Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাসন্তী দাসের ধারালো কলম

স্বাতী ভট্টাচার্য

 


আদিবাসী মহিলার প্রতি কটূক্তি, তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা গুরুতর অপরাধ, তাকে কোনও মতেই হালকাভাবে নেওয়া চলে না। তদন্ত অবশ্যই দরকার, তার জন্য অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদও দরকার। কিন্তু বাসন্তীর বিরুদ্ধে পুলিশি ‘অভিযান’-এর কী প্রয়োজন ছিল, কেন তাঁকে এফআইআর-এ উল্লিখিত অপরাধের বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ না করেই গ্রেফতার করা হল, সেই প্রশ্নগুলো কি আঘাত করে না?

 

সবচাইতে ধারালো অস্ত্র কী, তার পরীক্ষা চলছে। স্বয়ং নবাব বসেছেন পরীক্ষকের আসনে, তাঁকে ঘিরে আমির-ওমরা, তাদের ঘিরে আমজনতা। দেশ-বিদেশের নামীদামী কারিগররা উপস্থিত। কারও তলোয়ার সাতপুরু লোহার জাল নিমেষে কেটে দিচ্ছে, কারও তলোয়ারের এক কোপে দুখানা হয়ে যাচ্ছে পাথরের চাঁই। ওস্তাদ কারিগর এলেন শেষে। সাঁ করে হাওয়ায় পাক দিলেন, কিছুই হল না। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল। ওস্তাদ পাশে দাঁড়ানো এক খোজাকে বললেন, “এইও বেয়াদব, নবাবকে কুর্নিশ কর।” সে মাথাটা ঝোঁকাতেই টুপ করে সেটি খসে পড়ে গেল। এমনই ধার তলোয়ারের, যার মাথা কাটা গেছে সে-ও টের পায় না।

নবাব নিজের গলার মোতির মালা পরাতে যাবেন ওস্তাদের গলায়, এমন সময় এক রোগাভোগা চেহারার লোক ছুটতে ছুটতে এল, তার হাতে ধরা তার বউয়ের হাত। “জঁহাপনা, এখনই ইনাম দেবেন না। এই দেখুন, সব চাইতে ধারালো চিজ কোনটা।” এই বলে সে বউয়ের মুখের কাপড় উঠিয়ে দিল, আর বউ বার করে দিল নিজের জিভখানা। উপস্থিত সকলে এক বাক্যে স্বীকার করল, মেয়েদের জিভের চাইতে ধারালো কিছু হয় না। মোতির মালা পেল রোগা লোকটাই।

মুখরা, কলহপ্রিয়, অসহায় গৃহকর্তার উপর সদাই খড়্গহস্ত গৃহিনী— এমন কত না রসিকতা রয়েছে। এই চুটকি তারই একটা। একে হালকা, নির্দোষ আমোদ ভাবলেই তো হয়। কিন্তু কোথায় যেন খটকা লাগে। এ গল্পগুলো নির্ঘাৎ মেয়েরা লেখে না। সংসার, সমাজ তো এটাই রোজ দেখায় যে, নির্যাতন সে-ই করে যার হাতে ক্ষমতা, আর যার হাতে ক্ষমতা সে-ই লেখে চিত্রনাট্য। সেখানে প্রভাবশালী সর্বদাই নিজেকে রাখেন নির্যাতিত, নিপীড়িতের পার্টে। বিলিয়নেয়ার শিল্পপতি করুণ আফশোস করেন, শ্রমিকদের আগ্রাসনে তিনি জেরবার। সরকারি আধিকারিক এলাকার মানুষের চাপে বিপর্যস্ত। শিক্ষকেরা ছাত্রদের উপদ্রবে দিশাহারা। গৃহপরিচারকের টাকার খাঁই সামলাতে গৃহস্থের ঘাম ছুটে যায়, এসি-র হাওয়াতেও তা শুকোয় না।

সরকারি নীতির টেক্সট থেকে মোবাইলে পাঠানো চুটকি, সব কিছু নিরন্তর যে বয়ান রচনা করে যায়, তাতে বাস্তব এমনই হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ হয়ে দেখা দেয়। সেখানে শ্রমিকমাত্রই দুর্বৃত্ত, চাষিমাত্রই ফাটকাবাজ, মেয়েমাত্রই করালজিহ্বা। জনগণ সেখানে অর্ধভুক্ত, সিকি-মজুরিতে কাজ করা গরিব মানুষ নয়, তারা সতত আক্রমণোদ্যত, উন্মত্ত এক ভিড়। তার সামনে গোটা রাষ্ট্রই থরহরিকম্প, অসহায় বেড়ালছানা। সেইজন্যই না পুলিশের লাঠি-বন্দুকের এত দরকার?

খড়্গপুরের বাসন্তী দাসের সঙ্গে রাষ্ট্র যে ব্যবহারটা করল, তার মাথামুন্ডু খুঁজে পেতে হলে ক্ষমতার এই ‘হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ’ বয়ান ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। পুলিশ তাঁকে ৬ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। বাসন্তীকে রাতের পোশাক থেকে চুড়িদার-কামিজে বদল করতেও হয়েছে এক মহিলা পুলিশরক্ষীর সামনে, বাইরে তখন অপেক্ষা করছে পুলিশবাহিনী। যেন বাসন্তী কত বড় অপরাধী, যেন বহুদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, চুপিচুপি বাড়ি ফিরেছেন, গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের ‘অভিযান’ যেন এই বার্তাই দিতে চায় যে থানায় ডেকে পাঠালে, কিংবা দিনের বেলা গিয়ে কথাবার্তা বললে, ওই গৃহবধূ, যিনি দীর্ঘদিন ওই এলাকাতেই সপরিবারে বাস করছেন, তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন। আর বাসন্তী যদি মুক্ত থাকতেন, তাহলে এলাকার মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হত। সাতদিনের জেল হেফাজতের পর আদালত অবশ্য শর্তসাপেক্ষে বাসন্তী দাসকে জামিন দিতে দ্বিধা করেনি। আজ, ১৫ সেপ্টেম্বর, বাসন্তীর ছাড়া পাওয়ার কথা জেল থেকে। যদিও আদালতের নির্দেশ, তিনি নিজের এলাকায় ফিরতে পারবেন না এক মাস।

এলাকা থেকে বহু আগেই সরে গিয়েছেন বাসন্তীর স্বামী-পুত্র। পারিবারিক সূত্রে খবর, বাসন্তী গ্রেফতার হওয়ার পরেই তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়দের বাড়িতে। এলাকায় থাকা নিরাপদ মনে করছেন না তাঁরা।

কেন গ্রেফতার হয়েছিলেন বাসন্তী? একটি বড় কাগজের এক সাংবাদিকের সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। সেই সূত্রে খবরটি নানাভাবে চর্চিত হয়েছে। ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে চোলাই মদের ঠেক। খড়্গপুরের সাঁজোয়াল এলাকার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় চোলাই মদের কারবার, আর তার চারপাশে অসামাজিক কার্যকলাপ নিয়ে নালিশ করে আসছেন। মাতালদের কোলাহল, রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা, এলাকার মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারে তাঁরা অতিষ্ঠ। পুরপ্রতিনিধি-সহ নানা জনের কাছে দরবার করেও যখন লাভ হয়নি, তখন এলাকার মহিলারা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। বাসন্তী দাস, বন্দনা পাত্র, বীণা মাইতি, তনিশা মাইতি, দীপালি মহেশ, এবং এলাকার আরও কয়েকজন খড়্গপুর টাউন থানায় আগস্টের শেষে অভিযোগ করেন যে, অবৈধ মদের ভাটির জন্য তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। পুলিশ যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। নির্দিষ্ট কারও নামে অভিযোগ করা হয়নি। এই অভিযোগ গ্রহণের পরে পুলিশ একদিন ওই এলাকায় গিয়ে কিছু মদ্যপকে পাকড়াও করে। কারবারিদের কারওকে ধরা যায়নি। তার পরদিন, ২৭ অগস্ট, বাসন্তী, বন্দনা-সহ অভিযোগকারিণীদের বাড়িতে হানা দেয় অবৈধ কারবারিদের দল। তাদের নানা হুমকি দেওয়া হয়, এবং জানিয়ে দেওয়া হয় যে মদের কারবার বন্ধ হবে না। আতঙ্কিত বাসন্তী, বন্দনারা বারবার থানায় ফোন করেন। পুলিশ যতক্ষণে আসে, ততক্ষণে চলে গিয়েছে হামলাকারীরা।

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার পরে একাধিক বার পুলিশ বাসন্তীর কাছ জানতে চেয়েছে, তাঁকে আর বিরক্ত করা হয়েছে কিনা। সব ঠিক আছে কিনা। সেই পুলিশই কীভাবে সম্পূর্ণ অন্য মূর্তিতে দেখা দিল ৬ সেপ্টেম্বর, কীভাবে আদিবাসী মহিলার উপর হামলার মতো কঠোর ধারায় অভিযুক্ত করল বাসন্তীকে, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। অভিযোগকারিণী আদিবাসী মহিলা অবৈধ চোলাই কারবারে যুক্ত পরিবারগুলির সঙ্গে সংযুক্ত কি না, এবং এটা চোলাইয়ের ঠেক ভাঙার প্রতিক্রিয়া কিনা, সে সংশয় দেখা দেয় যখন দেখি, মহিলা তাঁর এফআইআর-এ লিখেছেন, তাঁর নামে অবৈধ মদের কারবারের মিথ্যা অভিযোগ করেছেন বাসন্তী ও অভিযুক্ত সাংবাদিক।

আদিবাসী মহিলার প্রতি কটূক্তি, তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা গুরুতর অপরাধ, তাকে কোনও মতেই হালকাভাবে নেওয়া চলে না। তদন্ত অবশ্যই দরকার, তার জন্য অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদও দরকার। কিন্তু বাসন্তীর বিরুদ্ধে পুলিশি ‘অভিযান’-এর কী প্রয়োজন ছিল, কেন তাঁকে এফআইআর-এ উল্লিখিত অপরাধের বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ না করেই গ্রেফতার করা হল, সেই প্রশ্নগুলো কি আঘাত করে না?

স্বাধীন জীবন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তাতে হস্তক্ষেপ করতে গেলে তা সবিশেষ চিন্তার পরেই করতে পারে পুলিশ, এ কথা বারবার মনে করিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এক্ষেত্রে কতটা চিন্তা করেছিল পুলিশ, বাসন্তীর অধিকার, নিরাপত্তা, সম্মানের বিষয়ে?

রাজ্যের যে অগণিত মেয়ে টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের পাতায় এই ঘটনার খবর দেখলেন, তাঁরা কী দেখলেন? দেখলেন, কত সহজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকারিণী এক মহিলাকে ‘অভিযুক্ত’ বলে দেখিয়ে দেওয়া যায়। কেমন করে চোলাইয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা নিমেষে বদলে যায় ভোররাতের সক্রিয়তায়— যখন অভিযুক্তরা এক গৃহবধূ, আর এক সাংবাদিক।

পশ্চিমবঙ্গে ‘উইমেন্স ইস্যু’ বলে যদি কিছু থাকে, যদি এমন কোনও কার্যসূচি থাকে যেখানে বাংলার মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক হয়ে রুখে দাঁড়ায়, তা হল চোলাইয়ের ঠেক ভাঙা। পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও ব্লক নেই, যার কোনও না কোনও গ্রামে মেয়েরা একজোট হয়ে চোলাইয়ের ঠেক ভাঙেনি। তার জন্য তারা ঘরে-বাইরে মার খেয়েছে, হজমও করেছে। তবে এবার যে মারটা পড়ল, তা একেবারে মোক্ষম। চোলাইয়ের ঠেক ভাঙার আবেদন থানায় জমা করার পর পরই যে জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হচ্ছে একটি মেয়ে, ভোররাতে তাকে বাড়ি থেকে টেনে থানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, এ দৃশ্যটা সামনে আসেনি এত দিন।

পুলিশ হয়তো বলবে, বাসন্তীর অভিযোগ আর বাসন্তীর গ্রেফতারি হল ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’

কিন্তু নারী অধিকার, নারী মর্যাদার পর্যবেক্ষকদের কাছে এ হল মেয়েদের প্রতি অবিচ্ছিন্ন হিংসার লাভাস্রোতের একটা স্ফুলিঙ্গবর্ষী ঢেউ মাত্র। মেয়েরা যখন মুখ খোলে, তখন এমনই ‘সামাল সামাল’ রব পড়ে যায়। কেন কলেজ থেকে ফেরার পথে মেয়েদের গণধর্ষিত হতে হবে, সর্বসমক্ষে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন কামদুনির মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল। তাঁদের সর্বসমক্ষে ‘মাওবাদী’ তকমা শুনতে হয়েছিল। বীরভূমে গণধর্ষিতা এক মহিলাকে শুনতে হয়েছিল, তিনি ‘ডেঞ্জারাস মেয়ে।’ যখনই মেয়েরা তাদের প্রতি প্রশাসনের, জনপ্রতিনিধিদের কর্তব্য মনে করিয়ে দিয়েছে, তখনই সেই শান্ত, আইনসিদ্ধ বাক্য এমনই আঘাত করেছে ক্ষমতাসীনকে, এমন পড়পড় করে ছিঁড়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের মুখোশ, যে অবমাননা থেকে অ্যারেস্ট, কিছুই বাকি থাকেনি। এ থেকে আন্দাজ হয়, তুখোড় সাংবাদিকের কলমের চাইতে বাসন্তী দাসের মতো মেয়েদের কলমের ধার কিছু কম নয়।

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দিল, মেয়েদের কথার ধার ঠিক কতখানি। আর, ‘উলটপুরাণ’ বজায় রাখতে কত দূর যেতে পারে রাষ্ট্র।


*মতামত ব্যক্তিগত