সত্যব্রত ঘোষ
২০১৬-পরবর্তী দিল্লিতে এই লেফটেন্যান্ট-গভর্নর বনাম দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে প্রশাসনিক সংঘাত বহুদিন ধরেই সংবাদে ছিল। আজ যখন এই গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০২৩ বিলটি সংসদে গৃহীত হল, তখন বোঝা যায় মোদি-শাহের যে ক্ষমতালোভ তা কতটা প্রকট।
ছোটবেলায় একটা বই পড়েছিলাম। তার নামটাই শুধু মনে আছে – ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে সংসদের শেষ বর্ষাকালীন অধিবেশনে যে কাণ্ড-কারখানা চলছে, তার আঁচটুকুতেই বইটার নাম মনে পড়ে গেল। সম্ভবত একটা দুষ্টু লোককে জব্দ করবার গল্প ছিল সেটি।
সংসদের অধিবেশন সম্পর্কে যতটুকু কেতাবি জ্ঞান আমাদের রয়েছে, তাতে অন্তত এটুকু আশা করা যেতে পারত যে দেশের নির্বাচিত সাংসদেরা এখানে সাধারণ মানুষের কথা বলবেন। কিন্তু সাত বছর আগেই সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন ভারতের সাংসদেরা। সেবারের শীতকালীন অধিবেশনে শোনা গেছিল নোটবন্দির যুক্তি হিসেবে রচিত এক মিথ্যাজগতের বিবরণী। আর সাত বছর পরে এখন সংখ্যাগুরুদের দাপটে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের ত্রাহি রব শোনা যাচ্ছে।
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লি একটি আজব শহর। এখানে ভারতের প্রায় প্রত্যেক হোমরা-চোমরা মানুষদের মোটা অক্ষরে লেখা একটা বা একাধিক ঠিকানা রয়েছে। এমনকি, প্রাক্তন হোমরা-চোমরাদের জন্যেও এলাহি ব্যবস্থাদি প্রস্তুত। আবার, ভারতের এই উত্তরদিকে স্থিত এই শহরটি এমন অনেক মানুষকেও ঠাই দিয়েছে, যাদের দু-বেলা পেট ভরানোর জন্যে অবিশ্বাস্য দৈহিক পরিশ্রম করতে হয়। এবং তারপরেও এই মানুষদের অনেকেরই অভুক্ত থেকে রাত কাটানোকে আর একটি ‘আম বাত’ হিসেবেই ধরা হয়।
৪২.৭ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী নতুন দিল্লি শহর এবং ১,৪৮৩ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী দিল্লি নামক সদ্যোজাত (১৯৯২ সালে ঘোষিত) রাজ্যটিতে আমীর-গরিব, দুই শ্রেণিরই বাস। সমস্যাটি হল মধ্য এবং নিম্ন-আয়ের অন্তর্ভুক্ত অধিবাসীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সুবিধার ভগ্নাংশটুকুও পান না যা দেশের মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসলভোগী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং উচ্চপদস্থ আমলারা নিজেদের পিতৃপুরুষের জমিদারি হিসেবে ভোগ করেন।
ব্যক্তিগত একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতেই পারে। গত শতকের আটের দশকের শেষদিকে দিল্লিতে লোডশেডিং শুরুর রাতটা মনে আছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো বলতে সার সার গাড়ির জ্বলন্ত হেডলাইট। মোমবাতি, কেরোসিন তেলের লন্ঠন এবং মিনি জেনারেটরের বানিজ্য তখনও জমে ওঠেনি ওখানে। অথচ আকবর রোড থেকে শুরু করে নতুন দিল্লির তৎকালীন নেতাদের ঘরে কিন্তু সেদিন বা পরবর্তীকালে কোনও সময়েই বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনও বিঘ্ন ঘটেনি। পেশাসূত্রে এক দাদা মন্তব্য করেছিলেন যে, এক শহরেই অন্তত দুটি শহর তো থাকেই। বর্ণে বর্ণে কথাটি সঠিক শুধু নয়, আমার মতো অনেকেই হয়তো মানবেন দিল্লির মধ্যে অন্তত চারটে শহর তো আছেই।
এখন প্রশ্ন হল দিল্লি কাদের শহর? যারা এখানে পুরুষানুক্রমে বাস করে এসেছে এবং প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক এবং আন্তর্কাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত কর্মীরা এখানে তাঁরা কি নাগরিকের ন্যুনতম স্বাচ্ছন্দ্যটুকু পাবেন? নাকি, সমাজ বিভাজনের ফায়দা তুলে এবং মেরুকরণকে এক সিদ্ধ ব্যবস্থায় পরিণত করে ভোটে জেতা গণশত্রুদেরই মৌরসিপাট্টা হয়ে উঠবে দিল্লি? প্রশ্নগুলো বিশেষ করে এখন তাৎপর্যময়, যখন সংসদের এই বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিল পাশ হয়ে গেল যে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নন, দিল্লির বর্তমান লেফটেন্যান্ট গভর্নর বিনয় কুমার সাক্সেনা দিল্লির সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ এবং বদলির সিদ্ধান্ত নেবেন।
এখানে উল্লেখনীয়, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি হোমরাচোমরাদের বাস দিল্লির ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন যাকে বিভিন্ন সংবাদসংস্থা সংক্ষেপে NCR লিখে ডেটলাইন দেন। ১৯৯২ সালের আগে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে দিল্লি দেশ স্বাধীনতার সময় থেকেই রাষ্ট্রপতির অধীনে ছিল। এবং একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করবার পরেও দিল্লির আরক্ষাবাহিনী কিন্তু সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশনায় কাজ করে। কিন্তু, মাত্র ৫৫.৮৭ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী এই NCR তাবড় দিল্লির প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়ার বায়না করা এই গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০২৩ বিলটিকে কী বলা উচিৎ? লোকসভায় ৩৩২ ধেড়ে খোকা-খুকুর কাণ্ড আর রাজ্যসভার ১১২ ধেড়ে খোকা-খুকুর কাণ্ড বলাই যায়।
অথচ এই বিলটি প্রস্তাবে অন্তত একটি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত, রাজ্য হিসেবে দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনে যদি আম আদমি পার্টি (AAP)-র বদলে বিজেপি জয়ী হত। আমরা জানি, বিগত দিনে শীলা দীক্ষিত যখন কংগ্রেস দলের এক নেত্রী হিসেবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীত্ব করছেন, তখন এই আগ্রাসী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি কারণ কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস এবং তার সহযোগী দলের সরকার ছিল। বস্তুত, ২০১৪ সালের পরে বিজেপি যখন ক্ষমতার পূর্ণ সুযোগের সদব্যবহার করছে, তখন দিল্লি রাজ্যই ছিল তাদের কাবাব মে হাড্ডি।
এই সুযোগে আরেকটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আবার আলোচনায় ফিরব। ২০১১ সালে আন্না হাজারে যখন জন লোকপাল বিল নিয়ে আমরণ অনশন শুরু করেন, তখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত এক কর্মী। পরবর্তীকালে, এই অনশনের ভিত্তিতে ২০১২ সালে যে বৃহত্তর ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন আন্দোলন শুরু হয়, ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার তা প্রতিরোধ করতে অক্ষম হন। ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস যে এনডিএ-র গোহারা হয়, তার কৃতিত্ব কিছুটা হলেও আন্না হাজারেকে দিতেই হয়। সেই হিসেবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে বিজেপি-র আঁতাত থাকলে তা তখন অসম্ভব কিছু ছিল না।
তবে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ যে এতটা আগ্রাসী এবং ক্রুর পদ্ধতি অবলম্বন করে আরএসএস দ্বারা প্রবর্তিত হিন্দু ভারতের ইতিহাস রচনায় মনোযোগী হবেন তা সম্ভবত কোনও স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষের কাছে আগাম বুঝে নেওয়ার অবকাশ ছিল না। কিন্তু ২০১৬ সালে নোটবন্দি ভারতের ভুক্তভোগীরা ভালোই বুঝতে পেরেছেন মোদি-শাহের মিথ্যাচার এবং কাপট্যের বেসাতি। এর ফলে বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি-র সমর্থন অত্যন্ত দ্রুত কমতে শুরু করে দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে কেজরিওয়াল বনাম মোদি-শাহের দ্বৈরথটি দেখা প্রয়োজন।
২০০১ সালে লস্কর-এ-তৈবা আর যৈশ-এ-মহম্মদ-এর আতঙ্কবাদীরা যখন ভারতের সংসদ ভবনে আক্রমণ চালায়, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেছিল যে শুধু পুলিশবাহিনী দিয়ে এর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা যাবে না। সুতরাং, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যৌথ অংশগ্রহণ তথা অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু সেক্ষেত্রেও এই অধিকারের সীমা ওই ৫৫.৮৭ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। ব্রিটিশ সরকারের পরম্পরা রক্ষা করা দিল্লির লেফটেন্যান্ট-গভর্নরদেরও এইটুকু বলয়ের মধ্যেই সক্রিয় থাকলে কারওর কিছু বলবার থাকতে পারে না।
অথচ ২০১৬-পরবর্তী দিল্লিতে এই লেফটেন্যান্ট-গভর্নর বনাম দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে প্রশাসনিক সংঘাত বহুদিন ধরেই সংবাদে ছিল। আজ যখন এই গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অফ দিল্লি (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০২৩ বিলটি সংসদে গৃহীত হল, তখন বোঝা যায় মোদি-শাহের যে ক্ষমতালোভ তা কতটা প্রকট। একটা কথা তো নিশ্চিত। দিল্লির দীনদয়াল মার্গে বিজেপি যত বড়ই হর্ম্য অট্টালিকাসদৃশ দপ্তর বানাক না কেন, দিল্লির জনগণের মধ্যে বিজেপি বিরোধিতা নোটবন্দির পর ক্রমশই কমেছে। এই অবস্থায় স্থানীয় বিজেপি কার্যকর্তাদের রোয়াব যে এলাকার মানুষরা ইদানিং সহ্য করছেন না, তা বলাই বাহুল্য। এই অবস্থায় AAP এবং বিজেপি-র সমান্তরাল প্রশাসন চললে তা নিশ্চিতভাবেই আসন্ন ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রতিফলিত হবেই। সুতরাং দিল্লির প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যে লেফটেন্যান্ট-গভর্নর বিনয় কুমার সাক্সেনা এবং তাঁর উত্তরসূরিদের হাতে ন্যস্ত হওয়াটা মোদি-শাহ সর্বস্ব বিজেপি-র কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত।
গণতন্ত্রের নামে যে প্রহসনের সাক্ষী হতে হতে আমরা ইদানিং বিস্মিত হতেও বোধহয় ভুলে গেছি। আমরা দেখেছি বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-শাহের অপদার্থতা প্রমাণিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি মণিপুরে মৈতেই এবং কুকি জনজাতির মধ্যে যে হিংসা প্রকট হয়েছে, তাতে মোদি-শাহের অত্যন্ত প্রিয় শব্দবন্ধ ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ যে অলীক এক কল্পনা, তাও ভারতবাসী তথা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও বানিজ্যিক মহলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এমনকি সদা শিরোনামের জন্যে ক্ষুধার্ত মুলস্রোতের সংবাদমাধ্যমকে মণিপুর থেকে মনোযোগ হটানোর জন্যে আরেকটি ডাবল-ইঞ্জিন চালিত রাজ্য হরিয়ানায় দাঙ্গা সংঘটিত করা হয়েছে, সেই সন্দেহও ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। শেষতম চাল হিসেবে বর্ষাকালীন সংসদ অধিবেশনের শেষ দিনে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের প্রধানমন্ত্রীর জবাব দেওয়ার দিন নির্ধারিত করার সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে মোদি-শাহের মসনদ টলমল করছে।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে INDIA জোট বিজেপির আধিপত্যকে কতটা খর্ব করতে পারবে, তা সময়ের অপেক্ষা। আশা করতে দোষ নেই, মোদি-শাহের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোটের সংখ্যাটিকে আর তাচ্ছিল্য করা যাবে না। সেই হিসেবটি অন্তত বিজেপি-র অন্দরমহলে তো শুরু হয়েই গেছে। নেতিবাচক ভোটের হারটিকে বিভাজিত করতে করতে নিজের জয় নিশ্চিত করবার জন্যে প্রথম পদক্ষেপ ছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর বিদায়ী ডিরেক্টর সঞ্জয় কুমার মিশ্রকে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে আগামী ১৫ই সেপ্টেম্বর অবধি বহাল রাখা, যাতে ভয় দেখিয়ে বিরোধী জোটের আরও কিছু গুণধর রাজনৈতিক নেতাদের অন্তত প্রাক-নির্বাচনী জোট ভাঙতে বাধ্য করা যায়।
সর্বোপরি, দিল্লিটাকে নিজের হাতে রেখে আধিপত্যের ঝান্ডাকে আরও একটু জোরে নাড়িয়ে আরও মিথ্যা, আরও বিভাজন, আরও হিংসা, আরও দ্বেষ ছড়িয়ে ভারত যে ধর্মনিরপেক্ষ এক অখণ্ড রাষ্ট্র নয়, তা উচ্চকিত কণ্ঠে বলা যায়।