শৌভিক ঘোষ
দেশের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হলে বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজনীয় পরিবেশ শুধু কিছু সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৈরি হতে পারে না। খরচ কম হল কিনা, ভারত প্রথম, দ্বিতীয় না চতুর্থ স্থানে রইল, এসবের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল মিশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সাফল্য এবং এই সাফল্যের ফলে ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঞ্চিত বিপুল অভিজ্ঞতা। সব ঠিক চললে আমরা যে তথ্য পাব সেগুলো আমাদের ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানগুলোর সহায়ক হবে
চন্দ্রযান বা এই ধরনের কোনও কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখার সমস্যা অনেক। প্রথমত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার এত ছোট-বড় শাখা এই ধরনের ‘মিশন’-এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যে পুরোটার খবর ঠিক ঠিক রাখা একজন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সাধারণ মানুষের বোঝার মতো করে অল্প পরিসরে সেই বিবরণী রাখা আরও কঠিন। আবার এইধরনের বিষয়ে সাধারণ মানুষের একটা স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে সে-কথাও তো সত্যি। তাই মোটের ওপর গত ২৩ আগস্ট, ২০২৩-এ যে ইতিহাস আমরা অনেকেই রচিত হতে দেখলাম, অল্পকথায় তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা দিক যতটা সহজ করে বলা যায় সেই চেষ্টাই করব।
চন্দ্রযান বেশ পুরনো প্রজেক্ট। ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি চন্দ্রযান ১-এর কথা ঘোষণা করেন। ২০০৮-এর ২২ অক্টোবর রওনা দিয়ে নভেম্বরে প্রথম চন্দ্রযান চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছয়। তার একটা অংশ, অর্বাইটর (Orbitor), চাঁদের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে এবং আরেকটি অংশ ইম্প্যাকটর (impactor) বিচ্ছিন্ন হয়ে চাঁদের ওপর নামে। নামা বলতে, নেহাতই আছড়ে পড়ার পরিকল্পনা। এই ইমপ্যাক্টর অংশটি কাজ করে চাঁদের জমির সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার আগে পর্যন্ত। চাঁদের মাটির অনেকটা কাছাকাছি পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই ইমপ্যাক্টর দেয়, এমনকি চাঁদে জমাট বরফের স্তরের হদিশ পর্যন্ত। তাছাড়া এই পরিকল্পিত সংঘর্ষের ফলে ধুলোমাটি ওড়ে, চাঁদের অভিকর্ষ কম বলে এইসব ধূলিকণা অনেক দূর পর্যন্ত উঠে আসে, সেখান থেকেও অর্বাইটর তথ্য সংগ্রহ করে।
এরপর ২০০৮-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ চন্দ্রযান-২ প্রজেক্ট ঘোষণা করেন। লক্ষ্য ছিল একটা অংশকে (এই অংশের নাম ল্যান্ডার— lander) ধীরে ধীরে সংঘর্ষ না ঘটিয়ে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করানো। এই ব্যাপারটাকেই ‘সফট ল্যান্ডিং’ (soft landing) বলা হয়। সঙ্গে এবারের মতোই ছিল একটি দূরনিয়ন্ত্রিত ও চাঁদে চলাফেরা করতে পারে এমন একটি গাড়ি যার পোশাকি নাম রোভার (Rover)। রাশিয়া ভারতকে ঠিক সময় চাঁদে অবতরণযোগ্য ‘ল্যান্ডার’ দিয়ে উঠতে না পারায় পরিকল্পনামতো ২০১৩-তে চন্দ্রযান চাঁদে রওনা হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ভারতেই ল্যান্ডার তৈরি হয় এবং ২০১৯-এর ২২ জুলাই চন্দ্রযান-২ চাঁদে রওনা হয়। চন্দ্রযান-২-এর অর্বাইটর সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে স্থাপিত হলেও শেষপর্যন্ত ল্যান্ডার চাঁদের মাটিতে সফট ল্যান্ডিং করতে পারেনি। প্রসঙ্গত বলে রাখা যেতে পারে চন্দ্র-অভিযানে এরকম বিপর্যয় নতুন কিছু নয়, আজ পর্যন্ত যত অভিযান হয়েছে তার একটা অংশ পুরো বা আংশিক ব্যর্থ হয়েছে। ২৩ আগস্ট যে চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি ছুঁল ২০১৯-এ সেই প্রজেক্টের সূচনা।
চন্দ্রযান ৩-এর তিনটে আলাদা আলাদা গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে:
- প্রোপালশন ইউনিট— একটা বাক্সমতন অংশ। এর মূল কাজ হল বাকি অংশগুলোকে চাঁদের ওপর ১০০ কিমি উচ্চতায় একটা কক্ষপথে স্থাপিত করা।
- ল্যান্ডার— যার মূল কাজ হল চাঁদের মাটিতে বিনা সংঘর্ষে নেমে আসা (সফট ল্যান্ডিং)। এটিও একটি বাক্সের মতো অংশ যার মাটিতে নামার জন্য যার চারটে পায়া আছে। ল্যান্ডারটির নাম বিক্রম।
- এছাড়া রয়েছে প্রজ্ঞান নামের একটি ছ-চাকার গাড়ি (rover)। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে মোটামুটি আড়াই ফুট ও এক ফুট এই গাড়ি চাঁদের অসমতল মাটিতে চলাফেরা করার জন্য তৈরি।
চন্দ্রযান-২-এর অর্বাইটর যে ছবি পাঠায়, তা থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ৪ কিমি দৈর্ঘ্য ও ২.৪ কিমি প্রস্থের একটা প্রায় সমতল অংশ চন্দ্রযান-৩-এর অবতরণের জন্য চিহ্নিত করা হয়। চাঁদের এই দক্ষিণ মেরু সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে এক গভীর কৌতূহলের বিষয়। এখানে এমন গভীর খাদ আছে যেখানে সূর্যালোক পৌঁছয় না কখনও। তাই জমাট বাঁধা বরফের যে ভাণ্ডার এই অংশে আছে, চাঁদের আর কোথাও তেমন নেই। চাঁদের এই অঞ্চলে চন্দ্রযান-৩-ই প্রথম রোভার অভিযান।
চন্দ্রযান-৩-এর তিনটি আলাদা আলাদা অংশে আলাদা আলাদা পরীক্ষার জন্য বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিক্রমে রয়েছে তিনটি যন্ত্র। ChaSTE যা দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠের ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা ও তাপ পরিবাহিতা মাপা হবে। ILSA যা চাঁদের সিসমিক অ্যাক্টিভিটি অর্থাৎ চন্দ্রপৃষ্ঠের কম্পন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে, এবং একটি ল্যাংম্যুর প্রোব (Langmuir Probe) যা চন্দ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি প্লাজমা প্রবাহ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে। প্রজ্ঞান-এ রয়েছে দুটি যন্ত্র। প্রথম যন্ত্র একটি আলফা কণা ও এক্স রশ্মি স্পেকট্রোমিটার (APXS)। বায়ুমণ্ডল এবং চৌম্বকক্ষেত্রে অনুপস্থিতির জন্য এই ধরনের উচ্চশক্তির রশ্মি (বা কণাপ্রবাহ) সহজেই চাঁদের পৃষ্ঠে এসে পড়ে এবং পাথর, মাটি থেকে বিচ্ছুরিত হয়। এই বিচ্ছুরণ-বর্ণালী বিশ্লেষণ করে এই যন্ত্রটি চাঁদের মাটি ও পাথরের রাসায়নিক এবং ধাতব গঠন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে। অন্য যন্ত্রের নাম LIBS. LIBS একটি স্পেকট্রোমিটার যার কাজ আশপাশের অঞ্চলের চাঁদের মাটিতে নানা মৌলের সন্ধান। এ ছাড়াও প্রপালশন মডিউলে আছে আরেকটি যন্ত্র— SHAPE। এর কাজ খুব মজার। সহজ কথায় চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে নজর দিয়ে এই যন্ত্র উন্নত প্রাণীর বসবাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে পৃথিবীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনও বসবাসযোগ্য গ্রহ খুঁজতে সুবিধে হয়। এছাড়া ওর ক্যামেরা সহ পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগস্থাপন, উচ্চতা ও গতিবেগ নির্ণয়, ইত্যাদির জন্য আরও অনেক ছোট ছোট যন্ত্র ল্যান্ডারে ও রোভারে রয়েছে। চন্দ্রযান-২-এর অর্বাইটর এখনও ক্রিয়াশীল বলে এবারের অভিযানে আলাদা করে কোনও অর্বাইটর রাখা হয়নি। ইতিমধ্যেই চন্দ্রযান-২ অর্বাইটরের সঙ্গে চন্দ্রযান-৩-এর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
প্রযুক্তিগতভাবে এই সফট ল্যান্ডিং-এর কাজটা বেশ জটিল। বায়ুমণ্ডল না থাকায় চাঁদে অবতরণের সময় বায়ুর বাধাও থাকে না। কাজেই কক্ষপথে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকা ল্যান্ডারের অনুভূমিক ও উল্লম্ব দুরকম গতিকেই বিপরীতমুখী রকেটের সাহায্যে ক্রমশ কমিয়ে আনতে হয়। সোজাসুজি নেমে আসাও সম্ভব নয়, কারণ তাতে ল্যান্ডার বেসামাল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। কাজেই গতি কমানোর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ল্যান্ডারকে ঘুরিয়ে যতটা সম্ভব উল্লম্ব করে নামিয়ে আনতে হয়। তাতেও মাটি ছোঁয়ার সময় যে সামান্য গতি থাকে তার জাড্যেও ল্যান্ডার উল্টে যেতে পারে। তাই অবতরণ করতে হয় এক বিশেষ কৌণিক প্রক্রিয়ায় যাতে সেই জাড্য ল্যান্ডারকে ঠিকমতো দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে, চন্দ্রপৃষ্ঠ পৃথিবীর তুলনায় অনেক অসমতল। আবার উলম্বের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট কোণ পর্যন্ত ল্যান্ডারকে দাঁড় করালে তবেই সেখান থেকে রোভার বেরিয়ে আসতে পারবে। এই গোটা প্রক্রিয়াটা পৃথিবী থেকে একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে করতে হয়, যদিও পৃথিবী থেকে চাঁদে সিগন্যাল পৌঁছতেই মিনিট তিনেক সময় লেগে যায়। একরকম নির্দিষ্ট ক্রমে ও ছন্দে সবকটা ধাপ পেরোতে পারলে তবেই সফল অবতরণ সম্ভব। এই পুরো ব্যাপারটাই আমরা সম্প্রচারে দেখতে পেয়েছি, এমনকি ল্যান্ডারের লেজারনির্ভর বেগ মাপার যন্ত্র থেকে গতিগুলোও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠছিল। শুধু এই সফল সফট ল্যান্ডিং-এর পেছনেই বহু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের অনেকদিনের পরিশ্রম জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে খুঁটিনাটি অনেক প্রযুক্তির একটা সামগ্রিক অর্কেস্ট্রা।
দুৰ্ভাগ্যবশত ভারতে পপুলার বিজ্ঞানচর্চা তেমন প্রচলিত নয়। সবার হাতে পৌঁছনোর মতো বিজ্ঞানপত্রিকা খুব একটা নেই। মূলধারার খবরের কাগজ বা খবরের চ্যানেলগুলো নিয়মিত ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে না। চন্দ্র-অভিযান জাতীয় বড় ঘটনা চ্যানেলে চ্যানেলে উঠে আসে, প্রথম পাতায় জায়গা করে নেয়, কিন্তু বিজ্ঞানের খবর পরিবেশনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পরিকাঠামো না থাকায় সাধারণত সাময়িক একটা উচ্ছ্বাস ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। মূল জায়গা থেকে দৃষ্টি সরে যায়। যেমন, বারবার খুব কম খরচে (৬১৫ কোটি টাকা মতো) অভিযানটি করা হয়েছে বলে একধরনের শ্লাঘা সর্বত্র চোখে পড়ছে। এই ধরনের প্রজেক্ট একটি আরেকটির থেকে অনেক সময়েই এত আলাদা হয় যে এককথায় সস্তা বলা ঠিক নয়। একথা সত্যি যে কিছুদিন আগে রাশিয়ার যে মিশনটি চাঁদে যান অবতরণ করাতে ব্যর্থ হল তাতে খরচ হয়েছিল চন্দ্রযান-৩-এর প্রায় তিনগুণ টাকা। কিন্তু বুঝে নিতে হবে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে চন্দ্রযান-৩ অনেক অন্য মিশনের তুলনায় আলাদা। যেমন চাঁদে পৌঁছতে চন্দ্রযান-৩-এর প্রায় চল্লিশ দিন সময় লাগে, যেখানে বহুবছর আগে আমেরিকার অ্যাপোলো মিশন তিন দিন সময় নিয়েছিল। কেন এত সময় লাগল? চন্দ্রযান-৩-কে যে LVM-III রকেট বহন করে নিয়ে যায় তা অনেক কম শক্তির, তাই সরাসরি সেটি পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে পারে না। প্রাথমিকভাবে চন্দ্রযান-৩-কে পৃথিবীর একটি কক্ষপথে স্থাপন করার পর পর্যায়ক্রমে আরও বড় কক্ষপথে তার স্থাপনা হয় এবং শেষপর্যন্ত তা চাঁদের একটি কক্ষপথে গিয়ে পৌঁছয়। এবার উল্টোরাস্তায় পর্যায়ক্রমে তাকে ছোট থেকে আরও ছোট কক্ষপথে স্থাপনা করে চাঁদের খুব কাছে নিয়ে আসা হয়। এই পদ্ধতিতে শক্তি ও খরচ যেমন কমে তেমনি সময় লাগে অনেক বেশি। কাজেই এই পদ্ধতি চাঁদে মানুষ পাঠানোর উপযুক্ত নয়। এমনিতেই সময় যত বেশি লাগে মাঝে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে— যেমন হয়তো সৌরঝড়ে যোগাযোগ বিপর্যস্ত হল। আবার বিক্রম ও প্রজ্ঞান মোটামুটিভাবে দু-সপ্তাহ কর্মক্ষম থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। মূলত সৌরশক্তিতে চালিত এই যন্ত্রগুলি চোদ্দদিন পর চাঁদের ওই অংশে যখন রাত নামবে তখন মাইনাস ২০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রবল ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে না। রাশিয়ার প্রজেক্ট সফল হলে তা হাজার দিন কর্মক্ষম থাকত। ফলে তুলনা তখনই করা যায় যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে দুটো আলাদা প্রজেক্ট সমতুল্য।
বিজ্ঞান গবেষণা একটা দীর্ঘমেয়াদি নিরবচ্ছিন্ন ব্যাপার। অনেক সময় খুব বড় ঘটনা ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই বহু মানুষের সহজে নজরে পড়ে, কিন্তু একটা দেশের বিজ্ঞানচর্চা শুধু কয়েকটা বিচ্ছিন্ন বড় ঘটনা দিয়ে এগোয় না। চন্দ্রযান-৩ নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা, কিন্তু বিজ্ঞানের ঘটনাকে যতটা সম্ভব বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়েই দেখতে হবে। চাঁদে রোভার অভিযান কোনও নতুন ঘটনা নয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেই প্রথম রোভার অভিযান রাশিয়া করেছে। তারপর থেকে আমেরিকা, রাশিয়া ও চিন অনেকগুলি রোভার অভিযান করেছে যার কিছু ক্ষেত্রে রোভারটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়েও আনা গিয়েছে। একাধিকবার আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাতে পেরেছে। এইসব দেশের তুলনায় ভারতের রকেটপ্রযুক্তি অনেকটাই দুর্বল, এমনকি অনেক বেসরকারি কোম্পানিও ভারতের চাইতে অনেক শক্তিশালী রকেট বানাতে সক্ষম। কাজেই প্রশংসনীয় হলেও কম খরচ আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চায়, এমনকি সার্বিকভাবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে ভারতের বিনিয়োগ পর্যাপ্ত নয় কোনওদিক থেকেই। বিশেষত বিজ্ঞানচর্চার প্রায়োগিক দিকটা ভারতে বরাবর উপেক্ষিত হয়েছে। বিজ্ঞান গবেষণা সাধারণের মাঝে এত কম আলোচিত হয় যে অনেকেই জানেন না যে ইসরো ঠিক মহাকাশ গবেষণার জন্য তৈরি হয়নি। বহুদিন পর্যন্ত এই সংস্থার প্রধান দায়িত্ব ছিল উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি এবং জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ ও পৃথিবীর কক্ষপথে তার প্রতিস্থাপন। সেই কারণেই খুব শক্তিশালী রকেট নির্মাণে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। একইভাবে ভারতের অন্যান্য নানা গবেষণাকেন্দ্র, আইআইটি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের গবেষণা হয় তাও সাধারণ মানুষ তেমন জানেন না। এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খানিকটা স্পষ্ট না হলে বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজনীয় পরিবেশ শুধু কিছু সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৈরি হতে পারে না। খরচ কম হল কিনা, ভারত প্রথম, দ্বিতীয় না চতুর্থ স্থানে রইল, এসবের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল মিশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সাফল্য এবং এই সাফল্যের ফলে ইসরো বিজ্ঞানীদের সঞ্চিত বিপুল অভিজ্ঞতা। তাছাড়া সব ঠিক চললে আমরা যে তথ্য পাব সেগুলো আমাদের ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানগুলোর সহায়ক হবে। যেমন চাঁদের আবহাওয়া ও মাটি সম্পর্কে যত নিখুঁতভাবে আমরা জানতে পারব তত ভবিষ্যতে চাঁদে স্পেসস্টেশন, এমনকি মানুষের বাসযোগ্য কলোনি বানানোর সম্ভাবনা বাড়বে। চাঁদের এই অংশে জমে থাকা জলের কথা আমরা জানি, আরও তথ্য ভবিষ্যতে আরও দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য চাঁদকে ব্যবহার করা বা এই জলকে বিশ্লেষণ করে দূরে পাড়ি দেওয়ার জ্বালানি তৈরি করে নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। এই পুরু জলের আস্তরণ ভেদ করে ক্ষতিকর রশ্মিগুলো বেশিদূর যেতে পারে না, তাই এই পুরু জলের স্তরের নিচে স্পেসস্টেশন তৈরির কল্পনাও অমূলক নয়। তবে এসবের প্রায় সবই অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং হতেই পারে এগুলোর সবগুলো, এমনকি কোনওটাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হল না। তা সত্ত্বেও এমনকি একটা ব্যর্থ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পও যেখানে পরবর্তী প্রকল্পের সাফল্যের রাস্তা খুলে দেয়, একধাপ এগিয়ে দেয় সমকালীন প্রযুক্তিকে, খুলে দেয় নতুন সম্ভাবনার জানলা, সেখানে এই সাফল্য যে ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করবে তাতে সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের একটা আর্থসামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক দিক আছে। এই সাফল্যের ফলে মহাকাশ গবেষণায় বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগের সম্ভাবনা যেমন বাড়ল তেমনি ইসরো-র গ্রহণযোগ্যতা নতুন মাত্রা পেল। কৃত্রিম উপগ্রহ উত্তোলনে নানা দেশকে ইসরো লঞ্চার ভাড়া দিয়ে থাকে, সে-বাবদ বিদেশি মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা বাড়ল। ২৩ আগস্ট যে ইতিহাস তৈরি হল আশা করা যায় শুধু ইসরো নয় ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার সমগ্র পরিসর তার সুফল পাবে।
তথ্যসূত্র ও আরও জানার সুযোগ:
- উইকিপিডিয়াতে সহজ করে চন্দ্রযান সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা আছে।
- ইসরো-র নিজস্ব ওয়েবসাইটে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
- দূরদর্শন বাংলায় এখনও পর্যন্ত দুই পর্বে চন্দ্রযান-৩ নিয়ে খুব বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে যার রেকর্ডিং ইউটিউবে পাওয়া যাবে।
*মতামত ব্যক্তিগত