Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৩ (দ্বিতীয়াংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চাতকপ্রাণ

তিন.

—শুনছ?

দুপুরের খাবার খেয়ে পরমেশ ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। ঘুমায়নি। বুকের উপর বইটা এখনও খোলা, ডানহাতের তর্জনী বইয়ের পাতা ধরে রেখেছে। চোখ বোঁজা। এতক্ষণ বই পড়ছিল বলে সুতপা ডাকতে সাহস পায়নি। পরমেশ কিছু পড়ার সময় কথা বললে রেগে যায়।

—কী হল? ভুরু কুঁচকে তাকাল পরমেশ। কোন ভাবনার জগৎ থেকে বের করে আনার বিরক্তি নিয়ে।

সুতপা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না। অথবা কীভাবে বললে পরমেশ রাগ করে উঠবে না সেটাই মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছিল। অপেক্ষা করে থেকে বিরক্ত হল পরমেশ। ব্যাপারটা কি বলো তো? ডেকে তুলে এখন মুখে তালা এঁটেছ?

—না মানে, শানু একটা কথা বলছিল।
—কীসের কথা? কাজের কথা নিশ্চয় নয়। ছেলের কাছ থেকে সেরকম কিছুর আশা বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে পরমেশ।
—ও বিয়ে করতে চায়।
—মানে? ধড়মড় করে উঠে বসল পরমেশ। কী যা তা বলছ? তুমি জানো না তোমার ছেলের কী অবস্থা? ডাক্তার পথ্যের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি পনেরো বছর ধরে। এখন কি আমায় পাগল ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজে বেড়াতে হবে নাকি?

শানু এখন বাড়িতে নেই। তবু গলার স্বর নামিয়ে আনল সুতপা। যখন থেকে শানু বলেছে তার মন সুস্থির নেই। একবার মনে হয়েছে ভালই তো যদি বিয়ে করে ও ভাল হয়ে যায়। কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব! ছেলে যে সুস্থ নয় সেটা তার থেকে ভাল করে কে আর জানে। কেন কোনও মেয়ে ওকে বিয়ে করতে চাইবে? আবার এটাও সত্যি গত কিছুদিন ওকে একটু অন্যরকম দেখছে। দাড়ি কেটে ফেলেছে, নোংরা পোশাকআশাক পরে না। ঠিকসময়ে খাওয়া দাওয়া করছে। চেঁচামেচি, পাগলামি অনেক কম। নিশ্চয় এই মেয়েটা তার পাগল ছেলেকে ভালবেসেছে আর সেইজন্যেই— সাহস করে বলেই ফেলল সুতপা। মেয়ে খুঁজতে হবে না। মেয়ে ও খুঁজে রেখেছে।

এবার আরও অস্থির হয়ে উঠে বসল পরমেশ। এতদিন রাস্তায়-ঘাটে বিভিন্ন রকম হাঙ্গামা বাঁধিয়েছে শানু। কিন্তু তার মধ্যে কখনও কোনও মেয়ে জড়িত ছিল না। এবার কি সেটাও হল? চেঁচিয়ে ওঠে পরমেশ। মেয়ে খুঁজে রেখেছে? তুমি কি জানো সুতপা এরপর মেয়েঘটিত পুলিশকেস হলে আমরা কোথায় যাব? কোন ভদ্রলোকের মেয়েকে গিয়ে বিরক্ত করছে শানু?

—আহা রেগে যাচ্ছ কেন? আগে পুরোটা শোনো তুমি। শানুর একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে, সেই কথাই বলছিল।
—ওর অনেককেই পছন্দ হতে পারে। কিন্তু সেই মেয়েটির ওকে কেন পছন্দ হবে! বলেছে তোমায় সেটা?
—দেখছ না আজকাল শানু কেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়? দাড়ি বাড়তে দেয় না। কে কেটে দেয় ওর দাড়ি? সেই মেয়েটাই তো।
—নাপিতের মেয়ে?
—আহা, তা কেন হবে? হয়তো ওর বড় চুল দাড়ি দেখে কষ্ট হয়েছে।
—তার মানে তুমি সব জানো। তলে তলে ছেলের সঙ্গে এইসব ফন্দি করছ। কই আমাকে কিছু জানাওনি তো।
—জেনেই তো তোমায় বলতে এসেছি। কিন্তু তুমি দিচ্ছ কই? মেয়েটার নাম শিউলি। বিধবা। একটা ছেলেও আছে নাকি। ছেলেটাকে শানু খুব ভালবাসে। তাই তো রোজ ওদের বাড়িতে যায়।

চড়চড় করে রাগ বাড়ছিল পরমেশের। এক পাগল ছেলের দেখভাল করতে করতে এতগুলো বছর কাটাচ্ছে। এখন তার বউ, পড়ে পাওয়া ছেলেকে ঘরে এনে তুলতে হবে? বোঝাই যাচ্ছে বিপদে পড়ে কোনও মেয়ে ঘাড়ে চাপার চেষ্টা করছে। শোনো সুতপা। ছেলের জন্য বেগার খাটছি সারা জীবন। আমি এখন তার বউবাচ্চা পালন করতে পারব না। বিয়ে যে করবে খাওয়াবেটা কী? বিয়ে করলে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয় সেসব জানে তোমার ছেলে? নাকি সেটাও বাপের ঘাড়ে?

—মেয়েটা নিজেই চাকরি করে শুনলাম কলকাতায়।
—কলকাতায় চাকরি করে তো দুর্গাপুরে থাকে কেন? ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল পরমেশের। আবার নাকি একটা ছেলেও আছে? কত বড় সেই ছেলে?
—আচ্ছা, আমাকে এত জেরা করছ কেন? যা জানি সব বললাম। এর পর ইচ্ছে হয় ছেলের সঙ্গে কথা বলো। মোড়া টেনে বসেছিল সুতপা। এবার রাগ করে উঠে চলে গেল।
—বলব! ওর সঙ্গেই কথা বলব। সে শাহেনশা কোথায়?

ব্যস্ত পায়ে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে বসল পরমেশ। তার চেহারা এখনও মজবুত। রিটায়ার করেছে, কিন্তু ছেলে পড়ানো তো চলছে। কাজেকর্মে থাকার জন্য শরীরে বয়সের ছায়া পড়েনি এখনও। সারা বাড়ি ঘুরে ছেলেকে কোথাও পেল না পরমেশ। রাগ বাড়তে থাকল। কিন্তু কিছু করার নেই। শানু যে কোথায় কখন যায়, কী করে জানা নেই তার। সব রাগ গিয়ে পড়ল সুতপার উপর। কোথায় যায় তার খোঁজ রাখো না কেন? পাগল হয়েছে বলে কি হাতির পাঁচ পা দেখেছে? এটা কোনও হোটেল নয়। আর কিছু না পারে বাড়ির দুটো কাজে হাত লাগাতে পারে।

শানুকে দিয়ে বাড়ির কোনও কাজ করানো হয় না। বাজারে পাঠাবার চেষ্টা করেছে সুতপা। শানু করেওছে। কিন্তু ওকে নিয়ে লোকে মজা করে। ঠকিয়ে দেয়। শেষ অবধি মারপিট করে বাড়ি ফেরে। পরমেশ না পারলে আজকাল সুতপা নিজেই যায় অথবা কাজের লোককে দিয়ে করিয়ে আনে। পরমেশ জানে সবই। কিন্তু এখন রাগ হয়েছে, তাই যা মনে আসে বলে যাবে। সুতপা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পরমেশ ছাড়লে তো। বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। ছাদে মেলে দেওয়া জামাকাপড় নেওয়ার বাহানায় চিলেকোঠার ঘরে এসে বসেছিল। জল ধরে যেতেও নামেনি। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। বৃষ্টি থামার আনন্দে পাখিদের কলরব শুরু হয়ে গেছে। বেশ লাগছিল সুতপার এই নিশ্চিন্তি, প্রকৃতির মগ্নতা। এক নিবিড় শান্তি। সুতপার খোঁজ করতে করতে পরমেশ সেখানে এসে হাজির।

—আমি তোমাকে কখন থেকে ডাকছি। এখানে বসে কী করছ?
—শুকনো জামা তুলতে এসেছিলাম। বৃষ্টি এসে গেল, তাই এখানেই…

পরমেশ ঘরটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। এই ঘরে আসা হয় না বহুদিন। ছোটবেলার থেকে শানু এই ঘরেই নিজের অনেক সরঞ্জাম রাখতে অভ্যস্ত। ঘরের এক কোনায় ডাঁই করে রাখা স্কুলের বই। একটা পুরনো আলমারিতে ঠাসা বই, কাগজপত্র। একটা পুরনো ট্র্যাঙ্কও আছে সবুজ রঙের। শানু এখনও মাঝেমাঝে বই পড়ে এটা পরমেশ জানে। কিন্তু সুস্থির হয়ে টানা কোনও বই পড়ার ক্ষমতা ওর নেই। কোনও বই পড়তে পড়তে হঠাৎ কোনও চিন্তা মাথা চাড়া দেয়। তখন সেই বই ছেড়ে আবার অন্য কোনও বই পড়ে। ডাক্তার সেন ওকে হালকা বই পড়তে বলেছেন। পরমেশ বই সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকে।

—ওর জিনিস ঘেঁটো না। শানু পছন্দ করে না।
—আমি কি ওকে ভয় পাই? তাছাড়া ওর জিনিস আবার কী? জীবনে দুটো পয়সা রোজগার করেছে কখনও? এখানে কোন জিনিসটা ও নিজের ক্ষমতায় করেছে? পরমেশের গলা চড়ছিল।

সুতপা জানে শানু আসা অবধি এই হম্বিতম্বি চলতেই থাকবে। থামানোর উপায় তার জানা নেই। কোনওদিন ছিল না। তবু একটা চেষ্টা করে। শোনো আমি বলছি কী, ছেলে এলেই ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পোড়ো না। একটাই ছেলে আমাদের। মাথা খারাপ হয়ে জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। তবু তো কতটা জীবন পড়ে আছে ওর।

—তুমি কি ভাবো আমি ওর ভাল চাই না? ফুঁসে উঠল পরমেশ।
—চাও। নিজের মতো করে। সুতপা নিজের গলার স্বরে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। এমনভাবে পরমেশের সঙ্গে কোনওদিন কথা বলে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজ ছেলের কথা ভেবেই বলছে। এতদিনে একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছে, সেটাকেই জিইয়ে রাখার চেষ্টা। যদি কোনও মেয়ের ভালবাসা পেয়ে ছেলে তার মতিগতি ফিরে পায়, কেন নষ্ট হতে দেবে সেটা?
—শোনো এত বছর এত ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। তাতে যদি কিছু না হয়ে থাকে, এখন কোথাকার একটা মেয়ে এসে ওকে নীরোগ করে দেবে এমন অবাস্তব স্বপ্ন আমি দেখি না সুতপা। সবদিক ভেবে না এগোলে, আরও বড় হাঙ্গামায় পড়ব সেটা কেন বোঝো না? তোমার কথায় ধরেই নিলাম, কোনও মেয়ে শানুর পাগলামির খবর জানার পরেও ওর সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়। কিন্তু তার একটা পরিবার-পরিজন আছে, তাদের মতামত থাকবে না? তাছাড়া বলছ ওর একটা ছেলেও আছে। আমাদের মাথায় কী চাপাতে চলেছে সেটা একবার বুঝতে পারছ?

এতসব কথা বলতে বলতে পরমেশ একটু ঠান্ডা হচ্ছিল। এইসব নিয়ে ভাবছে দেখেও সুতপা হালে পানি পেল। অন্তত পুরো নাকচ করে দেয়নি। এটাও ভাল। সাধারণত পরমেশ নিজের ভাবনা, নিজের গোঁ ছেড়ে একদম বেরোয় না। পাগল ছেলেরও তো তাই অবস্থা। সেই কারণে সুতপা একেবারে কাঁটা হয়ে থাকে। শানুকে বুঝিয়ে বলা এখন কষ্ট। অন্তত পরমেশ যদি মানে। সেই ভরসাতেই বলল। ভাল করে কথা বলে দেখো। এলেই শানুর উপর ঝাঁপিয়ে পোড়ো না। ধীরেসুস্থে কথা বলো। জানতে চাও কী ব্যাপার। মেয়েটার বাড়িতে যাও, ওর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলো। শানুর কথা কিছু লুকোনোর নেই। সব জেনেবুঝে কেউ যদি বিয়ে করতে রাজি থাকে, তাও আবার চাকরি করা মেয়ে, এতে দোষের কী আছে? আগেকার কালে শুনেছি লোকে লুকিয়ে পাগল ছেলের বিয়ে দিত মাথা ঠিক হয়ে যাবে এই ভরসায়। আমরা তো আর সেরকম কিছু করছি না।

এতগুলো কথা সুতপা একসঙ্গে বলে ফেলেছে এমন নয়। পরমেশ ছাদে পায়চারি করছিল। মাঝেমাঝে হাঁটা থামিয়ে তীব্র চোখে তাকাচ্ছিল সুতপার দিকে। কখনও কখনও তাচ্ছিল্যজনিত আওয়াজ বেরোচ্ছিল গলা থেকে। কিন্তু সাধারণত যেমন করে আজ সেরকমভাবে একেবারে থামিয়ে দেয়নি সুতপাকে। বলতে দিয়েছে। তার মানে বাইরে যেমনই ভাব দেখাক, পুরোপুরি অমত নেই পরমেশের।

নিচে ফিরে সুতপা জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে গেল। পরমেশ আবার ইজিচেয়ারে। হাতে বই নেই এখন। বাঁ হাত মাথার উপরে তোলা। দৃষ্টি স্থির। তার মানে ভাবছে। সুতপা বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে দেখল। চা দেব তোমায়?

ক্লিষ্ট চোখে তাকাল পরমেশ। যখন কথা বলল যেন অনেক দূরের থেকে। শানুকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিল না সুতপা? কিসের থেকে কী হয়ে গেল সব।

সুতপা থমকে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রিল ধরে। মনে কি তার কিছু কম বাজে? অংশুর খবর পায়। সুচিত্রার ছেলে। টাটায় কাজ করে, তড়তড় করে উঠে যাচ্ছে। আজ লন্ডন, তো কাল নিউ ইয়র্ক। নাতিটাকে নিয়ে সুচিত্রার খুব গর্ব। বড় মুখ করে বলে। মেয়ে শর্বাণী থাকে সুইডেন। অমিত আর সুচিত্রা এই সেদিন দুমাসের জন্য সুইডেন ঘুরে এল। সারা ইউরোপ ঘুরিয়েছে মেয়ে জামাই। শোনে সব। এইসব বলার শেষে সুচিত্রা জিজ্ঞেস করে শানু কেমন আছে রে দিদি? কী বলবে সুতপা? আহা-উহু শোনার জন্য? ছোটবেলা থেকে সুতপা কেন সব কিছুতে হেরে যায়। কপাল ছাড়া আর কাকে দোষ দেবে? তাই সে আর উপরের দিকে তাকায় না, সামনের দিকেও নয়। প্রতিটা দিন যাচাই করে নিজের মতো করে। একদিন শানু চুপচাপ শান্ত থাকলে মনে হয় দিনটা ভাল গেল। একদিন পরমেশ হাসলে ভাবে এইটুকুই তার সুখ। সেই মনোভাব থেকেই সান্ত্বনা দেয় পরমেশকে। যা হয়ে গেছে সেটা তো আর ফেরানো যাবে না। কত মায়ের ছেলে কুলাঙ্গার হয়। তারা বেঁচে আছে না?

পরমেশ শূন্য চোখে তাকায় শুধু।

—ভেবে ভেবে নিজের শরীর খারাপ কোরো না। আমি চা নিয়ে আসছি। খেয়ে একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে এসো, মন ভাল থাকবে।
—একটা কথা বলব সুতপা?

চোখে প্রশ্ন ভাসিয়ে পরমেশের দিকে তাকায় সুতপা।

—চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। দুর্গাপুরে আমাদের জন্য আর কিছু নেই। রিটায়ার করে গেছি, তাহলে কেন এইখানে পড়ে থাকা।
—দুর্গাপুর ছেড়ে কোথায় যাবে? আচমকা এমন প্রস্তাবে হকচকিয়ে গেল সুতপা।
—আমাদের গ্রামের বাড়িতে। দিদির বয়স হয়েছে। কুমার ওখানে একটা স্কুল করেছে গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্যে। শুনেছি বেশ ভাল কাজ করছে। চারপাশের গ্রাম থেকে ওর স্কুলে পড়তে আসে। ওটাকে এবার হাইস্কুল করবে। চাইলে আমি ওখানে পড়াতে পারি।
—তুমি যাবে ওখানে?

খুব অবাক হল সুতপা। দিদি আর বেশি দূর যাতায়াত করতে পারে না। আসে না এখানে বহু বছর। ছোটভাইয়ের সঙ্গে পরমেশের কোনওদিন বনত না তেমন। কুমারেশ রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পরেও। জেল থেকে বেরিয়েছিল খুব অসুস্থ অবস্থায়। পুলিশ মেরে শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিল। এখনও সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না, ঝুঁকে চলে। বিয়ে করেছিল। বেজাতের মেয়ে বলে পরমেশ বিয়েতেও যায়নি। মেয়েটা জাতে ডোম। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে কুমারেশ এদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল অনেকদিন। ওই মেয়েটাই কুমারেশকে শেল্টার দেয়। তখনই আলাপ। মাঝে শানু একবার কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তখনও মাথাটা অত খারাপ হয়নি ছেলের। পরমেশের সে কী রাগ সেদিন। এখন নিজে থেকে সেখানে গিয়ে থাকতে চাইছে? আচমকা শুনে অবাক লাগল সুতপার।

—কবে কথা হল তোমার? কোথায় দেখা হল? তুমি গেছিলে ওদের ওখানে?
—না না আমি আবার কখন গেলাম। আর গেলে তুমি কি জানতে পারতে না? ও দুর্গাপুরে কি একটা কাজে এসেছিল। দুজনেই মানে কুমার আর ওর বউ দীপালি। ওরা বইয়ের দোকানে এসেছিল। আমিও তখন বই কিনতে গেছি দুর্গাপুর বুক স্টোরে। শরীর ভাঙাচোরা, লাঠি নিয়ে হাঁটে। কিন্তু দীপালি মেয়েটা দেখলাম খুব খেয়াল রাখে। মেয়েটা খারাপ না জানো। আগে তো কখনও দেখিনি। এগিয়ে এসে আমাকে আবার প্রণাম করল।
—আচ্ছা, তুমি কী বলো তো? প্রণামটাই নিলে শুধু, ওদের একবার বাড়িতে নিয়ে এলে না? অত জাতপাত আজকাল কেউ মানে নাকি? আর তুমিই তো বলছ মেয়েটা কুমারের খুব খেয়াল রাখছিল।

সুতপার মাথায় ঘুরছিল শানুর কথা। ওর পছন্দের এই মেয়েটা কী জাতের কে জানে। পরমেশ যদি তার ভাইয়ের ডোমের ঘরের বউকে মেনে নিতে পারে, তাহলে নিজের ছেলের জন্যেও আলগা হবে খানিক।

পরমেশ একবার ওদের বাড়িতে আসবার কথা বলবে ভেবেছিল। কিন্তু এতদিন দূরে ঠেলে রেখেছে, যদি মুখের উপর না করে দেয়। এইসব ভেবেই আগ বাড়িয়ে নিমন্ত্রণ করে বসেনি। ইচ্ছা হয়নি এমন নয়। বয়স বাড়লে রক্তের টানটা যেন বাড়ে। জীবনে চারদিকে এত ঘা খেয়ে খেয়ে কেন যে মনে হচ্ছে দিদি আর ভাইয়ের সঙ্গে থাকলে বোধহয় একটু শান্তি পাবে। শত হলেও নিজের পরিবার। কুমারের সঙ্গে বেশ কথা হল সেদিন। ওর স্কুলের কথা তখনই জেনেছিল। সুতপাকে বলল, সে নয় একদিন ডাকা যাবে। মনে হল ওরা ভাল আছে। অন্তত জীবনে কাজের মতো কিছু কাজ করছে।

—দেখা হল, কথা বললে। অথচ আমাকে কিছু বলোনি তো কখনও।
—ভুলে গেছিলাম।

সুতপা জানে পরমেশ ভোলেনি। সব ভাবনা ভাগ করে নেয় না কোনওদিন। এ দুঃখ সুতপার চেয়ে বেশি আর কে বোঝে।

—যাবে তুমি? গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে?
—থাকিনি কোনওদিন? আমার তো গ্রামেই জন্ম। এই দেশে এসেছিলাম তখন তো ছিলাম বসিপোতা। গ্রামে আমি খুব থাকতে পারি। বরং তুমি আর শানু শহরে থাকা লোক। তোমরা থাকতে পারবে কিনা সেটাই আসল প্রশ্ন।

সুতপার কাছ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পরমেশ উদ্বিগ্ন হল। নিজে এই নিয়ে অনেক ভেবেছে, কিন্তু শুনতে চায় সুতপার মতামতটাও।

সুতপা ভাবছিল। এরকমভাবে চিন্তা করেনি তো আগে। হুট বললেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় নাকি? দুর্গাপুরে থাকতে তার সত্যিই আর ভাল লাগে না। কলকাতায় যাওয়ার কথা ভেবেছে। কিন্তু তার মানে সুচিত্রা কিংবা অন্য আত্মীয়স্বজনদের কাছে চলে যাওয়া। সেটাও ইচ্ছা নয়, চোখের আড়ালে আছে সে একরকম। সবার সামনে নিজের দুঃখের প্যাঁটরা উজাড় করতে চায় না। সেই ভেবেই বলল সুতপা, এখানের জীবনে আমাদের আর কী আছে বলো? আমাদের অতীতটাকে খোলসের মতো ফেলে যদি নতুন জায়গায় গিয়ে বসতে পারি হয়তো বাঁচার অন্য কোনও মানে পাব। কে বলতে পারে শানুর জন্য এরকম নতুন কোনও জায়গা হয়তো ভালই হবে। ছেলেটা পিসি আর কাকুকে ভালবাসত ছোটবেলা থেকে। কিন্তু যাবে যে, থাকবে কোথায়? ওখানে সবার থাকার মত অত ঘর কোথায়?

—আছে। আমাদের বড় বড় ঘর ছিল। পায়খানা বাথরুম সেরকম নয়। পুকুর আছে, গোয়াল আছে। দরকার পড়লে আমি আরও একটা দালানকোঠা তুলে নিতে পারি। এই বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম না হয়।
—একসঙ্গে অত কিছু ভেবো না। বহুবছর যাইনি সেখানে। চলো আগে একদিন ঘুরে আসি। দেখো কেমন লাগে তোমার। যদি মনে হয় আমরা ওখানে গিয়ে থাকব তাহলে দুটো ঘর তুলে নিয়ে যাওয়াই ভাল। এই বয়সে আবার দশজনের সংসারে থাকতে পারব না।

বলতে বলতেই সুতপা দেখছিল পরমেশের কপালের ভাঁজগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। ইস, শানুর ব্যাপারটাও যদি এমনিভাবে কিছু ফয়সালা হয়ে যায়, সুখ না হলেও অন্তত শান্তি ফেরে বাড়িতে। মনটা হঠাৎই ভাল লাগছিল সুতপার। বহুদিন বাদে।

—চা খাবে তুমি? গলাটা বসা বসা লাগছিল তোমার, একটু আদা দিয়ে করে দিই? সঙ্গে দুটো পাঁপড় ভেজে আনছি। পরমেশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই রান্নাঘরে পা বাড়াল সুতপা।

সন্ধ্যাটা বহুবছর বাদে একটু ভাল কেটেছিল সুতপার। পরমেশের সঙ্গে একত্রে শেষ কবে বিকেলের চা খেয়েছে মনেই পড়ে না। আজ চা পাঁপরভাজা খেতে খেতে কতরকমের কথা হল। মানুষে মানুষে কথা বললেই কথা জন্মায়, পুরনো কথারাও সজীব হয়। প্রথমে বসিপোতার বাড়ির কথা উঠল, সুতপা শেষ গেছে কুড়ি বছর আগে। পরমেশ একবার গেছিল দিদির শরীর খারাপের সময়। কিন্তু সেই যে কুমারেশের বিয়েতে গেল না, ব্যস। সব সম্পর্ক ঘুচে গেছিল। দিদি তারপরেও এসেছে, শানুর শরীর খারাপ হতে দেখতে এসেছিল। তখনই শানুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, জায়গা পরিবর্তনে ভাল হবে এমন কথাও বলেছিল। কিন্তু সেও তো পনেরো বছরের উপর হল। বসিপোতার পুকুরঘাট, বহুবছর আগে সেই পুকুরে স্নান করার স্মৃতি— সব একসঙ্গে ভিড় করে আসছিল। আমেরিকার কথা হল। কদিন আগেই শানুর সঙ্গে বসে পুরনো ছবি দেখছিল। আর তাদের সেই গাড়ি? হাডসন হর্নেট! শুনতে শুনতে পরমেশের চোখও স্মৃতিতে ঝাপসা। এইভাবেই কথা গড়াতে গড়াতে কেমনভাবে যে নটা বেজে গেল। সুতপার খেয়াল হল শানু বাড়িতে ফেরেনি এখনও। সুতপা রান্না ঘরে উঠে গেল রাতের রুটি কখানা বানাতে। রুটি বানিয়ে খাবার গরম করতে করতে দশটা। পরমেশ ততক্ষণে বারান্দায় পায়চারি করছিল। কিন্তু শানু তখনও আসেনি।

পরমেশের রাগ এবারে বাড়ছিল। দেখো তোমার গুণধর ছেলের কাণ্ড। রাত দশটা বেজে গেছে। বাড়িতে কোনও খবর দেওয়া নেই, কিচ্ছু না। দেখো গিয়ে কাদের হাতে মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে।

ভাবতেই সুতপা শিউরে উঠল। তার ছেলের মাথার ঠিক নেই। এরকম যে হয়নি কখনও তেমন নয়। কারও সঙ্গে ঝগড়া করেছে, কিংবা রাস্তায় কেউ হেনস্থা করেছে। রাত হলে ছেঁড়া জামাকাপড়ে নোংরা শরীরে শানু বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু এত রাত কোনওদিন হয়নি। গ্রিল ধরে রাস্তা দেখছিল সুতপা। রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। শুধু পাড়ার কুকুরগুলো মাঝে মাঝে উচ্চকিত হচ্ছে। তা না হলে চাঁদের আলোয় ধোয়া রাস্তা জনশূন্য।

—শোনো, সে মহারাজাধিরাজের জন্য অপেক্ষা করার কিছু নেই। আসার হলে আসবে, নয়তো রাস্তায় পড়ে থাকবে। কিংবা দেখো গিয়ে, ওই মেয়ের বাড়িতেই হয়তো আস্তানা গেড়েছে।
—তুমি খেয়ে নাও, আমি আর একটু দেখি। সুতপার গলায় ক্লান্তি গাঢ় হচ্ছিল। বিরক্তিও। এখন পরমেশ জেগে থাকলে তাপমাত্রা আরও বাড়বে।

সুতপা তাড়াতাড়ি করে পরমেশকে খাবার বেড়ে দিল। এমনিতেও পরমেশ একাই খায়। আজ বরং একসঙ্গে খাবে বলেছিল, কিন্তু সে হওয়ার নয়। পরমেশ খেয়ে গেলে সুতপা নিজের আর শানুর খাবার টেবিলে থালা দিয়ে ঢেকে সোফাতেই গুড়িমুড়ি হয়ে শুয়ে গেল। ছেলে ফিরলে উঠে খেয়ে নেবে। তারপর বিছানায় যাওয়া যাবে।

সুতপার ঘুম ভাঙল চোখে সূর্যের আলো নিয়ে। সূর্য তখনও নরম। নিজেকে সোফায় পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সুতপা। শানু এসেছে? যদিও বাইরের দরজা বন্ধই ছিল, এলে তার নিশ্চয় জানার কথা। কিন্তু সুতপা দৌড়ে শানুর শোওয়ার ঘরে গেল প্রথমেই। নাহ, কেউ নেই। তার মানে আসেনি। সারা রাত বাড়ি ফিরল না? ত্রস্ত পায়ে পরমেশকে ডেকে তুলল।

—শুনছ? শানু কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি।

 

চার.

কোথায় খুঁজবে পরমেশ? বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাকে পাগল ছেলের খোঁজ করতে হবে? কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কি। একটা রিক্সা নিয়ে নিল। প্রথমে সুরজিতের বাড়ি। শানুর সঙ্গে যেমনই ব্যবহার করুক, পরমেশকে এখনও সমীহ করে বেশ। অফিসে বেরোচ্ছিল। শানু রাত্রে বাড়ি ফেরেনি শুনে অবাক। কাকু, শানু এমনিতে যাই করুক, সন্ধ্যার পরে ওকে বিশেষ রাস্তাঘাটে দেখি না। আর সত্যি বলতে কি গেল কয়েক মাস ওকে পাড়াতেও তেমন দেখিনি। আমি তো ভাবছিলাম ও বোধহয় আগের থেকে ভাল আছে।

কী বলবে পরমেশ? আমরাও তো তেমনি ভাবছিলাম। কিন্তু কী কাণ্ড বলো দেখি। বুড়ো বাবা মাকে বাড়িতে ফেলে উনি কোথায় যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হতাশার সঙ্গে হাত উল্টাল পরমেশ।

—আপনি বলেই পারেন কাকু। এই বয়সেও ছেলেকে দায়িত্ব নিয়ে আগলে আগলে রাখেন। আমাদের ছেলেপিলের এমন হলে আমরা যে কতদূর করতে পারব— বেশ একটা গদগদ ভঙ্গিতে কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল সুরজিত।

সেখান থেকে সুবিমলের বাড়ি। ওখানেও কোন খবর নেই। দরজা খুলে সুবিমল একেবারে বিগলিত। আরে পরমেশদা, আসুন আসুন। কী সৌভাগ্য। ঠিক সময়ে এসেছেন, নাহলে এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।

লোকটাকে অত বেশি পছন্দ করে না পরমেশ। সাহিত্য করে। বিবেকানন্দের বুলি কপচায়। চরিত্র গঠনের কথা শোনায়। সেই জন্যেই যখন শানুর শরীরটা খারাপ হল, পরমেশ নিজে শানুকে ওর বিবেকানন্দ পাঠাগারে নিয়ে এসেছিল। ডুবন্ত মানুষ ঘাসপাতা ধরেও বাঁচতে চেষ্টা করে কিনা। কিন্তু লোকটার ভড়ং বেশি। এই যে কেমন আসতে বলেও, ওর যে তাড়া আছে সেই কথাটাও টুকুস করে শুনিয়ে দিল। কিন্তু মুখে ভাবনাটা ফুটতে না দিয়ে পরমেশ জানতে চাইল গতকাল শানুকে দেখেছে কিনা।

—কেন, কী হয়েছে?
—না, মানে কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। এমন তো কখনও করে না। বুঝতে পারছি না কোথায় যে চলে গেল।

সুবিমল মাথা নাড়াল। না পরমেশদা আমি তো জানি না। আজকাল ওর সঙ্গে তেমন দেখাও হয় না। জানেন তো সেদিন রাস্তায় আমার সঙ্গে কী করেছিল। সত্যি বলতে কি আজকাল আমি ওকে একটু এড়িয়ে থাকারই চেষ্টা করেছি। মিথ্যা বলব না, বাড়িতে এলেও হয়তো আমি ঢুকতে দিতাম না। তবে লোকজনের কাছে একটা খবর পাই, হয়তো আপনিও জানেন। একটু কিন্তু কিন্তু করছিল সুবিমল।

পরমেশ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়েছিল সুবিমলের দিকে। এত এত খারাপ খবর শুনেছে শানুকে নিয়ে, আর নতুন করে কী হবে।

—না, মানে ও নাকি আজকাল পেটো স্বপনের বাড়িতে রাতদিন পড়ে থাকে।
—পেটো স্বপন?
—প্রফেসার মানুষ, আপনি হয়তো চিনবেন না। একসময় এখানে বেশ নামজাদা গুণ্ডা ছিল, কয়েকবছর আগে মারা গেছে। ওই আর কি দলাদলি, জমির দালালি বোঝেন তো।

ভুরু কোঁচকাল পরমেশ। শানু ওই গুণ্ডাটার বাড়িতে যায়? বছর আট-দশ আগে খুন হয়েছিল সে খবরও জানি। কিন্তু তার বাড়িতে শানু কী করতে যাবে? কে আছে আর স্বপনের?

