Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাটশিল্প: মালিকের অতি মুনাফা আর শ্রমিকের বেঁচে থাকার অঙ্ক

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

 


এ-বছরে মিলশ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি এবং মে— দুই মাসেই দৈনিক মজুরিতে কোপ পড়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় মাস গেলে তিন থেকে চারশো টাকা প্রতিজন শ্রমিক কম পাচ্ছেন। ফলত তাঁদের এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে খেয়েপরে বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ মিলের শ্রমিকেরা “ফ্যাক্টরি আইন” অনুযায়ী এসটিএল–টুকুও পাননি সঠিকভাবে, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা পিএফ-গ্রাচ্যুইটি থেকেও বঞ্চিত

 

ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে বহুদিনের জমা নোংরা আবর্জনা স্তূপ। পাশের ড্রেন দিয়ে নোংরা কালো জল উপচে উঠছে মিল-মহল্লার দু-পাশের রাস্তা জুড়ে। দুর্গন্ধে জীবন হাঁসফাস মিলের শ্রমিকদের। এখানেই তাঁদের বসবাস। পৌরসভা থেকে লেবার অফিস বহু দৌড়াদৌড়ি করেও এসবের কোনও সদগতি হয়নি। কেবল কয়েক দফা ছবি তোলাতুলি হয়েছে। তারপরে আবার বৃষ্টির মরশুম চলে এসেছে— রাস্তার সমস্ত নোংরা জল ড্রেনের পচা কালো জলের সঙ্গে মিশে গিয়ে উঠবে শ্রমিকের ঘরের দুয়ারে। এমনিতে বহু শ্রমিকের ঘরগুলির টালির চালে বড় বড় ফুটো, সবাই সেগুলি মেরামত করতে ব্যস্ত। নইলে বর্ষায় ঘর ভেসে যেতে পারে! খুব আনন্দ সহকারে বলতে হয়— হিন্দু-মুসলমানেরও এতে কোনও বিভাজনমূলক নীতি নেই, এক্ষেত্রে সবার সমান অবস্থা মিলের মহল্লার শ্রমিকদের।

এমনই অবস্থা জুটমিল শ্রমিকদের অধিকাংশ থাকবার জায়গাগুলোর। এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ঘরের বাচ্চাদের তাঁরা গ্রামে রেখে আসেন। একেই জুন-জুলাই মাস, বছর শেষের মাস পাটশিল্পে। অধিকাংশ শ্রমিকেরা এইসময় গ্রামে যান চাষাবাদের কাজে হাত লাগাতে, ফসল কাটতে। এই সময় আবার মিলের ভেতরে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মোচ্ছব চলে— কখনও পাট না থাকার অজুহাতে আবার কখনও ‘মালের অর্ডার‘ না থাকার কারণ দেখিয়ে। কাজের শিফট কমিয়ে দেওয়া হয়। এই ছাঁটাইয়ের পরে ফের যখন নতুন বছরে মিল চালু হয়— তখন মিলের ভেতরে উপচে ওঠে “ভাউচার”-শ্রমিকের ভিড়। কী এই ভাউচার-শ্রমিক? এঁরা হল কাজ করতে আসা সেই সমস্ত শ্রমিক— যাঁদের সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের শুধু উৎপাদন এবং দৈনিক ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা মজুরির সম্পর্ক থাকে। এঁরা কেবল কাজ করেন আর টাকা নেন, এঁদের উপর মিলের মালিক তথা ম্যানেজমেন্টের কোনও দায়-দায়িত্ব থাকে না, এঁরা পিএফ-গ্রাচ্যুইটি কিছুই পান না। এঁরা কাজের খোঁজে আসে শহরে, মূলত গ্রামের ফোড়েদের (যারা গ্রামে চাষিদের কাছ থেকে পাট নিয়ে আসে) হাত ধরে। তারপর শহরের দালাল-চক্রের হাত ধরে গিয়ে পৌঁছায় মিলের ম্যানেজমেন্টের দুয়ারে (‘কাজ পাইয়ে দেওয়ার’ এই চক্র পুরোপুরি শাসক দলের মদতপুষ্ট)। লোভী ম্যানেজমেন্ট এঁদেরকে বেশি পরিমাণে উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে বাড়তি মুনাফা লাভ করে, পারলে রক্ত চুষে ১০ থেকে ১২ ঘন্টাও খাটিয়ে নেয় অনায়াসে।

১৫ বছরের বেশি হতে গেল মিল-শ্রমিকদের কোনও মাহিনা-পত্তর বাড়েনি। উল্টে বেড়েছে শ্রমিকদের খাটুনি এবং দৈনিক মজুরির উপরে মিলমালিকদের কোপের পরিমাণ। মিলের ভেতরে ঢুকেছে “চাইনিজ মেশিন“ যা লোভী মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার স্বার্থবহন করতে কাজে লাগে। আগে যে মেশিন শ্রমিকেরা দুটো কি তিনটে করে চালাতেন এখন এই মেশিন প্রতিজন শ্রমিককে চারটে থেকে ছয়টা করে চালাতে হয়। প্রতিটা মেশিন গড়ে দুটি করে চটের কাপড় উৎপাদন করে। অর্থাৎ একেকজন শ্রমিক দিনে ১২টি করে বড় বড় চটের কাপড় উৎপাদন করে ফেলেন। উপরন্তু এই মেশিনে ‘মিটার সিস্টেম‘ যা একবার পড়ে গেলে পুরো উৎপাদন পড়ে যায়, আবার নতুন করে শ্রমিকদের উৎপাদন করতে হয়। এর ফলে শ্রমিকেরা বাথরুমেও যেতে পারেন না ভয়ের চটে। গেলে পরেই যদি মিটার পড়ে যায় তখন কী হবে! এই মিটার অনুযায়ী মালিকের দেওয়া বিধিমতন প্রতিজন শ্রমিককে সেইমতন উৎপাদন করতে হয়, নইলে সেদিনের টাকায় মালিকের লোলুপ দৃষ্টির কোপ বসবে। এসব নিয়ে আবার গাঁইগুঁই করলে মিলের ভেতরের বাউন্সারেরা আচ্ছা করে কিল-চড় ঠুসে দেয় শ্রমিকদের গালে পিঠে। আর একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করলে? মিল বন্ধ নয়তো দেদারসে ছাঁটাই কিংবা গেট বাহির তো রয়েইছে। বর্তমানে মিলের ভেতরে যে চারটি ক্যাটাগরিতে মিলশ্রমিকদের (সব অস্থায়ী) ভাগ রয়েছে সবার জন্যেই এই নিয়ম প্রযোজ্য।

এ-বছরে মিলশ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি এবং মে— দুই মাসেই দৈনিক মজুরিতে কোপ পড়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় মাস গেলে তিন থেকে চারশো টাকা প্রতিজন শ্রমিক কম পাচ্ছেন। ফলত তাঁদের এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে খেয়েপরে বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ মিলের শ্রমিকেরা “ফ্যাক্টরি আইন” অনুযায়ী এসটিএল–টুকুও পাননি সঠিকভাবে, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা পিএফ-গ্রাচ্যুইটি থেকেও বঞ্চিত। ২০০০ সালে মিলের শ্রমিকদের মাসিক বেতনে প্রথম কোপ মারে সিপিআই-এম সরকার। তারপর তৃণমূল সরকার এসে বেতন বাড়ানোর কথা বলে, কিন্তু তা শুধু প্রতিবার ভোট এলেই। তারপর ভোট মিটে গেলে বেতন বেতনের জায়গাতে আর সরকার সরকারের। আজ কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকার ১০০ শতাংশ প্লাস্টিকের বস্তার অনুমোদন দিয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছে। এমনকি ‘ইন্ডিয়ান জুট কর্পোরেশন’-এ প্লাস্টিক ও চটমিশ্রিত বস্তা উৎপাদনে সুপারিশ দেওয়া কেন্দ্রের চিঠি আরও ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত দিচ্ছে; আশঙ্কা করা হচ্ছে, এরফলে চটকলগুলিতে পাটের সুতো ছাড়ানোর সেক্টর বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত সেক্টর বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার ফলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ থাকবে না পাটশিল্পের শ্রমিকদের।

বস্তুত ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই পাটশিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ; সে-সময়ে ১৮৭৩ সালে সর্বপ্রথম গড়ে ওঠা পাটকল— হুগলির রিষড়ায় ‘ওয়েলিংটন জুটমিল’, প্রায় গত তিন বছর ধরে বন্ধ। ১৮৭০ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে বাংলায় স্থাপিত হয় ১০১টি পাটকল। ব্রিটিশরা সেসময়ে নিজ দেশে পাটের চাহিদা মেটাতে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রধানত এ-বাংলার উপরেই। সে সময় ২,৮৬,৬৮১ জন শ্রমিক নিযুক্ত হন এই শিল্পে। যেহেতু উর্বর জমি, ভূ-প্রকৃতি, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পাট চাষ ভাল পরিমাণে হত এখানে, সেহেতু বাংলাই হয়ে দাঁড়াল ভারতের পাটশিল্পের প্রধান জায়গা। ১৯০৭ সাল থেকে প্লাস্টিকের গবেষণা শুরু হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৫০ সালে পেট্রোলিয়াম পদার্থের কমার্শিয়াল উৎপাদন শুরু হয় গোটা ইউরোপ জুড়ে। ফলত, তখন থেকেই শুরু হতে লাগে চট বনাম প্লাস্টিকের তীব্র লড়াই। যার ফলে, বাড়তে থাকে বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণির ফাটকা

ব্যবসা-বাণিজ্যে চটজলদি মুনাফা লাভের লোভও আরও বেশি পরিমাণে। ব্রিটিশরা স-শরীরে ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর তাদের পছন্দমতন যে যে বড় বড় পুঁজিপতি ও ভারতের রাজনৈতিক প্রশাসনিক সরকারের হাতে এখানকার মিলগুলির মালিকানা ‘লিজ’-এ সঁপে গেছিল, তাদের কাছে আজ এই মিলগুলি এবং মিল-লাগোয়া চত্বরের জমিপত্তরগুলো ফাটকা কিংবা কাঁচা মুনাফা অর্জনের উলঙ্গ মঞ্চ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর ইঙ্গ-মার্কিনিদের উন্নতমানের যন্ত্রপাতির দ্বারা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য উৎপাদন এবং তার ব্যবহার বাড়তে থাকায়, তৎকালীন ভারত সরকারও ধীরে ধীরে সেইদিকেই (প্লাস্টিক) ঝুঁকে পড়ল; পরিবেশ এবং শ্রমিক-কৃষকের জীবনমানের দামকে তুচ্ছ করে। সেই থেকেই ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্প মৃত্যুর পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। মাঝে কৃষক-শ্রমিকের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা সংগঠিত আন্দোলনের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে পাটশিল্পের দিকে নজর দিয়ে ৮০ দশকের শেষদিকে পাটশিল্পের শ্রমিক ও পাটচাষিদের স্বার্থে খাতায়কলমে বেশ কিছু আইন পাশ করালেও বাস্তবে তা সংসদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। তলায় তলায় প্লাস্টিক উৎপাদন বাড়তে থাকল ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণির হাত ধরে ইঙ্গ-মার্কিনদের দেখানো পথ বেয়ে! চিনি এবং খাদ্যশস্য পণ্যে ১০০ শতাংশ চটের বস্তা ও সিমেন্টে-সারের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ চটের বস্তার অনুমোদন পাশ করালেও পরবর্তীকালে ২০০৫ সালে কংগ্রেসের মনমোহন সরকার তা ৫০ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসে এবং ইঙ্গ-মার্কিন প্রস্তুত প্লাস্টিকজাত মোড়কেই জোর দিয়ে ভারতের পাটশিল্পকে ফের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়। এখন অবশ্য বিজেপি সরকার দেশের আধমরা হয়ে বেঁচে থাকা এই বৃহৎ শিল্পকে গলা টিপে পুরোপুরি মারতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমনটা চললে কিছুদিন পরে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের এই বৃহৎ শিল্প দেশের ‘গণতন্ত্রে’র মতনই জাদুঘরে ঠাই নিতে বাধ্য হবে।

এসব নিয়ে অবশ্য শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা কেউ কেউ কৌতুক করে বলেন— “মালিক ও সরকারের কাছে ওয়ার্কার মিনস জোকার”! আবার কেউ কেউ চাপা স্বরে বলে উঠেন— “পুঁজিপতি-মালিকশ্রেণির শোষণ শেষ কথা বলে না, ইতিহাস অন্য কথা বলছে।” যাক সেসব অন্য কথা। তবে পশ্চিমবঙ্গের এই পাটশিল্পের হাত ধরেই রাজ্য তথা দেশের বেকারত্ব সমস্যার সুরাহা করা যেত, রাজ্য থেকে বহু শ্রমিককে ভিন রাজ্যে কাজের জন্য পাড়ি দিতে হত না। আত্মহত্যাও করতে হত না কৃষককে। কিন্তু তার জন্য সরকারগুলিকে (কেন্দ্র-রাজ্য) বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশীয় মালিক তথা বিদেশি শক্তির কথায় কান ধরে উঠবস করা বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণির বিপক্ষে যেতে হত; যা দুর্ভাগ্যবশত ব্যক্তিস্বার্থে চলা সমাজব্যবস্থায় কোনও সরকারের পক্ষেই সম্ভব হল না।


*মতামত ব্যক্তিগত