নীলাঞ্জন হাজরা
নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্বন্ধে বিলেতের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা লিখল — “a who’s who of hawks, hypocrites and war criminals”। বস্তুত, শুরু থেকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার নানান রকম বিতর্কে জড়িয়ে। ডায়নামাইটের আবিষ্কারক নোবেলসাহেবকে নিন্দুকেরা বলেন ‘মৃত্যুর সওদাগর’। এ-হেন ব্যক্তিত্বের নামে শান্তি পুরস্কারকে মশকরার বস্তু হিসেবে দেখেন অনেকেই। তবে নাম যাঁরই থাক, কর্মেও শান্তি পুরস্কার মশকরা ও ঘৃণা কুড়িয়েছে যথেষ্ট। শান্তি পুরস্কার প্রাপকের তালিকার দিকে চোখ রাখলে গার্ডিয়ানের মন্তব্যের সত্যতা কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
শান্তি পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় সবথেকে বিতর্কিত ও ঘৃণ্য নামটা হেনরি কিসিঞ্জারের। ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন -– এমন দাবী করে কিসিঞ্জারকে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্পণ করা হয়। যুগ্মভাবে এই পুরস্কার দিতে চাওয়া হয় ভিয়েতনামের লে দক থ-কেও। তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন। ইসরায়েলের পারমাণবিক শক্তির প্রধান সংগঠক শিমোন পেরেজকে এই পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৯৪ সালে, য়িতজাক রাবিনের ও ইয়াসের আরাফাতের সঙ্গে। এর ঠিক দু’বছর পরেই কানা-র লেবানীয় শহরের রাষ্ট্রসংঘের শিবিরে বোমাবর্ষণ করে ১০৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করবার দায়ে পেরেজ অভিযুক্ত হন। কিসিঞ্জারের তুলনায় এই সংখ্যা অবশ্য কিছুই নয়। ‘লাইসেন্সড কিলার’ সু কি-র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ভো পাঠক?
আরও অজস্র নাম। বারাক ওবামা, কলম্বিয়ার হুয়ান মানুয়েল সান্তোস, আমাদের মাদার তেরেসা, মিখাইল গোরবাচেভ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন… এই তালিকার শেষ নাম ICAN-এর। এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেল এই সংস্থা -– মানবজাতির ওপর পারমাণবিক অস্ত্রপ্রয়োগের ভয়ঙ্কর পরিণাম এবং এই অস্ত্রের ব্যবহাররোধে একটি চুক্তির জন্য কাজ করে যাওয়ার ফলে। অথচ, ১৯৪৫ থেকে পারমাণবিক শক্তির বিপদ সম্বন্ধে সারা পৃথিবীকে সতর্ক করে চলা অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টদের সংগঠন কল্কে পেল না। ICAN পেল।
নোবেল শান্তি-র রাজনীতি নিয়ে অনেক অজানা, স্বল্প-জানা এবং ভুলে-যাওয়া কথা জানালেন নীলাঞ্জন হাজরা। পেশা সাংবাদিকতা। শখ ঘুরে বেড়ানো আর কবিতার মকশো করা। সাতপাঁচ ভাবা।
The illegal we do immediately; the unconstitutional takes a little longer (laughter). ইনি হেনরি এ কিসিঞ্জার। এই মস্করাটা তিনি করেছিলেন সোমবার, ১০ মার্চ, ১৯৭৫ সালে, সন্ধ্যা ৫:২০ থেকে ৬টার মধ্যে আঙ্কারায় তুরস্কের বিদেশ দপ্তরে বসে। অবৈধ এবং অসাংবিধানিকের মাঝখানে এমন ঠাট্টাপূর্ণ যাতায়াত করতে করতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের মস্করাবাজ নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জার সাহেব ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩-এর মধ্যে মার্কিন বোমায় কম্বোডিয়া তছনছ করে দিয়েছিলেন যাতে ভিয়েতনাম গণফৌজ (পিএভিএন) বা ভিয়েত কংয়ের যোদ্ধারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের মার্কিন উপনিবেশের উপর হামলা চালাতে না পারে। এই বোমা হামলায়, সাহেব নিজেই হিসেব করেছিলেন পরে, মরেছিল তা প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। নিন্দুকদের হিসেবে সংখ্যাটা ১ লক্ষ ৫০ হাজারের কাছাকাছি।
আর তিনি ভারি মস্করা করেছিলেন সেই সব মার্কিন কূটনীতিকদের নিয়ে ‘dying Bengalis’-দের জন্য যাঁদের হৃদয় ‘bleed’ করছে। সে মস্করার প্রেক্ষিতটা বুঝতে সুবিধা হবে ১৯৭১-এর ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল অকুতোভয় আর্চার ব্লাড ৩-২৫-৭১ তারিখে মার্কিন বিদেশ দপ্তরে যে ‘কেবল’ পাঠিয়েছিলেন তার ওপর চোখ বোলালেই। সেই যুগান্তকারী দলিলের প্রথম লাইন ছিল — Here in Decca we are mute and horrified witness to a reign of terror by the Pak military। সে ‘কেবল’-এর subject ছিল ‘Selective genocide’। কী ভাবে এই বিদ্রোহী কূটনীতিককে ‘this maniac’ বলে মস্করা করে হেনরি কিসিঞ্জার পূর্ববঙ্গের গণহত্যা চালিয়ে যেতে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পড়তে গেলে উল্টোতে হবে Garry J Bass-এর লেখা বই ‘The Blood Telegram’।
কিন্তু শেষ রক্ষা হল না দক্ষিণ এশিয়াতে। বাংলাদেশ সেই তৈরি হয়ে গেল ‘৭২-এ। আর ক্ষুরধার মেধার কিসিঞ্জার সাহেব এও বুঝে ফেলেছিলেন ভিয়েতনামেও মার্কিন মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। কাজেই তাঁর ঠাট্টাবাজ মন সুড়সুড় করছিল নিশ্চয়ই। অতএব ৯/১১। না মার্কিন মুলুকে ৯/১১-র কথা বলছি না। বলছি ১৯৭৩ সালের দক্ষিণ আমেরিকার চিলে-র ৯/১১-র কথা, সে দেশে বিপুল জনসমর্থনে ক্ষমতায় আসা বামপন্থী গণতান্ত্রিক সালভাদোর আয়েন্দে নেতৃত্বাধীন সরকারকে যে দিন সিআইএ সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে সরিয়ে দিলেন জেনারেল এর্নেস্তো পিনোচেৎ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পিনোচেতের এর সামরিক শাসনে ঠিক কত জন মানুষকে রাষ্ট্র হত্যা করেছিল তা জানা যায় না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস রুডল্ফ জোসেফ রামেলের হিসেবে সংখ্যাটা ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে। ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত যে পিনোচেৎ-কে ক্ষমতায় আনা অভ্যুত্থানের প্রধান পরিকল্পনাকারীও ছিল ঠাট্টাবাজ কিসিঞ্জার। যেমন ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত যে এ ঘটনার পরেই কিসিঞ্জার নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে পদোন্নতি হয়ে বনে গেলেন মার্কিন বিদেশ সচিব।
আর ইতিহাসে যা সুপ্রতিষ্ঠিত তা হল — সেই ১৯৭৩ সালেরই ১০ই ডিসেম্বর, মানে চিলে-কাণ্ডের ঠিক তিন মাস পরে, যৌথভাবে যে দুজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন তাঁদের একজনের নাম হেনরি এ কিসিঞ্জার, কারণ, নোবেল কমিটির তদানীন্তন চেয়ারম্যান (হ্যাঁ নোবেল কমিটির নিজের ওয়েবসাইটে ‘চেয়ারম্যান’ বলেই লেখা আছে) Mr. Aase Lionaes জানাচ্ছেন যে, ‘It was therefore quite natural that Kissinger should place very great emphasis on diplomacy as a factor for the promotion of peace as well, diplomacy both as a profession and as an art.’
সাবাশ নোবেল কমিটি! অনেক মস্করাটি আপনারা করেছেন বটে দুনিয়ার সঙ্গে, কিন্তু এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। এমনই মস্করা, যে ১৯৭৫ সালের সায়গনের, মানে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন উপনিবেশের, পতনের পরে স্বয়ং কিসিঞ্জার সাহেব নোবেল কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন — আমার পুরস্কারটি ফিরিয়ে নেবেন প্লিজ ভায়ারা?!
এ হেন মস্করাবাজ কিসিঞ্জার সাহেব সম্প্রতি, মানে ২০১৪ সালে, ফের একটি মস্করা করেছেন। সে বছর প্রকাশিত তাঁর বই ‘World Order’-এ তাঁর মস্করার বিষয় প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামার আট বছরের শাসন কালে সন্ত্রাসবাদী খতমে একটি নয়া অস্ত্রের ঢালাও ব্যবহার — ড্রোন। চালকহীন ছোট্ট ছোট্ট খেলনার মতো প্লেন, যার পেটে পোরা আছে বোমা। সন্ত্রাসবাদী কোথায় আছে আন্দাজ করে মার্কিন সামরিক শিবির থেকে উড়ে সে প্লেন পাকিস্তান, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশের নানান অঞ্চলে হাজির হয়ে বোমা মারে। পালটা বোমাও মারা হয় কিন্তু পাল্টা মারে মার্কিন সেনা মরার কোনও সম্ভবনা নেই। কাজেই চালাও ঢালাও। সে বোমা যে প্রায়শই সন্ত্রাসবাদীদের ডেরায় না পড়ে নিরপরাধ নিরস্ত্র গ্রামবাসীর মাথায় পড়ছে তা নিয়ে ইদানীং যথেষ্ট হইচই শুরু হয়েছে। সেই হইচই-এর সূত্র ধরেই ‘World Order’ বইতে কিসিঞ্জার সাহেবের মজারু মন্তব্য, ‘I bet if one did an honest account, there were fewer civilian casualties in Cambodia than there have been from American drone attacks’। কিন্তু ড্রোন হামলায় নিরপরাধ নিরস্ত্রদের মৃত্যু নিয়ে অনেকেই মোটেই মস্করা করেছেন না। এই সব হামলা পাকিস্তান, ইয়েমেন বা সোমালিয়ার এমন সব প্রত্যন্ত এলাকায় চালানো হচ্ছে, যেখানে গিয়ে অনুসন্ধান চালানো এক দুরূহ কাজ। সেই দুরূহ চ্যালেঞ্জ নিয়েই দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে The Bureau of Investigative Journalism জানাচ্ছে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত ড্রোন হামলায় মৃত ‘সিভিলিয়ান’-দের সংখ্যা ৩৮০ থেকে ৮০১ জন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা ধারাবাহিকভাবে মনে করে এসেছেন যে ড্রোন হামলাই সন্ত্রাসবাদী খতম করার শ্রেষ্ঠ উপায়। স্বাভাবিক, ওবামা ইদানীং কালের সারা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মেধাবী রাষ্ট্রপ্রধান। যুদ্ধ চালিয়েও বডি-ব্যাগে করে মৃত মার্কিন সেনার ফিরে না আসার দুরন্ত রাজনৈতিক সুবিধাটা তাঁর মতো বুদ্ধিমান রাজনীতিকের না বোঝার তো কথা নয়। কিন্তু মারণাস্ত্রকে সম্পূর্ণ যন্ত্রের মাধ্যমে দূর-দূরান্তে বিধ্বংসী অপারেশন চালাতে ব্যবহার করার হাড়-হিম-করা ইঙ্গিতটা এ হেন মেধাবী রাজনীতিক বোঝেননি, তাই বা কল্পনা করে নিই কী করে? একটা সময় যুদ্ধ হত মুখোমুখি। এক পক্ষ চোখের সামনে দেখতে পেত যতই শত্রু হোক তার ভয়াবহ দৈহিক ও মানসিক পরিণতি। বিংশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইস্তক মারণাস্ত্র পড়তে থাকল আকাশ থেকে। যদিও তা ফেলত মানুষ, নিজেও সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে। তাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতার মাত্রাটা বেড়ে গেল বহুগুণ। এবার যন্ত্র চলেছে যুদ্ধে। যে যন্ত্র পরিচালিত হবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে। ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। যন্ত্রের কোনও বিবেক নেই। কোনও দ্বিধা নেই। সংযম নেই। ওবামার আমলেই বিপুলভাবে যুদ্ধ-পদ্ধতির মূল ধারায় স্বীকৃতি পাওয়া ড্রোন যুদ্ধের সমালোচনার একটা মূল যুক্তি, যুদ্ধকে এভাবে অমানবিক করে তোলাও। পাকিস্তানের কোনও প্রত্যন্ত একরত্তি গ্রাম ওয়াশিংটন ডি.সি.-র ওয়ার রুমে কোনও দুষ্টু বাচ্চার খেলে বেড়ানোর মাঠ নয়, কোনও রমণীর কাপড়-জামা শুকতে দেবার উঠোন নয়, কোনও মেষপালকের ভেড়া চড়ানোর চারণভূমি নয়, তা একটা লক্ষের পুটকি মাত্র, যেখানে সেইসব লোকেদের যাতায়াত, যাঁদের বেঁচে থাকাই মার্কিন শিশুটির, মার্কিন নারীটির, মার্কিন শ্রমিকটির শান্তির পরিপন্থী। কাজেই পাঠাও ড্রোন। আর তার আগে ২০০৯-এর ১০ই ডিসেম্বর ওসলোতে গিয়ে নিয়ে এসো নোবেল শান্তি পুরস্কার।
কিসিঞ্জার এবং ওবামার উদাহরণ দেবার উদ্দেশ্য তাঁদের একই ব্র্যাকেটে বন্দি করা নয়। উদ্দেশ্য ‘শান্তি’ কিভাবে বিশ্লেষিত হয় তা বোঝার চেষ্টা করা। ‘Peace in Kamchatka is as important as it is in Washington, London or Moscow’, আমাদের ক্লাসে পড়িয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় রজতকান্ত রায়। লক্ষ করলে দেখা যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া উপনিবেশবাদের শান্তির যুদ্ধগুলো সর্বদাই হয় ‘উন্নত দুনিয়া’ থেকে বহু হাজার কিলোমিটার দূরে। পূর্ব এশিয়ায়, দক্ষিণ এশিয়ায়, দক্ষিণ আমেরিকায়, পূর্ব ইউরোপে, আফ্রিকায়। আর সেখানেও শান্তি যখন ভীষণ জরুরি হয়ে ওঠে, তা কিন্তু হয়ে ওঠে ওই উন্নত দুনিয়ার শান্তির স্থিতাবস্থাটি যাতে নড়বড়ে না হয়ে যায় তা সুনিশ্চিত করতেই। সেই কারণেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পান সেই সব রাজনীতিক যাঁরা প্রায় কেউই আর যাই করুন ‘World Order’-টিকে কদাচিৎ চ্যালেঞ্জ করবেন না। সেই জন্যই ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭-এ নাম প্রস্তাব হওয়া সত্ত্বেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় নেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নাম। থাকবে কী করে, সে নামের সঙ্গে যে বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের থেকে বিশ্বের বৃহত্তম উপনিবেশটি কাটা যাওয়ার ইতিহাস সরাসরি যুক্ত।
উঠবে নেলসন মান্দেলা এবং ইয়াসের আরাফতের কথা। কিন্তু তাঁরাও ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া ওয়ার্ল্ড অর্ডারটাকে চ্যালেঞ্জ করেননি। সেই ওয়ার্ল্ড অর্ডারের পশ্চিমি প্রভুদের ঠেকনাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসন বা পশ্চিম এশিয়ায় আগ্রাসী ইজরায়েলি উপনিবেশবাদের প্রতি পশ্চিমি শ্বেতাঙ্গ ক্ষমতার কুশীলবদের যে সমর্থন ছিল বা রয়েছে, খুব খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার সঙ্গে কর্পোরেট-চালিত নব্য-উপনিবেশবাদের মৌলিক চালিকাশক্তির বিশেষ সম্পর্ক নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসন শেষ হয়েছে, তাতে কর্পোরেটিয় উপনিবেশবাদকে আফ্রিকায় কিছু রদবদল করতে হয়েছে বটে, কিন্তু তার সামগ্রিক ডিজাইনে কোনও কাটাকুটি পড়েনি। ইজরায়েল যদি শেষ পর্যন্ত গাজা-ফিলিস্তিন থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্যও হয়, তার সঙ্গেও কর্পোরেট ঔপনিবেশিক যুক্তি নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে বলে আমার বিশ্বাস। ইজরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের মৌলিক ভিতটা হল মার্কিন আর্থ-রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণকারীদের কুশীলবদের ওপর ইহুদি লবির যাকে বলে সাঁড়াশি কামড়। সেটা মূলত ধর্মীয় ভাবাবেগ তাড়িত। কিন্তু মান্দেলা-আরাফতদের তালিকায় কিছুতেই থাকতে পারে না – ভ্লাদিমির লেনিন, মোহনদাস গান্ধী, মাও জে দং, হো চি মিনহ্দের নাম। যদিও অনায়াসেই থাকতে পারে কিসিঞ্জারের নাম, যার মস্করার বহরের সামান্য কিছু অংশ আমরা দেখেছি, বা আন্দ্রেই সাখারভের নাম (১৯৭৫), নোবেল কমিটি নিজেই যাকে চিহ্নিত করেছে ‘The father of the Soviet Hydrogen Bomb’ বলে। সাখারভের ঘোর বিশ্বাস ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কিন আধিপত্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। MAD, মানে Mutually Assured Destruction, যে ‘শান্তি’ আনে তা-ও শান্তি বইকি! এবং সেই শান্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের বিপুল, অকল্পনীয়ভাবে বিপুল অস্ত্রবাজারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরবর্তীকালে সাখারভের কট্টর সোভিয়েত শাসন-বিরোধিতা, যেটা প্রায়শই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একটা প্রাথমিক শর্তের মতোই ছিল খানিকটা। আবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকাতে হইহই করে থাকতে পারে মিখাইল গর্বাচভের নাম, তাঁর দেশকে ডিকটেটরশিপ থেকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু থাকতেই পারে না, ধরা যাক, হোসে দানিয়েল ওর্তেগার নাম, যদিও ১৯৬০-৭০-এর দশকে সোমোজা ডিকটেটরশিপে ছারখার হয়ে যাওয়া নিকারাগুয়ায় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনে এই সান্দিনিস্তা বিপ্লবীর অবদান অবিস্মরণীয়।
বিশ্বের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে মান্দেলা, আরাফত, সুচি-র যুগান্তকারী অবদানকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য নোবেল পুরস্কারগুলির মধ্যে সব থেকে রাজনৈতিক যে পুরস্কার, সেই শান্তি পুরস্কারের অন্তর্নিহিত যুক্তিটাকে বোঝার চেষ্টা করা। সেটা হেলাফেলা নয়। দীর্ঘ চর্চার পর, তর্ক-বিতর্কের পর সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই তর্ক-বিতর্কে ‘শান্তি’ কীভাবে ব্যাখ্যাত হয় আমার কাছে সেটাই বেশ কৌতুকপ্রদ। সেখানে যে শুধু ওয়াশিংটন, মস্কো, লন্ডনের শান্তিই স্বীকৃত তা নয়, কামচাটকার শান্তিও যথেষ্ট জরুরি, যদি, যদি কামচাটকায় অশান্তি ওয়াশিংটন, মস্কো, লন্ডনের শান্তিকে বিঘ্নিত করছে বলে ওয়াশিংটন, মস্কো, লন্ডন মনে করে। আর সেটা যে জরুরি তাই বিশ্বকে প্রত্যেক বছর মনে করিয়ে দেয় নোবেল শান্তি পুরস্কার।
এর পরেও আর একটা কথা আছে। নবীনচাঁদ তার জন্মদিনে নিজের কেনা মিহিদানা পাগলা দাশুকে না দিয়ে স্কুলের দারোয়ানের রামছাগলটিকে খাইয়ে ‘আমার মিহিদানা, আমি যা খুশি করব’, এই যুক্তি দেওয়ার প্রত্যুত্তরে এক প্যাকেট চিনে পটকা ক্লাসে মাস্টারের চেয়ারের তলায় বেমক্কা ফাটিয়ে দাশু যুক্তি দিয়েছিল, ‘আমার চিনে পটকা, আমিও যা খুশি করব।’ ‘Merchant of Death’ আলফ্রেড নোবেলের দিয়ে যাওয়া টাকা নিয়ে তাঁর নির্দেশ মতো তৈরি কমিটি যা খুশি করবে নিজস্ব যুক্তিতে। কথা হল, সেই যুক্তিটি নিয়েই আমরাও নিজেদের মতো করে ‘নোবেল’ ‘নোবেল’ বলে নাচানাচি করব কি না তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।