—বউ আর ছেলে। বউয়ের সম্বন্ধে কিছু খারাপ কথা শুনেছি, যাচাই করে দেখিনি সত্যি কি মিথ্যে। তবু বলছি, আপনার ছেলেটা এমনিতেই এত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে, আবার যেন কোনও বিপদে না পড়ে যায়। অস্বস্তির হাসি হাসল সুবিমল। বোঝেন তো শানুকে ভালবাসি, ওর ভাল হোক সেটাই চাই। নেহাত মাথাটা বিগড়ে গেছে, তা না হলে ও তো হীরের টুকরো ছেলে, আমাদের সবার গর্ব ছিল।

পরমেশের মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। এর কথাই বলছিল কি সুতপা? ছি ছি, এক গুণ্ডার বিধবার পিছনে জুটেছে শানু? নিজেকে কোনওমতে সামলে বলল, কোথায় থাকে জানো? শানু তো রাত্রে ফেরেনি, বুঝতে পারছি না কোথায় গেছে। বলতেই বলতেই মুখটা ঘৃনায় তেতো হয়ে যাচ্ছিল পরমেশের। ওই বাড়িতে যদি রাত কাটিয়ে থাকে, পরের ঘরের এক বিধবার সঙ্গে। সম্মান নিয়ে বাঁচতে দেবে না আর ছেলেটা, কোনওদিন এত অপমানিত বোধ করেনি পরমেশ।

কিন্তু ঠিকানা নিয়ে শিউলির বাড়িতে গিয়েও কাউকে পেল না পরমেশ। বাড়িতে তালা। ছোট বাড়ি। পাড়াটাও তথৈবচ। পাশের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল না। অবশ্য কাউকে ওখানে না পেয়ে খুশিই হয়েছিল পরমেশ। অন্তত এখানে রাত কাটায়নি। কিন্তু এর পরে কী করবে? রিক্সা বাড়ির দিকে ফেরাল। আগে বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক, যদি ইতিমধ্যে ফিরে থাকেন গুণধর। বারোটা বেজে গেছে। মাথার উপরে রোদ। স্নান খাওয়াও কিছু হয়নি সকাল থেকে। সেগুলো সারা দরকার। তারপরেও না ফিরলে পুলিশের কাছেই যেতে হবে। মাথা খারাপ ছেলে, কখন কোথায় যায়।

বাড়িতেও না পেয়ে থানায় গেল পরমেশ। সুতপা একদম ভেঙে পড়েছে। তাই স্নান খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল না পরমেশ। আগে অন্তত পুলিশে একটা ডাইরি করে দেওয়া যাক।

এইটাই বাকি ছিল জীবনে। থানাপুলিশ সেভাবে করতে হয়নি কখনও। জীবনে একবার মাত্র পুলিশের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল পাসপোর্ট করার সময়ে। সেও সাদা পোশাকের এক পুলিশ এসেছিল বাড়িতে খোঁজখবর নিতে। পঞ্চাশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে সব মিটে গেছিল। এছাড়া কুমারেশ বিচারাধীন ছিল বহুদিন। কিন্তু পরমেশ কখনও এসবের মধ্যে পড়েনি। কুমারেশ রাজনীতিতে ঢোকার পর সম্পর্কই রাখেনি কোনওদিন। দিদির মুখে যেটুকু শুনত। ছেলের জন্য আজ সেই থানাপুলিশই করতে হচ্ছে।

থানায় ঢুকে কী করতে হবে বুঝতে পারছিল না। দুটো লোক খাকি পোশাকে বসে আছে। তা না হলে থানা আর পোস্ট অফিস একইরকম লাগে যেন। সেই টেবিলে ডাঁই করা কাগজপত্র। দিনেরবেলাতেও আধো অন্ধকারে হলদে আলো জ্বলছে, দমবন্ধ করা পরিবেশ।

—কী চাই? দরজার মুখোমুখি টেবিলে বসা পুলিশের লোকটা জিজ্ঞেস করল। যদিও প্রশ্নে জানার ইচ্ছার থেকেও কেন থানায় ঢুকে বিরক্ত করছ এই ভাবটা বেশি।
—মানে, আমতা আমতা করে বলল পরমেশ, আমি আরই কলেজের রিটায়ার্ড প্রফেসার। আমার ছেলে হারিয়ে গেছে, তাই ডাইরি করতে এসেছি।

প্রফেসার বলায় কাজ হবে আশা করেই পরমেশ প্রথমে সেই তথ্যের জোগান দিয়েছিল। হয়তো কাজ হল, কিন্তু লোকটা দাঁত বের করে বলল, আপনার ছেলে না নাতি?

—ছেলে।
—অ। বুড়ো বয়সের নাকি।

লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল পরমেশের। কী সাহস, তার সঙ্গে এই ভঙ্গিতে কথা বলছে। নিজেকে কোনওমতে সামলে বলল, ছেলে বাচ্চা নয়, বয়স পঁয়ত্রিশ।

—অ। পারিবারিক ঝামেলা।

এতক্ষণেও বসতে বলেনি তাকে। পরমেশ টেবিলের সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন, এখানে বসতে পারি?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ বসুন। বলে একটা খাতা টেনে নিল। নাম?
—ছেলের? শান্তায়ন বসু।
—বয়স তো বললেন পঁয়ত্রিশ। বউ বাচ্চা ছেড়ে পালিয়েছে? এক্সট্রা ম্যারিটাল কেস?

মাথা গরম হয়ে যাওয়ার মতো কথা। এই লোকগুলো কিছু শুনতে চায় না, সবজান্তা ভাব নিয়ে বসে আছে যেন।

—বিয়ে করেনি। ওরকম কিছু নয়। নিজেকে সামলে গম্ভীরভাবে বলল পরমেশ।
—তা কী করেন উনি?
—কিছুই করে না। আসলে ওর মাথায় একটু গোলমাল আছে। বদ্ধ উন্মাদ নয়, তবে খামখেয়ালি। কথা মাথায় রাখতে পারে না। চিকিৎসার মধ্যে আছে গত পনেরো-কুড়ি বছর।
—অ। পাগলের ব্যাপার যখন দেখুন কোথায় চলে গেছে। কবে থেকে নেই?

পুলিশে চাকরি করলে কি ইনহিউম্যান হয়ে যেতে হবে এরকম? মানুষের সেবা করার কোনও ভাবনাই নেই এদের! এসব পরমেশের মনের মধ্যে চলছিল, কিন্তু মুখে তো আর বলা যায় না। বিরক্তি চেপে রেখে বলল, গতকাল রাত থেকে। আসলে ইন্সপেক্টার এত বছরে কোনওদিন এরকম করেনি, যেখানেই যাক রোজ বাড়ি ফেরে। সেরকম ধরনের পাগল নয় আমার ছেলে। একটু দেখবেন। বুঝতেই পারছেন বয়স হচ্ছে। ওই ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের। বলতে বলতে পরমেশ দেখলেন ওর গলা ভিজে যাচ্ছে। এরকম আবেগপ্রবণ নয় এমনিতে। শানুর উপরে রাগও তার কিছু কম নয়। কিন্তু আজ হারিয়ে যেতে ভিতরে বইতে থাকা ভালবাসার খোঁজও পেয়ে যাচ্ছিল যেন।

—দেখুন দুদিন। পাগল যখন ঘুরেফিরে ঠিক চলে আসবে। টাকাপয়সা ছিল কিছু পকেটে?
—না, সেরকম কিছু থাকার কথা নয়। আপনি কি একটু খোঁজখবর করে দেখবেন?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ সব করা হবে। আমরা আছি তো এইজন্যেই। কিন্তু দেখুন কেস তো আমাদের হাতে একটা নয়, অনেক। সময় লাগবে। বাড়ি যান। খবর পেলে ঠিক জানিয়ে দেব। ছবি আছে কোনও?

পরমেশ পকেট থেকে বের করে দিলেন একটা ছবি। এটা বছর দশেক আগের যদিও। অত ছবি তোলা হয় না তো আর।

—বেরোনোর সময় কী জামাকাপড় পরেছিল মনে আছে?

কী পরতে পারে? সবসময় তো ওই সাদা পাজামা আর নীল চেক জামাতেই দেখে ওকে। ওর সব জামাই নীল রঙের। এটা কখনও ভেবে দেখেনি পরমেশ। এখন হঠাৎ ভাবতে গিয়ে মাথায় এল।

শুনতে শুনতে লিখে নিচ্ছিল লোকটা। ঠিক আছে, সব কথাই লিখে নিলাম। এই রিপোর্টটার তলায় সই করে, নাম, ঠিকানা দিন। ফোন নাম্বার থাকলে সেটাও দিয়ে যান। কিছু খবর থাকলে জানাব।

পরমেশ বুঝতে পারছিল এইভাবে বিশেষ কিছু হবে না। পকেটে হাত দিল, আমি কি— আসলে ঘুষ দেওয়ার অভ্যাস না থাকায় কীভাবে দেবে বুঝতে পারছিল না। আসার পথে ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ হাজার টাকা তুলে এনেছিল যদি কাজে লাগে।

লোকটা দাঁত বের করে হাসল। কিছু দেওয়ার থাকলে দিয়ে দিন। অনেক কেস তো আমাদের, আপনারটায় তাহলে একটু বেশি নজর দেওয়া যাবে। সবারই তো প্রাপ্য থাকে।

টাকা হাতবদল হল। লোকটার কাজেও যেন একটু চাঞ্চল্য এল। পিছনের ডেস্প্যাচারকে ডেকে বলল, এই ফনী এই ছবিটা নাও। নাম শান্তায়ন বসু, বয়স পঁয়ত্রিশ। হারিয়ে যাওয়ার সময় সাদা পাজামা আর নীল ডোরাকাটা জামা ছিল। আশপাশের সব কটা থানায় জানিয়ে দাও। বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, কলকাতার এসপি অফিসেও জানিয়ে দাও। যদি ওদের এলাকায় এমন কাউকে দেখা যায়। ওরাও খবরটা ছড়িয়ে দিক।

—টাকা নেই, অত দূরে যাবে কেমন করে? পরমেশ অবাক হচ্ছিল।
—বললেন তো পাগল। মাথার ঠিক নেই যখন অত পয়সার হিসাব করে কি আর যাবে? ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করলে উঠে যাবে। বাস পেলে চেপে বসবে। হয় এরকম। তাই জানিয়ে রাখলাম সব জায়গায়।

সুতপা বাড়িতে না খেয়ে শুকনো মুখে বসেছিল। আশায় আশায়। যদি পরমেশ কোনও খবর আনতে পারে।

পরমেশ ক্লান্ত বোধ করছিল। সেই সকাল থেকে এতদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যর্থতা আরও বেশি রাগিয়ে দেয় মানুষকে। সুতপাকে খিঁচিয়ে উঠল। তোমার কি ধারণা গুণধর ছেলে থানায় গিয়ে বসে থাকবে? আমি যাব আর টুপ করে নিয়ে হাজির হব?

সুতপা কিছু বলল না। কী বলবে? ছেলে তার পাগল। জানে সেটা। তবু সেটাই তো মেনে নিয়েছিল। আশায় বুক বেঁধে থাকে মানুষ। কোনওদিন হয়তো ভাল হবে, কখনও। তাহলে শান্তিতে মরতে পারে সুতপা। ঠিক আছে, তুমি এবার স্নানটা সেরে নাও। সকাল থেকে মাথায় রোদ নিয়ে ঘুরছ। আমি খাবার বাড়ছি।

স্নান করে খেয়ে সবে ইজিচেয়ারে একটু গা এলিয়েছে পরমেশ, ফোন এল। থানার লোকটা।

—আপনি লাকি মশাই। আপনার ছেলেকে পাওয়া গেছে।
—পাওয়া গেছে? কোথায়?
—থানাতেই। এখানের থানায় নয়। কালীঘাটের।
—কালীঘাট? কলকাতা?
—হ্যাঁ স্যার। কাল থেকে কালীঘাট থানায় গিয়ে হুজ্জোতি করছিল। ওরা বাধ্য হয়ে লকআপে রেখে দেয়। দুর্গাপুরের লোক জানতে পেরে আমাদের এখানে যোগাযোগ করেছিল।
—কালীঘাটে? ও সেখানে কীভাবে যাবে? পরমেশ খুব অবাক হয়ে গেল। আপনি ঠিক জানেন?
—একদম। চেহারা মিলে যাচ্ছে। নামও বলেছে। একটু কোঁতকা পড়তে বাড়ির হদিশও দিয়ে দিয়েছে।
—কিন্তু ও কালীঘাট কেন যাবে? ওখানে আমাদের কেউ তো নেই।
—সে আরেক কেলো স্যার। কালকে কালীঘাটের দিকে কয়েকটা সন্দেহজনক জায়গায় রেইড হয়। মেয়েমানুষের ব্যাপার। ওখানে কিছু কিছু বাড়িতে ভাড়া নিয়ে বেশ্যাগিরি চলে। অনন্যা বলে একটা মেয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে। জানা গেছে তার আসল নাম শিউলি, দুর্গাপুর থেকে এই ব্যাবসা করতে আসে। হাফগেরস্ত আর কি। জানি না আপনার ছেলে কীভাবে এর চক্করে পড়ল। খবর পেয়ে কালীঘাট থানা অবধি চলে এসেছে। এসেই হম্বিতম্বি জুড়ে দিয়েছিল। ওই মাগীকে না ছাড়লে কোথাও যাবে না। ওরা বোধহয় একটু মারধর করেছে। তবে পাগল বুঝে কেস ঠোকেনি। খবর করার চেষ্টা করছিল।

শুনতে শুনতে পরমেশের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যাচ্ছিল। সুতপা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়েছিল। এগিয়ে এসে বলল, কী হল? শানুর কিছু হল নাকি? পরমেশ এক ঝটকায় সুতপাকে দূরে সরিয়ে দিল। নিস্তরঙ্গ গলায় ফোনে বলল, এখন তাহলে আমায় কী করতে হবে?

—ওরা আপনার ছেলেকে ধরে রাখবে। আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কালীঘাট থানা থেকে নিয়ে আসুন গিয়ে। পেয়ে গেলেন স্যার আপনার ছেলে। অথচ লোকে বলে পুলিশে কোনও কাজ করে না। লোকটার গলায় বেশ আত্মশ্লাঘা। পরমেশ মনে করিয়ে দিতে পারত, এই কাজের জন্যেই সরকার তোমায় টাকা দেয়। তার উপরে তুমি আমার কাছেও টাকা খেয়েছ। কিন্তু এখন এসব কিছুই বলল না। শানুর কীর্তিকলাপে তার কপালের রগ দপদপ করছে রাগে। লোকটা তবুও ছাড়ে না। যান গিয়ে নিয়ে আসুন স্যার। আমি রাতে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।

ফোনটা ছেড়েও পরমেশ খানিক থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এইটাও দেখার ছিল এক জীবনে? তার ছেলে একটা বেশ্যার জন্য থানায় গিয়ে হুজ্জোতি করছে। ছি, ছি! কপালে দুই হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়ল পরমেশ।

—কী হয়েছে আমায় একবার বলবে? আমার শানু ঠিক আছে তো?

ভেংচে উঠল পরমেশ। হ্যাঁ, আপনার শানু ঠিক আছে। যেটুকু সম্মান বাকি ছিল সেটাও এবার ধুলোয় লুটিয়ে দিল।

—কেন কী করেছে সে? কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইল সুতপা।

পরমেশের গলা উত্তরোত্তর চড়ছিল। বংশের নাম উজ্জ্বল করেছে। এত সেয়ানা ছেলে, এদিকে নাকি মাথায় কিছু রাখতে পারে না। কিন্তু একটা বেশ্যা মেয়েছেলের জন্য দুর্গাপুর থেকে উনি কলকাতা গেছেন। বাবা মাকে একবার বলাকওয়ার দরকার বোধ করলেন না। তার উপর কালীঘাট থানায় গিয়ে রাতভর হাঙ্গামা করেছেন। এখন লক আপে।

—কী বলছ এসব? আমার তো মাথায় ঢুকছে না কিছু।
—আর ঢোকাঢুকির কিছু নেই। কালকেই আনন্দে নাচছিলে না? তোমার ছেলে বিয়ে করবে, তাও আবার চাকরি করা মেয়ে। আর বিয়ে করেই তোমার ছেলে ভাল হয়ে যাবে? পরমেশের সব রাগ গিয়ে পড়েছিল সুতপার উপর। গলায় সমস্ত ঘৃণা ঢেলে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কী করে জানো সেই মেয়ে? আসলে একটা বেশ্যা। শরীর বেচে খায়। ওটাই ওর চাকরি।

সুতপা অবাক হল এই ভেবে যে এতসব শুনেও সে কেন একেবারে ভেঙে পড়ছে না। ঘা খেয়ে খেয়ে সে কি অনুভূতিহীন হয়ে গেছে? না কি সে তার পাগল ছেলেকে এতটাই ভালবাসে যে তাকে ফিরে পাওয়া গেছে সেটাতেই শান্তি। হয়তো এটাই সত্যি। একটা সময় ছিল পরমেশের কথায় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোর বাইরে কিছু করতে পারেনি। সব হারিয়ে কিছুটা হলেও নিজেকে ফিরে পেয়েছে সুতপা। সেই জোরটাই গলায় ফসফসে দেশলাইয়ের মতো জ্বালিয়ে বলল, এখন কী করতে হবে আমাদের?

—যেতে হবে কালিঘাট থানায়। নিয়ে আসতে হবে তোমার সবেধন নীলমণিকে। পারব না আমি এইসব। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। পচুক জেলে, জাহান্নমে যাক।

কীভাবে শক্তি পেল জানে না সুতপা। কিন্তু ভেবে নিয়েছে। ছেলেকে সেই আনতে যাবে। পাগল হোক, যাই হোক, তার ছেলে। ভাল থাকতে আগলে রাখতে পারেনি, কিন্তু এখন রাখবে। তাছাড়া পরমেশ গেলে রাস্তাতেই একটা কাণ্ড হবে। জোর দিয়ে বলল, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।

—তাহলে কে যাবে শুনি? কাকে পাঠাবে? কথাটা পাঁচকান করে কোনও লাভ আছে? খিঁচিয়ে উঠল পরমেশ।
—আমি যাব।
—তুমি যাবে কী করে? চমকে তাকাল পরমেশ। শেষ কবে একা কোথাও গেছে সুতপা?
—আমি ভাড়ার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি শুয়ে বিশ্রাম করো। আর মাথাটা ঠান্ডা করো একটু। সবসময়ে চেঁচামেচি করে সবকিছুর সুরাহা হয় না।
—ছেলের জন্য যে দরদ উল্টে যাচ্ছে একেবারে। পরমেশের গলায় বিদ্রূপ।

এবার ঝেঁঝে উঠল সুতপা। সকাল থেকে পেটে একটা দানা পড়েনি। বারবার শুধু ঠাকুরঘরে গিয়ে মাথা ঠুকেছে। সুতপার মন এই লোকটা কি কোনদিন বুঝবে না? ছেলে তার। জীবনে অকৃতকার্য হতে পারে। লোকের চোখে ফেলনা। কিন্তু তার কাছে তো নয়। ছিল না কোনওদিন। আগে পরমেশের রাগের সামনে মাথা তুলতে পারত না। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেছে সুতপার। খানিকটা হলেও। সেই জোরের সঙ্গেই বলল, কেন কী করেছে শানু? ও কি করে জানবে মেয়েটা কী করে না করে? ওর কি মাথায় এসব থাকে? মেয়েটা বেশ্যা বলে ওর কী দোষ? এমনি মানুষই এমন কত ঠকে যায়, আর ও তো পাগল। বিয়ে করবে ভেবেছিল, সাধ আহ্লাদ সব মানুষেরই থাকে। ওরও হয়েছিল। কিন্তু করে তো আর নি।

সুতপার যুক্তি অকাট্য। গলার জোরটাও পাশে সরিয়ে রাখার মতো নয়। পরমেশকেও মানতে হল। একটু ঠান্ডা হয়ে বলল, তোমাকে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।

—একদম না। তোমার মাথা গরম, কী বলতে কী বলবে। ছেলেটা দুদিন কী খেয়েছে, কী খায়নি আমার জানা নেই। আগে আমি ছেলেকে বাড়িতে আনি। নিজের হাতে খাওয়াই। তারপরে অন্য কথা। আমরা ফিরলেও কোনও কথা বলবে না শুরুতে। আমি সব বুঝিয়ে বলে দেব ওকে।

স্বভাববিরুদ্ধ দৃপ্ততায় তৈরি হতে চলে গেল সুতপা।

পরমেশ জামাটা গলিয়ে আবার বেরোল। মোড়ের মাথার স্টেশনারি দোকানটায় ভাড়ার গাড়ি দেয়। যখন খুব অসুস্থ ছিল শানু, কলকাতায় ডাক্তার দেখানোর সময় নিয়েছিল পরমেশ। সুতপার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা অন্তত করে দেওয়া যাক।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]