tagore, by Fritjof Capra,
  12. রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ, ২০০০
  13. Physics and Beyond, by Werner Hesenberg, Harper & Row, 1971
  14. অন্তর্জাল মুক্ত বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া’-র বিভিন্ন প্রবন্ধ
এই লেখাটি কয়েক বছর আগে একটি ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অবিমৃষ্যকারী মন্তব্যের প্রেক্ষিতে। সম্প্রতি আবারও ‘ইসরো’-র বড়কর্তা একই ধরনের উক্তি করেছেন, তাই নিয়ে প্রচুর শোরগোল উঠেছে। আমাদের দেশে সরকারি কর্তারা বরাবরই নানা অবৈজ্ঞানিক কথা ও কাজকর্মে পটু, কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে এটা শুধু কর্তাদের ব্যক্তিগত কুসংস্কারের প্রমাণ নয়, এটা তাঁদের এক পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রোগ্রাম। তাই, এটা আবারও প্রকাশ করতে ইচ্ছে হল, যৎসামান্য সম্পাদনা সহকারে। পুনঃপ্রকাশ করার জন্যে ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ পত্রিকাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।