শুভদীপ বড়ুয়া
‘মৃত্যু আর অমরত্ব একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। পুরনো এবং শক্তপোক্ত জুটি। মার্ক্স-এঙ্গেলসের চাইতেও অভিন্নহৃদয় জুটি, রোমিও-জুলিয়েটের চাইতেও, এমন কি লরেল-হার্ডির চাইতেও।’— এই প্রহসন মিলান কুন্দেরাকেই মানায়। তাঁর প্রহসনই তাঁর অমরত্ব
ঈশ্বর যেদিন তাঁর সিংহাসন ছেড়ে উঠে পড়লেন, জগৎসংসার চালনার নিয়ম আর মূল্যবোধগুলোকে নির্দিষ্ট করে দিয়ে, ভাল আর খারাপের ফারাক স্পষ্ট করে দিয়ে, পৃথিবীর সবকিছুর একটা পরিষ্কার মানে করে দিয়ে, দন কিহোতে সেদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল, প্রবেশ করেছিল এমন একটা পৃথিবীতে, যা তার চেনাশোনার বাইরে। সর্বেসর্বা বিচারকের অনুপস্থিতিতে সেই অচেনা পৃথিবী তার সামনে ভয়ানক দুর্বোধ্য কিছু একটা হয়ে দেখা দিল। এতকালের পুরনো এক এবং অদ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্য টুকরো টুকরো হয়ে একেকজনের কাছে একটু একটু করে ধরা দিতে লাগল। এইভাবে জন্ম হয়েছিল আধুনিক যুগের, আর উপন্যাসের, যাকে যুগের প্রতিচ্ছবি বা মডেল বলেও ভাবা যেতে পারে।
ওপরের কথাগুলো মিলান কুন্দেরা (১৯২৯ থেকে ২০২৩) উপন্যাস-শিল্প নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ (১৯৮৬) গ্রন্থে। তিনি ঔপন্যাসিক। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ (১৯৬৭) প্রকাশের পর থেকেই সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর নাম। শেষ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রথমটি থেকে শুরু করে শেষতম উপন্যাস ‘দ্য ফেস্টিভ্যাল অফ ইনসিগফিক্যান্স’, তিনি পাঠকের কাছে কখনও দুরূহ তাঁর ভাবের বিস্তারে, কখনও তিনি বিশেষ চমকপ্রদ শুধু কাহিনির অবিশ্বাস্যতায়, মুগ্ধতার রূপকার তিনি সৌন্দর্যের সৃষ্টি আর ধ্বংসের সমাহারে, বিশিষ্ট তিনি যৌনতা আর রাজনীতির জটিলতর বর্ণনা আর ব্যাখ্যায়। কিন্তু সবকিছুর পর তিনি সারা বিশ্বের চোখে বিশিষ্টতম, মানুষকে নিয়ে মজা করায়। প্রহসন, বা বিশুদ্ধ রসিকতায়। মিলান কুন্দেরা যৌবন পার করে প্রৌঢ় হয়েছেন, বার্ধক্য এসেছে তাঁর, তিনি বদলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর উপন্যাস বদলায়নি এতটুকুও। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, তাঁর উপন্যাস যেন একটিই। প্রায় কাছাকাছি ধরনের চরিত্ররা নাম বদল করে, দেশ বদল করে যেন ঘোরাফেরা করছে এক উপন্যাস থেকে আরেক উপন্যাসে। নানান গল্প তৈরি হচ্ছে, আবার ভেঙেও যাচ্ছে। বলতে গেলে, তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসই উপন্যাসতত্ত্বের নিরিখে অসমাপ্ত। কোনও একটি চরিত্র হয়তো সহসা দেখা দিল কোনও উপন্যাসের একটি অধ্যায়ে, তারপর সে কোথায় গেল, কী তার পরিণতি হল, কেউ জানতে পারল না। কিন্তু সেই আগন্তুক চরিত্রের ছাপ পড়ে গিয়েছে ততক্ষণে সেই উপন্যাসে। গল্পের অভিমুখই হয়তো বদলে দিল সে। সেই চরিত্রেরই আদলের কোনও চরিত্রকে এরপর ঠিক চিনে নিতে পারেন পাঠক, তাঁর অন্য কোনও উপন্যাসে। মিলান কুন্দেরা মনে করতেন, মানবচরিত্ররা মারা যান বাস্তব পৃথিবীতে, উপন্যাসে নয়। কারণ উপন্যাস আদতে একটি কল্পরাজ্য।
তাঁর উপন্যাস আসলে ঠিক কেমন? প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ তাঁর স্বদেশ চেকোশ্লোভাকিয়ার (বর্তমান চেক রেপাবলিক) তৎকালীন কমিউনিস্ট-সরকারকে নিয়ে প্রবল ব্যঙ্গ আর প্রহসনের কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেই থেকে তিনি ফ্রান্সে। ১৯৮৪ সালে ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ প্রকাশিত হয়েছিল প্রথমে ফরাসি অনুবাদে, চেক-ভাষার মূল উপন্যাসটি প্রকাশ পায় পরের বছর। উপন্যাসটি তাঁকে একেবারে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে পৌঁছয়। দেশ-বিদেশে সাহিত্য-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তখন শুধুই তিনি। ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে সোভিয়েত রাশিয়া সেনা পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল গোটা দেশটির দখল নেওয়া, সেইসঙ্গে চেকোশ্লোভাকিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। যুদ্ধকালীন অস্থির পরিস্থিতিতে একদিকে টমাস-তেরেসা, তারা তরুণ দম্পতি, আর তাদের কথা-বলা কুকুর, আরেকদিকে সাবিনা নামে এক খামখেয়ালি যুবতী আর তার প্রেমিক ফ্রানৎস, মাত্র অল্প কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে যে কাহিনির অবতারণা, সেটি মিলান কুন্দেরার উপন্যাসশৈলীকে শুধু তাঁর নিজের সময় নয়, উপন্যাসের ইতিহাসেও একান্ত বিশিষ্ট বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। অস্তিত্বের স্বাভাবিকতা থেকে সরে আসে যদি কেউ, বা একটি দম্পতি, একটি শহর, কি আস্ত একটা দেশ, তবে মানুষগুলো যত না অচেনা হয়ে ওঠে, তার চাইতেও বেশি অচেনা হয়ে যায় সভ্যতার যাবতীয় ইতিহাস আর দর্শন, সঙ্গে সভ্যতা নিয়ে অসংখ্য গুরুভার তত্ত্ব। অনেকেই মনে করতেন, এমনকি আজও করেন, মিলান কুন্দেরা আসলে একজন তাত্ত্বিক-দার্শনিক। যদি তিনি হয়েও থাকেন, তাঁর উপন্যাসের আসল টান কিন্তু আজও গল্প। গল্পের কারণেই তিনি বেস্ট-সেলার। তত্ত্বের কারণে নয়। সভ্যতার ধারণার নানান রূপকে তিনি তাঁর একেকটি উপন্যাসে একেকভাবে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, কোনও কিছুই বেশিদিন একরকম থেকে যেতে পারে না। বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যক্তিসত্তা থেকে শুরু করে সভ্যতার ইতিহাস, প্রাচীনতা থেকে আধুনিকতা, সব কিছুরই নিঃশব্দ ক্ষয় বা বিকার ঘটতে থাকে ক্রমাগত। কিন্তু শূন্যও হয় না কখনও। বিলীন হতে চলেছে, এমন ভাব দেখা দিলেও আদতে পুরোপুরি বিলীন হওয়ার নয়। কিছু একটা থেকে যাচ্ছে, যা একেবারেই তলানি বা প্রান্তিক, কিন্তু অনিঃশেষ। সেই শেষ বা প্রান্তিক-ভাব, সেটিকে ঘিরেই মানুষের মনে সৃষ্টি হতে থাকে কল্পনা, তত্ত্ব, এবং নস্টালজিয়া। বিভ্রমজনিত এই ফ্যান্টাসিকে ‘প্রান্তিক হেঁয়ালি’ বা ‘টার্মিনাল প্যারাডক্স’ বলেছেন মিলান কুন্দেরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবী কি সাধারণ মানুষের চেতনায় কোনও কিছু নিয়ে যে বিভ্রম না হেঁয়ালির অবতারণা ঘটে, সেটি এক ধরনের ‘ভুলে যাওয়া’ বা বিস্মরণের কারণে ঘটে। ফলে লঘু-গুরুত্বের কোনও ঘটনাকে কিছুকাল পরেই গুরুতর কিছু ভেবে বসা, কিংবা তার বিপরীত, এতসব নিয়েই আধুনিক পৃথিবীর মানুষ আর তার আধুনিক বিভ্রম।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন,
যতই প্রমাণের অভাব থাক না কেন, ৪৮ সালের প্রাগ-কমিউনিস্ট বিদ্রোহকে শেষ অবধি বিপ্লব ভেবে নেওয়া হয়েছিল। এর সবরকম গড়নপেটন, বিভ্রম, তাৎক্ষণিকতা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আর ঘটে যাওয়া অপরাধ, সবকিছুকে নিয়ে আমি যখন আজকের দিনে ভাবতে বসি, দেখি, এটি হল ইওরোপের বহু পুরনো যে বিপ্লবের ঐতিহ্য, তারই আবেগঘন প্যারোডি। ইওরোপের বিপ্লবের ঐতিহ্যেরই একটি সোচ্চার কিন্তু ভূতুড়েভাব নিরবচ্ছিন্ন স্রোতে বয়ে গেল যেন। যেন আমারই কোনও উপন্যাসের চরিত্র। জারোমিল (লাইফ ইজ এলসহোয়ের), যে ছিল ভিকতোর উগো হয়ে র্যাবোর নিরবচ্ছিন্নতা, ভূতুড়েভাবে ইওরোপীয় কবিতার ঐতিহ্য বয়ে গেল। কিংবা ধরা যাক, জারোস্লাভ (দ্য জোক), যে কিনা দিনরাত প্রাগের সেইসব পপুলার আর্টের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাত, যেগুলো অনেককাল আগেই অচল হয়ে গিয়েছে। ডঃ হাভেল, লাফেবল লাভস-এর নায়ক, যে দন জুয়ান হতে চেয়েছিল এমন একটা সময়ে, যখন দন জুয়ানকে নিয়ে লোকে বেজায় হাসাহাসি করছে। আবার ধরুন ফ্রানৎস, আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং-এর, সে হচ্ছে ইওরোপীয় বামপন্থার গ্র্যান্ড মার্চের শেষতম বিষণ্ণ সুর। আর তেরেসা, সে যখন তার দেশের বাড়ি, বোহেমিয়ার গণ্ডগ্রামে ফিরে গেল, সে শুধুমাত্র তার অতি প্রচলিত দৈনন্দিন জীবন থেকেই মুক্তি পেতে চাইল এমন নয়, সে চাইছিল, সেই রাজপথ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে, যে পথে দেকার্তের সেই ‘প্রকৃতির প্রভু এবং একমাত্র স্বত্বাধিকারী’ অর্থাৎ মানবজাতি বিজয় গৌরবে এগিয়ে চলেছে। এইসব চরিত্রদের ভূতুড়ে পরিণতিগুলো একান্ত ব্যক্তিগত ইতিহাসনির্ভর নয়, এগুলোর সবটাই ইওরোপ নামে এক মহাদেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতা।
তাঁর উপন্যাস আদতে ইওরোপের হাজার বছরের পুরনো নানান ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ছোটবড় ঘটনা আর পরিবর্তনকে বারবার আধুনিকতার আলোয় ফেলে দেখানো যেন। বিশ্বযুদ্ধের পরেকার পাশ্চাত্য-দর্শন যাঁর তত্ত্বে বিশেষভাবে চিন্তাশীল হয়ে উঠেছিল, সেই ফ্রেডরিকশ নিটশের ‘ইতিহাসের বারংবার ঘটে যাওয়া’ বা ‘ফিরে আসা’ কথাটাকে মিলান কুন্দেরা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে নানানভাবে আধুনিক মানুষের চেতনার মাধ্যমে উপলব্ধ করাতে চেয়েছেন। যতক্ষণ না কিছু একটা পুনরাবৃত্ত না হচ্ছে, সেটি যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে না। গুরুভার অস্তিত্ব নিয়ে প্রায় দাসের মতো বেঁচে থাকা কেউ একজন যদি আচমকা তাঁর অস্তিত্বে লঘুতাকে অনুভব করে, সেটি যেমন প্রথমে তার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে, তেমনি অসম্ভব লঘু অস্তিত্বের জীবন যদি কেউ কাটিয়ে ফেলে, তার মনে হতে একটি জীবন যথেষ্ট নয়, আরও গোটা কয়েক জীবন না পেলে জীবনের অর্থ বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়। ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ উপন্যাসে কাহিনির প্রধান পুরুষ চরিত্র টমাস উচ্চারণ করছে জার্মান প্রবাদ: ‘আইনমাল ইশট কাইনমাল। একবার ঘটেছে, মানে সেটা আসলে ঘটেনি। আমাদের যদি একটাই জীবন বেঁচে থাকতে হয়, তার মানে আমরা আসলে বাঁচিইনি।’
বেঁচে থাকা এবং সংলগ্ন সকল জাগতিক অস্তিত্ব ইওরোপের জনজীবনে দ্রুত বদলাতে শুরু করেছিল পাঁচের দশক থেকেই। বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং সমসময়ে লেখা টমাস মানের উপন্যাসে অস্তিত্ব নিয়ে যে সঙ্কট এবং সংশয় দেখা গিয়েছে, বিশ্বযুদ্ধ পরেকার গুন্টার গ্রাসের উপন্যাসে সেই একই জার্মান-জাতি যেন আরও জটিল অস্তিত্বের সংশয়ে ভুগছে। কাফকা দিনদিন গুরুভার হতে থাকা বিভিন্ন ধরনের অস্তিত্বের কার্যকারণগুলোর সন্ধান করেছিলেন তাঁর রচনাবলিতে, তাঁরই দেশের বিশ্বযুদ্ধের পরের লেখক মিলান কুন্দেরা কাফকার সেই অনুসন্ধানেরই নতুন করে পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিলেন কাফকার বিপরীত নন্দনতত্ত্বে। কাফকার লেখাকে কেউ যদি ‘ডার্ক হিউমার’ মনে করেন, তবে মিলান কুন্দেরা তার উল্টো। কিন্তু একই ঐতিহ্যের নিরন্তর প্রবাহ এবং পুনরাবৃত্তি। ইওরোপের সহস্রাব্দপ্রাচীন আর সব ঐতিহ্যের মতোই। সেরভান্তেস থেকে শুরু হয়েছিল ইওরোপের উপন্যাসের যে জয়যাত্রা, তার প্রসঙ্গে মিলান কুন্দেরা তাঁর ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ গ্রন্থে লিখছেন: এতসব কিছুর পরেও, অস্তিত্ববাদ নিয়ে অনেক চর্চা হওয়ার পর, হাইডেগার তাঁর ‘বিয়িং অ্যান্ড টাইম’ গ্রন্থে স্পষ্ট বলে গিয়েছেন, অস্তিত্ব ব্যাপারটাকে আগেকার ইওরোপীয় দার্শনিকেরা বেশ অবহেলা করেছেন। বরং ব্যাপারটা একটু হলেও পর্দার আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, আলোর মুখ দেখেছে, শেষ চার শতকের (পুনর্জাগরিত ইওরোপ) বিভিন্ন উপন্যাসে। নিজের মতো করে, নিজস্ব কায়দায়, উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে অস্তিত্বের নানান রূপ। সেরভান্তেস ও তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন, যারা মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নানান রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার শুরু করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন রিচার্ডসন, যিনি খুঁজতে শুরু করেছিলেন ‘আসলে কী ঘটছে’, অনুভূতির ভেতরকার সূক্ষ্মতর অনুভূতিগুলোর রহস্য, সঙ্গে ছিলেন বালজাক, যিনি আবিষ্কার করলেন ‘মানুষ আসলে ইতিহাসে গাঁথা রয়েছে’, সঙ্গে ছিলেন ফ্লবেয়র, যিনি ঘোরাফেরা করতেন অজানা দেশে যা তাঁর নিত্যদিন দেখা অচেনা নারীদের মতো ছিল, সঙ্গে ছিলেন তলস্তয়, যিনি প্রথম মানুষের অযৌক্তিক আচরণ আর সিদ্ধান্তের ওপর আলোকসম্পাত করলেন। সময়ের গতিবিধি নিয়ে কাজ শুরু হল, প্রহেলিকায় ভরা প্রুস্তের অতীত, আর প্রহেলিকাময় জেমস জয়েসের বর্তমান সময়, টমাস মান ছিলেন সঙ্গে, বললেন, অতীতের পুরনো বিশ্বাস আর সংস্কার কীভাবে বর্তমান সময়ে প্রবেশ করে যায়, তারপর নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে সময়কেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
মিলান কুন্দেরা বারবার লিখেছেন তাঁর উপন্যাসের পাতায়, সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, মানুষ যত আধুনিক হয়েছে, যত জটিলতর হয়েছে তার অস্তিত্ব, বিভ্রম বা প্রহেলিকা তত বেড়েছে। আধুনিক জীবনের প্রহেলিকাকে তিনি জার্মান শব্দ ‘কিশ’ (Kitsch)-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। শব্দটির প্রথম প্রবেশ দেখা যায় তাঁর ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ উপন্যাসে। সেই উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে, ‘কিশ’ নামের এক অদ্ভুত বিভ্রম বা প্রহেলিকার কারণেই আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব এত লঘু এবং ভঙ্গুর। ‘বোঝার চেষ্টা না করা’, ‘বুঝেও না বোঝা’, ‘দেখেও না দেখা’, ‘আলস্যতার কারণে এড়িয়ে যাওয়া’, ‘অন্যের চোখ দিয়ে দেখা’, ‘অন্যের অভিজ্ঞতাকে নিজের বলে মনে করা’, যাকে মিলান কুন্দেরা বলছেন ‘Non-Thoughts and Received Ideas’, এসবের মূলে রয়েছে ‘কিশ’ নামে অতি-আধুনিক এই প্রহেলিকা। উপন্যাসের কাজ হল প্রহেলিকার চাদর সরিয়ে বাস্তবটিকে যথাযথ মেলে ধরা। অতি-নাটকীয়তা, অতি-রোমান্স, অতি-আবেগ যদি কোনও উপন্যাসে পাওয়া যায়, তবে সেই উপন্যাসের লেখক নিজেই কিশ-কবলিত। ‘কিশ হচ্ছে অন্যের চোখে দেখা জগৎ থেকে পড়ে পাওয়া বোকামিগুলোর সৌন্দর্য আর অনুভূতিপূর্ণ ভাষায় চমৎকার সরাসরি অনুবাদ। যা আমাদের চোখ জলে ভরিয়ে তোলে, আর নিজেদেরই খুব করুণা করতে ইচ্ছে করে তখন। কারণ আমরা জানি, যা আমরা আসলে ভাবি, তাকে কিছুতেই আর অনুভব করতে পারছি না।’ বলছেন মিলান কুন্দেরা। ‘কিশ’-এর কারণে বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ মানুষের যে ‘সর্বজনীন বিস্মরণ’ এবং ‘অবহেলা’ বা ‘দেখেও না দেখা’, ফলত আধুনিক পৃথিবীতে কোনও শক্তিশালী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করাটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ক্ষমতাধারী কোনও প্রশাসন প্রথমে স্বৈরাচারী, তারপর একদিন অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসকে পরিণত হয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনটি বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ, সকলেরই উপলব্ধির অতীত। কারণ তাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন আবেগ আর মধুর উত্তেজনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে।
একাধিপত্যের বিশ্বে কখনও উপন্যাস লেখা হতে পারে না। কারণ একাধিপত্যবাদীর সত্যের সন্ধানে আপেক্ষিকতা, সংশয়, প্রশ্ন, এসব শব্দগুলো অর্থহীন। মিলান কুন্দেরা এমন কথা একাধিকবার লিখেছেন তাঁর উপন্যাসে। চরম বা একটিমাত্র সত্যে বিশ্বাস রাখা মানবজাতি আধুনিক পৃথিবীতে যত বহুস্তরযুক্ত আপেক্ষিক সত্যের প্রতি উৎসুক হয়ে উঠছে, ততই ‘কিশ’-এর প্রকোপে তারা ভাবাবেগ-তাড়িত সুকুমার স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করছে। অতিরিক্ত ভাবাবেগমুক্ত প্রহসনই একমাত্র উপায়, কিশ-এর বর্মের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া সত্যের বিশেষ কোনও রূপকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার। দীর্ঘ কাহিনির স্তরে স্তরেও জমে উঠতে পারে প্রচলিত ভাবাবেগ, অনাহূত সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে অভিনব পন্থা ব্যবহার করেছেন মিলান কুন্দেরা। ‘ইমমর্টালিটি’ (১৯৮৮) উপন্যাসে তিনি নিজের সত্তা, অর্থাৎ খোদ লেখক মিলান কুন্দেরাকে প্রবেশ করিয়েছেন। লেখক নিজের থেকে উপন্যাসে প্রবেশ করে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন। কাহিনি কোনদিকে মোড় নিতে পারে এবার, সেই নিয়েও চলছে আলোচনা। যাতে পাঠক কিছুতেই ভুলতে না পারেন, এই যে তিনি পাতার পর পাতা পড়ে চলেছেন গল্পের টানে, সেটি আদতে একটি গল্প। মিলান কুন্দেরা নামে কেউ একজনের কল্পিত স্বর্গরাজ্য। ‘ইমেজোলজি’ নামে একটি শব্দকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি ‘ইমমর্টালিটি’ উপন্যাসে। একটি বাক্য যদি বা দুটি কি তিনটে সত্যকে ধারণ করতে পারে, সেক্ষেত্রে একটি চিত্র বা চিত্রকল্পের ক্ষমতা অনেক বেশি। একটি ছবি দেখে দশজন লোক অনায়াসে দশ রকমের মানে করতে পারেন। অর্থাৎ, সত্যের বহুত্বের সম্ভাবনা সবসময়েই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেশি। ‘ইমমর্টালিটি’ উপন্যাসের ভেতরে লেখক মিলান কুন্দেরা সুইমিং পুলের ধারে বসে থাকা এক নারীকে দেখে ভাবছিলেন: ‘বসার ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি, এই সেই অ্যাগনেস, যাকে কেন্দ্র করে একটি উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছিলাম বছর কয়েক আগে।’ মজার ব্যাপার, সেই নারীর নামও কিন্তু অ্যাগনেস, যে কি না ‘ইমমর্টালিটি’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। যে উপন্যাসে লেখক মিলান কুন্দেরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন এমন একটি চরিত্র, যে চরিত্রের মৃত্যুর পরেও অমরত্ব থেকে যাবে। কাহিনির অভাবনীয় বহুমুখী প্রসারে, জার্মান ধ্রুপদী কবি গ্যোয়েটে স্বর্গে গিয়ে একাকী দিন কাটাচ্ছেন। অমরত্ব নিয়ে তিনি বিশেষ সন্দিহান। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। আত্মবিশ্বাসী হেমিংওয়ের সঙ্গে আলাপে গ্যোয়েটে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেন। হেমিংওয়ে বলছিলেন, ‘জানো তো! লোকে আমার লেখা আজকাল না পড়েই সমালোচনা লিখে ফেলছে!’
‘দারুণ! একেই বলে অমরত্ব।’ ফিসফিস করে বলেছিলেন গ্যোয়েটে।
মিলান কুন্দেরার প্রহসন ধ্রুপদীর উন্নাসিকতা আর আধুনিকের জনপ্রিয়তার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে। হেমিংওয়ে আর গ্যোয়েটের সংলাপে নতুন করে সংজ্ঞায়িত হতে থাকে অমরত্ব। মৃত্যু আর অমরত্ব যেন দুটি ভিন্ন সত্তা। কোনও এক সংযোগসূত্রে তাদের কখনও দেখা হয়ে যায়। তারপর দুটি সত্তার মধ্যে একটিকে বিদায় নিতে হয়, অপরটি রয়ে যায়। কিন্তু কার জীবনের পর মৃত্যুই শেষ কথা, কার জন্যেই বা অমরত্ব? ‘মৃত্যু আর অমরত্ব একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। পুরনো এবং শক্তপোক্ত জুটি। মার্ক্স-এঙ্গেলসের চাইতেও অভিন্নহৃদয় জুটি, রোমিও-জুলিয়েটের চাইতেও, এমন কি লরেল-হার্ডির চাইতেও।’
এই প্রহসন তাঁকেই মানায়। তাঁর প্রহসন তাঁর অমরত্ব।