Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হরিয়ানায় হিংসা: বিড়ম্বিত হিন্দুত্ববাদীদের লম্বা কদম

মনসুর মণ্ডল

 


হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক বিদ্বেষ-বিভাজনের কর্মকাণ্ড ও সনাতনী ভাবধারার মাহাত্ম্য কীর্তন সত্ত্বেও ‘মুজফফরনগর’ হাতছাড়া হয়, কর্নাটকে নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটে। ফলে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে বৈরিতার ক্ষেত্র ক্রমপ্রসারিত করতে হয়। সেই জায়গা থেকে এসেছে বুলডোজার-আগ্রাসন, হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক হিংসায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ। লোকসভা ভোটের আগে এরকম আরও অনেক মুজফফরনগর, জাহাঙ্গিরপুরী বা নুহ্ ঘটানোর পরিকল্পনা আছে হিন্দুত্ববাদীদের


হরিয়ানার মেওয়াট জেলার নুহ-তে গত ৩১ জুলাই বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান হিংসার ঘটনায় শান্তিপ্রিয় মানুষের আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব। কারণ খবরে যে ভয়াবহতার ছবি উঠে এসেছে, তাতে মানুষ উদ্বিগ্ন। তার ওপর বিচলিত রাজনৈতিক দলগুলি সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্বের সপক্ষেই কথা বলেছে, তার ছাপ মানুষের মধ্যে থাকেই। এইদিক থেকে মনে হবে, এই হিংসার ঘটনা শেষ বিচারে অঘটন।

নুহতে মিছিলের আগে দুই মুসলিমের নৃশংস হত্যার মূল আসামি মনু মানেসর সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। তিনি মিছিলের নেতৃত্বে থাকবেন, এ খবর প্রচারিত ছিল। নুহতে মিছিল শুরুর আগে একটি মন্দিরের সামনে জমায়েতকে উদ্দেশ্য করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র জৈন মুসলমান বিরোধী ভাষণ দিয়েছিলেন। এবং যথেচ্ছভাবে তলোয়ার ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিল করা হয়েছিল। এ সমস্ত কিছুর পরেও হরিয়ানা সরকার ও পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার ছিল। অন্যদিকে গত ২ আগস্ট শীর্ষ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ সাংবাদিক শাহিন আবদুল্লার আবেদনের প্রেক্ষিতে হরিয়ানার হিংসা নিয়ে দ্রুত শুনানি করল এবং বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে ঘৃণা-ভাষণ বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ও হরিয়ানা সরকারকে নির্দেশ দিল।

নুহ্, গুরুগ্রাম ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসার আগেই হরিয়ানা সরকার নুহ্র পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমান বস্তিগুলি উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। সরকারের অভিযোগ, তারা সব বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। খবর, গত ৩১ আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে একটু দেরি হল। অতঃপর গত ৪ আগস্ট অভিযান শুরু করল।

হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ও মুসলমান উচ্ছেদ— দুটো ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন? যদি বিচ্ছিন্ন মনে করি, তা হলে এই সাম্প্রদায়িক হিংসায় স্রেফ সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্বের বাণীতেই আমাদের বিবেক-বাসনা সার্থক করতে হবে। নচেৎ নিহিত বাস্তবতাকে কাটাছেঁড়া করতে হবে, অনেকটা এগোতে হবে।

প্রথমে কোনও ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো, তারপর সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরত মুসলিমদের উচ্ছেদ করা— এটা উত্তর ভারতে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলমান বিরোধী কর্মকাণ্ডে বিশেষ ধরনে পরিণত হয়েছে। ১১ এপ্রিল ২০২২-এ মধ্যপ্রদেশের খারগাঁওয়ে বুলডোজার দিয়ে বহু মুসলিমের বাসস্থান ও সম্পত্তি ধ্বংস করেছিল মধ্যপ্রদেশ সরকার। অজুহাত, আগের দিন ১০ এপ্রিল রামনবমীর শোভাযাত্রায় মুসলিমরা নাকি পাথর ছুড়েছিল। একইরকম অজুহাত খাড়া করে গুজরাত ও উত্তরাখণ্ডে বুলডোজার অভিযান চালানো হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল ২০২২-এ দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রা চলাকালীন হিন্দু-মুসলমানে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০ এপ্রিল উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (বিজেপি পরিচালিত) বুলডোজার নিয়ে সেখানে মসজিদ থেকে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙতে ছুটেছিল। সবক্ষেত্রেই সরকারের যুক্তি ছিল— ওসব বেআইনি নির্মাণ। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কোনও নির্মাণ বেআইনি কিনা সে সম্পর্কে কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তার জন্য আদালত আছে।

হরিয়ানায় মুসলমান বস্তি উচ্ছেদে অভিযোগ গুরুতর। এখানে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। কিন্তু কথা হল, সত্যি যদি সেখানকার বাঙালি মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত করতে হয়, তার জন্য ফরেনার্স অ্যাক্ট আছে, পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট আছে এবং সমস্যার নিষ্পত্তির জন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আছে। এদিকটা এড়িয়ে গিয়ে সরকারের মনে হল তারা অনুপ্রবেশকারী, অমনি সিপাই-সান্ত্রি-বুলডোজার নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল— এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকার আইনের তোয়াক্কা না করে একাংশের মুসলিমদের ওপর আগ্রাসন শুরু করল ও সেই আবহে হিন্দু-মুসলমানে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল, এটা যে মুসলিমদের প্রতি বৈরী সামাজিক ও রাজনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করার পরিকল্পনার অংশ, তা বুঝতে খুব বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয় না।

বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল অভিযোগ করেছে, বিজেপি সামনের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক হিংসাকে ব্যবহার করতে চাইছে। এটা তো ঠিকই। ২০১৩-র আগস্ট-সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর জেলায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ঘটেছিল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার পুরো ফায়দা তুলেছিল। সেদিন ছিল নির্বাচনী ফায়দা ওঠানো। কিন্তু আজ স্রেফ নির্বাচন উদ্দেশ্য নয়, পরিকল্পনা প্রসারিত— একটা জনগোষ্ঠীকে দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হিসেবে দেখানো। স্বয়ং হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মুসলিমরা আক্রমণকারী এবং তারা বহিরাগত। যারা অনুপ্রবেশকারী, তারাই আক্রমণকারী— এই বিভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে মুসলমান পীড়ন ও বিতাড়নকে বৈধতা দিতে চায় হরিয়ানা সরকার। মুসলমান বিরোধী রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় রাষ্ট্রের একাংশ ও বিভেদকামী হিন্দু সংগঠন জড়িত। এভাবে মুসলমান দমন-পীড়ন থেকে হিন্দু মেরুকরণ, একটা মতাদর্শের অধীনেই এটা হওয়া সম্ভব। হিন্দুত্বের রাজনীতি এই ধারাতেই তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বিষয়টাকে এইভাবে দেখতে ও দেখাতে প্রস্তুত? যদি সেটা না পারে, তা হলে তাদের সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের “ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”। তাহলে শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, উত্তর ভারতের একটা  পরিসরে হরিয়ানার আজকের ঘটনা হিন্দু মেরুকরণের রাস্তা খুলে দেবে।

আমরা দেখেছিলাম, ২০২০ থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে সংগঠিত তিনটি কেন্দ্রীয় কৃষি আইন বিরোধী কৃষক আন্দোলনের প্রভাবের অন্যতম জায়গা ছিল হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশ। এই অঞ্চলে জাঠ সম্প্রদায় প্রায় সকলেই কৃষক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। কৃষক আন্দোলনে শীর্ষনেতৃত্বে জাঠদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ও জাঠ সম্প্রদায় প্রায় সার্বিকভাবে কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। জাঠদের সামাজিক সংগঠন খাপ সবই কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কিষাণ মহাপঞ্চায়েতগুলি সংগঠনে খাপের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল। খাপ ধর্মীয় রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে থেকে এতদিন দলিতদের ব্রাত্য করেই রেখেছিল ও মুসলিমদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলত। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে রক্ষণশীলতা লঘু হয়ে পড়ে— দলিত ও মুসলিমদের কৃষক আন্দোলনে সামিল করতে খাপগুলি সক্রিয় ভূমিকা নেয়। ২০১৩-তে মুজফফরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর সেখানে হিন্দু-মুসলমান আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ২০২১-এর ৫ সেপ্টেম্বর সেখানে দেখা গেল কিষাণ মহাপঞ্চায়েত সংগঠনে সেখানকার হিন্দু ও মুসলমান মিলে হাত লাগিয়েছে।

বিভেদ-বিদ্বেষের মৃগয়াক্ষেত্র গোটা হিন্দি বলয়ে বিভেদপন্থীদের হাতে একটাও ‘মুজফফরনগর’ থাকবে না, এটা তাদের ব্যর্থতা। ফলে অচিরেই তারা ময়দানে নেমে পড়ল। প্রাথমিক দায়িত্বটা ধর্মীয় গুরুকুলেই বর্তেছিল। ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ২০২১-এ হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্ম সংসদে দেশে মুসলমান নিকেশ করার ডাক শোনা গেল। এই রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই নুহতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে।

২০ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ অসমের দরং জেলার ধলপুর এলাকায় কুড়ি হাজার মানুষকে পুলিশ দিয়ে দমন-পীড়ন করে, বুলডোজার দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অসম সরকার বলেছিল, তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। পরে সরকারি রিপোর্টে জানা যায়, এনআরসি-তে তাদের নাম আছে। তবু তারা আক্রোশের শিকার হয়েছিল; কারণ তারা ছিল বাঙালি মুসলমান।

অসমে ছিল অনুপ্রবেশ-মুসলমান উচ্ছেদ প্রসঙ্গ। অসমের প্রেক্ষাপটে অনুপ্রবেশ ইস্যুতে বাঙালি অমুসলিম শরণার্থী ও বাঙালি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী— এই ছকটা দাঁড় করানোর তাগিদ ছিল। হরিয়ানার ক্ষেত্রে লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। এখানে সরকার বনাম মুসলমান জনগোষ্ঠী নয়, এক্ষেত্রে হিন্দু মেরুকরণের উদ্দেশ্যে সরকার সংখ্যাগুরু হিংসার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে ও অনুপ্রবেশ ইস্যুর সঙ্গে মুসলমান সমাজকে জড়িয়ে তাদের ভারত-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাওয়া হচ্ছে। হরিদ্বার ধর্ম সংসদে এই আশঙ্কার কথা শোনানো হয়েছিল যে, ভারতে যেরকম দ্রুত হারে মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে ২০২৯-এ একজন মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব নয়। সেই ধারাতেই হরিয়ানায় দেশে কাল্পনিক মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মুসলমান অনুপ্রবেশকে মিলিয়ে মুসলমান-বিরোধী হিন্দু জনমত সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো হল। নুহতে মিছিল শুরুর ঠিক আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা সুরেন্দ্র জৈন মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষারত মানুষের জমায়েতে ভাষণে মেওয়াট এলাকার চরিত্র বদলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন (মেওয়াট জেলায় জনসংখ্যার ৭৯.২০ শতাংশ মুসলমান)। কথাটা নিছক মুসলিমদের প্রতি আক্রোশবশত ও সমবেত মানুষকে উত্তেজিত করতে বলেননি, মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভীতি ছড়িয়ে তাদের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোবৃত্তিকে উস্কে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই বলেছিলেন।

হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক বিদ্বেষ-বিভাজনের কর্মকাণ্ড ও সনাতনী ভাবধারার মাহাত্ম্য কীর্তন সত্ত্বেও ‘মুজফফরনগর’ হাতছাড়া হয়, কর্নাটকের মতো নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটে। ফলে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে বৈরিতার ক্ষেত্র ক্রমপ্রসারিত করতে হয়। সেই জায়গা থেকে এসেছে বুলডোজার-আগ্রাসন, হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক হিংসায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ। লোকসভা ভোটের আগে এরকম আরও অনেক মুজফফরনগর, জাহাঙ্গিরপুরী বা নুহ্ ঘটানোর পরিকল্পনা আছে হিন্দুত্ববাদীদের। সাধারণ মানুষকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত