Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিরোধী জোটের গোদি-অ্যাঙ্কর বয়কট: পাল্টা কোপ স্বাধীন মিডিয়ায়?

সুমিত দাস

 


ক্ষমতায় এসেই গণতন্ত্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ' সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে বিজেপি। এক দশকে আমূল বদলে যাওয়া 'পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া' নিয়ে অবস্থান নিয়েছে বিরোধী জোট। অতঃপর? এবার কি স্বাধীন ডিজিটাল মিডিয়ায় পাল্টা কোপ? কারণ, সেখানে এখনও সরকারকে প্রশ্ন করা হয়

 

সত্তর শতাংশ মিডিয়াকর্মী পেশাকেন্দ্রিক মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে এই তথ্য দিয়েছে লোকনীতি-সিএসডিএস। কৌতূহল আছে। বাকি ৩০ শতাংশ কারা, যাঁরা মানসিক চাপের বাইরে? তাঁরা কি নির্দিষ্ট সংস্থার পলিসি-মেকার? নাকি সাধারণ কর্মী? যাঁদের ঋণ আছে, মাসিক খরচ আছে, সংসার আছে? সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন মনে হচ্ছে। তবে গণমাধ্যম, সাংবাদিকতার বেসিক নৈতিকতা মাথায় রাখলে— উত্তরে জটিলতা কমে। কারণ, লোকনীতি-সিএসডিএস-এর সমীক্ষা বলছে, ৮২ শতাংশ সংবাদমাধ্যমেপর কর্মী মনে করেন, তাঁদের সংস্থা বা ব্র্যান্ড সরাসরি একপাক্ষিকভাবে বিজেপির সাপোর্টার বা বিজেপিরই চ্যানেল। ২০৬ জনের এই স্যাম্পেল সার্ভে-তে ৭৫ শতাংশ পুরুষ মিডিয়াকর্মী অংশগ্রহণ করেছিলেন। মূলত ইংরেজি ও উত্তরভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের পাশাপাশি বেশ কিছু অন্যান্য ভাষার সংবাদকর্মী সার্ভেতে অংশগ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, তাতে বাংলার সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও ছিলেন। আর, সামগ্রিক পরিস্থিতিটাও কার্যকারণ ছাড়া তৈরি হয়নি।

 

দুই.

২০১৯-এর শেষ সাধারণ নির্বাচনটি ছিল ভারতের ‘প্রথম হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন’। এই নির্বাচনের মূল অস্ত্র ছিল ‘ফেক নিউজ’, মানে ভুয়ো খবর। আর সেই নির্বাচন আসার আগের বছর, স্রেফ ২০১৮ সালে মোবাইল মারফত ছড়িয়ে পড়া গুজবে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পরিস্থিতি নির্বাচনের আগে এমন ছিল, যাতে প্রতিদিন ১০ লক্ষ করে ভুয়ো খবর বা গুজব ছড়ানো অ্যাকাউন্ট ফেসবুক বন্ধ করেছে। ভারতে গুগলের সূচিতে থাকা ২৩টি ইউজার ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে মাত্র ১০টিতে ব্যবস্থা নেওয়া গেছে। সে-সময়ে কন্নর, ওড়িয়া ও সিন্ধ্রির মতো ভাষায় কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেনি তৎকালীন ফেসবুক। ফলত, নানাভাবে বিকৃত তথ্য, সরাসরি মিথ্যা তথ্য, কৌশলে সম্পাদিত ভিডিও, মিম, বিজ্ঞাপন মারফত ভুয়ো খবরের বাজার নিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের টাটকা অভিজ্ঞতা আছে।

ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশ। ৬৯.২০ কোটি মানুষ এখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। চলতি বছরে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৩.৩৮ কোটি ছাড়িয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপের এত বড় বাজারটি প্রচারমাধ্যম হিসেবে প্রতিদিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তুলনায়, টেলিভিশন সেটের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু মোবাইল ফোন মারফত টিভির বাজার বেশ বড়। প্রচারমাধ্যম হিসেবে কর্পোরেট চ্যানেল শক্তিশালী। কন্টেন্ট বা বিষয় ইন্টারনেটে ছড়ানোর ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেলগুলো বড় রাজনৈতিক দল ও সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সেক্ষেত্রে নিউজ চ্যানেল মারফত দৃষ্টিকোণ নির্মাণ ও হোয়াটসঅ্যাপ মারফত ভুয়ো খবর ছড়ানো, দুই পন্থা একযোগে বাজিমাত করেছে।

 

তিন.

সাধারণ নির্বাচনের দামামা পুনরায় বাজতে শুরু করেছে। বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ আগেভাগে টেলিভিশন নিউজের ১৪ জন অ্যাঙ্কর নির্বাচন করে, পক্ষপাতদুষ্ট টক-শোয়ে না যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আসলে, তা নির্দিষ্ট কর্পোরেট চ্যানেলগুলোর দিকেই পক্ষপাতের অভিযোগ তুলছে। সাজানো টক-শো দৃষ্টিকোণ তৈরি করবে, রোজ একই বিষয় একপাক্ষিকভাবে বলতে বলতে বিষয়টির বৈধতা নির্মাণ করবে। ২০১৯-এর নির্বাচন পেরিয়ে এখন এই প্র্যাকটিস ক্রমেই তীব্রতর হয়েছে। পাশাপাশি, ইউটিউব ও নানান পোর্টাল মারফত মোদি-সরকারপন্থী কন্টেন্ট যেমন তৈরি হচ্ছে, মিডিয়া-হাউস দখল করতে গিয়ে বিজেপির কোপে বাতিল হওয়া সাংবাদিকদের ইউটিউব-চ্যানেল ও পোর্টালগুলিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবুও, বিনিয়োগ, বিস্তার ও প্রভাবে টিভি নিউজচ্যানেলগুলি গুরুত্বপূর্ণই থাকছে। যে চ্যানেলগুলির ৮২ শতাংশ কর্মী বিশ্বাস করেন— তাঁদের ম্যানেজমেন্ট বিজেপি পরিচালিত। আর, তাঁদের ৭০ শতাংশ সহকর্মী কোনও না কোনও পেশাগত কারণে হতাশায় ভুগছেন।

 

চার.

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যা গোনা চলছিল। সরাসরি প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিক তাঁকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলছেন। মার্কিন মিডিয়া ট্রাম্পের ফতোয়া মানেনি। এ ছবি ইন্টারনেটে অজস্র। আর করণ থাপার নরেন্দ্র মোদিকে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্ন করছেন, লেপেল খুলে আলোচনা ছেড়ে পালাচ্ছেন গণহত্যা-উত্তর গুজরাতের ‘সফল’ মুখ্যমন্ত্রী। দুটো ছবিই ইন্টারনেটে আছে। সেটা অবশ্য ২০১৪-র নির্বাচনের আগের ছবি। প্রশ্ন থাকবে বুঝেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারত নির্মাণের স্বপ্নে মশগুল প্রধানমন্ত্রী মিডিয়া দখলে জোর দিয়েছেন। এবার পাল্টা সেই সরকারপন্থী চ্যানেলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে বিরোধীরা।

জরুরি অবস্থায় সরকারকে প্রশ্ন করে জেলে যেতে হয়েছে সাংবাদিকদের। তাঁরা তো ‘পত্রকার’ বা সাংবাদিক। ‘মিডিয়া-পার্সোনালিটি’ বলে কোনও টার্ম ছিল না। পার্সোনালিটি। তবে এরা স্রেফ ‘হিমশৈলের চূড়া’ মাত্র। ইন্ডিয়া জোট নাকি বিজেপি, সে আলোচনা চলবে, স্বাভাবিকভাবেই চলবে। তবে, চ্যানেলের প্যানেল ও প্যানেলের চ্যানেল ও তার ‘সোনামুখটি’ নির্বাচন হওয়া জরুরি ছিল। মূলধারার মিডিয়া যেভাবে বা যার দ্বারা চালিত হয়, চ্যানেলের মধ্যে যে ‘পাওয়ার স্ট্রাকচার’ থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন বহুকালের। কিন্তু, শেষমেশ অন্তত বাহ্যিক এথিক্সটা মানা হত। আর হয় না।

ব্যক্তির মুখ, ব্যক্তিতে বিনিয়োগ, লাভক্ষতি, পাপপূণ্য সব ব্যক্তির। অতএব, টিআরপি নামক গোলকধাঁধা ব্যক্তি অপারেট করছে, আর টিভি মারফত ঘরে ঘরে বোধবুদ্ধি, বেচাকেনা সাপ্লাই দিয়ে ব্যক্তি হিরো হবে— এ তো যুগের ধারা।

 

পাঁচ.

ঘণ্টা বাঁধা দরকার ছিল। আসন্ন নির্বাচনে যেই জিতুক, লড়াইটা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক। ‘গণতান্ত্রিক মিডিয়া কেমন হবে’ বা হওয়া উচিত, তা নিয়ে কোটি কোটি মানুষ ভাবিত নয়। হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, ভাবা জরুরি। আর ভাবলে সংঘাতও অনিবার্য। পাড়ার মোড় থেকে মোবাইল হয়ে প্রিয়তম টিভিসেটখানি, মিডিয়া সর্বত্র। চাইলেই কথা বলা যায়, চাইলেই ছবি তোলা যায়, চাইলেই পক্ষ নেওয়া যায়, চাইলেই সনাতনী অর্থে বর্ণবাদী হওয়া যায়, চাইলেই একটি গোষ্ঠী, জাতি, ধর্মাবলম্বী, ভাষাভাষী, বা বিশ্ববিদ্যালয়কে দু-ঘণ্টার কাঠগড়ায় তোলা যায়! ভাইরাল হওয়া যায়, ভাইরাল করা যায়। হেব্বি পপুলার হওয়া যায়! এই ধারা নির্মাণ করতে অনেক বিনিয়োগ করতে হয়েছে।

অ্যাঙ্কর চ্যানেলের মুখ। ব্যক্তি যখন, এবার নাম আসা শুরু হল ব্যক্তির। আসলে নামগুলো ছিলই। তিলে তিলে নির্মাণ হয়েছে নাম। হিমশৈলের নিচের অংশে পৌঁছনোর কৌতূহল ও আকাঙ্খা থাকবেই। কোটি কোটি মানুষের নয়, সামান্য লোকজনেরই থাকবে। তৎসহ, সনাতনী বর্ণবাদের অনুশীলনের মতো, বিশ্বাস লাভজনক হলেও, সঙ্কট আসা ভাল, তাতে সময় নড়াচড়া করে। আলোচনা হয়। চিন্তার দেওয়া-নেওয়া বাড়ে। অতএব, নড়াচড়া হোক। আরেকটা লিস্টও আছে, যাঁরা চলে গেলেন। কাজ ছাড়লেন, চাকরি ছাড়লেন। ছাড়তে বাধ্য হলেন। সে লিস্টটাও দীর্ঘতর।

 

ছয়.

