Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুলি কাহার এবং ভোট-বৃত্তান্ত

শঙ্কর সান্যাল

 


এই আবহেই ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে গ্রামবাংলায়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারেনি দুলি আর বাঁটুল কাহার। নাসিমা আর রহিম বক্সও পারেনি। এবার দুলি বলেছে নাসিমাকে— ভোটটা দেবই, যা কপালে আছে, হবে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল মানুষ কেবল মার খাচ্ছে না, পাল্টা ফিরিয়েও দিচ্ছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এই প্রতিরোধটা অত্যন্ত জরুরি

 

দুলি কাহার দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলাই করছিল। ছেলেটা এখন আর ইস্কুলে যায় না। তিন কেলাসে উঠতেই ইস্কুলের দরজায় তালা। বুড়ি এক মাস্টারনি আর বুড়ো এক মাস্টার ছিল। দুজনেই নাকি রিটিয়ার করে গিয়েছে। তারপর থেকেই ইস্কুল বন্ধ। নতুন মাস্টার এলে ইস্কুল খুলবে। এ গেরামে একটাই পেরায়মরা (প্রাইমারি) ইস্কুল ছেল। টিনের চাল ফুটো। বর্ষায় ঝরঝর করে জল পড়ত। তবু ছেল, দশটায় খুলত, তিনটে পর্যন্ত কেলাস হত। তবু ছেলেমেয়েগুলান কিছু তো শিখত। মাস্টার আসে না, ইস্কুলও খোলে না। নকুড় সামন্তর বাড়িতে সকাল বিকাল ঘরকন্নার কাজে যায় দুলি। সেখানেই টিভিতে দেখেছে যারা নাকি মাস্টার হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করেছে, তারা সব রাস্তায় বসে আছে। পুলিশ এসে মাঝেমাঝেই তাদের বেদম পেটায়। ছেলেটা একদম অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। দুলির কান্না পেয়ে যায় এসব ভাবলেই। দুলির বর বাঁটুল বেশ একশোদিনের কাজ করছিল। হঠাৎ একদিন পঞ্চায়েত মেম্বার এসে জবকার্ডটা নিয়ে নিল। তারপর থেকে আর কাজ নাই। গেরামেও কাজ হয় না। আগে শুখা মরশুমে রাাস্তা হত, পুকুর কাটা হত। এখন কিছুই হয় না। আগে তবু দু-পাঁচশো টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকত। এখন লবডঙ্কা। লালপার্টির জমানায় দুলির শ্বশুর তিনকাঠা জমির পাট্টা পেয়েছিল। জমি তো জমি, সার বীজ জল কেনার টাকা কই? চাষ তো হত না। ছোট ননদের বিয়ের আগে শ্বশুর সেই জমি বন্ধক দিয়ে দিল নকুড় সামন্তর কাছে। এখন এই ভিটেটুকুই সম্বল। দুলি কাঁথায় ফোঁড় দেয় আর ভাবে— কী হবে? লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশো টাকা পায়। আজকের দিনে পাঁচশো টাকায় কী হয়! দুলি ভেবেই পায় না এই পাঁচশো টাকাটা সে পায় কেন।

নাসিমা বানো দুলির মেয়েবেলার বন্ধু। মোছলমান পাড়ায় থাকে। মাঝেমধ্যে গল্প করতে আসে। ওর বর রহিম বক্স। জমিজিরেত নেই। গায়েগতরে খেটে রোজগার। তা এখেনে কাজ কই? রহিম তাই দূর দেশে খাটতে যায়। কখনও চাষের কাজ, আবার কখনও রাজমিস্ত্রির জোগারে। নিজের খরচা চালিয়ে ঘরের জন্য টাকা আনে। এবার ফিরে বাঁটুলকেও নিয়ে যাবে। আগে গেরামে কাজ ছেল। দুটো মোটা ভাত জুটে যেত। এখন কাজও নেই, ভাতও নেই। মানুষটা দূরে চলে যাবে ভাবতেই কান্না পায় দুলির। কিন্তু কী আর করা! ঘরের চাল ছাইতেই হবে বর্ষার আগে। একে ভাত জোটে না, তায়ে আবার চাল ফুটো। এবেলা কটা পান্তা আছে। কিন্তু ওবেলা? দুলি আবার কাঁথায় ফোঁড় তোলে।

হ্যাঁ, এটাই বাংলার গ্রাম। ২০২৩ সালে। এখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কাজ নেই। রুজিও নেই। সবাই যেন এক আজব নেইরাজ্যের বাসিন্দা। সবাই কথাটা বলা ভুল। কারও কারও আছে। যাদের আছে, তাদের চোখ টাটানোর মতোই আছে। পাকা দালানকোঠা, দুচাকা দু-চারটে, চারচাকাও। গলায় আর হাতে সোনার চেন, এমন মোটা যেন কুকুর বাঁধা যায়। টাকা যেন উপচে পড়ছে। আসে কোত্থোকে? উত্তর একটিই— কাটমানি। যে মানি আসে আর কাটতে কাটতে ওপরতলায় উঠে যায়, তাকেই নাকি কাটমানি বলে। গরু, কয়লা, বালি, পাথর— সব লম্বা লম্বা কেস। পঞ্চায়েতবাবুদের ওখানে গল্প নেই। গল্পটা আছে প্রকল্পের টাকায়। অজস্র প্রকল্প, অজস্র টাকা। বাতাসে উড়ছে, আকাশে ভাসছে। হাত বাড়ালেই ধনপতি সওদাগর। হ্যাঁ সওদাগরই বটে। গত এক যুগে এই বাংলায় রাজনীতিটা আসলে ব্যবসা হয়ে গিয়েছে। এখন আর রাজনীতি নেই, রাজব্যবসা হয়ে গিয়েছে। আবাস, কন্যাশ্রী, বিধবাভাতা, আরও কত কী! নলকূপ বসানোর টাকাও উবে যায় উষ্ণ বাতাসে। ভোলাটাইল ফান্ড! চাকরির জন্য হেদিয়ে মরছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম। এটা যে কত ভাল ব্যবসা হতে পারে, সেটা বোঝা গেল এই এক যুগেই। চাকরি হোক বা না হোক, টাকা তো ঘরে এল। কী বলছেন, প্রতারণা? হলেই বা কী? ধরা না পড়লেই হল। কিন্তু হালে অবশ্য সে গুড়ে বালি পড়ছে আদালতের খোঁচায়। ল্যাজা, আখনা-পাখনা, গাদা-পেটি, সবই টপাটপ জেলের ভাত খাচ্ছে। কিন্তু মুড়োর দেখা নাই রে, মুড়োর দেখা নাই। সেখানে আবার কী এক সেটিং-সেটিং খেলা!

“সততার প্রতীক” কোথায় হারিয়ে গেল দেওয়াল আর ফ্লেক্স থেকে কে জানে! এখন তৃণমূলিরাও ওই শব্দবন্ধ লিখতে সম্ভবত লজ্জা পায়। একটা পারসেপশন জনগণমনে গেঁড়ে বসেছে— ওরা সবাই চোর। উর্দুতে একটি গাল রয়েছে, ভয়ঙ্কর ঘৃণ্য কোনও ব্যক্তিকে দেওয়া হয়— কাফন চোর। তৃণমূলিরা বোধহয় মৃতদেহের কাফনটাও ছাড়ে না। তার থেকেও পারলে কাটমানি শুষে নেয়। দুর্যোগে, বন্যায়, অতিমারিতে মানুষের যখন সর্বনাশ, তখন পৌষমাস এঁদের। ওরে বাবা, কত ত্রিপল, কত চাল, চিঁড়ে, গুঁড়ো দুধ, কত টাকা! আমফানের পরে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে ভূভারতে দুর্লভ সব চিত্রপট। আপাদমস্তক তৃণমূলিদের একটাই লক্ষ্য। নোট চাই। তার জন্যই ভোট চাই। ক্ষমতাই সম্পদের উৎস, আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল। তাই ভোটশঙ্খ বাজলেই হোঁৎকামতো কাতলামুড়ো চড়াম চড়াম ঢাক বাজাত, গুড় বাতাসা বিলি করত।

এই আবহেই ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে গ্রামবাংলায়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারেনি দুলি আর বাঁটুল কাহার। নাসিমা আর রহিম বক্সও পারেনি। এবার দুলি বলেছে নাসিমাকে— ভোটটা দেবই, যা কপালে আছে, হবে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল মানুষ কেবল মার খাচ্ছে না, পাল্টা ফিরিয়েও দিচ্ছে। বিরুদ্ধতার কণ্ঠস্বর ক্রমশই উচ্চকিত হচ্ছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এই প্রতিরোধটা অত্যন্ত জরুরি।

গত এক যুগে আরও একটি বাণিজ্য জন্ম নিয়েছে এই বাংলায়। সেটা মেরুদণ্ডের বাণিজ্য। রাষ্ট্র যখন মেরুদণ্ডের খরিদ্দার হয়ে যায়, তখন বড় ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। যার সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ভয়াবহ। গরিব মানুষের মেরুদণ্ডের তেমন দাম নেই। শাসক ধরেই নেয় সন্ত্রাসের সামাজিকীকরণ করে দিলে দরিদ্রের মেরুদণ্ড এমনিই বেঁকে যায়। পুলিস, প্রশাসন এবং একটি প্রগাঢ় সামাজিক নীরবতা ছাড়া এই সার্বিক স্বৈরাচার তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। তাই প্রয়োজন মধ্যশ্রেণির মেরুদণ্ডের। যাঁরা প্রশাসনে আছেন, বৌদ্ধিক জগতে বিরাজ করে মুখ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের মেরুদণ্ড চাই। অতঃপর কূশ্রী, বিশ্রী, হতশ্রী ইত্যাদি রোমহর্ষক পুরস্কার দাও। পদে এবং বি-পদে বসিয়ে আ-পদ বানিয়ে কিছু অর্থের সংস্থান করে দাও। বিনিময়ে মহার্ঘ্য মেরুদণ্ডটি এই অবসরে কিনে নাও। এরাই ভোটবাক্সের শেষ পারানি গুনে দেবে।

আজ ৫ জুলাই, ২০২৩। আর তিনদিনের দিন ৮ জুলাই বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট। দিন ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রাণ গিয়েছে। আরও কত, আমরা জানি না। ভোটের দিন কী হতে চলেছে, তাও আমরা জানি না। আবার ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি, নাকি নতুন ইতিহাস? ভোটগণনায় কারসাজি নাকি প্রতিরোধ? এত কিছুর পরেও খেটেখাওয়া মানুষের মেরুদণ্ডই সবচেয়ে বড় ভরসা।


*মতামত ব্যক্তিগত