Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিরোধী জোট ও বাংলার বিরোধী ভোট: জটিলতা ও সম্ভাবনা

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

 


খেলা ঘোরাতে গেলে বামপন্থীদের তৃণমূল-বিরোধী ভোট বিজেপির কবল থেকে বার করে আনতে হবে, আর তৃণমূলের পাশাপাশি তীব্রভাবে বিজেপির বিরোধিতা না-করলে, বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহ ভাঙতে না-পারলে, সেটা সম্ভব হবে না

 

পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, ১৬ই জুলাই সিপিআই(এম)-এর মুখপত্র গণশক্তিতে প্রকাশিত প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ীর একটি প্রবন্ধের শিরোনাম– “দম ধরে রাখতে হবে, খেলা ঘুরছে”। নির্বাচনে বিজেপির ক্ষয় ও বামেদের ভোটবৃদ্ধি প্রসঙ্গেই এই খেলা ঘোরার দাবি।

মূলত তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা-করা এই লেখার শেষে শমীকবাবু আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় পার্টির রাজনৈতিক লাইন কী হবে, তারও আভাস দিয়েছেন। তাঁর মতে, “২০২৩-এ স্বৈরাচারী-লুটেরাদের ভিত নড়ে গেছে, ২০২৪-এ হবে দুর্নীতির চূড়ামণি পিসি-ভাইপোর রক্ষাকর্তা বিজেপি-কে হটানোর লড়াই। তারপর ২০২৬-এ স্বৈরাচারী-লুটেরাদের অট্টালিকা ধূলিসাৎ করার লড়াই হবে। দম রাখতে হবে— একযুগের অন্ধকার কাটিয়ে নতুন সূর্যোদয়ের জন্য।”

এর ঠিক তিন দিন পর, ১৯ তারিখের গণশক্তির প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবর, বেঙ্গালুরুতে ২৬টি বিজেপি-বিরোধী দলের বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠনের সংবাদে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধি, মল্লিকার্জুন খড়গে, সিপিআইএমের সীতারাম ইয়েচুরি, আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রমুখের বক্তব্যের পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও রাখা হয়েছে: “তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘ইন্ডিয়া জিতবে, দেশ জিতবে’।”

তা হলে কি ‘তৃণমূলের রক্ষাকর্তা’ বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়েই হবে? তা কি সম্ভব?

এই প্রশ্নের একটা যুক্তিসম্মত উত্তর সিপিআইএমকে খুঁজে বের করতে হবে, এবং জনতার কাছে তা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে, কেন-না আগামী কয়েকমাস এই প্রশ্ন তাদের কাছে ঘুরেফিরে আসবে— শুধু বিজেপির থেকেই নয়— তাদের নিজেদের সমর্থকদের একাংশের থেকেও।

তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির আঁতাতের অভিযোগ রাজ্যের বাম নেতৃত্ব বহুদিন থেকেই করছেন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহুবার ডাকার পরেও কেন্দ্রীয় এজেন্সি কেন এখনও গ্রেফতার করল না, তা নিয়েও ‘সেটিং’-এর তত্ত্ব তাঁরা বেশ জোরালোভাবেই প্রচার করেন। ২০১৪-এ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিবাদী বাম নেতৃত্বের সাক্ষাৎ ঘিরে ছড়ানো ‘ফিশফ্রাই ডিপ্লোম্যাসি’-র তত্ত্ব যেমন বামেদের বিপদ ডেকেছিল, তৃণমূলের সঙ্গে সেটিং-এর তত্ত্বের সফল প্রচার তেমনই বিজেপির সমস্যার কারণ হতে পারে।

কিন্তু আবার বাম-তৃণমূল ‘সেটিং’-এর তত্ত্ব সামনে চলে এলে?

২০২১ নির্বাচনের পর থেকে রাজ্য বিজেপিকে একটু ঝিমিয়ে পড়তে দেখা গেছে, এবং রাস্তায় বামেদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বেড়েছে। বুথভিত্তিক সংগঠনে বিজেপির দুর্বলতা ছিলই, তৃণমূল-বিরোধী ভোটের বেশ কিছুটা বামেরা আবার বিজেপির থেকে ফেরত আনতে পারায় বিজেপির গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কে একটা ধাক্কা লেগেছে। ধস নেমেছে এ-কথা অবশ্য বলা যায় না। তারা এবারও ২৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আর সেটা পেয়েছে মোট পঞ্চায়েত আসনের ৬০.৮৫ শতাংশ, সমিতি আসনের ৭২.২৭ শতাংশ ও জেলা পরিষদ আসনের ৯৬.৬৫ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যেভাবে, বামেরা তাদের ১৩.২ শতাংশ ভোট পেয়েছে পঞ্চায়েতের ৫৬ শতাংশ, সমিতির ৬৯.৪ শতাংশ ও জেলা পরিষদের ৮০.৫ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যেখানে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না, সেখানে তাদের ভোট নেই বা থাকলেও নগণ্য, এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। তৃণমূল কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতে ৬৩,২২৯ আসনের মধ্যে ৬১,৫৫১ বা ৯৭.৫ শতাংশ আসনে, পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯,৭৩০ আসনের মধ্যে ৯,৪১৯ বা ৯৬.৮ শতাংশ আসনে আর জেলা পরিষদের ৯২৮-এর সবকটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা আসনের সংখ্যা ২০১৮-র তুলনায় অনেকটাই কমেছে। ২০১৯-এ পাওয়া শিক্ষার ফলে এবার শাসকদল বাড়াবাড়ি করার ক্ষেত্রে একটু সংযম দেখানোর চেষ্টা করেছে। তারপরও, পঞ্চায়েতের মোট আসনের ৭,৯৯২টি বা প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশের ফয়সালা হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যার মধ্যে ৭,৯২৭টি জিতেছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯,৭৩০ আসনের মধ্যে ৯৮০টি বা ১০ শতাংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল, ১২টি অন্যরা, যা মূলত দার্জিলিঙে। জেলা পরিষদে ১৬টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল, যার আটটি দক্ষিণ ও তিনটি উত্তর ২৪ পরগণায়। এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা আসনের ভোট লোকসভা নির্বাচনে কোনদিকে যাবে, বলা মুশকিল। ২০১৯-এর ভোটে কিন্তু ২০১৮-তে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা অনেক আসনেরই ফলাফল তৃণমূলের জন্য সুখকর হয়নি।

এই সমস্ত তথ্য ও প্রেক্ষিত বিচার করে এটা ধরে নেওয়াই যায় যে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের ভোট বাড়বে। যে পরিমাণ গা-জোয়ারি দেখা গিয়েছে শাসকদলের তরফে, নির্বাচনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জনতার একাংশের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তার ফলস্বরূপ তৃণমূলের ভোট শতাংশ ৫২ শতাংশের চেয়ে বেশ কিছুটা কম হবে এমনটাও ধরে নেওয়াই যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, গত বছর দেড়েকের দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহে, অন্তত শহরাঞ্চলে, তৃণমূলের প্রতি জনতার একাংশের মোহভঙ্গ হয়েছে। এঁদের কেউ কেউ ২০২১-এ তৃণমূলকেই ভোট দিয়েছিলেন। তৃণমূলের ভোট কমলে সেটা তা হলে কোন খাতায় যাবে?

খাতায়-কলমে, ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে পঞ্চায়েতের ১৫.৫ শতাংশ, সমিতির ১১ শতাংশ ও জেলা পরিষদের ৩১টি আসন জিতেছে বিজেপি। বামেরা সেখানে ১৩.২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫.২ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন ও ২ শতাংশ সমিতির আসন পেয়েছে। কংগ্রেস ৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে পঞ্চায়েতের ৪.২ শতাংশ ও সমিতির ৩ শতাংশ আসন জিতেছে। বিজেপি প্রায় গোটা রাজ্যেই ভোট পেয়েছে, কংগ্রেস মূলত মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুরে, আর বামেরা মুর্শিদাবাদের নিচের দিকে, অর্থাৎ মূলত দক্ষিণবঙ্গে। এই হিসেব সামনে রাখার কারণ, দেখাই যাচ্ছে, তৃণমূলের মূল বিরোধী হিসেবে বিজেপি এখনও বামেদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে। তদুপরি, কেন্দ্রে সরকারে থাকার কিছু সুবিধা তারা পাবে। এই অবস্থায়, বিজেপির কাছে হারানো ভোট ফেরাতে গেলে বামেদের নিজেদেরকে তৃণমূলের আরও বড় ও কঠিন বিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে হবে। স ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের সঙ্গে এক মঞ্চে থাকাটা তাদের পক্ষে খানিকটা অসুবিধেজনক পরিস্থিতির তৈরি করছে।