আপাতত আলোচনার কেন্দ্রে গোদি মিডিয়া। হিন্দি শব্দ গোদ মানে ‘কোল’— ‘কোলে বসা মিডিয়া’। ইংরেজি শব্দটি আরও বেশি নিন্দাসূচক। ‘ল্যাপডগ মিডিয়া’। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে এই শব্দের প্রণেতা প্রাক্তন এনডিটিভির সাংবাদিক রভীশ কুমার। বিজেপির মুখপাত্র হয়ে ওঠা চ্যানেলগুলির পক্ষপাতিত্ব ‘গোদি মিডিয়া’ নাম পাওয়ার পর সরাসরি ভোটের ইস্যু হয়ে উঠবে তা একপ্রকার অনুমান করা যাচ্ছিল। সরকার ও সরকারপন্থী কর্পোরেট যখন বিজ্ঞাপনের মূল সোর্স, তখন ক্রমে তাকে গোদ বা কোলে বসানো কঠিন হয়নি। শুরুতে বাধ সেধেছিল সাংবাদিকতার বহিরঙ্গের আদর্শগত চলন। ওই ‘নিরপেক্ষতা’। তাকে দুরমুশ করতে লাগাতার প্যাঁচ কষে গেছে আরএসএসের হিন্দু জাতীয়তাবাদী থিঙ্কট্যাঙ্ক। করণ থাপার, পূণ্যপ্রসূন বাজপেয়ী, অভিসার শর্মা, রভীশ কুমার স্বয়ং, এমনকি ভারতীয় টিভি সাংবাদিকতায় অন্যতম সেরা প্রণয় রায়-ও অতীত হতে বাধ্য হলেন। তালিকা দীর্ঘ। এঁদের অনেকেই ইউটিউবে নতুন করে জনপ্রিয়তা ও সাফল্য পেয়েছেন। অতএব, বিজেপির কর্পোরেট চ্যানেলের সঙ্গে সামান্য হলেও লড়াই থাকবে। আর, নানান রাজ্যে সাম্প্রতিক হয়ে যাওয়া নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবিও ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে বিরোধী জোটের ‘মিডিয়া-অবস্থান’। যা আসলে যুদ্ধংদেহী মনোভাব। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নামকরণ থেকে বিজেপি এমনকি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি বিরোধীদের পাল্টা কৌশল নিচ্ছেন। এতদিন ছবিটা উল্টো ছিল। বিজেপির চালে ভাবতে হচ্ছিল বিরোধীদের। তবু, তথাকথিত ‘গোদি মিডিয়া’ ছাড়াই বিরোধীরা রাজ্যগুলিতে জিতছে। এমনকি মিশন-চন্দ্রযানের সাফল্যে আলাদা করে অ্যাডভান্টেজ পায়নি বিজেপি। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না। আচমকা রীতি ভেঙে বিশেষ পার্লামেন্ট অধিবেশন ডেকে কি তবে বড় কিছু সিদ্ধান্ত আরোপ করবে বিজেপি? ‘এক দেশ, এক ভোট’-সহ ‘স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র’ নির্মাণের জন্য একযোগে বহু ব্রেকিং নিউজ বানানোর দিকে এগোচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি? আলোচনায় আসছে, এ পর্বে কি ‘স্বাধীন ডিজিটাল মিডিয়া’গুলোকেও বেড়ি পরানো হবে? নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাদের? কারণ, ভারতের নিরাপত্তা, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, নয়া পার্লামেন্ট, সেনাকে দিয়ে সরকার বা বকলমে দলের প্রচার— সঙ্গে চন্দ্রযান ও জি-টুয়েন্টির সাফল্য সামনে রেখে, ভারতের ‘ভারত’ নাম দিয়ে ‘সফল রূপকার মোদি’-ব্র্যান্ড তুলে ধরে নির্বাচনে এগোবে বিজেপি? যাঁর হাতে এবার ‘সনাতনী রাজদণ্ড’? স্বাধীন মিডিয়া প্রশ্ন করবেই। কারণ, সেই প্রশ্নগুলির মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব, ‘সাংবাদিকতার বেঁচে থাকা’। অতএব, চরম সংঘাতের আভাস আছেই। এই অধিবেশনে স্বাধীন মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ বা আরোপের সম্ভাবনা তাই থাকছেই। নানাভাবে আরও সংঘাত অনিবার্য। ওয়াকিবহাল মহলে কানাঘুষো সেই কথাই বলছে।


*মতামত ব্যক্তিগত। হেডারের ছবিটি এঁকেছেন কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত