সোমব্রত সরকার
আলেয়া হ্রদের শিকার কবিতায় জয় গোস্বামী লিখেছিলেন— দৌড়োও যতটা গেলে ফল্গুদের হাতে বোনা তাঁত/সড়কের পাশ থেকে নেমে গেছে ফিতে রাস্তা, পাকাবাড়ি ও গ্রামে একটাই/সেটা ফল্গুদের নয়। শান্তিপুরের নতুনহাটে ফল্গু বসুর বাড়িতে সেই জয় গোস্বামী কথিত হাতে বোনা তাঁত আমি দেখিনি। শুনেছিলাম ফল্গুদার মা তাঁত চালাতেন। আর জয়ের দেখা ১৯৭৯ সালের ফিতে রাস্তা ২০০২ সালে তখন পিচে ঢালাই। আর ফল্গুদাদের কাঁচাবাড়ির ঘরগুলো পরিত্যক্ত। তার দু’একটাতে পুরনো টালির গড়নের ইটের গাঁথুনি। ওই ঘরে মাসিমা থাকতেন। আর নতুনহাটে তখন বেশ কিছু পাকাবাড়ি। ফল্গুদাদের সেই তাঁত বোনা ও পুরনো বসবাসের পরিত্যক্ত খিলানভাঙা, জানলা-দরজা-থামের লতাঝোপ পেরিয়ে ছমছমে গাছের সারির অন্ধকার মাড়িয়ে যেতে হয় পেছনের দিকের নতুন বাড়িতে। এমনিভাবেই ২০০২ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর আমি গিয়েছিলাম ফল্গুবসুর বাড়িতে। দিনটা ছিল মেঘলা ও বৃষ্টিমাখা। ফল্গু বসুর প্রথম কবিতার বই অবাধ্যের পুঁথি, দ্বিতীয় বই অক্ষরবল্কল, তৃতীয় ভূভারত সুধাময়, চতুর্থ মৃদুচিহ্ন সবই আমি উপহার পেয়েছিলাম সেদিন। দুই-তিন ফর্মা বইগুলোর প্রথম পাতাতে এখনও সেই সালতামামির স্মৃতি। আমি তখন থাকতাম রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর বনানীবাড়িতে। সেখানে একসময় আসতেন জয়, সুবোধ, ফল্গু। রানাঘাটে নতুন ব্রিজের চূর্ণীঘাটের কিছু আগে আছে আনন্দ প্রামাণিকের দোকান। সেই দোকানে জয়, তপন ভট্টাচার্য, প্লাবন ভৌমিকরা সব আড্ডা দিতেন। ফল্গু বসু ছিলেন আকাইপুরের লাইব্রেরিয়ান। বনগাঁ লাইনের ট্রেন বদলের জন্য শান্তিপুর থেকে রানাঘাট নেমে তিনি আকাইপুরে যেতেন। ফেরার পথে আনন্দ প্রামাণিকের দোকানে আড্ডা। এই আড্ডাতে কৃষ্ণনগর থেকে আসতেন বন্ধু জয়ের সঙ্গে দেখা করতে সুবোধ সরকার। আসতেন দেবদাস আচার্য। কার্তিক মোদক রানাঘাটে থাকেন। আসতেন। নিজন দে চৌধুরী আসতেন। আর আসতেন ভাস্কর চক্রবর্তী। তিনি তখন কবিতার আড্ডার টানে ও প্রেমিকা বাসবী চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করার কারণে ঘনঘন রানাঘাটে। বাসবী চক্রবর্তীর বাবা গোবিন্দ চক্রবর্তী চল্লিশ দশকের কবি। বাসবী নিজন দে চৌধুরীর বাড়ির কাছেপিঠে থাকতেন। নিজন দে চৌধুরীকে বলতেন সন্টুকাকা। নিজন দে চৌধুরীর বাড়িতে আসতেন জয় ও ওঁর সঙ্গে মৃদুল দাশগুপ্ত। এসব কথা আমার ফল্গু বসু ও নিজন দে চৌধুরীর মুখে শোনা। রানাঘাটে কবিতা ঘিরে আশ্চর্য মধুময় দিন। সেই সংঘ ২০০০ সালে আমার লেখা শুরুর সময়টায় আর নেই। আমার ছিল নৈহাটির বনানীবাড়ি। রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর বাড়ি হয়ে হাঁটা পথে লঞ্চঘাটের কাছে সরোজ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি। এই বাড়িতে জয় আসতেন। নৈহাটি ছাড়া আরেকটা কবিতা নিয়ে কথা বলার জায়গা কল্যাণীতে বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের বাড়ি। অসমবাস থেকে ফিরে বীরেন্দ্রনাথ তখন সবে এসেছেন আমাদের শহরে। এই শহরে আছে রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর আরেক বাড়ি আরশীনগর। ওঁর প্রথম বইয়ের নামে বাড়ি। বাড়ির নামকরণের লেটারিং করে দিয়েছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। নৈহাটির বনানীবাড়ি থেকেই একদিন গেলাম ফল্গু বসুর বাড়ি। তখন আমরা হিল্লোল নামে একটি কাগজ করি। সেই কাগজে বের হয় রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর তোলপাড় করা সাক্ষাৎকার। হিল্লোলের প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদে থাকত মণীন্দ্র গুপ্তের হাতের কাজ। লিখতেন আলোক সরকার, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুধেন্দু মল্লিক, দেবারতি মিত্র, দেবদাস আচার্য, সুধীর চক্রবর্তী, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, অরুণ বসু, অর্চনা আচার্য চৌধুরী, অঞ্জলি দাশ, অমিতাভ গুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ, রমা ঘোষ, মৃদুল দাশগুপ্ত, গৌতম চৌধুরী, অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, সংযম পাল। পুণে থেকে কবিতা পাঠাতেন রাজলক্ষ্মী দেবী। ফল্গু বসু এরপর কবিতা দিলেন। কত সখ্য গল্প মত ও মতান্তর। কৃষ্ণনগরে দেবদাস আচার্যের একক কবিতা পাঠের আসর করলাম। চাকদহে বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের। অরুণ বসুর। সব বিষয়ে ফল্গুদা পাশে। ২০০৫-এর পর ওঁর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমি তখন বাউল ফকির ভৈরবী সাধু তান্ত্রিক গুরু ভৈরব বৈষ্ণব সহজিয়া মানুষ নিয়ে ব্যস্ত। রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের কার্ড দিতে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। তারপর আর যাওয়া হয়নি। ২০০৫ সালে পেয়েছিলাম ওঁর আরও দু’টি কৃশতনু বই— করতলে ভাগ্যরেখা নেই আর স্বভাববর্ণ। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফল্গু বসু লিখতে এসেছিলেন। ওঁর আসল নাম অসীমকুমার বসু। ফল্গু ডাকনাম। আমাদের প্রজন্মের ক’জন বা ওঁর নাম জানেন বা কবিতা পড়েছেন? তবে ওঁর কবিতা না পড়লে বাংলা কবিতার ভাষাশৈলীর এক আশ্চর্য দিক অচেনা থেকে যাবে। গত সপ্তাহে অভীকদা জিজ্ঞেস করছিল ফল্গু বসুর খবর। বলল, দেখতে যাওনি? অসুস্থ, চলে যাওয়ার দিকে পা বাড়িয়ে রাখা একজন মানুষকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করেনি আর। ফল্গু বসু আছেন আমার কবিতাযাপনের বেড়ে ওঠায়। এই তো আসল থাকা। জানি না নতুনহাটের সেই বাড়ি এখন কেমন। জয় গোস্বামীর দেখা তাঁতের খটখট আওয়াজ তো নেই। কোন আওয়াজ খেলা করে ও বাড়িতে? ওঁর মেয়ে পথিকা এখন নিশ্চয়ই অনেক অনেক বড়। আমি জানি ও বাড়িতে চিরদিন থেকে যাবে কবিতার আওয়াজ। কেউ বুনে চলবেন নিঃশব্দ তাঁত— কবিতার।