Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিশ্বদুয়ারে BRICS

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

 


জোটের মূল সদস্যদের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ব্রিকস আজ এক শক্তিশালী জোট। বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ ভূখণ্ড জুড়ে এর ব্যাপ্তি, যেখানে বিশ্বের ৪২ শতাংশ মানুষের বসবাস। সব মিলিয়ে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের ২৫ শতাংশ জ্বালানি তেল এবং ইস্পাত তৈরিতে ৫০ শতাংশ আকরিক লোহা উৎপাদন করে থাকে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভুট্টা এবং ৪৬ শতাংশ গমও এই জোটভুক্ত দেশগুলোতে উৎপন্ন হয়

 

গত বছর “BRICS”-এর ১৪তম সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, ব্রিকস দেশগুলো এমন এক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করবে, যা দিয়ে একটি নতুন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা চালু করা যাবে। এটি মার্কিন ডলারের আধিপত্যের জন্য সরাসরি হুমকি হবে এবং এর আধিপত্য খর্ব করতে সাহায্য করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সে-সময়ে বলেছিলেন, এতে দেশ তথা সারা বিশ্বের ভাল হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এই মুদ্রাব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অর্থাৎ পুতিন যে ব্রিকস জোট সম্প্রসারণের কথা বলেছিলেন তা বোঝা গিয়েছিল স্পষ্ট। এবং তাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও ইন্ধন ছিল ভালমতন।

এ বছর ২২ থেকে ২৪ আগস্ট BRICS-এর ১৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে। পুতিন বাদে প্রায় সমস্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সশরীরে যোগ দিলেন তাতে। ইউক্রেন যুদ্ধের অপরাধে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার ফলে পুতিন যোগ দিলেন ভার্চুয়ালি।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত জোট BRICS থেকে এবারে ঠিক কী ধরনের ফলাফল আসে সেই নিয়ে উচ্চ আশায় বুক বেঁধে ছিলেন অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক। ‘চায়না ডেইলি’তে ৭ আগস্ট প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, অন্যান্য অনেক দেশ তাদের নিজস্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার উপায় হিসাবে ব্রিকসের এবারের সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই নিবন্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল ডায়ালগ’-এর নির্বাহী পরিচালক ফিলানি এমথেম্বুর উদ্ধৃতি ধরে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির পর এবার প্রথম সশরীরে ব্রিকসের বৈঠক হবে। এতে দেখা যায় বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ সব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেললেও সদস্য দেশগুলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে উন্নতি করছে। এদিকে বর্তমানে ভারতেরও বিভিন্ন ইস্যুতে চিনের প্রতি সুর অনেকটাই নরম। গত তিন-চার বছরে উপর উপর মিডিয়ার মাধ্যমে সেনাদের রক্তবিনিময়ের রাজনীতি দেখিয়ে, তলায় তলায় ভারতের সঙ্গে চিনের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে বুলেট ট্রেনের গতিতে। ভারত সরকারও এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে দিয়েই বিশ্বের দুয়ারে খানিক মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সে দেশের জনগণের উপরে পুঁজির স্বার্থে যতই নিপীড়ন করুক না কেন!

এই মাসেই দিল্লিতে বসতে চলেছে জি-২০ সন্মেলন। যেখানে, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের উপস্থিত থাকবারও কথা রয়েছে। তাই ভারত সরকারও এই সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে এবং চিনের প্রেসিডেন্ট জিনপিং-এর ভারত সফর সুনিশ্চিত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। তবে এই সম্মেলনের আগেও জিংপিং-এর সাথে নরেন্দ্র মোদির জোহানেসবার্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। নিশ্চিত সেখানেও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে নানান কথাবার্তা হতে পারে। ভারতের সঙ্গে চিনের যে সাপ এবং নেউলের সম্পর্ক নয় তা কার্যত নরেন্দ্র মোদি বারেবারে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

নাম করা অর্থনীতিবিদ জেমি ও’‌নিল ২০০১ সালে তাঁর লেখা গবেষণামূলক একটি প্রবন্ধে বিশ্ব-অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চিন অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব-অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন উন্নত দেশের জোট ‘জি সেভেন’–এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে। সেখান থেকেই নাকি ‘মানব কল্যাণস্বার্থের’ কথা ভেবে ২০০৬ সালে প্রথম এই জোট গঠিত করে চারটি দেশ মিলে; যার প্রথম সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে, “BRIC” রূপে। পরবর্তীতে এই জোটে দক্ষিণ আফ্রিকা অংশগ্রহণ করলে হয় BRICS। বর্তমানে এই জোটে স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার জন্য প্রায় ৪০টি দেশ আবেদন জানালেও, আলোচনার মাধ্যমে সদস্যপদ দেওয়া হল মোট ছয়টি দেশকে, সম্ভবত, তাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জোর দেখে। এই দেশগুলির মধ্যে চারটি দেশই হল মধ্যপ্রাচ্যের। এবং একটি লাতিন আমেরিকা ও একটি আফ্রিকার। অতএব প্রতিটি দেশই সম্পদশালী এবং প্রতিটি দেশের অর্থনীতিও ইউরোপ-আমেরিকার দ্বারা কলঙ্কিত। বলা ভাল, যুগ যুগ ধরে ইউরোপ-আমেরিকা নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খুঁটি শক্তিশালী করেছে মূলত এই মহাদেশগুলির ঘাড়েই বন্দুক রেখে।

প্রথমে আমেরিকা ও ইউরোপীয়রা এই জোটকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন দিতে বসেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ব্রিকসের বিকল্প অর্থনীতি আগামীদিনে ডলারের বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে চলেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা সারা বিশ্বজুড়ে আমেরিকান দাদাগিরির মুখে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। সম্ভবত বিশ্বের গতি বহুমেরু কিংবা দ্বিমেরু দিকেই ছুটবে, যেটা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির প্রধান লক্ষ্য। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চিন উদীয়মান অর্থনীতি হওয়ার দরুন বিশ্বের চোখে তার ‘দেবতা’-রূপী মনোরম জায়গা থেকে আমেরিকাকে হটিয়ে সেই জায়গায় চিন দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠবে। গোল্ডম্যান সাক্স সংস্থার সদ্য-প্রকাশিত একটি রিপোর্টেও তেমনটাই তুলে ধরা হয়েছে। যার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে— ২০৫০ সালের ভেতরে।

প্রথমে এ-জোট নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামানোর মাসুল আজ আমেরিকাকে গুনতে হচ্ছে, এমনটাও মনে করছেন অনেকে। জোটের মূল সদস্যদের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ব্রিকস আজ এক শক্তিশালী জোট। বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ ভূখণ্ড জুড়ে এর ব্যাপ্তি, যেখানে বিশ্বের ৪২ শতাংশ মানুষের বসবাস। সব মিলিয়ে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের ২৫ শতাংশ জ্বালানি তেল এবং ইস্পাত তৈরিতে ৫০ ভাগ আকরিক লোহা উৎপাদন করে থাকে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভুট্টা এবং ৪৬ শতাংশ গমও এই জোটভুক্ত দেশগুলোতে উৎপন্ন হয়। বর্তমানে আরও সম্পদশালী রাষ্ট্র এই জোটে অংশগ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবেই এই জোটের শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং আমেরিকা সারা বিশ্বের দুয়ারে ক্রমশ বুড়ো বাঘে পরিণত হবে। এর সদস্যদের মূল লক্ষ্য, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে মার্কিন একাধিপত্যের মোকাবিলা করা। চিনকে আমেরিকার জায়গা বসানো, এমনটা নয়। অথচ চিন তার উদীয়মান অর্থনীতির জোরে এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক সহযোগিতা পেয়ে সেই জায়গা বানাতে ক্রমশ সক্ষম হচ্ছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার পটভূমিতে ব্রিকস জোটের সম্প্রসারণের গতি যেমন বেড়েছে, তেমন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খুঁটিও যে শক্তিশালী হয়েছে, তা আজ বারেবারে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

২০১৪ সালে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসাবে ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক’ চালু করে। ব্যাঙ্কটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মূলধন নিয়ে, যার ২০ শতাংশ দিয়েছিল ব্রিকস জোটের দেশগুলো। ২০২১ সালে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, উরুগুয়ে, মিশর ও বাংলাদেশ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের শেয়ার গ্রহণ করে। এই ব্যাঙ্ক এখনও পর্যন্ত মোট ৯৬টি প্রকল্পের জন্য ৩৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। যার ফলে ব্রিকস মার্কিন ডলারভিত্তিক একাধিপত্যের হাত থেকে বাঁচবার এবং নিজেদের রাজনৈতিক জোর বাড়াবার একটি সফল প্ল্যাটফর্মে পরিণত হওয়ায়, এখন অনেক রাষ্ট্রনেতারাই এতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং এই জোটের আধিপত্য কায়েমের মধ্যে দিয়ে চিন বিশ্ববাজারে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক জোর দ্রুত গতিতে বাড়াতে প্রবলভাবে সক্ষম হওয়ার ফলে নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারও ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তায় রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঘাড়ের পাশে নিঃশ্বাস ফেলা চিনের হাতে বিশ্বের পুরোপুরি ক্ষমতা চলে যাক, এমনটাও চাইবে না ভারত। কারণ তাহলেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর দরকষাকষির রাজনৈতিক ‘ক্যারিশমা’ হারাতে শুরু করবেন, গদি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়বেন এবং ভারত ক্রমশ আমেরিকা ও চিনের দ্বন্দ্বে তুরুপের তাসে পরিণত হবে। এক পক্ষের হয়ে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব-হেতু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেও বাধ্য হবে। যাতে আখেরে ভারতীয় শাসকশ্রেণির সামগ্রিকভাবে ক্ষতিই হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত