পরিমল ভট্টাচার্য
সমর বাগচির কাছে পরিবেশচর্চা আর মানবাধিকার আন্দোলন একটাই বৃহত্তর লড়াইয়ের অংশ। তাই তিনি যেমন ওয়েলিংটনে পরিবেশ বিরোধী সরকারি কর্মসূচির প্রতিবাদে বক্তব্য রাখছেন, ঠিক তেমনি পার্ক সার্কাসে এনআরসি-বিরোধী মিছিলে হাঁটছেন। ঊননব্বই বছর বয়সে একজন মানুষ অশক্ত শরীরে রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে পথে নামছেন, এরকম কিন্তু খুব বেশি দেখা যায় না
প্রথমেই বলতে চাই, ব্যক্তিগত পরিচয়ের বাইরে সমর বাগচির বিপুল কর্মময় জীবন নিয়ে কথা বলার সঠিক লোক আমি নই, তাঁর কাজ নিয়ে কথা বলার জন্য যোগ্যতর লোকেরা আছেন, আমি আমার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সমরবাবুকে যেমনভাবে দেখেছি, চিনেছি, বলার চেষ্টা করব।
সমর বাগচির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় টেলিফোনে, প্রায় দশ-বারো বছর আগে। উনি আমার লেখা একটি বই ‘সত্যি রূপকথা’ পড়ে আমাকে ফোন করেন, তাও সুদূর কাশ্মির থেকে৷ সম্ভবত এক বন্ধুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন। উনি আমার বইটির সম্বন্ধে ওঁর ভাললাগা জানান৷ এছাড়াও নানা বিষয়ে কথা হয়। সেই প্রথম ব্যক্তিগত পরিচয়। অবশ্য এর অনেক আগে থেকে আমি সমর বাগচি নামটির সঙ্গে পরিচিত। আমরা প্রায় সবাই জানি একসময় দূরদর্শনে সমর বাগচি এবং পার্থ ঘোষের পরিবেশনায় এক বিখ্যাত অনুষ্ঠানের কথা— কোয়েস্ট। এর আগেও, আমাদের ছোটবেলায় সাদাকালো টিভিতে আরও একটি অনুষ্ঠান করতেন তিনি, সেটির নাম অবশ্য আমার মনে নেই। ফলে সেদিন প্রথমবার ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে টেলিভিশনে ছেলেবেলায় দেখা সমর বাগচির মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।
প্রথম ফোনের পর থেকে সমরবাবুই আমাকে নিয়মিত ফোন করতেন। উনি প্রচুর পড়তেন৷ এমনকি ‘সত্যি রূপকথা’ থেকে শুরু করে কয়েকমাস আগে প্রকাশিত আমার সাম্প্রতিকতম বই ‘ফিল্ডনোটস..’-ও উনি পড়েছেন, এমনকি ওঁর বন্ধুদের উপহারও দিয়েছেন। আর এমনটি নয় যে সমরবাবু শুধু আমার বই পড়তেন বা আমাকেই এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে ফোন করতেন। উনি প্রচুর অনুজ লেখকের বইপত্র খুঁজে খুঁজে পড়তেন, বই পড়ে ভাল লাগলে লেখকদের ঠিকানা-ফোন নাম্বার খুঁজে বের করে, প্রয়োজনে প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, তারপর লেখকদের ফোন করতেন। আশি পেরিয়ে গেলে এমনিতেই একজন মানুষের নতুন বিষয় নিয়ে তেমন কোনও আগ্রহ থাকে না। সেখানে সমরবাবু নতুন লেখকের বই খুঁজে এনে পড়ছেন, তারপর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছেন, নিজের ভাললাগা জানাচ্ছেন, বিষয়টির গভীরে গিয়ে আলোচনা করছেন, এটা নিঃসন্দেহে একজন বড়মাপের ও বিরল মানুষের পরিচয়৷
সমরবাবুর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও তা মূলত টেলিফোনের মাধ্যমেই বজায় ছিল। বাদুতে আদিবাসী বাচ্চাদের নিয়ে উনি একটা স্কুল চালাতেন। সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বাচ্চাদের গল্পের মতো করে অতি সহজে বিজ্ঞানের গূঢ় কথা তিনি বুঝিয়ে দিতে পারতেন। সমরবাবুর অন্য সমস্ত পরিচয়ের পাশাপাশি ওঁর এই ক্ষমতাটা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। আসলে বিজ্ঞানবুদ্ধির পাশাপাশি ওঁর মধ্যে একটা সাহিত্যরসিক মন ছিল, তাই তিনি এই ‘স্টোরি টেলিং’-এর ওপর বিশেষ জোর দিতেন। গল্পের মতো করে একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লেখা হচ্ছে ও তা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে আকর্ষণ করছে, এই পদ্ধতিটা ওঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। কারণ উনি নিজে একজন খুব ভাল কমিউনিকেটর ছিলেন। আগেই বলেছি, ফোনে আমাদের দীর্ঘক্ষণ কথা হত। উনি নতুন কিছু লিখলে আমাকে তা মেল করতেন। সেটা পড়ে আমি আবার তাঁকে কলব্যাক করতাম। সেইসময় উনি ভবানীপুরের বাড়িতে থাকতেন। উনি ভুবনেশ্বর গেলেন কয়েকমাস আগে। তার আগে রানিকুঠিতে থাকাকালীন আমাকে ওঁর বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। তা অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি। কারণ পরে যখন আবার ওঁর কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, শুনলাম, উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
নানা গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেই উনি দারুণ সক্রিয় ছিলেন। শেষবার আমার সঙ্গে ওঁর আমার দেখা হয়েছিল কোভিড আসার ঠিক আগে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সরকারের পরিবেশ বিরোধী কর্মসূচির বিরুদ্ধে একটা জমায়েত হয়েছিল, তাতে কলকাতার নানা স্কুল-কলেজের প্রচুর ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়েছিল। আমিও আমার কলেজের ছাত্রছাত্রীদের এই জমায়েতের কথাটা বলেছিলাম। তারাও যোগ দিয়েছিল। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে মেধা পাটেকরও এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে সমরবাবু একটা ম্যাটাডোর ভ্যানের পেছন উঠে বক্তৃতা করেছিলেন। সেই সময় ওঁর শরীর যথেষ্ট অসুস্থ। বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্যানসারে ভুগছিলেন, একাধিক অপারেশনও হয়েছিল, হাসপাতালে থাকতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। তার মধ্যেও উনি যেভাবে নাগরিক পরিসরে সক্রিয় ছিলেন, ভাবা যায় না। এরকমই একজন সতেজ সপ্রাণ মানুষ ছিলেন তিনি।
সমর বাগচি ছিলেন আগাগোড়া বিজ্ঞানের মানুষ। আমি যতদূর জানি, পেশাগত পরিচয়ে সমরবাবু একজন প্রশিক্ষিত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছাড়ার পর তিনি বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামের দায়িত্ব নেন এবং সেটিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে দাঁড় করান। আমি অনেককাল আগে, সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি কলেজে পড়ার সময় বিড়লা মিউজিয়ামে গেছি, ততদিনে সমরবাবু মিউজিয়ামকে সাজিয়ে ফেলেছেন। তিনি যে বিড়লা মিউজিয়ামের ডিরেক্টর তা অবশ্য তখন আমি জানি না বা জানার কথাও নয়। তারপরেও আমার অনেক পরিচিতজন সেখানে গেছেন, মিউজিয়াম তাঁদের সকলের ভাল লেগেছে, সমরবাবু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা বিষয় সাধারণের জন্য সেখানে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এখন মনে পড়ছে, মিউজিয়ামের নিচে একটা কয়লাখনির মডেল করা ছিল, লিফটে করে নিচে নেমে সেই খনিতে ঘোরা যেত, একটা খনির ভেতরটা ঠিক কীরকম হতে পারে, কীভাবে কয়লা উত্তোলন করা হয়— তা দেখতে পাওয়া যেত। এখন মনে হচ্ছে, এই খনির মডেলটা সম্ভবত নিজে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুণ সমরবাবুই প্রথম চালু করেন। এই মুহূর্তে আরও কথা মনে পড়ছে, আমারই এক আত্মীয়ার ছেলেকে প্রতি বছর তার জন্মদিনে নিয়ম করে তাকে ওই মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে হত, সেই ছেলে আজ বড় হয়ে মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক হয়েছে, আইআইটিতে গবেষণা করছে। অর্থাৎ সমরবাবুর কর্মকাণ্ড কোথায় কীভাবে কার মনে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, তা আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়।
ফলিত বিজ্ঞান বা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রতি সমরবাবুর আগ্রহ ও কমিটমেন্ট ছিল অভূতপূর্ব। আমাদের দেশে এখনও হাতেকলমে কাজ করাকে কিছুটা নিচু চোখে দেখা হয়। কদিন আগে পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ডেমন্সট্রেটরের জন্য আলাদা পদ ছিল, যিনি থিওরি ব্যাখ্যা করতেন তিনি হাতেকলমে তা পরীক্ষা করে দেখাতেন না, সে কাজের ভার ছিল ডেমন্সট্রেটরের ওপর। অর্থাৎ অধ্যাপক শুধু লেকচার দেবেন, তিনি নিজের হাতে যন্ত্রপাতি ছুঁয়ে দেখবেন না, রাসায়নিক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না, যা করার করবেন ওই ডেমন্সট্রেটর ভদ্রলোক। এখন অবশ্য কলেজে ডেমন্সট্রেটরের পদটি উঠে গেছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের ফলিত বা এক্সপেরিমেন্টাল দিকটি সবসময় তার তাত্ত্বিক দিকটির থেকে ছোট করে দেখা হত। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রথম বিশ্বের যেকটি দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসামান্য উন্নতি করেছে, তারা সকলেই তাত্ত্বিক ও ফলিত, উভয় ক্ষেত্রকেই সমান মর্যাদা দিয়েছে। সম্প্রতি আমি এডিনবরা গেছিলাম, সেখানকার মিউজিয়ামেও গিয়েছি, ওদের বিজ্ঞানের ইতিহাস এমনিতেই অনেক পুরনো ও সমৃদ্ধ, আমি দেখছিলাম মিউজিয়ামে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ওরা অনেকটা জায়গা রেখেছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট তথা শিল্পবিপ্লবের জন্য। কোনও দেশে ওই মানের শিল্পোন্নতি সম্ভব নয়, যদি না সে দেশে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে প্রথম থেকেই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমরবাবু প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের ফলিত দিকগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান যে কতখানি আকর্ষক হতে পারে, দূরদর্শনে সমরবাবুর শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানগুলোই তার প্রমাণ। সম্ভবত পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে সাধারণ্যে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টাই তাঁর কর্মময় জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান। আমরা যদি সেসব কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে তা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে৷ কারণ এখনও আমরা বিজ্ঞানকে অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র একটা বৌদ্ধিক চর্চার মধ্যেই আটকে রাখতে চাই। সম্ভবত, আমাদের এইরকম চিন্তা ও আচরণের শিকড় রয়ে গেছে আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী উত্তরাধিকারের মধ্যে। যেমন আমার ছোটবেলা কেটেছে ভাটপাড়ায়, যা ছিল বাংলার টোল-ভিত্তিক বিদ্যাচর্চা ও সংস্কৃতশিক্ষার পীঠস্থান। আমি দেখেছি, ব্রাহ্মণ্য টোলশিক্ষায় সবচেয়ে উপরের দিকে স্থান পেত ন্যায়শাস্ত্র। যেমন এখন ধরেই নেওয়া হয় যে ভাল ছেলেরা সায়েন্স নিয়ে পড়বে, তেমনি টোলে ন্যায় পড়বে শুধুমাত্র মেধাবী ছেলেরা। আর টোলে কাব্য পড়বে যাদের মেধা তেমন নেই। অথচ কাব্য, যা খুব জরুরি, যা ভাষার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের মতো জরুরি কাজ করছে, গভীর সত্যকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির বা হীনতর ভাবা হত। আর তাই কাব্য পড়বে কম মেধাবীরা। জ্ঞানচর্চার এই বিভাজন বা হায়ারার্কির নির্মাণ আমাদের উন্নত তো করেইনি, বরং পিছিয়ে দিয়েছে। তাই মধ্যযুগের ভারত বিজ্ঞানচর্চায় প্রভূত উন্নতি করলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাবে বৌদ্ধিক চর্চা ও হাতেকলমে পরীক্ষা— এই দুইয়ের বিচ্ছেদ তার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। চিকিৎসক যিনি মানুষের শরীরের রোগব্যাধি নিয়ে গবেষণা করছেন, ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন, মৃত মানুষের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে জ্ঞানার্জনের অধিকার তার নেই। সে কাজ করলে চিকিৎসককে বর্ণচ্যুত হতে হবে, কারণ সে ঘৃণ্য কাজ শুধুমাত্র শূদ্রের জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু জ্ঞানচর্চা তখনই সম্পূর্ণ ও সার্বিক হয়ে ওঠে, যখন বৌদ্ধিক চর্চার সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান এসে মেশে। এই দুইয়ের সমন্বয় সমরবাবুর সারা জীবনের কাজের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
বিজ্ঞানের এই হায়ারার্কি নির্মাণের পাশাপাশি আমাদের মননে আরও একটি সমস্যার জায়গা আছে, তা হল জ্ঞানচর্চাকে আমরা বড় বেশি কম্পার্টমেন্টালাইজ করে তুলেছি। অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক্সের একেকটি ধারার সঙ্গে অন্য আরেকটি ধারার কোনও মুখ দেখাদেখি বা আদানপ্রদান নেই৷ যিনি বিজ্ঞানচর্চা করবেন, তিনি রাজনীতি নিয়ে ভাববেন না, তিনি সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে অসচেতন থাকবেন। আবার যিনি সমাজচর্চা করবেন, মানবাধিকার নিয়ে ভাববেন, তিনি পরিবেশ নিয়ে ভাববেন না— এমনটাই যেন দস্তুর। সংস্কৃতির এই খণ্ডন আমাদের কতবড় ক্ষতি করেছে তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এখন এই অভ্যেসটা অবশ্য খুব ধীরে হলেও বদলাচ্ছে। অথচ সমর বাগচি ছিলেন এমন একজন বিরল মানুষ, যিনি কোনওদিন জ্ঞানের এই প্রকোষ্ঠবদ্ধতায় বিশ্বাস করতেন না৷ আমরা যদি তাঁর কাজ দেখি, দেখব, তিনি বিজ্ঞান থেকে পরিবেশে যাচ্ছেন, এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক চেতনা দিয়ে পরিবেশচর্চাকে সমৃদ্ধ করছেন। পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই আছে যাদের বিজ্ঞানের বোধটা ততটা শক্তপোক্ত নয়। সেই কারণেই পরিবেশ আন্দোলনে সমর বাগচির মতো মানুষের যোগদানের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। সমর বাগচির কাছে এগুলো কিন্তু কোনও আলাদা বিষয় ছিল না, তাঁর কাছে পরিবেশচর্চা আর মানবাধিকার আন্দোলন একটাই বৃহত্তর লড়াইয়ের অংশ। তাই তিনি যেমন ওয়েলিংটনে পরিবেশ বিরোধী সরকারি কর্মসূচির প্রতিবাদে বক্তব্য রাখছেন, ঠিক তেমনি পার্ক সার্কাসে এনআরসি-বিরোধী মিছিলে হাঁটছেন। ঊননব্বই বছর বয়সে একজন মানুষ অশক্ত শরীরে রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে পথে নামছেন, এরকম কিন্তু খুব বেশি দেখা যায় না৷ কে একজন বলেছিলেন, কখনও কখনও এমন একটা সময় আসে, যখন নিজের বিশ্বাসের জায়গায় নিজের শরীরটাকেও নিয়ে যেতে হয়। সমরবাবুকে আমি ঠিক সেই কাজটাই যেন করতে দেখেছি। আর এইসব নিয়ে তিনি কোনওদিন নিজস্ব লাভক্ষতির হিসেব কষেননি। সবমিলিয়ে এক অবিস্মরণীয় মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
সমর বাগচি চলে যাওয়ার পরেও ওঁর জীবনের নানা ঘটনা আমি নতুন করে জানছি। একটা অ্যানেকডোটের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। সম্প্রতি এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম, বিড়লা মিউজিয়ামের ডিরেক্টর থাকাকালীন সমরবাবু ওখানে একটা পেট লাইব্রেরি চালু করেছিলেন৷ পেট লাইব্রেরি হল এমন একটা জায়গা যেখানে বিভিন্নরকম পশুপাখি রাখা হত। লাইব্রেরির সদস্যরা মূলত বাচ্চারা সেই লাইব্রেরি থেকে একটি পশু বা পাখিকে বাড়ি নিয়ে যেত, কিছুদিন সেটির দেখাশুনো করত, তারপর নির্দিষ্ট সময় পর প্রাণীটিকে লাইব্রেরিতে ফেরত দিয়ে যেত। সবমিলিয়ে একটা অভিনব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। এবার, একটি ছেলে লাইব্রেরি থেকে কোনও এক বিরল প্রজাতির পাখি বাড়ি নিয়ে যায়, এবং তারপর একদিন সেই বাড়ি থেকেই পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে চলে যায়৷ ছেলেটির বাবা-মা স্বভাবতই খুব লজ্জিত ও শঙ্কিত হয়ে পাখিটির খোঁজে সারা কলকাতা চষে ফেলেন, কিন্তু পাখির দেখা মেলে না। আর ওই বিরল প্রজাতির পাখি কলকাতার কোথাও কিনতেও পাওয়া গেল না। তখন ওঁরা আর কোনও উপায় না পেয়ে ছেলেটিকে নিয়ে সমরবাবুর কাছে যান এবং খুবই কুণ্ঠিত হয়ে পুরো ঘটনাটা সমরবাবুকে খুলে বলেন। ছেলেটির বাবা-মা এও বলেন যে তাঁরা হারিয়ে যাওয়ার পাখিটির জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত। অর্থাৎ এই প্রজাতির আরেকটি পাখি বাইরে থেকে আনাতে যা খরচ পড়বে তা তাঁরা দিতে রাজি। সমরবাবু কিন্তু বাচ্চা ছেলেটিকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “সত্যি করে বলো তো, পাখিটা কি নিজেই উড়ে গেছে না তুমি ওকে উড়িয়ে দিয়েছ?” ছেলেটি বাবা-মায়ের সামনে মুখ ফুটে কথা বলছিল না। সে এবার সমরবাবুকে জানায় যে সে-ই পাখিটিকে উড়িয়ে দিয়েছে কারণ খাঁচার মধ্যে থাকতে পাখিটার খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ সমরবাবু তখন ছেলেটিকে তার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন যে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দরকার নেই। বরং ওঁর এই পেট লাইব্রেরি তৈরি করার উদ্দেশ্য এতদিনে সফল হল, কারণ এই লাইব্রেরি তৈরির লক্ষ্যই ছিল বাচ্চাদের মধ্যে পশুপাখির প্রতি ভালবাসা ও সহমর্মিতা গড়ে তোলা, এই ছেলেটি সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করেছে। এরকম ছোট ছোট নানা ঘটনা আমাকে সমরবাবুর চিন্তাভাবনা, তাঁর উন্নত মনটাকে বুঝতে সাহায্য করছে।
আশ্চর্যের বিষয়, সমরবাবুর চলে যাওয়ার পরে আমার ইচ্ছে হয়েছিল একবার ইন্টারনেটে যাব, উইকিপিডিয়ায় ওঁর সম্বন্ধে সাধারণ কিছু তথ্য জেনে নেব৷ কিন্তু আমি অবাক হলাম, উইকিতে ওঁর কোনও প্রোফাইল নেই। আমাদের লজ্জা, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজ্যে চোর-ছ্যাঁচড়দের, আধা-নাটুয়া, আধা-পটুয়াদেরও উইকিপিডিয়ায় বড় বড় প্রোফাইল আছে, অথচ সমর বাগচির মতো বিরাট মাপের মানুষের নামে কোনও তথ্যভাণ্ডার নেই। বুঝতে পারি, এগুলোও হয়তো নিজের উদ্যোগে করিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু সমর বাগচি এসব করতে গিয়ে ‘সময় নষ্ট’ করার মতো মানুষ ছিলেন না৷ তাঁর সমস্ত কর্মক্ষমতা নিয়োজিত ছিল অন্য জায়গায়, তিনি জীবনের প্রায় শেষ সময় অবধি নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন, নানা কাজে নানা চর্চায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, নির্দিষ্ট পরিসরে স্পেশালাইজড হওয়ার সমস্ত গুণ, যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে আবদ্ধ রাখেননি৷ সমর বাগচি নিজের মেধাকে, নিজের আগ্রহকে, নিজের বোধিকে বিশেষায়িত হতে দেননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন নানাদিকে৷ নিজেকে বিশেষায়িত করলে তাঁর হয়তো আজ জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও খ্যাতি হতে পারত। সেটা হয়তো তিনি পেলেন না৷ কিন্তু তিনি যা করতে পারলেন, তার উত্তরাধিকার ঠিকমতো বহন করে চলাও খুব সহজ ব্যাপার হবে না। আমি জানি না, আমরা বাঙালিরা ঠিক কতদূর তাঁর উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব, আদৌ পারব কিনা, নাকি সমর বাগচি শুধুই একটা নাম হয়ে থেকে যাবেন৷ হয়তো উনি ওঁর সন্তানদের উদ্যোগে সমর বাগচি মেমোরিয়াল লেকচার হিসেবেই থেকে যাবেন… আমরা জানি না।
পরক্ষণেই আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুল ভাবছি। সমর বাগচি অনেক মনে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন। আমার সেই আত্মীয়ার ছেলেটির কথা আগেই বলেছি। এরকম নিশ্চয়ই আরও অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা কোনও না কোনওভাবে সমর বাগচির চিন্তাভাবনার দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়েছে, আলোড়িত হয়েছে। সমর বাগচি হয়তো এইভাবেই আমাদের সকলের মধ্যে চিরদিন থেকে যাবেন।
[সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত]