Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পঞ্চায়েতের ভোটকাব্যে এবারও উপেক্ষিতা পরিবেশ

জয়ন্ত বসু

 


আজকে গ্রামবাংলার বাতাস এতই দূষিত যে গবেষণা অনুযায়ী গ্রামের ৭২ শতাংশ মানুষের জীবনকাল প্রায় ৬ বছর কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি রাজ্যের ৪১,৫০০ গ্রামের মধ্যে ০.৫ শতাংশতেও কোনওরকম কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। রাজ্যের প্রায় ১০০টির কাছাকাছি অঞ্চলে, যার অধিকাংশের ঠিকানাই গ্রামবাংলা, মাটির তলার জল হয় দ্রুত নামছে বা দূষিত হয়েছে। ১২০০০ ইটভাটা, যার বেশিরভাগই বেআইনি, কৃষিজমির দফারফা করছে। সঙ্গে দোসর কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি। রয়েছে আর একটি বিষয়। কলকাতা থেকে ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল হবে কিন্তু সে চলতে পারে গ্রামাঞ্চলে, শহরাঞ্চলে আর দূষণসৃষ্টিকারী শিল্প বসানো যাবে না কিন্তু তা স্বচ্ছন্দে বসানো যেতে পারে গ্রামাঞ্চলে— অর্থাৎ দেশ ও রাজ্যের পরিবেশ নীতিতে গ্রাম বর্তমানে দূষণের ভাগাড় বললে অত্যুক্তি করা হবে না


নির্বাচনের মতো এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মানুষের ভিড় গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু শেষ কথা নয়, বেশ কয়েক বছর আগে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডাঃ দেবকুমার বসু। কথাটা মনে পড়ে গেল সম্প্রতি হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া অঞ্চলের জগৎপুরের এক আলোচনাসভায় গিয়ে। দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আনন্দ ভবন ডেফ অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুলে আয়োজিত হয়েছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিবেশ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে বা পাচ্ছে না, সেই আলোচনা। প্রবল বৃষ্টিতে সপসপে ভেজা হাতে গোনা কিছু মানুষ আর স্থানীয় সাংবাদিক। কিন্তু এমনই হাতেগোনা মানুষের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যা সম্ভবত রাজ্যের পরিবেশচর্চার ইতিহাসে আগামী দিনে মাইলস্টোন হিসাবে চিহ্নিত হবে।

পরিবেশ নিয়ে রাজ্যব্যাপী কাজ করা সবুজ মঞ্চ ও হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের উদ্যোগে প্রকাশিত হল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে এক পরিবেশ ইস্তাহার। গ্রামের আবর্জনা ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ুদূষণ, নিকাশিব্যবস্থা, জলবায়ু ও বিপর্যয় প্রতিরোধ, নদী-জলাভূমি-জলাশয় সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কট, বনাঞ্চল রক্ষা ও গাছ কাটা, বেআইনি ইটভাটা ও কীটনাশকের অফুরন্ত ব্যবহারের ফলে চাষের জমির সর্বনাশ— এমন নানা বিষয় উঠে এল সেই ইস্তাহারে। হাওড়ার পাশাপাশি প্রায় একযোগে হুগলি, নদিয়া ও রাজ্যের অন্যান্য জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সবুজ বাঁচানোর কথা বারবার উঠছে, উঠছে কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারেই পরিবেশের বিষয় হয় আদৌ নেই বা থাকলেও হাতেগোনা কয়েক লাইন— সে কথাও।

এটা কোনও নতুন বিষয় নয়। লোকসভা নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে কোনও নির্বাচনেই রাজনৈতিক দলগুলি পরিবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, একথা মানেন রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীরাও। পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে সে প্রবণতা আরও বেশি কেননা এখনও রাজনৈতিক এবং নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ মনে করেন যে গ্রামে পরিবেশের বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। ফলে পরিবেশ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনও নেই।

কিন্তু তথ্য অন্য কথা বলছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘নিস্তব্ধ গ্রামের মিষ্টি মধুর বাতাস বারবার অনুভূতিহীন করেছে আমায়’, কিন্তু আজকে গ্রামবাংলার বাতাস এতই দূষিত যে গবেষণা অনুযায়ী গ্রামের ৭২ শতাংশ মানুষের জীবনকাল প্রায় ৬ বছর কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি রাজ্যের ৪১,৫০০ গ্রামের মধ্যে ০.৫ শতাংশতেও কোনওরকম কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই যদিও ২০১৬ সালেই সে নিয়ম হয়ে গেছে।

তথ্য বলছে রাজ্যের প্রায় ১০০টির কাছাকাছি অঞ্চলে, যার অধিকাংশের ঠিকানাই গ্রামবাংলা, মাটির তলার জল হয় দ্রুত নামছে বা দূষিত হয়েছে। ১২০০০ ইটভাটা, যার বেশিরভাগই বেআইনি, কৃষিজমির দফারফা করছে। সঙ্গে দোসর কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি। মনে রাখতে হবে গ্রামবাংলার ক্ষেত্রে এমনটা শহরের তুলনায় বেশি চিন্তার, কেননা এখানকার মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য পরিবেশের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল।

এইসব তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে আর একটি বিষয়। কলকাতা থেকে ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল হবে কিন্তু সে চলতে পারে গ্রামাঞ্চলে, শহরাঞ্চলে আর দূষণসৃষ্টিকারী শিল্প বসানো যাবে না কিন্তু তা স্বচ্ছন্দে বসানো যেতে পারে গ্রামাঞ্চলে— অর্থাৎ দেশ ও রাজ্যের পরিবেশ নীতিতে গ্রাম বর্তমানে দূষণের ভাগাড় বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এক সময় যখন গ্রামের পরিবেশ অনেক ভাল ছিল তখন এমন নীতি তর্কের খাতিরে খানিকটা মানা গেলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটা কোনওক্রমেই মানা যায় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আলোচনার সামনে আসা প্রয়োজন।

পরিবেশ নিয়ে এই ঘন অন্ধকারের মধ্যে আশার রূপরেখা একটিই যে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে পরিবেশের নানান বিষয়কে সামনে রেখে— নদীয়ায় জলঙ্গি নদী নিয়ে, কোথাও দেউচা পাচামির দূষণ নিয়ে— পঞ্চায়েত নির্বাচনে নেমেছেন বেশ কিছু মানুষ; কেউ কোনও দলের হয়ে কেউবা নির্দল। আগামীদিনে পরিবেশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে এরাই চিমটি কাটার কাজ করবে তেমনটাই আশা, আর তাহলেই হাওড়ার জগৎপুরের গুটিকয় মানুষের পঞ্চায়েতের পরিবেশ নিয়ে হওয়া আলোচনাটি সত্যিসত্যিই ঐতিহাসিক হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত