মানস প্রতিম দাস
শক্তিশালী এক মানুষ ছিলেন বিকাশ সিংহ যিনি জানতেন কীভাবে বিজ্ঞানের পবেষণাকে প্রসারিত করতে হয়, কীভাবে তুলে ধরতে হয় প্রতিশ্রুতিবান তরুণ গবেষককে, কীভাবে কিশোর মনকে জারিত করতে হয় বিজ্ঞান গবেষণার স্বপ্নে। মিডিয়ার সামনে বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অকপট, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান লেখায় তিনি সাবলীল। কুসংস্কারের ছায়া পড়তে দেননি বিজ্ঞানের অঙ্গনে
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ক্লাস নিতেন দীপক ঘোষ। সব জায়গাতেই মাস্টারমশাইদের নামের সংক্ষিপ্তকরণ হয়, এখানেও হয়েছিল। আমরা ডাকতাম ডিজি বলে, আড়ালে এখনও তাই ডাকি। নানা বিষয়ে আগ্রহ ছিল ডিজি স্যারের। ক্লাস করাতে এসে সংশ্লিষ্ট সময়ের ইতিহাসের কথা বেশ মজা করে বলতে পারতেন। রসবোধের অন্যান্য পরিচয়ও পেয়েছি যখন দেখলাম গান্ধি ভবনে জ্যাম (জাস্ট আ মিনিট) প্রতিযোগিতায় বিচারকদের একজন তিনি। যে প্রতিযোগিতায় শিষ্ট ভাষার প্রয়োগ প্রায় অপ্রত্যাশিত, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই যেটা এড়িয়ে চলেন, সেখানে নিবিষ্ট মনে বিচারের কাজ করতে বাধে না তাঁর। এদিকে সঙ্গীত নিয়ে নাড়াচাড়া করা পদার্থবিদদের একরকম অধিকারের মধ্যেই পড়ে, সেটা আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন বা সত্যেন্দ্রনাথ বসু এসরাজ বাজাতেন বলেই কেবল নয়। যাই হোক, ডিজি স্যার সঙ্গীত নিয়েও ভীষণভাবে আগ্রহী, মিউজিক থেরাপির বৈজ্ঞানিক ভিত্তির প্রতিষ্ঠায় তিনি একজন অগ্রণী বিজ্ঞানী। তাঁরই হাতে রূপ পেয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিভি রমন সেন্টার ফর মিউজিক অ্যান্ড ফিজিক্স’। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষপূর্তিতে এই গবেষণাকেন্দ্র নানা কাজ করেছিল। ডিজি স্যারের নিজের কথায়,
…দেড়শো বছর পূর্তিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র ‘স্যার সিভি রমন সেন্টার ফর মিউজিক অ্যান্ড ফিজিক্স’ প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র, যারা রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান লেখা নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠান, পুস্তক প্রকাশ এবং গবেষণা শুরু করে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বিস্তর উৎসাহ দিয়েছিলেন।[1]
উদ্ধৃত অংশটা বিকাশ সিংহের লেখা বই ’বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ’-এর প্রাককথন থেকে নেওয়া। এই অংশেই আরও দুটো তথ্য রয়েছে যা উল্লেখ করার মতো। যে বছর এই বই প্রকাশিত হয় সেই বছরেই বিকাশ সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন ‘টেগোর সেন্টার ফর ন্যাচারাল সায়েন্স অ্যান্ড ফিলজফি’।[2] সংবাদসূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠা হয় এই কেন্দ্রের। দুটো প্রতিষ্ঠানের মিলিত উদ্যোগ ছিল এখানে— বোস ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার ফর ন্যাচারাল সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিলজফি, কলকাতা। চারটে আলাদা গবেষণাকেন্দ্র বা ‘স্কুল’ স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল এই উদ্যোগের অধীনে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডনের কিংস কলেজের সঙ্গে টেগোর সেন্টারের সহযোগিতা গড়ে উঠবে বলে জানানো হয়। অর্থসাহায্য যা দরকার তার পুরোটাই নানা ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত। রবিঠাকুরের লেখা ‘বিশ্বপরিচয়’ অনুবাদ করা এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে সেটাকে স্থান দেওয়া তাঁদের পরিকল্পনার অন্যতম অঙ্গ বলে জানিয়েছিলেন বিকাশ সিংহ।[3]
অন্য তথ্যটা বইয়ের প্রকাশ সম্পর্কিত। ডিজি স্যার লিখেছেন,
বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ’ একদম ভিন্ন গোত্রের বই। বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ নিজস্ব ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের গভীরতম ভাবনার সাথে বিভিন্ন দর্শনের তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিত মিলিয়ে মিশিয়ে ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে অসামান্য দক্ষতায় নান্দনিক পরিবেশনে পাঠককে দিয়েছেন এক দুর্লভতম রবীন্দ্র গবেষণার দলিল, বিজ্ঞানের উপর। আমি এই বই সম্পাদনা ও প্রকাশ করার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছি অন্তরের তাগিদে— রসাস্বাদন বিতরণে বাড়বে এই প্রত্যয়ে।[4]
এভাবেই আমাদের সময়ের দুজন অগ্রণী পদার্থবিদের এক অসামান্য উদ্যোগ ধরা রইল দু মলাটের মধ্যে। বইয়ের মধ্যে কী আছে তা তো পাঠ করলেই জানা যাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের আলাপচারিতার উল্লেখ করে যে ব্যাখ্যায় পৌঁছেছেন বিকাশ সিংহ তা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। এ ব্যাখ্যাকে কে মৌলিক বলবেন আর কে সেটা বলবেন না, সে আলোচনা তোলা থাক। বার্লিনে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের আলোচনার যেমন একাধিক ভাষ্য পাওয়া যায় তেমনি তাঁদের নিজের-নিজের দর্শনের বিবৃতি নিয়ে সমর্থন-অসমর্থনের প্রাচুর্যও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বরণীয় মানুষকে স্মরণ করতে গিয়ে যে আলোচনা করা হল এতক্ষণ তাতে অন্য একটা দিকের আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ছে। সামাজিক জীবনের সরল কথাবার্তায় বিজ্ঞানীর প্রবেশ ঘটলে কেমন একটা অস্বস্তি খেলা করে আমাদের মনে। সাহিত্য বা সঙ্গীত নিয়ে বিজ্ঞানীর উচ্চারণ শুনলে সেটাও কেমন অপ্রত্যাশিত ঠেকে। রবীন্দ্রনাথের মতো গান-কবিতা উপহার দেওয়া মনীষীকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিস্তারিত আলোচনা শুনলে হয়তো মনে হয়, কতক্ষণে শেষ হবে এই পর্ব! আসলে বিজ্ঞানীকে যন্ত্রপাতি-তত্ত্ব-সূত্রের বাইরে বেরোতে দিতে চাই না আমরা। রবীন্দ্রনাথ যদি বিজ্ঞান নিয়ে ভেবেও থাকেন তাহলেও সেটা অনুচ্চারিত থাকুক— এমনি সম্ভবত আমাদের মনোগত বাসনা। কিন্তু যে বিজ্ঞানী প্রকৃতির রহস্য বুঝতে নিয়োজিত তিনি রবিঠাকুরের রহস্যভেদী দৃষ্টিকে আদর না করে থাকেন কীভাবে! তাই বিকাশ সিংহর মতো বিজ্ঞানী স্বাভাবিকভাবেই আবিষ্ট হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টির সূক্ষ্মতায়।
তাতে কখনওই ছেদ পড়ে না তাঁর রুটিন কাজকর্মে। ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারের কথা ধরা যাক। সেবার কলকাতার ‘ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার’ নিয়ে এক প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলাম। ছাপা হবে কেন্দ্রীয় স্বশাসিত সংস্থা বিজ্ঞান প্রসারের মুখপত্র Dream 2047-এ। লেখার জন্য কিছু শর্ত দেওয়া ছিল। প্রথমত প্রতিষ্ঠানের কাজের বর্ণনা দেওয়া হবে, সঙ্গে দেওয়া থাকবে সংশ্লিষ্ট মৌলিক বিজ্ঞানের নাতিদীর্ঘ ব্যাখ্যা। এরই সঙ্গে দিতে হবে অধিকর্তার সাক্ষাৎকার। বিকাশ সিংহ তখন দুটো প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হিসাবে কাজ করছেন— ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার এবং সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। আমার দায়িত্ব প্রথমটার কাজকর্ম নিয়ে খোঁজখবর করা। প্রতিষ্ঠানে চলতে থাকা নানা কাজের কথা জানলাম বিভিন্ন বিভাগের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে। এর মধ্যে একটা কাজ খুব আকর্ষণীয়। সেটা হল বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে হিলিয়াম নিষ্কাশনের উদ্ভাবনী উপায় বের করা। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উৎসাহে বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণে রেডন ও হিলিয়ামের পরিমাণ বের করার মহার্ঘ্য কাজটা করেছিলেন শ্যামাদাস চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা। সেখানকার গরম জলে হিলিয়ামের প্রকৃত শতাংশ বের করার জন্য রাজাবাজারের বিজ্ঞান কলেজে নতুন যন্ত্রও উদ্ভাবন করেন শ্যামাদাস। পরে এ সম্পর্কিত দায়িত্বভার নিয়ে নেয় পারমাণবিক শক্তি দপ্তর। বক্রেশ্বরে বসানো পরিকাঠামো ব্যবহার করে হিলিয়াম নিষ্কাশনের কাজে হাত দেন এই দপ্তরের বিজ্ঞানীরা। ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার পারমাণবিক শক্তি দপ্তরের অধীনে একটা প্রতিষ্ঠান। তাই হিলিয়াম নিষ্কাশন সংক্রান্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁদের উপর।[5]
গবেষণার কথা জানার পর্ব সেরে অধিকর্তার মুখোমুখি হলাম সাক্ষাৎকারের জন্য। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তিনি ব্যাখ্যা করলেন প্রতিষ্ঠানের শক্তির জায়গাটা। মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির মিশ্রণে কেমনভাবে কাজ করছে সাইক্লোট্রন তার উল্লেখ করলেন। এর পরের প্রশ্নটা ছিল প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা নিয়ে। বিন্দুমাত্র রাখঢাক না করে তিনি বললেন, যে মানের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ কাজ করেন এখানে তাতে আরও অনেক বেশি ভাল কাজ হওয়া উচিত ছিল। প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যে আরও কাজ করতে পারেন কিন্তু করছেন না সেটা বলতে তাঁর বাধেনি একটুও। অর্থের টানাটানি নিয়ে তৃতীয় প্রশ্নে আরও সোজাসাপ্টা তিনি। আমেরিকার সঙ্গে তুলনা টেনে বললেন, বিজ্ঞানের গবেষণায় আমাদের দেশ এত কম খরচ করলে ভবিষ্যতে ফল ভাল হবে না! এই হচ্ছেন বিকাশ সিংহ। যা মনে করতেন তা বলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না তাঁর। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে যেমন সচেতন ছিলেন তেমনই আগ্রাসী ছিলেন আরও নতুন কিছু করতে![6]
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় সাহা ইনস্টিটিউটে রাজা রমান্না স্মারক বক্তৃতার কথা। সেবার আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) ভূতপূর্ব অধিকর্তা কৃষ্ণস্বামী কস্তুরীরঙ্গন। ভারতের মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করলেন তিনি। বক্তৃতার শেষে বিকাশ সিংহর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সাহা ইনস্টিটিউট হঠাৎ কস্তুরীরঙ্গনকে আমন্ত্রণ জানাতে গেল কেন? মহাকাশ গবেষণা নিয়ে কি কোনও পরিকল্পনা আছে তাঁদের? উত্তরটা ছিল শোনার মতো। বাংলায় বসে মেঘনাদ সাহা আয়োনাইজেশনের সূত্র আবিষ্কার করলেন, পৃথিবীতে নিয়ে এলেন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের পরিমাণগত (কোয়ান্টিটেটিভ) ধারণা। অথচ আজকের পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে কোনও গবেষণার কেন্দ্র নেই। তাই নিজের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একটা অ্যাস্ট্রোপার্টিকল রিসার্চ সেন্টার গড়ে তুলবেন তিনি, এই ছিল বিকাশ সিংহর প্রতিজ্ঞা। কতটা সফল হতে পেরেছিলেন তিনি তা নিয়ে বিশ্লেষণে যাব না কিন্তু এ কথাটা স্পষ্ট করে বলে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের প্রতি একটা বঞ্চনার ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন তিনি।[7] ইসরোর কোনও শাখা গবেষণাকেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে না থাকা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের। যেখানে এত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তৈরি হয় সেখানে কেন থাকবে না একটা অ্যাস্ট্রোপার্টিকল রিসার্চ সেন্টার? নিজের ভাবনা ব্যক্ত করতে কখনও কেউ বিকাশ সিংহকে ইতস্তত করতে দেখেছেন কিনা জানা নেই। কোনও রাজনৈতিক মতের কাছে মাথা নোয়াতেন না তিনি, কাজ করতেন নিজের আত্মবিশ্বাসে ভর করে। এই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক।
২০১০ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হওয়ার পরেও আকাশবাণীর পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎকার। কথাপ্রসঙ্গে তিনি এনেছিলেন তাঁর নিজের গবেষণার প্রয়োগের দিক। সাধারণভাবে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যান। অনেকেই বলেন, এ সব গবেষণা থেকে চটজলদি ফলাফল আশা করা বৃথা। মানুষের কাজে সরাসরি লাগতে হলে অপেক্ষা করতে হবে বহু বছর। কিন্তু বিকাশ সিংহ এখানেও আচরণে ভিন্ন। তিনি জোর দেন ঠাকুরপুকুরে ক্যান্সার সেন্টার ওয়েলফেয়ার হোমের সঙ্গে সহযোগিতায় রিজিওনাল রেডিয়েশন মেডিসিন সেন্টার গড়ে তোলার উপর। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ-চিকিৎসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে এই কেন্দ্র।[8]
তবে বিকাশ সিংহর সঙ্গে আমার আলাপের আখ্যান শেষ হবে না যদি না আকাশবাণী কলকাতার এফএম চ্যানেলে লাইভ, ফোন-ইন অনুষ্ঠানের কথা না বলি। সেটা সত্যিই এক কাহিনি। ১৯৯৯ সালে অনেক সাহসে বুক বেঁধে শুরু করি ‘বিজ্ঞান রসিকের দরবারে’। পাক্ষিক অনুষ্ঠান, মাসের দুটো শুক্রবার রাত দশটা থেকে বারোটা শোনা যেত এই পরিবেশন। প্রথমদিকে শ্রোতাদের মধ্যে থেকে ততটা সাড়া না পেলেও মাস ছয়েকের মধ্যেই দেখা গেল নাটক-গানের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে বিজ্ঞানের এই অনুষ্ঠান। যাকে বলে, ব্যতিক্রমী ব্যাপারস্যাপার। শ্রোতাদের চাহিদা বুঝে বাড়াতে হল বৈচিত্র্যের সম্ভার। চেষ্টা করতে হল বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের স্টুডিওতে নিয়ে আসার। এই ব্যাপারটা কতটা কঠিন তা বোঝানো যাবে না। সেমিনারে, কনফারেন্সে বিজ্ঞানীরা গণমাধ্যমের জন্য কিছু বলেন ঠিকই, কখনও এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারও দেন কাগজ বা টেলিভিশনের জন্য। কিন্তু রাত দশটা থেকে দু ঘন্টা তাঁদের বেতারের স্টুডিওতে বসতে বলা মানে যেচে তাচ্ছিল্য ডেকে আনা। অনেকেই মন্তব্য করতেন, ‘কে রাত জেগে শোনে মশাই আপনাদের এইসব অনুষ্ঠান?’ মন্তব্যকারীকে কে বোঝাবে যে অনেকেই রাতে জাগেন, কাজের জন্য বা বিনোদনের প্রয়োজনে! রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার সুবোধ রুটিন যে সবার নয় তা উল্লেখ করতে পারতাম না!
সে যাই হোক, সবকিছু মেনে নিয়েই হাত বাড়ালাম অসম্ভবের দিকে। অনুষ্ঠানে পেতে চাইলাম বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহকে। প্রস্তাব শুনে তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত অট্টহাস্য শোনালেন, বুঝিয়ে দিলেন এ ব্যাপারে সায় দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু অবশেষে জয় হল আমাদের জেদের। আবদারে সাড়া না দিয়ে পারলেন না তিনি। অনুষ্ঠানের দিন সকালে তিনি ফিরেছেন বিদেশ থেকে, রাতে এলেন আকাশবাণীর স্টুডিওতে। সঙ্গে দুজন গবেষক ছাত্র। আমি বেশ টেনশনে আছি। আমার প্রশ্ন ওনার পছন্দ হবে তো? যান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠিকঠাক কাজ করবে তো? কথার ফাঁকে গান বাজালে, সে গান ভাল লাগবে তো তাঁর? লাইভ অনুষ্ঠানে ফোন এলে কেমনভাবে নেবেন তিনি? মনের এই সব আলো-আঁধারি নিয়েই শুরু করলাম, প্রশ্নোত্তরে এগোতে লাগল অনুষ্ঠান। কথায়-কথায় এল তাঁর ছোটবেলার প্রসঙ্গ। এল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার কাহিনি।
এরপর প্রথম ফোন। মনে খুব আশা ছিল, প্রশ্নটা কোনওভাবে বিজ্ঞানকে ছুঁয়ে থাকবে। বিকাশ সিংহ নামটা অন্তত জানা থাকবে কলারের। কিন্তু কোথায় কী! ‘ভগবানের অস্তিত্ব স্বীকার করেন আপনি? বিজ্ঞানের সঙ্গে ভগবানের….’, যা প্রাণে চায় আর কী! ফোনে ঢুকে পড়ার প্রতিযোগিতা শ্রোতাদের মধ্যে। নাটক, গান ইত্যাদি নিয়ে তো কথাই নেই, অন্য যে কোনও বিষয়েও প্রত্যেকে বিশেষভাবে জ্ঞানী। বুঝলাম, ইনি সেইরকম স্থায়ী কলার। কিন্তু বিজ্ঞানটা তো আর ওইরকম পাড়া-কালেকশনে হয় না। তাই শতবার হয়ে যাওয়া পপুলার বিতর্ক! বিকাশবাবু অবশ্য সহজভাবেই নিলেন ব্যাপারটা। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন।
পরের ফোন। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা পথ দেখিয়েছেন। সেই পথেই আবার, ঈশ্বর ও বিজ্ঞান! কী করি এবার? নিয়ন্ত্রণ কিঞ্চিৎ বাড়াতে হল। কথার মোড় ঘুরিয়ে আনলাম বিজ্ঞানের কাহিনিতে। কণা পদার্থবিজ্ঞান, কসমোলজি, হাই এনার্জি ফিজিক্স যতটা বোঝার মতো করে বলা যায় তা বলা হল। বিজ্ঞানীরা সাধারণত নিজের স্পেশালাইজেশনের বাইরে কিছু বলতে চান না। তবু অনুরোধ করে প্রাথমিক কিছু কথা বলানো গেল। কিছু পরে অবশ্য দু-একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আসতে থাকল ফোনে, তাঁর ছাত্রদের ফোনও পেলাম। যেসব স্কুলে বা কলেজে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি সেখানকার শিক্ষক বা ছাত্রদের দু-একজনও এলেন ফোনে। এই সবকিছুর সঙ্গে ঈশ্বর-বিজ্ঞান কিন্তু মিশে থাকছেই। যাই হোক, মিলেমিশে জমে গেল বিজ্ঞানের আড্ডাটা। বিকাশবাবু সঙ্গীতরসিকও বটে। কিছুটা আলোচনা করলেন তাঁর পছন্দের সঙ্গীত নিয়ে। ভাল গান বাজালে বলে উঠলেন ‘বাহ্’!
এভাবে দু ঘন্টা পর শেষ হল অনুষ্ঠান। বিকাশবাবু বিরক্ত হননি। নিজের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে বিদায়ের সময় বললেন— বেশ উপভোগ করলাম অনুষ্ঠান! আজ যখন ফিরে তাকাতে চাই এই অনুষ্ঠানের দিকে তখন বেশ একটা আহ্লাদ বোধ হয়। কিছুদিন আগে পুরনো ইমেল ঘাঁটছিলাম। দেখলাম একটা মেলে এই অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে। ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে সায়ন্তন লিখেছেন, ‘I still remember Dr Bikash Sinha as one of your guests talking about popularizing physics at the school level.’ খেয়াল রাখতে হবে যে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহকে নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান হয়েছিল একুশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে। সেই সময় শ্রোতা নিশ্চয়ই স্কুলের ছাত্র! পনেরো-ষোলো বছর পরেও গবেষক সায়ন্তনের মনে সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতি উজ্জ্বল। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় পাওয়া!
বিকাশ সিংহের কাছাকাছি থাকার আর একটা উদাহরণ ভাগ করে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারব না। সেটা ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মেইন ক্যাম্পাসে আয়োজিত হয়েছিল দীপ্তা মেমোরিয়াল সিম্পোজিয়াম। তারই অঙ্গ ছিল এক প্যানেল ডিসকাশন। অধিকর্তা শিবাজি রাহার আগ্রহে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মাঝে কীভাবে যেন বিজ্ঞান-সাংবাদিক হিসাবে ঢুকে পড়লাম আমিও। আর কী আশ্চর্য, আমার বসার স্থান বিকাশ সিংহের ঠিক পাশেই। সে বছরের মার্চ মাসে জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে গিয়েছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। বিষিয়ে গিয়েছে আশেপাশের বায়ু-জল-মাটি। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্যানেল ডিসকাশনের বিষয়ও ছিল ফুকুশিমা। সেদিন আলোচনা রূপ নিয়েছিল বিতর্কের এবং বিকাশ সিংহ ছিলেন আমার বিরোধী শিবিরে। কিন্তু তিনি যে পক্ষেই থাকুন, তাঁর পাশে বসে কিছু বলতে পারার আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি! সেও এক অসামান্য স্মৃতি।[9]
তাঁর সম্পর্কে কথা বলা শেষ করি কীভাবে? ভিড় করে আসে আরও কত টুকরো ঘটনা। তাঁর চলার ভঙ্গি, তাঁর ভারী কন্ঠ, তাঁর হাসি সবকিছুই ঘিরে ধরছে। শক্তিশালী এক মানুষ বিকাশ সিংহ যিনি জানতেন কীভাবে বিজ্ঞানের পবেষণাকে প্রসারিত করতে হয়, কীভাবে তুলে ধরতে হয় প্রতিশ্রুতিবান তরুণ গবেষককে, কীভাবে কিশোর মনকে জারিত করতে হয় বিজ্ঞান গবেষণার স্বপ্নে। মিডিয়ার সামনে বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অকপট, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান লেখায় তিনি সাবলীল। কুসংস্কারের ছায়া পড়তে দেননি বিজ্ঞানের অঙ্গনে। বিজ্ঞানের এমন এক দূতকে হারিয়ে সত্যিই অনেকটা দরিদ্র হলাম। তাঁকে মনে পড়বে, বারবার ফিরে আসবেন তিনি, উঁকি দেবেন স্মৃতির কুঠুরি থেকে। এটা আমার জন্য যেমন সত্যি তেমনই সত্যি আরও বহু মানুষের জন্য।
[1] সিংহ, বিকাশ। বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ। দীপা পাবলিকেশনস। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩। প্রাক কথন।
[2] পূর্বোক্ত।
[3] Kolkata to Get Hub on Tagore. Indiatimes. Updated on Jun 12, 2013.
[4] দ্রষ্টব্য টীকা ১।
[5] Dream 2047, V0l. 6. August 2004. এবং Roy, Amit & Chatterjee, Shyamadas. Experimenter Par Excellence! RESONANCE. September 2015.
[6] Dream 2047, V0l. 6. August 2004.
[7] রাজা রমান্না স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিভাগের জন্য সাক্ষাৎকার।
[8] ২০১০ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হওয়ার পরে আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিভাগকে দেওয়া সাক্ষাৎকার।
[9] Bose Institute News, A Newsletter of Bose Institute, May & November 2011.