নিরুপম চক্রবর্তী
কামিস্কার বাসস্টপে অনেক অনেকদিন বাদে ফিরে এসে
শ্রীযুক্তা ট্রংকোভা
বেজায় আশ্বস্ত হন সবকিছু ঠিক আছে দেখে।
এ পাশে গ্রোসারি স্টোর:
ভিয়েতনামি চু-দা-খাই আর তার বউ
শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাইকে ঠকিয়ে চলেছে,
ওপাশে সরাইখানা; সেখানে খদ্দের নেই
রাঁধুনি ও ওয়েটার মনের আনন্দে বসে সিগারেট ফোঁকে।
সামনেই ফ্ল্যাটবাড়ি, বুড়োবাবু কুত্তা নিয়ে বসেছে দরজায়:
‘আরে আরে, বনলতা! এতদিন কোথায় ছিলেন?
‘ডব্রিডেন! ডব্রিডেন!’ বুড়োবাবু পরম আনন্দে বলে ওঠে।
সবকিছু ঠিকঠাক। লিফট নেই, খাড়া সিঁড়ি স্বর্গ খুঁজে আগের মতোই সেই
ধাপেধাপে ওপরে উঠেছে। ডাকবাক্সে নাম লেখা, নাম লেখা সদর দরজায়,
চাবিটি ঘুরছে ঠিক, সেই কবে স্বহস্তে লাগানো ফুলগাছে একটি লাজুক কুঁড়ি;
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে শ্রীযুক্তা ট্রংকোভা আজ খুব খুশি সবকিছু ঠিকঠাক দেখে।
এই তো সবুজ ভাঙা সোফা! অপোগণ্ড বড়ছেলে ইয়ারিকে বারবার বলে
কিছুতেই পালটানো গেল না! টেবিল চেয়ার সব ঠিকঠাক, রান্নাঘরে বাসনের তাক
আগের মতোই সেই থালা-কাপ-গ্লাসে ভরে আছে। গ্যাসের বার্নারে আরে
তিনখানা স্টোভ জ্বলে, একটা খারাপ হয়ে গেছে!
আগে কি এমনই ছিল? অনেক ভাবেন তিনি
কিছুতেই স্মরণে আসে না।
‘বয়স হচ্ছে তো বুঝি আজকাল, কতকিছু ভুলে যাই’,
এই বলে শ্রীযুক্তা ট্রংকোভা শয়নকক্ষতে যান;
সেখানে নতুন একটা খাট, আইকিয়া কোম্পানির,
‘দেখতে হবে না আর, বড়ছেলে ইয়ারির কাজ:
সোফা না সারিয়ে বুঝি মাতৃভক্ত বড়খোকা
এইসব কিনে বেড়িয়েছে!’
তারপরে বারান্দায়:
একরাশ কাপড় শুকোয় সেইখানে।
‘এগুলো আমার নয়! এগুলো এখানে তবে কার?’
আচমকা ঘরের ভেতরে
কার যেন চলাফেরা, আবছায়া মূর্তি এক
আলো আঁধারিতে বসে ফোনেতে বাজাতে থাকে
অজানা ভাষায় কোনও গান!
বয়স হয়েছে তাই ঠিকঠাক নজর পড়ে না।
এটা কি সত্যিই কেউ? নাকি এ নিছকই ভীমরতি?
‘কে গো ওইখানে? আমার ফ্ল্যাটেতে তুমি ঢুকেছ কীভাবে আর
কোন সাহসেতে?’
সত্যিই যায় না বোঝা লোকটা বাস্তব নাকি সবটাই দিবস-বিভ্রম।
‘বেরোও এখান থেকে!’ এই বলে দরজা খুলে বীরদর্পে দাঁড়ান ট্রংকোভা:
লোকটা কোথাও নেই; বাতাসে মিলিয়ে যায় অবিন্যস্ত ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি!
দরজায় ট্রংকোভা লেখা আগের মতোই ঠিকঠাক:
কে যেন কখন এসে সেইখানে চক্রবর্তী লিখে চলে গেছে!
পুরনো দিনের লোক শ্রীযুক্তা ট্রংকোভা।
ভূতপ্রেতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনওটাই ভালভাবে নেই।
তা বলে এখানে থাকা ঠিক হবে, এইসব অস্বস্তি এড়িয়ে?
মনে হয় ফিরে যাওয়া ভাল হবে তাঁর সেই নতুন বাড়িতে।
ঈশ্বরে বিশ্বাসী তিনি:
সে আস্তানা খুব ছোট, নড়াচড়া মুশকিল,
যাইহোক, মাথার ওপরে
ওখানে তো ক্রসটুকু ঠিকঠাক আছে।
শ্রীযুক্তা ট্রংকোভা তাই ট্যাক্সি ডেকে ফিরে চলে যান।
কিছুটা বিধ্বস্ত লাগে তাঁকে:
‘তাড়াতাড়ি চলো ড্রাইভার
ওলসনি সিমেটারি যাব!’
প্রাগের ফাঁপা কাফকা ও আইরিশ চে
ইহুদি অঞ্চলে প্রাগে হতভম্ভ ট্যুরিস্টের ভিড়:
কাফকা মূর্তি নিরুদ্দেশ, ফাঁপা কাফকা প্রাগ শহরের
ইহুদি নগরে প্রাগে বহুকাল আছে সে দাঁড়িয়ে,
সর্ব অঙ্গে অসীম শূন্যতা;
ফাঁপা কোট, ফাঁপা প্যান্ট; হৃদয়ে শূন্যতা নিয়ে মস্তিষ্কবিহীন ধড়ে
সমাসীন কাফকানামী প্রেত,
কতকাল বসে আছে আমাদের সম্ভ্রম জাগিয়ে!
আহারে! কোথায় সে যে যেতে পারে সে তো আমি জানি!
মোল্লার দৌড় সেই মসজিদেই, আবার কোথায়?
এই তো একটু আগে চলে গেছে মাত্র দু একটা ব্লক আগে
সে আর গোভারা বুঝি বসেছে বিয়ার নিয়ে
গোভারার সদ্যখোলা আইরিশ পাবে!
বলিভিয়া অন্যদেশ, অন্যকাল। গুলিবিদ্ধ মৃতদেহটিও
জেগে ওঠে, হেসে ওঠে, পুঁজির প্রলেপে।
কবে যে আইরিশ ছিল চে যে নিজে এখনও জানে না,
যীশুর মতোই বুঝি ইস্টার দিবসে তার পুনর্জন্ম ঘটে
তেএঁটে নাস্তিক তাই অ্যাসেনসনে স্বর্গবাস নেই
ভালই লাগছে প্রাগে, আপাতত সদ্যখোলা মদের দোকানে
বন্ধু কাফকার সঙ্গে বেশ দেখি জমিয়ে বসেছে!
কাফকা বিয়ার খায়, আর তার ফাঁপা অঙ্গ থেকে
নদীর স্রোতের মতো উপচে পড়ে ফেনা ও মদিরা আর
গড়ে ওঠে বিয়ার ফ্যাক্টরি!
কাফকা হাসতে থাকে: ওরে বুদ্ধু এই দ্যাখ্, এই তোর বিপ্লবের শেষ আর শুরু!
সবকিছু পণ্য আজ, তুই আমি, আমরা সবাই!
বেজায় খুশিতে তাই
কাফকার কোমর ধরে প্রাগে নাচে আইরিশ গোভারা তার
বৈপ্লবিক ট্যাঙ্গো নাচ, আর্জেন্টিন, বিদ্যুতের মতো চলাফেরা!
এদিকে কাফকার খোঁজে শহরে তখন ঘোরে ভ্রমণার্থী গেরিলা স্কোয়াড!
কাফকা ও গোভারা দ্যাখে:
হতভম্ব কার্ল মার্ক্স অবশেষে গোলাপের দোকান খুলেছে
দোকানের এক কোণে রাখা আছে জরাজীর্ণ দাস কাপিতাল
দৌড়চ্ছে নাইকি জুতো
পাবের রাস্তার ধারে সুরহীন বেহালার ছড়ে
বেজে যাচ্ছে
ভুলে যাওয়া ইন্টারন্যাশনাল!