Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি: এক ভিন্নতর দেওয়া-নেওয়ার ইঙ্গিত?

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


বিজেপি-র নেতাদের মুখে যা শুনবেন তাকে অবিশ্বাস করাই বর্তমানে ভারতীয় জনগণের প্রথম কাজ। ওরা দেশে এগারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু রেখে শুধুমাত্র মুসলিম পারসোনাল ল তুলে দিয়ে আপনাকে বোঝাতে চাইতে পারে, দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে ফেলছে

 

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (uniform civil code) এই ত্রিপদী স্লোগান আমি আমার বোধ-কিশোরকাল থেকে শুনে আসছি। আসলে যখন আমি যৌবনে পদার্পণ করেছিলাম। তার আগেও হয়তো কথাটা কানে এসেছে। তবে চিৎকার হিসাবে যতটা, অর্থযুক্ত শব্দ হিসাবে তার চাইতে অনেক কম। সক্রিয় এবং সার্বক্ষণিক বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে স্বভাবতই সেকালীন সিনিয়র এবং/অথবা নেতাদের কাছে এর অর্থ জানতে চেয়েছিলাম। তাঁরা প্রথমে ফৌজদারি আর দেওয়ানি বিধির পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন। তারপর বুঝিয়েছিলেন, কেন আমাদের দেশে ফৌজদারি বিধি সমস্ত নাগরিকদের জন্যই এক বা অভিন্ন এবং দেওয়ানি বিধি কেন বিভিন্ন ধর্ম ও জনজাতির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা। আরও বেশ কিছুকাল পরে, মোটামুটি ১৯৮০ সাল নাগাদ সংবিধানের ৩০গ ধারা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়। আমার স্মৃতিশক্তি এবং ধারণামতে, বিগত চার দশকে এই সংক্রান্ত বোধ ক্রমে ক্রমে সাবালকত্ব অর্জন করেছে বলেই আমার অনুমান। যদিও অনেক অনুমানের মতোই এটিও ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে পারে।

আমাকে যদি ২০১৪ সালের আগে প্রাক-মোদি জমানায় কেউ প্রশ্ন করতেন, আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতাম, ৩০গ ধারা সংবিধানের একটি ভয়ঙ্কর দুর্বলতা। একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার সভ্য রাষ্ট্রে এরকম একটি ধারা থাকতে পারে না, অন্তত থাকা উচিত নয়, যার সহায়তায় দেশের সমস্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের বিষয়টি লঙ্ঘিত হয়, দুই সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে অধিকারের বৈষম্য হয় এবং নারীর পক্ষে অবমাননাকর কিছু সামাজিক পারিবারিক ব্যবস্থা সংবিধানে মান্যতা পায়। অথবা, সংবিধানে এমন একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়, যার মাধ্যমে ফৌজদারি আইনের সরল চোখে আদালতে প্রমাণিত একটি অপরাধ দেওয়ানি বিধির ট্যারা চোখ দিয়ে দেখার ফলে ন্যায্যতা পেয়ে যায়। দ্রষ্টব্য— শাহ বানু মামলা ও তার চূড়ান্ত ফলাফল। প্রযত্নে রাজীব গান্ধির প্রধানমন্ত্রিত্ব।

বিজেপি-আপদ থেকে দেশ মুক্ত হয়ে গেলে আমি আবার সেই অবস্থান থেকেই আমার বক্তব্য উত্থাপন করব। কিন্তু এখন আমাকে একেবারে উল্টো কথা বলতে হচ্ছে। বলতে আমি বাধ্য। পরিস্থিতির চাপে।

কেননা, মোদি জমানায় প্রবেশ ও অসংখ্য ঘন কৃষ্ণ অভিজ্ঞতার স্রোতে আমি আর আগেকার সেই উত্তর দিতে পারছি না শুধু তাই নয়, বিজেপি-র উত্থাপিত প্রতিটি স্লোগান ও কর্মসূচিকে সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কীভাবে সেটাই একে একে বলি।

 

অনাগরিকদের আবার দেওয়ানি বিধি কী?

প্রথম কথা হচ্ছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাদের জন্য?

কেন, দেশের নাগরিকদের জন্য। এ-নিয়ে আবার প্রশ্ন করার কী আছে?

বোকা বোকা শোনালেও প্রশ্নটা তুলতে বাধ্য হচ্ছি এই কারণে যে যাদের জন্য এই সময়ে এরকম একটি অ-দে-বি প্রস্তাব নিয়ে আকাশবাতাস গুঞ্জরিত হচ্ছে বা গুঞ্জন তোলা হচ্ছে, সেই নাগরিক কারা? কোথায় তাদের পাচ্ছেন? নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি এবং অমিত শাহ মিলে এখন দেশের জনগণকে ভোটার বা ভোটদাতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে রাজি থাকলেও নাগরিক বলতে রাজি নন। তাঁদের রচিত এনআরসি ছাঁকনি পার হয়ে যারা টিকে থাকবে, তারাই হবে আগামীদিনে ভারতের নাগরিক। তার আগে অবধি আপনি কিংবা আমি বিজেপি-র চোখে নিছকই বোতাম-টিপক।

কী বলছেন? আপনার ভোটার আইকার্ড আছে? আপনি নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে ভোট দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন?

আপনার আধার কার্ড আছে এবং তাতে লিঙ্ক করে আরও অনেক কার্ড আপনি করাতে পেরেছেন? নানারকম নাগরিক সুবিধা পেয়ে চলেছেন?

আপনার স্কুল-কলেজের অ্যাডমিট কার্ড, মার্কশিট ইত্যাদি আছে?

আপনি বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করাতে পেরেছেন এবং দু-চারটে দেশে ঘুরেও এসেছেন?

হা হা হা হা…

ওসব যাই থাকুক, আপনি মোদির জমানায় শাহর ফতোয়ায় আপাতত নাগরিক নন। এনপিআর পাশ করে এনআরসি-তে প্রোমোশন পেলে তবেই আপনি নাগরিক হতে পারবেন। বিভিন্ন জনসভায় পথসভায় ভাজপা-র ছোট বড় ফুল হাফ বা কোয়ার্টার নেতাদের ভাষণ শুনুন। তাচ্ছিল্য করে নয়, মনোযোগ দিয়ে। শুনতে পাবেন, মোদি শাহ জমানায় বিজেপি-র সবচাইতে বড় অবদান নাকি দেশের মানুষকে তারা নাগরিক শংসাপত্র দিতে চাইছে। বিরোধী দলগুলি তাতে বাগড়া দিয়ে চলেছে বলে আপনারা সেই শংসাপত্র হাতে পাচ্ছেন না।

কী হাতে পাচ্ছেন না? নাগরিক শংসাপত্র। তার মানেটা কি বুঝলেন?

সেই শংসাপত্র না-পাওয়ার ফলে আপনার এবং অবশ্যই আমারও, এই মুহূর্তে স্ট্যাটাস কী? অনাগরিক।

এই কথাটা আমরা কেউই আগে জানতাম না যে ভাজপার হাত ধরে আমাদের ভারতের নাগরিক হতে হবে। আমরা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলেই ভেবে এবং জেনে এসেছি এতকাল। যা কিছু সরকারি সুযোগসুবিধা পেয়েছি তাকে নাগরিক-সুবিধা বলেই ভেবেছি। যা কিছু কাজকর্ম দায়িত্ব পালন করেছি, তাও নাগরিক কর্তব্য পালন বলেই জেনে এসেছি।

দামোদরের বানে সেই সব জানা-বোঝা কোথায় ভেসে গেছে। মোদি-শাহ কোম্পানির কাছে জানা গেল, সব জায়গায় কংগ্রেস আমাদের সঙ্গে নাগরিক সাজিয়ে প্রতারণা করেছে; নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব আমাদের ঠকিয়ে এসেছে সরকারপ্রদত্ত সুবিধাকে নাগরিক সুবিধা বলে ভাবিয়ে; আর মোদিকোম্পানির উদার বদান্যতায় আমরা অনাগরিক হয়েও ওসব পেয়েছি। বিজেপি-ই একমাত্র আমার আপনার মধ্যে দেশপ্রেমের জন্ম দিয়ে এইসব করিয়ে নিচ্ছে আর পাইয়ে দিচ্ছে। দেশপ্রেমিক আর নাগরিক এক নয়।

২০০৩ সালেই বাজপেয়ির সরকার দেশের সমস্ত মানুষকে তাদের সম্পূর্ণ গাঢ় অন্ধকারে রেখে অনাগরিক বানিয়ে নাগরিকতা-প্রার্থী স্ট্যাটাস দান করে গেছে। আপনারা এবং আমরা সে-সম্পর্কে ভুল জানতেন এবং জানতাম। কংগ্রেস সিপিএম টিএমসি আপ— কেউ আমাদের সেকথা জানায়নি। টিএমসি এমনকি পশ্চিমবাংলার ভোটার তালিকায় অজস্র ভুয়ো (বাংলাদেশি) ভোটার আছে বলে ব্যাপক শোরগোল তুলে ভাজপার প্রচারকেই মান্যতা দিয়েছিল। হয়তো এরা নিজেরাও ভাজপা-র প্যাঁচটা কোথায় সেই ব্যাপারটা বোঝেনি। ২০১৯ সালে সিএএ এবং এনআরসি-বিরোধী দেশজোড়া আন্দোলনের ফলে মোদি এবং শাহ গ্যাং তাদের প্রকল্পটা গুছিয়ে এখনও সেরে ফেলতে পারেনি। দুই কদম পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটা চালু আছে এবং সামান্য ঢিলেমি দিলেই আবার ওরা ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।

তা হলে যারা দেশের নাগরিকই নয়, তাদের জন্য আবার দেওয়ানি বিধি কী? তার আবার ভিন্ন-অভিন্নই বা কী? অতএব, আমার দাবি হচ্ছে, ভাজপা সরকার আগে স্বীকার করুক যে তারা দেশের বিদ্যমান সমস্ত নাগরিকদের নাগরিক বলে মেনে নিচ্ছে এবং নাগরিকত্ব প্রদানের নাটক বা প্রহসন বন্ধ করছে। তারপর আমরা অ-দে-বি সম্পর্কে কথা শুনতে এবং বলতে আগ্রহ দেখাতে পারি।

 

ল কমিশনের মিশন?

দু নম্বর কথা হল, অ-দে-বি-র প্রশ্নটা ঝপ করে ল কমিশনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগেকার দিন হলে আমরা এতেও খুশি হতে পারতাম। অতীতে ল কমিশন বহু বিষয়ে অত্যন্ত ভাল ভাল প্রস্তাব নিয়েছে এবং সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। যদিও অতীতের কোনও সরকারই সেই সমস্ত সুপারিশ গ্রহণ বা রূপায়ণে আগ্রহ দেখায়নি।

হাল আমলে ল কমিশন সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাও খুব খারাপ।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালাকানুনের ধারাবাহী সিডিশন আইন এবং ইউএপিএ-র অধীনে বিনা বিচারে সীমাহীন আটকের কালা আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবার পর কেন্দ্রীয় সরকার যখন বর্তমান ল কমিশনের কাছে বিষয়টা বিবেচনার জন্য পাঠায়, কমিশন সুপারিশ করেছে সেই সব অসভ্য দানবিক আইন বলবৎ রাখার পক্ষে। এরপর আমরা আর কোনওভাবেই ল কমিশনের বোধভাস্যির উপরে আস্থা রাখতে পারছি না। আমাদের সন্দেহ, অন্য অনেক স্বশাসিত সংস্থার মতোই ল কমিশনও এখন দামোদরের ব্রিজ হয়ে উঠেছে। তার কাছে সভ্যতার সপক্ষে কিছু পাওয়ার আশা করা দুরাশা মাত্র!

এটা নিছক আমাদের বিশ্লেষণ নয়। কঠোর তথ্য।

ল কমিশন দেশের (অনাগরিক) জনগণের কাছে অ-দে-বি সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ভারি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কীসের উপর আপনি মত জানাবেন? একটা স্লোগানের উপর? যেটা সঙ্ঘ পরিবার, জনসঙ্ঘ হয়ে বিজেপি দীর্ঘকাল ধরে ফাটা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেছে (পাঠকদের যে অংশ পুরনোদিনের ফাটা রেকর্ড দেখেননি এবং শোনেননি, তাঁরা পঞ্চাশোর্ধদের কাছে অনুগ্রহ করে জেনে নেবেন)! খসড়া কিছু বানিয়েছেন? কোনও সুপারিশের মুসাবিদা আছে?

কিছুই নেই।

অর্থাৎ, দেশের মানুষের এক বড় অংশ পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে অজ্ঞ তথা নিস্পৃহ থেকে অপেক্ষা করবেন, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি নিশ্চয় দেশের ভাল করার জন্য মুসলমানদের আর একটা বাঁশ দেবেনই। যাঁরা মতামত জানাবেন, তাঁরাও সঙ্ঘ পরিবারের একটা স্লোগানের উপরে মত জানাতে থাকবেন। স্লোগানটা এইভাবে দেশের বুকে মান্যতা পেতে থাকবে। দিল্লি থেকে শাসক দল প্রতিদিন সতেরোবার করে এক দেশ এক আইন বলে যাবে, এবং বিভিন্ন শ্রীচরণেষু গণমাধ্যম প্রতি ঘন্টায় তার প্রতিধ্বনি করতে থাকবে, আর তাতেই তাঁরা পর্যাপ্ত খুশি হয়ে যাবেন। যেমন কাশ্মির ভাঙার বেলায় হয়েছিল।

দেশের অন্তত এগারোটা রাজ্যে এক দেশ ভিন্ন আইন থাকা সত্ত্বেও শুধু কাশ্মিরকে দেখিয়ে মুসলিমবিদ্বেষী জনতাংশকে এটা বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছিল যে মোদি-শাহ জুটি এক দেশ এক আইন কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর! প্রসিদ্ধ ওলন্দাজ দার্শনিক স্পিনোজার মতে অজ্ঞতা কোনও যুক্তি নয়, কিন্তু লেভ তলস্তয়ের মতো তিনি তো আর জানতেন না, জনগণের অজ্ঞতা এক বড় শক্তি তো বটেই। অন্তত বিজেপি-র মতো শাসক দলের কাছে।

 

ঘুঘু যখন ফাঁদে পড়ে

তবে চারদিকের অনেক খারাপ লক্ষণের মধ্যেও কিছু শুভ্ররেখা দেখা যাচ্ছে।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জনজাতির প্রতিনিধিরা আপত্তি জানাতে শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয় সর্ন সমিতির এক নেতা সন্তোষ তিরকে বলেছেন, “It (UCC) would infringe upon our customary laws of marriage, divorce, inheritance and transfer of land…” ঝাড়খণ্ডের আর একজন আদিবাসী নেতা রতন তিরকে জানিয়েছেন, “We will not only register our protest by sending emails to the Law Commission but also stage a protest on the ground. Meetings are being planned to chalk out our strategies. The UCC will dilute the provisions of Fifth and Sixth Schedule of the Constitution…”

সংবাদপত্রে বেরিয়েছে যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিজেপি সহ তাদের অন্যান্য সহযোগী দলের নেতারাও ঘোষণা করেছেন, তাঁরা অ-দে-বি-র বিরোধিতা করে যাবেন। আইন বিষয়ক কেন্দ্রীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপি নেতা সুশীল মোদিও এ-নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, জনগণের সমস্ত অংশে, বিশেষ করে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজাতিদের ক্ষেত্রে অ-দে-বি কার্যকর করা যাবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে।

তথাপি আমাদের আশঙ্কা, জোড়াতালি ও সমঝোতা করে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে আইনভেদ বজায় রেখে শুধুমাত্র সংবিধানের ৩০গ ধারা বিলোপ করে অথবা একটা অতিরিক্ত ধারা যোগ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এক দেশ এক আইন কার্যকর করা হবে। মণিপুরে নাগাল্যান্ডে গোয়ায় বা উত্তরাখণ্ডে কী বহাল রইল না জেনেই দেশের সেই বৃহত্তর অংশ তাতে খুশি হয়ে যাবে।

অন্তত বিজেপি-র এখনও সেটাই পাটিগণিত। এর ভিত্তিতেই সে এগোচ্ছে। ২০২৪-এর ভোটে ফাটা নৌকা পার করাতে হলে পুলওয়ামা-২ ঘটানো আর সম্ভব নয়। পুলওয়ামা-১ নিয়ে নিজের দলেরই এক নেতা, একজন প্রাক্তন রাজ্যপাল, বিশ্বাসভঙ্গ করে যেভাবে পর্দা ফাঁসের মাধ্যমে আসর গরম করতে শুরু করে দিয়েছেন, তাতে আর একবার ৪০-৫০টা হিন্দু জওয়ানের লাশের বিনিময়ে হিন্দু তাস হাতে ভোটে নামা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সেবার খেলেও এবারে আর সহজে লোকজন সেটা পাকিস্তানের নামে খাবে এমন ভরসা কম। দেশের বাইরে কিছু একটা পাকানো যায় কিনা তার চেষ্টাও চলতে থাকবে। আবার এই অ-দে-বি নিয়েও একটা উত্তেজনা ছড়ানো যায় কিনা দেখা দরকার। রাম মন্দির নিয়ে মুসলিমদের উত্তেজিত করা যায়নি; কর্নাটকে হিজাব বিরোধিতা করে কাজ হল না; তিন তালাক প্রথাকে তালাক দেওয়ার নাম করেও তাদের খেপিয়ে তোলা গেল না। এখন এই পার্সোনাল ল-কে আক্রমণ করে যদি কিছু করা যায়!

আমি খুব আনন্দের সাথে লক্ষ করেছি, মুসলিমরা অধিকাংশই এই টোপটা ধরে ফেলেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরা ৩০গ বিলোপ বা অ-দে-বি চালু করার চালাকিও ধরে ফেলবেন।

অন্যদিকে যাদেরকে মুসলিমবিদ্বেষের হাডুডু-তে নামিয়ে এবং ভাসিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে, তাঁরাও দেরিতে হলেও ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছেন, বিজেপি থাকলে হিন্দুদের তথা অমুসলিম সমস্ত জনগণের বিপদও ভয়ঙ্কর মাত্রায় বাড়বে। অসমের চোদ্দ লক্ষ বাঙালি হিন্দু তার মূল্য দিচ্ছে, দিল্লিতে অলিম্পিকে খেতাব আনা কুস্তিগিররা এবং তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানো খেলোয়াড়রা তার প্রমাণ পাচ্ছেন। বিজেপি-র হাতে বিপন্ন হতে আপনাকে মুসলমান বা দলিত হতে হবে না। এমনকি হিন্দু মহিলা হওয়ারও দরকার নেই। বিজেপি মানেই সে একটা আদ্যন্ত জনবিরোধী চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল কর্পোরেট দালাল শক্তি।

এরা সেকুলার রাজনীতির প্রয়োজনে সমস্ত মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে অ-দে-বি-র কথা তুলছে না। তুলছে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর আর একটা নতুনতর আয়োজন করার জন্য। যাতে ওরা ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে একে ব্যবহার করে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে। ১৯৫৪-৫৫ সালে যখন সংসদে হিন্দু কোড বিল উত্থাপিত হয় হিন্দু বিবাহ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রগুলিতে পুরনো মনুস্মৃতি ও তার ভাষ্য মিতাক্ষরা বা দায়ভাগের বস্তাপচা সামন্তযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক বিধি থেকে হিন্দু জনসাধারণকে বের করে আনার লক্ষ্যে, সেই সময় আরএসএস এবং জনসঙ্ঘ তথা শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকার কথা বয়স্ক লোকজন এখনও ভুলে যাননি। সেই সেকুলার বিলের সমর্থনে আয়োজিত বহু জনসভায় গিয়ে ওদের লোকজন গোলমাল পাকাত, সভা পণ্ড করে দিতে চেষ্টা করত, ইত্যাদি। এবং এখন আবার সঙ্ঘ পরিবারের প্রতিনিধিদের মুখে মাঝে মাঝেই মনুস্মৃতির শাসন ফিরিয়ে আনার গুজগুজ ফুসফুস শোনা যায়। সুতরাং ওদের বর্তমান অ-দে-বি-র লক্ষ্যও সেকুলার রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি নয়, বিশুদ্ধ আগমার্কা মুসলিমবিদ্বেষ। আর মনে মনে “হিন্দুরাষ্ট্র সংস্থাপনের ছক”।

তাই বিজেপি-র নেতাদের মুখে যা শুনবেন তাকে অবিশ্বাস করাই বর্তমানে ভারতীয় জনগণের প্রথম কাজ। ওরা দেশে এগারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু রেখে শুধুমাত্র মুসলিম পারসোনাল ল তুলে দিয়ে আপনাকে বোঝাতে চাইতে পারে, দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে ফেলছে।

আসুন, আমরা জোর গলায় জানিয়ে দিই, এই অ-দে-বি ধোঁকাটা আমরা নিলাম না!


*মতামত ব্যক্তিগত