কিন্তু যদি জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিত দেখি, তা হলে যেখানে আপ-কংগ্রেসের মতো যুযুধান দুই পক্ষ ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ এক টেবলে এসে বসেছে, এবং যেখানে কেরলে বাম-কংগ্রেস লড়াই সত্ত্বেও জাতীয় রাজনীতিতে তারা পাশাপাশি থাকতে পেরেছে, সেখানে তৃণমূল জোটে থাকার অজুহাতে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা বামেদের পক্ষে বেঠিক হত। অন্যদিকে, জোটে সিপিএম থাকার অজুহাতে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা তৃণমূলের পক্ষেও, অন্তত প্রাথমিক স্তরে, সম্ভব নয়। দুই ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পার্টি বিজেপি-বিরোধী জোট ভাঙার অভিযোগে বিজেপি-বিরোধী ভোট হারাতে পারে।

তা হলে উপায়? রাজ্য কংগ্রেসের পরিস্থিতিও প্রায় বামেদের মতোই— তৃণমূল-বিরোধিতার স্বরের তীব্রতার ওপর তাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল; কিন্তু আবার খানিক আলাদাও— কারণ, জাতীয় স্তরে শেষ মুহূর্তে যে বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার নির্দেশ আসবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বাংলার কংগ্রেস নেতারা বামেদের সঙ্গেই জোট করতে চান, কিন্তু তাঁদের চাওয়াটাই সবসময় চূড়ান্ত নয়। অপরদিকে, তৃণমূলের সঙ্গে কোনওরকম নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা বামেদের নেই। তাদেরকে তাই সব সম্ভাবনা খোলা রেখেই এগোতে হবে। ঘটনাচক্রে, যদিও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ, কং-তৃণমূল আসন সমঝোতা হয়ে গেলে বামেদের ক্ষতি, কারণ একক ক্ষমতায় কোনও লোকসভা আসন জেতার পরিস্থিতিতে তারা নেই। এই ক্ষেত্রে, একা বামকে মানুষ দুর্বল ভাবলে তৃণমূল-বিরোধী ভোট, মালদা-মুর্শিদাবাদের বাইরে, আবার বিজেপির হাতে চলে যেতে পারে।

বাম-কংগ্রেস যদি শেষপর্যন্ত জোট বেঁধে লড়ে, তা হলে অবশ্য মালদা-মুর্শিদাবাদের বাইরেও বেশ কিছু আসনে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা, যাতে তৃণমূলের চেয়েও বেশি বিপদ বিজেপিরই।

কিন্তু বামেদেরকে সবরকম সম্ভাবনার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি একা লড়তে হয়, সেই পরিস্থিতির জন্যও। একা লড়তে হলে কীভাবেই বা তারা তৃণমূল-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধী ভোট মেরুকরণ ভেঙে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারে, সেই রাস্তা খুঁজতে হবে।

গত ১২ বছরের তৃণমূলের রাজ্য শাসনে ও বিজেপির এই ৯ বছরের দেশ শাসনে নিশ্চিতভাবেই রাজ্যে একাংশের ভোটার তৈরি হয়েছে যারা দুই দলের প্রতিই ক্ষুব্ধ। তীব্র মেরুকরণ ও তৃতীয় শক্তির অনুপস্থিতি এই ভোটারদের বাধ্য করে কোনও এক পক্ষ বেছে নিতে। ২০২১-এ যেমন আমরা দেখেছি, বামেদের ভোটারদের মধ্যে যারা বেশি তৃণমূল-বিরোধী তারা অনেকেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, আবার যারা বেশি বিজেপি-বিরোধী তাঁদের কেউ কেউ তৃণমূলকেও ভোট দিয়েছেন।

এই পঞ্চায়েত নির্বাচন, শত প্রহসন সত্ত্বেও, সেই মেরুকরণ ভাঙার একটা ইঙ্গিত দিয়েছে। হিংসা ও অন্যান্য কারচুপি সত্ত্বেও বামেদের ভোট দক্ষিণবঙ্গের অনেক এলাকায় বেশ ভালই বেড়েছে। বহু আসনে বিরোধী ভোট বিজেপি ও বামেদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে তৃণমূলের সুবিধা করে দিয়েছে, আবার মালদা ও নদিয়ার কিছু আসনে বাম বা কংগ্রেসের ভোট বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু, মোটের ওপর, ত্রিমুখী (কোথাও চতুর্মুখী) নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বিজেপিরই হয়েছে।

পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্যে ত্রিমুখী রাজনীতির যে সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তা আরও পুষ্ট হওয়ার জন্য বাম-কংগ্রেস (ও আইএসএফ) জোট বেঁধে লড়াই করা প্রয়োজন। এতে দুই শাসক দলই চাপে থাকবে। কিন্তু কংগ্রেসকে পাওয়া যাবে অথবা যাবে না— এই দুই সম্ভাব্য পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো করেই প্রস্তুত হতে হবে বামেদের। বুথভিত্তিক সংগঠনের দুর্বলতা ছাড়াও যেটা বিজেপির ভোটক্ষয়ের কারণ, সেটা হল আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের পাশে, বিশেষত ২০২১-পরবর্তী সময়ে, দাঁড়াতে না-পারা। সেভাবেই, আক্রান্ত জনতার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বামেরা তাঁদের হারানো সমর্থন ফিরে পেতে পারে। এখানেই প্রয়োজন স্পষ্ট যুক্তির। বিজেপি-বিরোধী শিবিরে তৃণমূলের উপস্থিতির যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা। মনে পড়ছে, ২০২১-এর অগস্টে, মুজফ্‌ফর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, পার্টির বিরুদ্ধে ওঠা বিজেপি ও তৃণমূলকে এক করে দেখার অভিযোগ ঠিক নয়।

তাঁর বক্তব্য ছিল, “একটি দল উগ্র দক্ষিণপন্থী, আর একটি হল আঞ্চলিক দল। সব আঞ্চলিক দলের নিজস্ব চরিত্র আছে। আরজেডি-র বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাক এটা কখনওই বলা যাবে না যে তারা কখনও বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বা আরএসএস-এর কাছে আত্মসমর্পন করেছে। কিন্তু এ রাজ্যের ইতিহাস তো আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, উনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আরএসএস-এর কাছে গিয়েছিলেন, গান্ধির হত্যাকারীদের দেশপ্রেমী আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে এটা মনে করা ভুল, যে ২০১৯ বা ২০২১ সালের নির্বাচন তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে লড়েছিল। তা নয়। এরা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করছে, ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে। ওই সময় আর এই সময় আলাদা। কিন্তু এই রাজ্যের পরিস্থিতিতে তৃণমূল বা বিজেপি কারুর প্রতিই আমরা নরম হতে পারি না। তৃণমূলের ছত্রছায়ায় থেকে বিজেপির বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। আবার তৃণমূল যেমন আমাদের হারাতে বিজেপিকে ডেকে আনার অন্যায় করেছিল, আমরা সেটাও করতে পারি না।”

তাঁর পরেই বলতে উঠে মহম্মদ সেলিম, যিনি আর কিছুদিন পর সূর্যবাবুর স্থলাভিষিক্ত হবেন, কিন্তু তাঁদের প্রাক-নির্বাচনী ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব সঠিক ছিল বলেই দাবি করেন। “… নিজাম প্যালেস থেকে সিবিআই-ইডি হয়ে আমাদের রাজ্যে একশ্রেণির সঙ্কর প্রজাতির রাজনীতিবিদ তৈরি হয়নি? এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে না? আমাদের সাহিত্যে আছে, হাঁসজারু, বকচ্ছপ। বক এবং কচ্ছপ আলাদা, কিন্তু সুকুমার রায়ের সাহিত্যে তো দুটো জুড়ে গেছে। রাজনীতিতেও আমরা আগে কংশাল বলিনি? কংগ্রেস ও নকশাল সম্পুর্ণ আলাদা দল। কিন্তু তারা একে অন্যের উদ্দেশ্যসাধনে সাহায্য করছে, তাদের মধ্যে একটা আদানপ্রদান হচ্ছে।” দুই দলের মধ্যে কার বিরুদ্ধে বেশি আক্রমণ শানানো হবে তা-ও নিক্তি মেপে করতে হবে কি না, তা নিয়েও সেলিমবাবু সেদিন খানিক ব্যঙ্গ করেন।

দুই দলের বিরোধিতার সামঞ্জস্য রক্ষা নিয়ে বাম নেতৃত্বের মধ্যে যে দোলাচল এই দুই বক্তৃতায় ধরা পড়েছিল, তা এখনও বিদ্যমান বলেই আমার ধারণা।

আজকে ‘তৃণমূলের রক্ষাকর্তা বিজেপি’ বলা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে এলে যখন কেন্দ্রীয় এজেন্সি বা রাজ্যপালকে দিয়ে তৃণমূল নেতা বা রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের দৌড় করানো হবে, তখনও জনতা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করবে তো? যদি পরপর কিছু নেতাকে জেলে ঢোকানো হয়, বা নিদেনপক্ষে ডেকে পাঠানো হয়? গোটা দেশ জুড়ে বিরোধী দলের নেতাদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে, বাংলায় নির্বাচনের ঠিক আগে কি কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে সত্যিই গারদে ঢোকানো যায় না? কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত আবার তীব্র রূপ নিলে, তখনও বিজেমূল তত্ত্ব কি মানুষ গ্রহণ করবে? এর চেয়ে কি তাদের মোদ্দা ভাষ্যটি সহজভাবে মানুষকে বলাই শ্রেয় নয় যে, বিজেপিকে সরাতেই হবে, কিন্তু তৃণমূলকে দিয়ে সরাতে গেলে রাজ্যের অব্যবস্থার সমাধান হবে না, আমাদের দিয়ে সরালে আমরা রাজ্যকে সৎ সাংসদও দেব, রাজ্যের ওপরও দুর্নীতি প্রসঙ্গে চাপ তৈরি করব? নানান স্তরের বাম নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এটাই তাঁদের মোদ্দা বক্তব্য। সহজ কথাকে কি সহজভাবে বলা যায় না? যদিও একাংশের বাম নেতা অবশ্যই আছেন যাঁরা তৃণমূল সংঘ পরিবারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে এই তত্ত্বে আন্তরিকভাবেই তীব্র বিশ্বাস করেন।

বামেরা সংবাদমাধ্যমের অযাচিত পরামর্শ পছন্দ করেন না। এখানে যা যা লেখা হল, তার সবটাই নিশ্চয়ই তাঁরা ইতিমধ্যেই জানেন। তাই সাধারণ পাঠকদের জন্য আমার পর্যবেক্ষণটুকু জানিয়ে রাখি। খেলা ঘোরাতে গেলে তৃণমূল-বিরোধী ভোট তাঁদের বিজেপির কবল থেকে বার করে আনতে হবে, আর তৃণমূলের পাশাপাশি তীব্রভাবে বিজেপির বিরোধিতা না-করলে, বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহ ভাঙতে না-পারলে, সেটা সম্ভব হবে না। ২০১৯-এ কিন্তু বামেরা তৃণমূলকে যতটা আক্রমণ করেছে, তার সিকিভাগও বিজেপিকে করেনি। নেতাদের বক্তৃতাগুলি আবার শুনলেই বোঝা যাবে। ২১-এ বিজেমূল তত্ত্ব সামনে এলেও প্রয়োগে বিশেষ পার্থক্য হয়নি, আক্রমণের কেন্দ্রে তৃণমূলই থেকেছে। মোদি সরকার ফেলা দরকার, এটা মানুষের কাছে প্রাথমিকতা হিসেবে তুলে আনতে না-পারলে বিজেপির কাছে হারানো ভোট তাঁরা কীভাবে ফিরে পাবেন, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

আগামীদিনে রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতির এই জটিলতায় সিপিএম কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে, তার ওপর শুধু তাদের ভাগ্য নয়, রাজ্য রাজনীতির ভারসাম্যও অনেকটাই নির্ভর করছে।


*মতামত ব্যক্তিগত