উন্মেষ মিত্র
ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে বনভূমির আয়তন সরকারি হিসাবে দেশের মোট আয়তনের ২৪.৬২ শতাংশ। একটি দেশে ন্যূনতম বনভূমি থাকার প্রয়োজন দেশের আয়তনের এক তৃতীয়াংশ। গত ২০ বছরে দেশের বনভূমির পরিমাণ ‘বেড়েছে’ ৩৮,২৫১ বর্গ কিলোমিটার। তবে তা আসলে ‘Open Forest’, ‘Dense Forest’-এর আয়তন ক্রমসঙ্কুচিত হয়েছে। বন (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০-র এই সংশোধনী দেশের পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণ বাঁচানোর এত বছরের লড়াইয়ে জল ঢেলে দেবে। মৃত্যুঘন্টা বাজছে, আমরা শুনতে পাচ্ছি না
ইদানীং ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ খুব ঘুরছে। যার বয়ানটা হল, “আজ মানুষ অনুভব করছে খুব গরম, কিন্তু কতদিন তারা এসির সাহায্য নেবে, আজ ভারতে ৫০০ কোটি গাছের প্রয়োজন।… অবশ্যই দুটি গাছ লাগাবেন, সরকারের উপর সব ছেড়ে দেবেন না।” এই মেসেজের আহ্বান মেনে মানুষজন ৫০ জনকে সেই মেসেজ শেয়ার করে বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। সত্যিই তো! সব কিছু “সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া” বড়ই অন্যায় কাজ। সরকার বাহাদুর বড়ই ব্যস্ত। গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়ে মানুষ যখন গলদঘর্ম হয়ে জানালা দিয়ে এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণবর্ণ মেঘের আশায় অপেক্ষা করছেন, সরকার বাহাদুর তখন বড্ড ব্যস্ত বন (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০-কে সংশোধন করার কাজে।
ইংরেজি শব্দ Amendment এর বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘সংশোধন’, অর্থাৎ, “ভুল, দোষ ইত্যাদি দূর করে শুদ্ধ করার ক্রিয়া।“ সেইরকমভাবেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করেছে দেশের বন (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০-র ত্রুটিগুলিকে দূর করা প্রয়োজন। এটি প্রথমবার নয়, ইতিপূর্বে আরও অনেকবার এই আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে, তবে পূর্বের সকল সংশোধনীর সঙ্গে এই সংশোধনীর মূলগত পার্থক্যটি হল, পূর্বে এই আইনের মাধ্যমে দেশের আরও বেশি সংখ্যক বনভূমিকে সুরক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আর এইবারের সংশোধনী অনুসারে দেশের বৃহৎ অংশের বনভূমিকে আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়ার আইনি বন্দোবস্ত করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন নিন্দুকেরা।
নিন্দুকদের প্রথম অভিযোগ
১৯৯৬ সালের টিএন গোদাভারাম থিরুমুল্কপাদ বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ একটি ঐতিহাসিক রায় দান করে। এই মামলা বদলে দেয় ‘বন’-এর আইনি সংজ্ঞা। এর আগে আইনি ভাষায় ‘বন’ বলতে বোঝানো হত সরকারি মালিকাধীন জমিতে অবস্থিত বনভূমিকে। ব্যাক্তিগত বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন বনভূমিতে বিনা অনুমতিতে কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতিতে অবাধে বৃক্ষছেদন করা যেত। কিন্তু, এই ঐতিহাসিক রায় নির্দেশ দেয়, ‘বন’-এর সংজ্ঞা ‘মালিকানার’ উপর নির্ভর করবে না। যে কোনও ধরনের মালিকানাধীন বনভূমি, বন (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০-এর অন্তর্ভুক্ত, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া সেখানে বনভূমি ধ্বংস করা যাবে না। আরও সহজভাবে বোঝাতে গেলে, বর্তমানে দেশের মানচিত্রের মাত্র ৫.২৮ শতাংশ অঞ্চল সংরক্ষিত বনভূমি, আর সমগ্র দেশে বনাঞ্চল রয়েছে ২৪.৬২ শতাংশ এলাকায়। অর্থাৎ পাটিগণিতের সহজ হিসাবে দেশের ১৯.৩৪ শতাংশ বনভূমি রয়েছে অসংরক্ষিত অঞ্চলে। ১৯৯৬ সালের উক্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের আগে এই ১৯.৩৪ শতাংশ বনভূমি বিনা অনুমতি বা সামান্য অনুমতিতে ছেদন করা যেতে পারত, বর্তমানে কোনও বনভূমিই অনুমতি ছাড়া ধ্বংস করা যায় না। তবে, নিন্দুকেরা দাবি করেছেন বন আইনের এই সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়কে অথর্ব করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
নিন্দুকদের দ্বিতীয় অভিযোগ
এই সংশোধনী অনুসারে, আন্তর্জাতিক সীমান্তে বা লাইন অব কন্ট্রোলের পার্শ্ববর্তী ১০০ কিলোমিটার এলাকায় বনভূমি ছেদন করে বিনা অনুমতিতেই রাস্তা তৈরি বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ ইত্যাদি কাজ করা যাবে। সরকার বাহাদুর এক্ষেত্রে জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নকে হাতিয়ার করলেও নিন্দুকেরা জোশিমঠের উদাহরণ টেনে এনেছেন। সেখানেও এই একই যুক্তি হাতিয়ার করে সরকার বাহাদুর রাস্তা এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল, তারপরের ঘটনাক্রম আমাদের সকলের জানা।
নিন্দুকদের তৃতীয় অভিযোগ
বৈচিত্র্যের দেশ ভারতবর্ষে বন (Forest) বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কর্নাটকের কোডাগু জেলায় ১,৪৩৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সরকারি নথিতে বন (Forest) হিসাবে স্বীকৃত, কিন্তু জেলার বাকি বনাঞ্চল সরকারি নথিতে ‘বানে’, ‘পাইসারি’, ‘দেভারকাডু’, ‘উরুডভে’, ‘উরুগুপ্পে’ নামে উল্লিখিত আছে। একইরকমভাবে পশ্চিম রাজস্থানের বনভূমি সরকারি নথিতে ‘ওরান’ নামে লিপিবদ্ধ আছে। নতুন সংশোধনী অনুসারে এই অঞ্চলগুলি বন (Forest) বলে স্বীকৃতি পাবে না। অথচ এই বনভূমি অতি সঙ্কটগ্রস্ত পাখি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড’ বা বিলুপ্তির কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘ভারতীয় নেকড়ে’দের শেষ আবাসস্থল।
নিন্দুকদের চতুর্থ অভিযোগ
ন্যাশনাল বোর্ড অব ওয়াইল্ডলাইফের প্রাক্তন সদস্যা প্রেরণা সিং বিন্দ্রা এবং ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের আধিকারিক প্রকৃতি শ্রীবাস্তব মন্তব্য করেছেন, এই সংশোধনী আইন আসলে ‘Sustainable Development’ বা ‘Carbon Neutrality’-র মতো ভারী ভারী শব্দকে আগে রেখে ভারতের বনভূমিকে ‘বেসরকারিকরণ’ করার প্রথম ধাপ। ‘সবুজ বাঁচানোর আহ্বান’ বলে প্রচার করা এই সংশোধনী আইন আদতে শিল্পপতিদের ‘রিসর্ট’, ‘বেসরকারি চিড়িয়াখানা’, ‘বিনোদন পার্ক’ তৈরির পথকেই সুগম করবে।
নিন্দুকদের পঞ্চম অভিযোগ
দেশের অমৃতকালে ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানের’ পবিত্র মন্ত্রে এগিয়ে চলা ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর সরকার জানিয়েছে এলাহবাদ বা মুঘল গার্ডেনের মতোই আলোচ্য আইনের নাম Forest (Conservation) Act থেকে পরিবর্তন করে Van (Sanrakshan Evam Samvardhan) Adhiniyam করা হবে। এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে নিন্দুকেরা একে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের নতুন নখ-দাঁত বলে অভিহিত করেছেন।
বর্তমান অবস্থা
লোকসভায় প্রস্তাবিত এই বিলের বিরুদ্ধে নিন্দুকদের অভিযোগ শোনার জন্য ৩১ সদস্যের যুগ্ম সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ রাজেন্দ্র আগরওয়ালের নেতৃত্বে এই কমিটিতে শাসক দলের সর্বমোট ১৮ জন সদস্য ছিলেন। এই কমিটির ছয়জন সদস্য সাংসদ এই বিলের নানান বিষয়ের উপর সন্দেহ এবং প্রতিবাদ জানালেও সংখ্যাধিক্য সদস্য কোনও সমস্যা খুঁজে পাননি। এই বিলের উপর প্রশ্ন এবং সংশোধনের দাবি জানানো বিভিন্ন পরিবেশ, বন্যজীব সংগঠনের আপত্তিকে নস্যাৎ করে যে রূপে এই বিল লোকসভায় প্রস্তাবিত হয়েছিল সেই রূপেই আসন্ন বর্ষাকালীন অধিবেশনে (যা আগামী ২০ জুলাই থেকে শুরু হবে) পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
সবশেষে
ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে বনভূমির আয়তন সরকারি হিসাবে দেশের মোট আয়তনের ২৪.৬২ শতাংশ। একটি দেশে ন্যূনতম বনভূমি থাকার প্রয়োজন দেশের আয়তনের এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৩৩.৩৩ শতাংশ। গত ২০ বছরে দেশের বনভূমির পরিমাণ ‘বেড়েছে’ ৩৮,২৫১ বর্গ কিলোমিটার। তবে নিন্দুকেরা নিন্দা করে বলেন যা বেড়েছে বলে দেখনো হয় তা আসলে ‘Open Forest’ (ক্যানোপি কভার ১০-৪০ শতাংশ) আর ‘Dense Forest’-এর আয়তন ক্রমসঙ্কুচিত হয়েছে। নিন্দুকেদের মতে বন (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০-র এই সংশোধনী দেশের পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণ বাঁচানোর এত বছরের লড়াইয়ে জল ঢেলে দেবে। নিন্দুকেরা বলছেন, মৃত্যুঘন্টা বাজছে, আমরা নাকি শুনতে পাচ্ছি না।
সে বাজুক গিয়ে। আসুন আমরা আবার গরমে ঘামতে ঘামতে “উফ! এই গরমে আর পারা যাচ্ছে না” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোয়াটসঅ্যাপে “একটি গাছ, একটি প্রাণ” ফটোওয়ালা মেসেজ ফরওয়ার্ড করে চিত্ত প্রসন্ন করি। সরকার বাহাদুর বড়ই ব্যস্ত, সরকারের উপর এত দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়।
*মতামত ব্যক্তিগত