মনসুর মণ্ডল
একথা বলা যায় না যে, মুজফফরনগরের সাম্প্রদায়িক বৈরিতার কারণেই ছাত্রপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মূল রয়েছে অন্যত্র। ইসলামোফোবিয়া দিনে দিনে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার ও পরিবেশে মননে বাসা বেঁধেছে। এটা সূক্ষ্ম ও বদ্ধমূল। সেখানে মুজফফরনগরের সাম্প্রদায়িক বিভেদের বাতাবরণ ছাত্রপীড়নে ইন্ধন জুগিয়েছে
কদিন আগে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর জেলার খুববাপুর গ্রামে পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা তৃপ্তা ত্যাগী দ্বিতীয় শ্রেণির এক মুসলিম ছাত্রকে শাস্তি দেওয়ার ছলে তার ধর্মীয় পরিচিতিকে হেয় করার চেষ্টা করলেন। এই ভেদবুদ্ধি এতটাই ঘৃণ্য ছিল যে, ওই ছাত্রকে তার একাধিক সহপাঠীকে দিয়ে একের পর এক থাপ্পড় দেওয়ানো হয়েছিল।
এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা ব্যতিক্রম হিসেবে অভিযুক্ত শিক্ষিকার মনোবিকার বলে ভেবে নেওয়ার কোনও জায়গা নেই। এই ঘটনা বিষম সমাজ-বাস্তবতার এক খণ্ডচিত্র। এককভাবে কোনও শিক্ষকের পক্ষে কোনও ছাত্রের ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে এরকম নাড়াঘাঁটা করা সম্ভব নয়, যদি শিক্ষকসমাজে ও বৃহত্তর সমাজে তার কোনও আনুকূল্য না থাকে।
মুজফফরনগর জেলা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের দিক থেকে স্পর্শকাতর। এখানে বেশ কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩-র আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে ভয়ানক দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় ৪২ জন মুসলমান ও ২০ জন হিন্দু প্রাণ হারায়। জখম হয়েছিল ৯৩ জন। ৬০ হাজারের ওপর মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল। অথচ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার সূত্রপাত, তার প্রতিক্রিয়া এমন বিধ্বংসী হওয়ার কথা নয়। গৌরব সিং ও মুজাসসিম নামে দুই যুবকের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝামেলা-মারপিট হয়েছিল। পরে গৌরব সিং, তার ভাই সচিন ও তাদের পরিবারের আরও ছজন তাদের এক কমবয়সি আত্মীয়ার যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে মুজাসসিমের জেঠতুতো ভাই শাহনওয়াজকে তাদের বাড়ির পাশে অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। পরক্ষণে উত্তেজিত গ্রামবাসী গৌরব ও সচিনকে ধরে ফেললে গণধোলাইয়ে দুজনেই মারা পড়ে। পরে পুলিশি তদন্তে জানা যায়, ওই মেয়েটি যৌন হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে হত্যা ও হিন্দু মেয়ের অপমানের অভিযোগে মুজফফরনগর জেলা ও পার্শ্ববর্তী শামলি জেলায় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিল হিন্দু ও মুসলিমরা।
মুজফফরনগর দাঙ্গায় স্পষ্ট, সেখানে হিন্দুমনে মুসলমানবিদ্বেষ একটা মানসিকতার রূপ নিয়েছিল। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার একটা পুরনো ধারা। তার প্রভাব মুজফফরনগরে গেঁড়ে বসেছিল। এই জায়গা থেকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে একটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। এটাই ইন্ধন যে, হিন্দু মেয়ের তথাকথিত যৌন হয়রানির দায় মুসলমান সমাজের উপর চাপানো গিয়েছিল সহিংসতার মূল্যে।
এই সহিংসতার একটা পরিণাম হল এই যে, গৌরব ও সচিনকে হত্যার অভিযোগে মৃত শাহনওয়াজের দুই ভাই, দুই খুড়তুতো ভাই এবং অন্য দুই গ্রামবাসী আফজল ও ইকবালের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে ২০১৯-এর জানুয়ারিতে। কিন্তু শাহনওয়াজকে হত্যায় অভিযুক্ত মৃত গৌরবের পরিবারের ছজনকে ২০১৯-এর জুনের আগে গ্রেফতারই করা হয়নি। বারবার তাদের পলাতক দেখানোর পর কোর্ট যখন তাদের সম্পত্তি ক্রোক করার নির্দেশ দিল, তখন পুলিশ তাদের কোর্টে হাজির করল। এবং পুলিশের বদান্যতায় এক থেকে দুই মাসের মধ্যে সকলেই জামিন পেয়ে গেল। এখনও তারা জেলের বাইরে। আরও ঘটনা হল, ২০২১-এ উত্তরপ্রদেশ সরকার মুজফফরনগর দাঙ্গায় অভিযুক্ত বারোজন বিজেপি নেতার নামে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
মুজফফরনগরে ছাত্রপীড়নের পটভূমি এইরকম। তবে একথা বলা যায় না যে, এই এলাকার সাম্প্রদায়িক বৈরিতার কারণেই ছাত্রপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। নির্ঝঞ্ঝাট-নিরুপদ্রব সময়ে এটা ঘটার কথা নয়। এর মূল রয়েছে অন্যত্র। এটা মনের একটা অবস্থার প্রতিফলন। এক্ষেত্রে ইসলামোফোবিয়া, যা দিনে দিনে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার ও পরিবেশে মননে বাসা বেঁধেছে। এটা সূক্ষ্ম ও বদ্ধমূল। সেখানে মুজফফরনগরের সাম্প্রদায়িক বিভেদের বাতাবরণ ছাত্রপীড়নে ইন্ধন জুগিয়েছে।
হিন্দুসমাজে এরকম ঘৃণা-বিদ্বেষের চাষ হিন্দুত্ববাদীদের একটা ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড। এর একটা দিক হল, শিশুমনকে কর্ষণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া। সারা দেশে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও সমগোত্রীয় কটা সংগঠন মিলে প্রত্যন্ত এলাকায় সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট হিন্দু ও কোথাও কোথাও আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রতিকূল অবস্থার সুযোগে তাদের সন্তানদের নিয়ে ‘একল বিদ্যালয়’ চালাচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গঠনের নামে একেবারে শৈশব থেকে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের তালিম দেওয়ার কেন্দ্র এই বিদ্যালয়গুলি। সারা দেশে এর সংখ্যা ১ লক্ষ ১ হাজার ৪১৭টি। পড়ুয়ার সংখ্যা ২৭ লক্ষ। এই অপকৃতি এখন একল বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্য বিদ্যালয়েও পৌঁছে গেছে। মুজফফরনগরে ছাত্রপীড়ন একটা দৃষ্টান্ত। এলাকায় খোঁজ নিলে এরকম অপকৃতির সন্ধান আরও মিলবে বলেই মনে হয়।
দেখা গেল, কৃষক সংগঠনের কজন নেতা খুববাপুর গ্রামে গিয়ে পীড়িত ছাত্র ও পীড়নকারী এক ছাত্রকে পরস্পর আলিঙ্গন করাচ্ছেন। এটাকে ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাশীল নাগরিকদের প্রয়াস হিসেবে ভাবলে দেখব এর তাৎপর্য ভিনধর্মীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনের মধ্যে নিহিত। কিন্তু কৃষক সংগঠনের নেতা হিসেবে যখন তাঁদের এই প্রয়াস, তখন বুঝতে হবে, এর তাৎপর্য আরও গভীর।
২০১৩-র পর প্রায় এক দশক মুজফফরনগরের মানুষ— হিন্দু ও মুসলমান— দাঙ্গার অভিঘাতে নিজ নিজ সমাজের সামনে পারস্পরিক ব্যবধানের প্রাচীর তুলে দিয়েছিল। অবশেষে কৃষক আন্দোলনের সুবাদে দাঙ্গা-বিভাজিত মুজফফরনগরকে এক করার রাস্তা খুলে গেল। ২০২০-র শেষের দিকে শুরু হওয়া তিন কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসেবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সংগঠিত একাধিক কিষান মহাপঞ্চায়েতের একটা হয়েছিল মুজফফরনগর সদরে গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ। হিন্দু-মুসলমান মিলে মুজফফরনগর জেলার হাজার হাজার কৃষক কিষান মহাপঞ্চায়েতে সামিল হয়েছিল। মহামিছিলে স্লোগান ছিল— “হর হর মহাদেব”, “আল্লাহু আকবর”।
এই সম্প্রীতি-বন্ধনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল ‘খাপ পঞ্চায়েত’ নামে সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা [পঞ্চায়েত (গ্রাম স্তরে)> থাম্বা (৭টি পঞ্চায়েত নিয়ে)> খাপ (১২টি থাম্বা নিয়ে)]। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গ্রামাঞ্চলে খাপ আছে অনেক। খাপ সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া হিন্দু জাঠদের মধ্যেই দেখা যায়। সমাজ-সংস্কৃতিতে খাপের ভূমিকা রক্ষণশীল। তারা পশ্চাৎপদ সংস্কার-প্রথাকে ধরে রেখেছে বলে বদনাম আছে। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে হিন্দু জাঠরা প্রায় সকলেই ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের প্রভাবাধীন। কেন্দ্রীয় কৃষি আইন-বিরোধী কৃষক আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিল ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন। ফলে সব খাপই কোনও-না-কোনওভাবে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সামাজিক রক্ষণশীল অবস্থান ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভাজিত পরিবেশের দিক থেকে হিন্দু জাঠরা সাধারণত মুসলিমদের থেকে দূরত্ব রেখেই চলত। জাঠ জাতিভাবনার সমাজ-পংক্তিতে দলিতরা এতদিন ব্রাত্যই ছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে ও প্রয়োজনে যথাসম্ভব জাতিপরিচিতি ও সাম্প্রদায়িক ব্যবধান অতিক্রম করে বৃহত্তর সমাজে খাপ নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পথে এগিয়েছিল।
মুজফফরনগরের ছাত্রপীড়নের ঘটনা এক সামাজিক অবক্ষয়কে সূচিত করে। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব এইখানে যে, এই ধরনের অপরাধে এই হিন্দুত্বের ক্ষমতাকেন্দ্র কোনও-না-কোনওভাবে সহায় থাকে। কিন্তু সামাজিক দিক থেকে এর তাৎপর্য গভীর ও দূরপ্রসারী। উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা উত্তর ভারত ধর্মীয় ও জাতপাতগত বিভেদ-বিদ্বেষের মৃগয়াক্ষেত্র। সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে খুব একটা আশ্চর্যের মনে না হতে পারে। কিন্তু যদি পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ঘটে, কী ভাবব? ২০২০-র মাঝামাঝি সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা জোর চর্চা হয়েছিল যে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় এক শ্রেণির শিক্ষকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের নম্বর দেওয়ায় বৈষম্য করছেন। দাবি উঠেছিল, এটা বন্ধ করতে উত্তরপত্রে নাম না লিখে শুধু রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও রোল নম্বর লেখার নিয়ম চালু করতে হবে। কোনও কোনও রাজনৈতিক দল থেকেও একথা বলা হয়েছিল। এরকম বৈষম্যমূলক মানসিকতা সেই বিষম সমাজ-বাস্তবতার প্রতিফলন, যা ধর্মীয় বা সংখ্যাগুরুসুলভ আধিপত্যকামী দৃষ্টিভঙ্গিকে বহন করে। এটা কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অবজ্ঞা, কোথাও জাতপাতের দ্বন্দ্বের চেহারায় নিজেকে প্রকাশ করে। কখনও তা চরম সিদ্ধান্তে বিদ্বেষভাবাপন্ন। হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এ এক কর্ষণযোগ্য ক্ষেত্র বটে।
মুজফফরনগরে ছাত্রপীড়নের প্রতিবাদ করা বা জাত-ধর্ম বিচার করে পরীক্ষায় নম্বর-বৈষম্য নিরসনের দাবি তোলা, এটা মানবিক দায়িত্বের ব্যাপার। সময়ের দাবিতে এটা করতেই হয়। কিন্তু ধর্মীয় বা জাতপাতগত ভেদবুদ্ধির চোরাস্রোত সমাজে সতত বয়ে চলেছে। সেখানে বাঁধ দেওয়ার জন্য হাত লাগানো প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন। আমরা কবি শঙ্খ ঘোষের কথা স্মরণ করতে পারি। ২০১৬-র ১৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় গোর্কি সদনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের সমস্যা সংক্রান্ত এক আলোচনায় কবি বলেছিলেন,
আমাদের সমাজজীবনে বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক অপরিচয় আছে। তার থেকে আসে অজ্ঞানতা। সেখান থেকে জন্মায় অবিশ্বাস। তার থেকে আসে অসহিষ্ণুতা। সেখান থেকে তৈরি হয় অশান্তি, যা কখনও-কখনও দাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ই এই সমস্যা ঠেকানোর পথ এবং সেটা সরকারের নয়, সমাজের দায়িত্ব।
-মতামত ব্যক্তিগত