Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ম্যানগ্রোভ বনসৃজন: জলবায়ু পরিবর্তনকালীন হুজুগ না কি একটি আবশ্যিক কাজ

অমিতাভ আইচ

 


জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তটরেখাগুলি এবং সুন্দরবন গভীর সঙ্কটাপন্ন। ম্যানগ্রোভ বনসৃজন বা কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ লাগিয়েই তার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবাই ভুল। এর জন্য সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং বহুমাত্রিক ভাবনা দরকার। দরকার সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন

 

*গত ২৬ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হল। সেই উপলক্ষে এই জরুরি নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হল। নিবন্ধটি ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ গ্রাউন্ডজিরো পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়

 

ম্যানগ্রোভ লাগানোর ধুম নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বিশেষ করে ফেসবুকে অনেক সমালোচনা নজরে আসছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যে কোনও জিনিস যদি হুজুগে পরিণত হয় তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশাপ্রদ ফল দিতে পারে না। তবে পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝা দরকার ও সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্যও সামনে আসা দরকার। এটা ঠিক যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় বাদাবন বিশেষজ্ঞরা, যেমন ব্রাউন, লিউস, উইনটারওয়ার্প (শেষজন জিও মরফোলজিস্ট) বাদাবনের কৃত্রিম সৃজনের পক্ষে নন এবং মূলত ইকোলজিকাল ম্যানগ্রোভ রেস্টোরেশনের কথা বলেন, অর্থাৎ যেখানে সেখানে ম্যানগ্রোভ সৃজন নয় বরঞ্চ ম্যানগ্রোভ তৈরি হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশরক্ষার এবং তৈরি করার কথা বেশি করে বলেন। তাঁরা কেন এটা বলেন সেটা আলোচনার আগে যেটা আলোচনা করা দরকার যে এই বাদাবন সৃজনের ভাবনা কোথা থেকে এল। এল কারণ বাদাবন নিয়ে বিপুল প্রচার থাকা সত্ত্বেও বিপুল বাদাবন সারা পৃথিবী জুড়ে কাটা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে আরও ভূমিক্ষয় হচ্ছে এবং বাড়তে থাকা জলোচ্ছ্বাস আরও ক্ষতি করছে। আমাদের ধারণা ম্যানগ্রোভ লাগালে সেটা কমবে। গবেষণা কিন্তু বলছে ম্যানগ্রোভ জলোচ্ছ্বাস আটকাতে পারলেও ক্ষয়িষ্ণু জায়গায় ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে ভূমিক্ষয় আটকানো যায় না। যদি না সেই ভূমিক্ষয়টাই আগে আটকানো যায়। তেমনই বাঁধের সামনে বা যেকোনও চর দেখলেই যদি সরকারি বা বেসরকারি প্রোজেক্টের টাকা খরচ করে দেখানোর জন্য ম্যানগ্রোভ লাগানো হয় তবে তা অধিকাংশ জায়গায় টেকে না। তার কারণ হাইড্রোলজি আর কতটা জল উঠবে সেটা দেখে প্রজাতি নির্বাচন না করা এবং সেখানে ম্যানগ্রোভের চারা বেঁচে থাকতে পারবে কি না সেটা না বুঝে লাগানো। তার মানে এটা নয়, এমন বনসৃজন সফল হয়নি। অনেক উদাহরণ আছে। যেমন সুন্দরবনে পুইঁজালি ঘাটের পাশে যে বিপুল ম্যানগ্রোভ বন আছে ওগুলো লাগানো। এমন বহু আছে। আমাদের সঠিক পরিকল্পনা আর বিজ্ঞানটা জানতে হবে।

এ বিষয়ে ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশানাল বহু আগেই পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সঙ্কলন করে একটি প্রচারপুস্তিকা বার করেছিল। যেটি ইন্টারনেটে সহজেই পাওয়া যাবে, নিচে রেফারেন্স দেওয়া রইল। এখানে তাহলে সেই বিষয়টি আরও সহজে আলোচনা করা যাক।

ম্যানগ্রোভ আদৌ লাগাব, না লাগাব না? বা কোথায় লাগাব, এবং কোথায় লাগাব না?

১) ম্যানগ্রোভ লাগাতে হতে পারে সেইক্ষেত্রে যেখানে ম্যানগ্রোভ আগে ছিল, এখন নেই। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিকভাবে কোনও বীজ অঙ্কুরিত হয়ে প্রাকৃতিক বনসৃজন হচ্ছে না এই কারণে যে, আশেপাশে কোনও ম্যানগ্রোভ বন নেই বা বীজ আসছে না।

২) কোনও চরম সঙ্কটাপন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য তার চারা রোপন করা যেতে পারে।

৩) ম্যানগ্রোভ কেটে যেখানে ভেড়ি তৈরি করা হয়েছিল তার পাড় রক্ষার জন্য, এবং পুরনো ম্যানগ্রোভের কিছুটা অন্তত ফেরত দেওয়ার জন্য ম্যানগ্রোভ রোপন করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিকে ‘সিলভোফিসারি’ বলে এবং ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে মাছের ভেড়ির কারণে নষ্ট হওয়া বিপুল অঞ্চলে এভাবে ম্যানগ্রোভ ফেরত আনা হয়েছে। তবে ভেড়ির বাঁধ কেটে জোয়ার-ভাটা খেলিয়ে এই কাজ করতে হবে।

৪) জনশিক্ষা, গবেষণা ও জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের কারণে ম্যানগ্রোভ লাগানো যেতে পারে।

৫) ক্ষয়িষ্ণু তটরেখা বিশেষ করে সুন্দরবনের ‘ইস্ট ফেসিং কনকেভ শোর লাইন’, যেখানে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ঘুরতে থাকা পূবালি হাওয়ার দাপটে জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ছে এবং যেখানে বহুকাল আগে ম্যানগ্রোভ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সরাসরি ম্যানগ্রোভের চারা রোপন করলে বা ভারি বাঁধ দিলে কোনওভাবেই দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা মিলবে না। এখানে ম্যানগ্রোভ টিকবে না, কারণ ভূমিক্ষয় ও জলের আন্ডারকাট এত বেশি যা এমনকি ভারী কংক্রিটের বাঁধও ধসিয়ে দেবে। এমনিতেও এগুলি প্রচণ্ড ব্যয়বহুল। এখানে ম্যানগ্রোভ ফেরাতে গেলে আগে ‘শোর লাইন কারেকশন’ করার চেষ্টা করতে হবে। বাঁশ ও গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি করা পামিয়েবল ড্যাম বা ভেদ্য বাঁধ তৈরি করে এই তটরেখায় পলি জমানো যেতে পারে। পলি সঠিকভাবে জমতে শুরু করলে ঘাস ও ম্যানগ্রোভের চারা বসতে শুরু করবে। সে সময় জমির উচ্চতা অনুযায়ী প্রজাতি নির্বাচন করে কিছু ম্যানগ্রোভ লাগানো যেতে পারে তবে হেক্টরে বড়জোর চার হাজারের বেশি নয় এবং কখনওই একই প্রজাতি নয়। এছাড়াও এসব জায়গায় চেরা বাঁশের প্রোটেকশন দিয়ে ম্যানগ্রোভ লাগালে ভাল থাকবে। এই পদ্ধতিকে রিলে এনকেস (Riley Encase) বলে। নিচে ছবি দেখলে বোঝা যাবে।[1]

৬) কোথায় ম্যানগ্রোভ গাছ লাগাতে যাব না বিষয়টা অনেকটাই কাণ্ডজ্ঞাননির্ভর। তটরেখা রক্ষার জন্য ম্যানগ্রোভ দরকার এবং তার বহু বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য আছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে কর্দমময় মোহনার তটরেখা যেখানে নদীর মিষ্টিজল সাগরে মিশছে, এক জটিল ও অনন্য বাস্তুতন্ত্র যার প্রতিটি অংশের আলাদা মূল্য আছে। তাই শুধুমাত্র ম্যানগ্রোভ নয়, এর পুরোটাই আমাদের রক্ষা করতে হবে। যেমন যেখানে নোনা ঘাস চলে এসেছে এবং উত্তল কাদার চর আছে সেখানে ম্যানগ্রোভ লাগানো চলবে না। কারণ ওখানে এমনিতেই পলি পড়ছে এবং যদি এমনই ছেড়ে রাখা যায় তাহলেই ম্যানগ্রোভ আসবে। তবে এমন চরমাত্রেই ম্যানগ্রোভ আসবে না। বুঝতে হবে প্রকৃতি ওই চরগুলি অমনই রাখতে চায় বা ওই চর ম্যানগ্রোভ সাকসেশন জোনের নিচে আছে। ওই চর বিপুল ধরনের কাঁকড়া, অঙ্গুরিমাল, কম্বোজ বা শামুক, ঝিনুক, মাডস্কিপার, চরম বিপন্নপ্রায় অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঁকড়া এবং বহু আরও প্রাণীর বসবাস। স্থলের ও হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি জমানো পরিযায়ী জলার পাখিরা এখানে ভাটায় খাওয়ার আর বিশ্রামের জন্য নামে। ফলে এই সব চরায় ম্যানগ্রোভ লাগাতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই ওখানে ম্যানগ্রোভ হয় না, আর হলে ধীরে ধীরে আপনিই হবে। এগুলিকে কোনও জাল দিয়ে ঘেরারও দরকার নেই। মুক্তই ছাড়তে হবে।

৭) ম্যানগ্রোভ বনসৃজন বা বনরক্ষা কোনও প্রতিযোগিতা নয়। তাই যেখানেসেখানে চর বা খালি জায়গা দেখলেই ম্যানগ্রোভ লাগানো হল, দেখো কত লাগিয়েছি বা লাগাতে পারি বা অনুদান সংস্থাকে কাজ দেখানো ও ছবি তোলার জন্য এটা বন্ধ হওয়া দরকার। তবে এটা নিশ্চিত এই বনসৃজন পদ্ধতির মাধ্যমে একটা বিকল্প কর্মদিবস সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেটা জরুরিও। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে বাদাবন রক্ষা ও বাদাবনসৃজনের মূল কারণ তার বাস্তুতান্ত্রিক মূল্যগুলিকে রক্ষা করা। আর তা সঠিক বনসৃজনের পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই হতে পারে। শুধু নার্সারি তৈরি নয়, ভেদ্য বাঁধ তৈরি ও রক্ষা করা, চারা রোপন, রক্ষা ও নজরদারি করার পাশাপাশি তাদের আরও বিকল্প ও সুস্থায়ী রোজগারের রাস্তা তৈরি করা একই সঙ্গে জরুরি। আর তা দেশি মৌমাছি পালন হতে পারে, দেশি ধানের চাষ হতে পারে ও সুসংবদ্ধ গ্রামীণ বিকাশের নানান কর্মসূচি হতে পারে যা ম্যানগ্রোভ বন ও তটরেখার উপর চাপ কমাবে। আর এর ফলে মানগ্রোভ রক্ষিত হয়ে তার বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য ফেরত আসবে মাছ, কাঁকড়ার উৎপাদন বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাস রোধ, ভূমিক্ষয় রোধ, পরিযায়ী পাখির আগমন এবং পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে।

জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তটরেখাগুলি এবং সুন্দরবন গভীর সঙ্কটাপন্ন। ম্যানগ্রোভ বনসৃজন বা কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ লাগিয়েই তার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবাই ভুল। এর জন্য সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং বহুমাত্রিক ভাবনা দরকার। দরকার সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন। বহু বছরের মাটির বাঁধ সুন্দরবনের মানুষ-বসবাসকারী দ্বীপগুলিকে পলি না জমতে দিয়ে নিচু করেছে। আমরা প্রাকৃতিক মিষ্টি জলের প্রবাহ নদীগুলির উপরের অংশকে নষ্ট করে ও বাঁধ দিয়ে কমিয়ে দিয়েছি। কাজেই কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ পুঁতে চললেই এই ক্ষতিপুরণ হবে না। বরঞ্চ কী পুঁতছি, কোথায় পুঁতছি আর পোঁতার পরে দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি ও বাস্তুতান্ত্রিক মূল্যগুলির কী অবস্থায় আছে বা পরিবর্তিত হচ্ছে তা যদি ক্রমাগত পর্যালোচনা করা না যায় তবে এই কাজ ফলদায়ী হবে না।

 

রেফারেন্স:


[1] পারমিয়েবল ড্যাম কী এবং তা কী করে তটরেখা রক্ষা করে এটা জানতে দেখতে পারেন: আয়লা থেকে আমফান, সুন্দরবনে কী বদলায়নি আর কী বদলানো দরকার: ইয়াসের পরে ফিরে দেখা