সুমন কল্যাণ মৌলিক
নিরপেক্ষ ও নিয়মানুগভাবে ভোট পরিচালনা ভোটকর্মীর দায়িত্ব। কিন্তু কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছে উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তা না পেলে কাজটা কীভাবে করা সম্ভব! কতজন এই তথ্যটা জানেন যে এবার সমস্ত ভোটকর্মীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য (নাম, স্কুল/প্রতিষ্ঠানের নাম, ব্লক, মোবাইল নাম্বার) কমিশনের সৌজন্যে ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকেই সোশাল মিডিয়ায় উপলব্ধ ছিল। আর সেই তথ্য দেখে আগে থেকেই ভোটকর্মীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার কাজ ছিল নেহাৎই জলভাত
গোটা পঞ্চাশেক তরতাজা লাশ, অজস্র আহত মানুষ, নিরবচ্ছিন্ন হিংসা, শান্তিরক্ষকদের ক্লীবতা, রাজ্যপালের নিয়মমাফিক চেতাবনি, ভোটকর্মীদের অসহায়তা এবং নির্বাচন কমিশনের অতুলনীয় ‘অপদার্থতা’র মিশেলে সম্পন্ন হল ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। গণতন্ত্রে ব্যালটের শক্তি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানে বহু কথা আলোচিত হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনে ব্যালটের যে অবাধ গতি দেখা গেছে তা অভূতপূর্ব। নালা, নর্দমা থেকে পুকুর হয়ে মানুষের পাকস্থলী— ব্যালট এবার সর্বভূতে বিরাজমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয় পঞ্চায়েত হল তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রের নিখাদ অনুশীলন যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করে। লাঠি, গুলি, বোমা, বন্দুক, তীরধনুক-লাঞ্ছিত এই ভোট দেখে অবশ্য রাজ্যবাসী ক্ষমতায়নের স্বরূপটিকে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। জানি এসব কথা বললে ‘চোখে আঙুল দাদা’রা রীতিমতো কাগজকলম বের করে, তথ্যপ্রমাণ দেখিয়ে বলবেন পঞ্চায়েতে হিংসাই তো এ রাজ্যে স্বাভাবিক। যদিও এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে না যে তাহলে পরিবর্তনের এত ঢক্কানিনাদ কেন! পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার সংস্কৃতি, এই নির্বাচনের ফলাফলের রাজনৈতিক গুরুত্ব, আগামী লোকসভা নির্বাচনে এই ফলের প্রভাব নিয়ে জ্ঞানীজনের অনেক সন্দর্ভ প্রকাশিত হচ্ছে বা হবে, তবে সবিনয়ে বলি এই লেখা সেসব থেকে অনেক দূরে। এ লেখা এক ভোটকর্মীর কথকতা যে গত তিরিশ বছর ধরে সরকারি চাকরি বাঁচাবার দায় থেকে গণতন্ত্রের এই রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত থেকেছে। ভোটের ডিউটিতে যাওয়ার সময় থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার পরিজনের শঙ্কিত মুখ তাকে ব্যথিত করেছে, নির্বাচন কমিশনের অপ্রতুল ও নির্বোধ ব্যবস্থাপনার কারণে যাকে এবং তার মতো হাজার হাজার ভোটকর্মীকে প্রতিমুহূর্তে পীড়িত হতে হয়েছে, সেই সব নগণ্য কিন্তু ভোট পরিচালনায় অপরিহার্য মানুষদের কথা তুলে ধরার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা।
যদিও এ লেখার ভরকেন্দ্রে রয়েছে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, তবে ধারাবাহিকতার স্বার্থে কিছু পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাও আলোচনায় আসবে। প্রথমে বলে নেওয়া ভাল যে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন পরিচালিত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পরিচালিত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মূলগত কয়েকটি পার্থক্য আছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন ত্রিস্তর অর্থাৎ একজন ভোটারের তিনটি ভোট এবং তাও তাকে দিতে হবে ব্যালটে ছাপ মেরে। ইভিএম মেশিনে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত ভোটারদের কাছে এবং ভোটকর্মীদের কাছেও বিষয়টা অনেক জটিল এবং সময়সাধ্য। সর্বোপরি সাংবিধানিক রীতি অনুসারে রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ও নির্দেশ=নির্ভর। এই কথাটার অর্থ হল স্বাভাবিক অবস্থায় রাজ্য সরকারের মর্জি ছাড়া কমিশন নেহাৎই ঠুঁটো জগন্নাথ। ফলত নির্বাচন পরিচালনা থেকে ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা শাসকদলের হাতেই কেন্দ্রীভূত। এটা হবেই জানা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোনও সংসদীয় রাজনৈতিক দল নিয়মের পরিবর্তন চায়নি। ফলে সবচেয়ে আতান্তরে পড়েছেন ভোটকর্মীরা।
চাকরিজীবনের প্রথমদিকে যখন ভোট করাতে যেতাম (সম্ভবত নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্বে) তখন ভোটকর্মীরা ছিল নেহাৎই ছাগলের তৃতীয় সন্তান। ব্যাগে ছাতু, মুড়ি, মশার ধূপ, মশারি, শতরঞ্জি, গামছা ও এক সেট অতিরিক্ত জামাকাপড় নিয়ে অজানা জায়গায় অভিযান, খাবারের জন্য বুথে গিয়ে নিজেদেরই ব্যবস্থাপনা করতে হত। বেশিরভাগ জায়গায় প্রাইমারি স্কুলে বুথ হত, পানীয় জল বা শৌচাগারের ব্যবস্থা কহতব্য নয়। তবে একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে পরিকাঠামোর অবস্থা আগের চেয়ে এখন ভাল হয়েছে। সর্বশিক্ষা অভিযান এবং এই ধরনের আরও নানান পরিকল্পনার দৌলতে স্কুলগুলোর হাল ফিরেছে, বেশিরভাগ জায়গায় শৌচালয় আছে, কমিশনের পক্ষ থেকে আজকাল বোতলবন্দি জল, পার্সোনাল কিট দেওয়া হয়, এমনকি মিড ডে মিল পরিচালনাকারী দিদিদের সৌজন্যে খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে আরেকটা পরিবর্তনও উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনে হিংসা, বুথ জ্যাম, ভোট লুঠের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণভাবে ভোটপ্রক্রিয়ার প্রতি, ভোটকর্মীদের প্রতি আচরণের বিষয়ে যে একটা স্বাভাবিক ভব্যতা ছিল তা কমে আসছে। দিন দিন রাজনৈতিক লুম্পেনদের প্রভাব বাড়ছে, আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন অসহায় ভোটকর্মীরা।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ রাজনৈতিক দলসমূহ, তাদের প্রতিশ্রুতিমালা, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে মিডিয়ায় যত আলোচনা হত তার একাংশও জুটত না ভোটকর্মীদের ভাগ্যে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটল ২০১৮ সালের রক্তস্নাত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে। নির্বাচন করতে গিয়ে রহস্যময়ভাবে খুন হয়ে গেলেন রায়গঞ্জের তরুণ শিক্ষক রাজকুমার রায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে সেখানকার শিক্ষকেরা যেভাবে প্রতিবাদ সংঘটিত করেন তা অবশ্যই আজ ইতিহাসের অংশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সন্ত্রাসকে অগ্রাহ্য করে রাজকুমারের খুনিদের গ্রেপ্তার ও ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দাবিতে সেই লড়াই গোটা রাজ্যের ভোটকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে। একাধিক সংগঠন পথে নামে তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে রেখে গঠিত হয় শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চ নামে এক সংগঠন। এর পর থেকে ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দাবিটিকে আর নস্যাৎ করা যায়নি। যদিও বাস্তবায়নের প্রশ্নে মিশ্র ফল দেখা গিয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের নির্বাচন তুলনামূলক অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলেও পৌর নির্বাচনগুলোতে যথেচ্ছ ছাপ্পা ভোট হয়েছে, প্রাণভয়ে ভোটকর্মীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুর্গাপুর পৌর নিগমের ভোট, যেখানে শাসক দলের কল্যাণে বেলা বারোটার মধ্যে ভোটপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। এই যে কেন্দ্রীয় ও লোকাল বডি নির্বাচনের বিপরীত চিত্র তার প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় বাহিনির কার্যকর উপস্থিতি। এই সাধারণ সত্যটিকে যারা অস্বীকার করবেন তাঁরা নিশ্চিতভাবে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে অবগত নন। এই অবস্থায় ভোটকর্মীদের কাছে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল অ্যাসিড টেস্ট।
এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণার আগে থেকেই কিন্তু নিরাপত্তার দাবিতে ভোটকর্মীদের সক্রিয়তা শুরু হয়। এর একটা বড় কারণ ডিএ সহ অন্যান্য পেশাগত দাবিতে সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ব্যানারে আন্দোলনরত অবস্থায় ছিল, বামপন্থী দলগুলোর প্রভাবিত সংগঠনগুলোর যৌথ মঞ্চও তাদের মতো করে কার্যক্রম নিয়েছিল। এর ফলে নির্বাচন ঘোষণা হওয়া মাত্র আইনি ও রাস্তার লড়াই শুরু হয়। আদালতের রায়ও ভোটকর্মীদের পক্ষে ছিল, কিন্তু বাস্তব হল ভোটকর্মীদের লড়াই কিন্তু ভোটের বাজারে কাজে এল না। এটা কেন হল না তা সমস্ত ভোটকর্মীদের ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করা দরকার। প্রকৃত অর্থে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও নির্বাচন কমিশন ভোট করানোর যে নীল নকশা প্রস্তুত করেছিল, ভোটটা সেভাবেই হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু রাজ্য সরকারই নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা সমানভাবে দায়ী। প্রথমে আদালত কখনওই বলেনি যে সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েন করতে হবে। এই রায় এসেছে নির্বাচনের ঠিক দুদিন আগে। এই রায় নিয়ে উল্লসিত হওয়া যেতে পারে কিন্তু সেদিনই পরিষ্কার হয়ে গেছিল সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনি থাকবে না। আর প্রতি বুথে একজন রাজ্য পুলিশ ও একজন কেন্দ্রীয় বাহিনির জওয়ানের টোটকা নেহাৎই অর্বাচীন প্রস্তাব। কারণ হাফ কোম্পানির কমে সশস্ত্র বাহিনি মোতায়েন বাহিনির স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকলের বাইরে। এখানে একমাত্র কার্যকরী প্রস্তাব ছিল নির্বাচনের দিন বৃদ্ধি করে বাহিনি মোতায়েন করা যা কিন্তু আদালত পত্রপাঠ নাকচ করে দেয়। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনি না দিলে ভোটকর্মীরা ভোট করতে যাবে না— এই আহ্বান চটকদার হলেও তা রাজ্যজুড়ে কার্যকরী করার মতো কোনও অবস্থা ছিল না। তাই ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোটকর্মী একান্ত বাধ্য হয়ে একজন রাজ্য সরকারের সশস্ত্র পুলিশের ভরসায় ভোট করতে যান। পরে আমার হিসাবে দশ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনি পৌঁছায়। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে ভোটের অনিয়মের যে সমস্ত ছবি আমরা দেখছি তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি। তাই আদালত ও রাস্তার লড়াইতে সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আমরা নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের কাছে দশ গোল খেলাম তা আমাদের পর্যালোচনা করতেই হবে।
ভোটকর্মীদের গল্পটা শুরু হয় নির্বাচন শুরু হওয়ার আগের থেকেই। একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে নব্বই শতাংশ ভোটকর্মী (এই নিবন্ধকারও তাঁদের মধ্যে একজন) স্বেচ্ছায় ভোটের ডিউটি করেন না, ডিউটিতে যান চাকরি বাঁচাতে। তাই ভোটের দিন ঘোষণার আগে থেকে অনেকে চেষ্টা করেন ভোটের ডিউটি থেকে নাম কাটাতে। জেলাশাসকের দপ্তরের ‘ইলেকশন সেলে’ যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা চলে জোরকদমে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। তবে যে সমস্ত শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী বা ভোটের দিন দলীয় এজেন্ট হিসাবে কাজ করার জন্য নথিবদ্ধ, তাদের ডিউটি আসে না। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটি ব্লকে জনা কুড়ি শিক্ষক নির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশ করেছিলেন ভোটের ডিউটির হাত থেকে বাঁচতে। আরেকটা প্রচলিত বিষয় হল ছদ্ম-অসুস্থতার ভান করে ডিউটি থেকে অব্যাহতি নেওয়া। আমার এক সতীর্থ যিনি বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, তাঁর এ বিষয়ে দক্ষতা ছিল সুবিদিত। তবে ইদানীং সরকারি হাসপাতালে ভর্তি না হলে রেহাই মিলবে না— এই নিয়ম চালু হওয়ার ফলে রোগীর ভান করার সুযোগ অনেকটাই কমেছে।
ভোটকর্মীদের নির্বাচনী উত্তেজনা শুরু হয় ট্রেনিং পর্ব থেকে, বিশেষ করে জানার আগ্রহ থাকে কোনও নতুন নিয়ম সংযোজিত হল কি না। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে দু-একজন এমন শিক্ষক থাকেন যাঁরা ভোটের নিয়মকানুন অন্যদের চেয়ে ভাল বোঝেন, এই কটা দিন তাঁরা আমাদের কাছে রীতিমতো স্টারের মর্যাদা পান। তবে ইদানীং লক্ষ্মণের বড়দার দৌলতে একের পর এক ভোট পরিচালনার ভিডিও ভোটকর্মীদের কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
ভোটকর্মীদের লড়াই শুরু হয় ডিসিআরসি (ভোটের সামগ্রী, ব্যালট বাক্স ও ব্যালট নেওয়া ও জমা দেওয়ার কেন্দ্র) থেকে। এবার কাউন্টারে যাওয়া মাত্র দেখলাম সামনের মানুষটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন, মুখে রাজ্যজয়ের আনন্দ। প্রশ্ন করাতে জানতে পারলাম তাঁর বুথে শুধু জেলা পরিষদের নির্বাচন, গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি বিরোধীশূন্য। এককথায় কাজটা অনেক কম, প্রাজ্ঞ শিক্ষক এটাও জানালেন বিরোধী নেই তাই ঝামেলাও নেই। বোকা বাক্সের ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা গণতন্ত্রের এহেন ন্যারেটিভ শুনে কী বলবেন জানা নেই, তবে এটাই গ্রাউন্ডজিরোর বাস্তবতা। মালপত্র মিলিয়ে নেওয়ার পর এবার যাওয়া হল হেল্প ডেস্কে। আদালতের নির্দেশের উল্লেখ করে সেন্ট্রাল ফোর্স পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞেস করাতে মিটিমিটি হাসি ও হেঁয়ালিভরা উত্তরে ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দু-একজনকে নিয়ে একটু হাল্লাগুল্লা করার চেষ্টাও মাঠে মারা গেল, একজন আধিকারিক সান্ত্বনা দিলেন যে হতাশ হবেন না, রাতে ফোর্স এলে পাঠানো হবে। এরপর পুলিশ ট্যাগিং করতে যাওয়া। এই ক্ষেত্রে একটা কমিক রিলিফের ব্যাপার আছে। প্রিসাইডিং অফিসারের লক্ষ্য স্থির, যেন তাঁর বুথের পুলিশটি পদের হয়। এবার বহু বুথে মহিলা পুলিশকর্মী দেওয়া হয়েছে যাঁরা দিন দশেক আগে ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন, কোনওরকমে একটা ট্রেনিং শেষ করে গণতন্ত্রের কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত।
ভোট সাতটার সময় শুরু হলেও প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় সকাল ছটা থেকে। তবে ভোটকর্মীদের দক্ষতা কতটা তার প্রমাণ হয় আগের রাতে সে কতটা কাগজকলমের কাজ সেরে রাখতে পারবে তার উপর। ওয়াকিবহাল মাত্রই জানেন নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গুচ্ছের কাগজ ও ফর্ম নেহাৎই অকার্যকর, তবুও মহান গণতন্ত্রের পবিত্রতা বজায় রাখতে তা পূরণ করতে হয়। একটা টিমে চার থেকে পাঁচজন ভোটকর্মী থাকেন যাঁরা কয়েক ঘন্টা আগেও ছিলেন নেহাৎই অপরিচিত, পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করে একটা টিম হয়ে কাজ করতে। আর এই ভোটপ্রক্রিয়ায় কোনও বিরতি থাকে না। তাই ওই কর্মব্যস্ততার মধ্যেও এক এক করে খাওয়ার সময় বের করে নিতে হয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ক্ষমতার ভাণ্ডটা যেহেতু স্থানীয় স্তরে, প্রার্থীরা গ্রামের কারও দাদা, ভাই, বৌদি বা কাকিমা, তাই ভোট দেওয়ার উৎসাহ অনেক বেশি, যেমন বেশি গায়ের জোরে ভোটে জেতার উদগ্র বাসনা। গণনাকক্ষে ব্যালট খেয়ে নেওয়া বা ব্যালটে কালি ঢেলে দেওয়া বা ব্যালট বাক্স পুকুরের জলে ঢেলে দেওয়া সেই বাসনারই ব্যবহারিক প্রয়োগ। এই অবস্থায় একজন সশস্ত্র রাজ্য পুলিশ ও নামসাক্ষী সিভিক দিয়ে ভোট করানোর পরিণতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে। নেভিল কার্ডাস ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডকে গাধা বলেছিলেন, ভোটের সময় গাধা হল প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি। কারণ তাতে দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে বুথ সন্ত্রাসের কোনও প্রমাণ লিপিবদ্ধ থাকে না। আর প্রমাণ লিপিবদ্ধ করার জ্বালাও কম নয়। কারণ এসব লিখলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ বাড়বে, রিলিজ জুটবে না। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেসমস্ত বুথে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে তার এক ও একমাত্র কারণ বিরোধী দলের এজেন্টদের মাটি কামড়ানো উপস্থিতি ও ভোটদাতাদের সচেতনতা।
নিরপেক্ষ ও নিয়মানুগভাবে ভোট পরিচালনা ভোটকর্মীর দায়িত্ব। কিন্তু কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছে উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তা না পেলে কাজটা কীভাবে করা সম্ভব! কতজন এই তথ্যটা জানেন যে এবার সমস্ত ভোটকর্মীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য (নাম, স্কুল/প্রতিষ্ঠানের নাম, ব্লক, মোবাইল নাম্বার) কমিশনের সৌজন্যে ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকেই সোশাল মিডিয়ায় উপলব্ধ ছিল। আর সেই তথ্য দেখে আগে থেকেই ভোটকর্মীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার কাজ ছিল নেহাৎই জলভাত। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে ভোটকর্মীরা নিরাপত্তার দাবি তুলতেই পারেন কিন্তু কেন তাঁরা নির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয় বাহিনির দাবি করছেন! ভাবের ঘরে চুরি না করে তাঁরা যদি নিজেদের প্রশ্ন করেন যে আর কোনভাবে এ রাজ্যে ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব, তাহলে তাঁরা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আশা করি এবারের ভোটপর্ব (কাউন্টিং সহ) নিরাপত্তার প্রশ্নে ভোটকর্মীদের দাবিসমূহের ন্যায্যতাকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করবে। শুধুমাত্র শারীরিক নিগ্রহ নয়, প্রায় ৩৬ ঘন্টা ধরে একজন ভোটকর্মীকে যে মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাও হিসেবের মধ্যে আসা উচিত।
ভোটগণনা পর্বে ব্যালট খেয়ে ফেলা নেহাৎই ছোটখাটো বিষয় মনে হবে যদি আমরা কাউন্টিং পর্বের অন্যান্য সন্ত্রাসগুলোকে মাথায় রাখি। যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা দখলের জন্য কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় তার আদর্শ উদাহরণ হল এই মুহূর্তের ভাঙরের ঘটনা। ভাঙরে যা হচ্ছে তা শুধু খুন নয়, গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে নরমেধ যজ্ঞের এক সুপরিকল্পিত অনুশীলন। এই অবস্থায় ভোটকর্মীদের কাছে শুধু নির্বাচনের দিন নয়, গণনার দিনও এখন থেকে আতঙ্কের দিন বলে প্রতিভাত হবে।
যাই হোক, সন্ধ্যা সাতটায় ভোট শেষ হল, কাগজকলমের কাজ শেষ হতে আরও এক ঘন্টা। কিন্তু দশটার আগে ডিসিআরসিতে পৌঁছাতে পারলাম না। কারণ আরেকটা টিমের (বরাদ্দ মিনিবাস একটা) কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছে। জমা দেওয়ার পর্বে খুব একটা জটিলতা হল না, আমাদের সবার চোখেমুখে এক স্বস্তির ছাপ। এই রক্তস্নাত উপত্যকায়, গণতন্ত্রের রক্তখেকো নরকযাত্রা এবারের মতো হয়তো শেষ হল। এবার বাড়িতে ফোন, ফেরার বাস ধরার তাড়া। সংসদীয় গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক, রাজনীতির কারবারিরা করে-কর্মে খাক।
*মতামত ব্যক্তিগত