মুকুটমনিপুর থেকে কুড়িয়ে নেওয়া পলাশগুচ্ছ
১.
তোমাকে নিয়ে লিখছি-লিখব করে করে
বসাই হয়নি আর।
এদিকে আজ প্রথম লাইন লিখতে না লিখতেই
লোডশেডিংয়ের আলো নেমে এল!
এই যে ভীষণ লিখতে চাইছি তোমায়, অথচ
দেখতে পাচ্ছি না কিছুই,
এসবের মধ্যে কোথাও একটা অভিশাপ দেখতে পাই—
সমস্ত আলোর তরফ থেকে যা দাবি করে বসে
জিরো পাওয়ারের বাতিরা।
সারা জীবন তুমি ‘জিরো’ বলে
ডেকে এসেছ যাদের;
অথচ ঘরোয়া অন্ধকারে একে-অন্যের মুখ দেখতে
আমাদের আর কিছুই করার ছিল না, হাতড়ে হাতড়ে
কেবল তাদের জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া—
২.
এখানে আলোরা সব, বনপলাশ;
এখানে অন্ধকারের রং, সোনাঝুরি।
এখান থেকে মনে হয়,
তোমার সামনে দাঁড়ানো খুব সহজ—
অথচ আগে যতবার ভেবেছি, আয়না
হেসে উঠেছে খিলখিলিয়ে।
এখানে কোনও আয়না নেই, জানো!
ভাবতে হয় না তোমার সামনে,
কী রং মেখে সাজি।
এই যে দ্যাখো, অন্ধকার নেমে এল
ঢালু কোনও পথ বেয়ে,
দূরে দূরে জ্বলে উঠল টিমটিমে সব আলো—
এসব আসলে, জলের উপরে সাঁকোর কথা বলে…
যে সাঁকো বেয়ে তুমি অবধি, পৌঁছে যাওয়া যায় এক্ষুনি—
আলো বলতে এখানে শুধুই,
টলটলে জল বুঝি।
৩.
অবশেষে সেই হেঁটেই ফেললাম তোমাকে,
অবশেষে সেই, লিখেই ফেললাম।
এই যে তুমি ফিরে আসছ এখন,
এই যে আমি, হেঁটে আসছি তোমাকে—
এ তো আসলে একটা বনপথ।
এই যে দ্যাখো, টুপটাপ ঝরে পড়ছে পাতা,
যেন, রিমঝিম ঝরে পড়ছো তুমি!
আমি সাবধানে এগিয়ে আসছি পা ফেলে ফেলে,
আর তক্ষুনি জ্বলে উঠছে হেডলাইট—
পড়ে ফেলছি, ‘এখানে আগুন জ্বালানো বারণ…’
বিশ্বাস করো, উত্তাপ প্রশমন বা দৈবিক যা কিছু
সে সব আগে কক্ষনও আর শিখতে হয়নি এমন।
৪.
সারা দুপুর বৃষ্টি ঝরল অঝোর। এ তোমাকে মানায়—
রুখা টাঁড়, ভিজে ভিজে ওঠে।
এই যে পাতার শব্দ, রাঢ়পথ বেয়ে গড়িয়ে আসা
বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি—
আজীবন শুধু ভুল ব্যাকরণ ধরবার কারণে,
সঠিক ওজন করে উঠতে পারলো না তোমার।
অথচ আমি জেনেছি ঠিক,
তোমার ধুলো হতে চাওয়া ইচ্ছেদের…
লুটিয়ে পড়ার ইচ্ছেদের…
আমায় চুন-চুনকে ভিজিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেদের,
কানায় কানায়—
জেনেছি এই তুমুল অঝোর বৃষ্টি,
বিকেল রঙের প্যালেটে মিশিয়ে দিলে,
কীভাবে তা মানিয়ে নেয়, মেঘলা রঙের তোমায়।
৫.
পথ চিনে চিনে রাতে, নেমে গেছি
জলেদের কাছে।
জল নিচু যত, তার চেয়ে নিচু জোনাকি।
ছাদ থেকে ছুঁয়ে ফেলি চাঁদ, আকাশ ছেনে এনে তারা,
সাজাতে চাই ঘর—
আর গান গাই, ‘ইক্কেবারে মানাইছে না রে’…
এদিকে দ্যাখো, তোমার মুকুট ভর্তি পলাশ;
তোমার মণিতে পোরা জোনাকি—
এসবের কাছে, আমি আর কী!
তাই তো অগত্যা, একা পথ হাঁটি—
গাছেদের ভিড়ে খুঁজি আদিম লুকোচুরি,
সজোরে ধাক্কা পিঠে, অথবা, ঝোপের আড়াল থেকে
চেপে ধরা চোখ; ঝাঁপিয়ে পড়া, ‘টুকি’!
৬.
মেষ থেকে মীন, কেমন যাবে আজকের দিন?
কে কোথায় ঝোল হবে, কে কোথায় বলি?
এসব দেখে-শুনে, পাঁজি ছুঁড়ে ফেলি—
মনে মনে হাসি।
অগত্যা আর, ধুলো ঝেড়ে ফেলি না গা থেকে;
পাহাড়-গোধুলি-আঁকাবাঁকা লাল পথ-আলো…
বাঁধের শিকল ভেঙে খলবল ঢুকে আসা জল,
আমাকে তো ডুবিয়ে নেয় না, রাক্ষসী!
চুপচাপ হেঁটে যাই আলপথ বেয়ে;
সন্ধে হয়ে এলে, কেবলই শুনে যাই গুনগুন ঝুমুর।
ছো-নাচের বাজনা বাজছে কোনখানে…
হা-রে-রে-রে-রে-রে বেড়ে যায় যত, মনে হয় তোমার নাম ধরে শুধু
ডাকছে পাহাড়তলি—
৭.
ঝগড়া হলে, আমি লিখতে পারি না কিছু।
আমার সবুজ মলাটের খাতা, লাল কালির পেন
জুলু জুলু চেখে তাকিয়ে থাকে—
আসলে, একটা ম্যাজিক খুঁজছি বহুদিন;
ঘর ঝাঁট দেওয়ায়, সিগারেট ঘষে নিভিয়ে ফেলায়
তোমায় খুঁজছি। তোমার আঁচল খুঁজে,
মুছে নিতে চাইছি কপালের জমে থাকা ঘাম।
…অথচ সেসব কিছুই না হওয়াতে,
আমি বসতে পারছি না কিছুতেই একটা জায়গায়।
এই যে আমার ভীষণ মাথা ধরার রোগ;
তায় অনর্গল খসখস পাতা ঝরে পড়ার শব্দে
আমাদের ঝগড়া হচ্ছে ভীষণ—
পাহাড়ের ওপাড় থেকে সেসব ‘দ্রিম দ্রিম’ ভেসে আসছে
হাওয়ায়। আমি শুধু যা বলতে চাইছি, তা হল,
সকাল থেকে ঝগড়া হওয়ায়,
অবিরাম আবীর-পলাশ মেখেও আমি
কিছুতেই লিখে উঠতে পারছি না তোমায়—