Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যা দেখি, যা শুনি

যা দেখি, যা শুনি | প্রবুদ্ধ বাগচী

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

ঘটনাচক্রে উত্তর কলকাতার একটা বিস্তীর্ণ অংশে আমায় ঘুরে বেড়াতে হয় একরকম জীবিকাসূত্রেই। আর যে এলাকায় আমার বাস সেটাও কলকাতার তথাকথিত ‘পশ’ এলাকা একদমই নয়— পুরনো জনপদ, সাবেকি বাড়ি ভেঙে ভেঙে বহুতল উঠলেও এখনও আছে কিছু প্রাচীন বাড়ি, তার চারদিকের সোঁদা আর ভিজে মাটির গন্ধ নিয়েই। প্রবাহিনী গঙ্গার পাড়ে পাড়ে প্রোমোটারের গ্রাসে ‘রিভার ফেসিং অ্যাপার্টমেন্টের’ হাতছানি থাকলেও থেকে গেছে কিছু পুরনো ঘাট, ঘাটের সিঁড়িগুলি অধুনা উন্নয়নের রঙে বাঁধানো হলেও সেই ঘাটে যাঁদের নিত্য আসা-যাওয়া তাঁরা আজও ততটা ‘উন্নত’ নন— কয়েক প্রজন্মের মোটা দেওয়াল আর গোল থামের বাড়িতে ভাগের মা গঙ্গা না পেলেও তাঁরা আছেন, এখনও টিকে আছেন। কথাটা ঠিক তাঁদের নিয়ে নয়। বরং বলছি একটা পাল্টে যাওয়া পরিবেশের কথা। না, এটা ঠিক একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার দুঃখ-বিলাস নয়, নয় পাড়ার হারিয়ে যাওয়া রক আর তারই মধ্যে সামাজিক অভিভাবকের আধিপত্য বা প্রশ্রয়ের বহু পরিচিত আখ্যান। এটা একটা অন্য গল্প, গল্পটা ‘পরিবর্তন’-এর আসলে যাকে খালি চোখে দেখলে ঠিক ভিতরের সত্যি বা অভিপ্রায়টা বোঝা মুশকিল। তাই একটু কান পেতে শোনা আর কি!

বছর ছয়েক আগে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ‘রামনবমী’ নিয়ে যখন প্রতিযোগিতামূলক ‘রামভক্তি’র বান ডেকেছিল ঠিক সেই সময়ে আমরা হয়তো বুঝতে পারিনি এই ‘সংবাদ শিরোনাম’ কোথাও আসলে একটা নতুন মনোভঙ্গিমার গর্ভাধান ঘটিয়ে ফেলল। ব্যাপারটা শুধু যে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে ধর্মীয় উৎসব পালন নিয়ে আকচা-আকচি তাই নয়, এই অতিরিক্ত ধর্মীয় আবেগের ছুঁচোবাজির আসল উদ্দেশ্য বোঝা গেল যখন ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে হঠাৎই বিরোধী দল হিসেবে সামনে চলে এল কেন্দ্রের শাসক দল। তখন তাদের পায় কে! পারলে সেই মুহূর্তেই তারা দখল করে নিতে চায় পশ্চিমবঙ্গের রাজপাট। রোজ সকালে সংবাদপত্রে তাদের ‘সুভাষিত’, টিভি চ্যানেলে তাদের আগ্রাসী দেহভাষা— প্রায় যেন তারা অর্ধেক রাজত্ব পেয়েই গেছে! এই আগ্রাসনের চূড়ান্ত এক চেহারা আমরা দেখেছিলাম ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের প্রায় ছ-মাস আগে থেকে। শাসক দলের হেভিওয়েট নেতাদের কেনা-বেচা, রং পাল্টে তাঁদের রাতারাতি বিরোধী বনে যাওয়া ও তাই নিয়ে প্রবল মিডিয়া হাইপ। হাওড়ার ডুমুরজলা ময়দানে যেদিন ‘যোগদান-মেলা’ হয়েছিল, সেদিন ঘটনাস্থলে হাজির থেকে খেয়াল করেছিলাম বিশাল মঞ্চে যত নেতার সমাবেশ, তার দ্বিগুণ উপস্থিত সংবাদমাধ্যম, তুলনায় মাঠে ভিড় অনেক কম। অনেকেই হয়তো জানেন, কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ যখন সংবাদমাধ্যম কভার করতে যায়, ডাইরেক্ট টেলিকাস্টের ছবি তাদের পেতে হয় ওই দলের নিজস্ব ক্যামেরা নেটওয়ার্ক থেকে, সেই ক্যামেরা যেটুকু যেভাবে দেখায় সেইটুকুই দেখতে পাই আমরা। বোঝাই যায়, ফাঁকা মাঠের ছবি সেভাবে সেদিন কেউ দেখেননি। তবে বাসে বা ম্যাটাডোরে যেসব সমর্থক এসেছিলেন তাঁদের শরীরী ভাষা ছিল এসপার ওসপার করে ফেলার। আজ সবাই জানেন সেই ‘উদ্দীপ্ত’ জনতার আগুন জনমতের প্রাচীরকে ছিন্ন করতে পারেনি, পারেনি রাজ্যে প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রীর কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঙ্কার সত্ত্বেও। এটা নিশ্চয়ই নাকে ঝামা ঘষে দেওয়ার মতো পরাজয়। আর সেই পরাজয়ের পরে দলবদলু ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে এসেছে, রাজ্যের রাজনীতির স্রোত বয়ে চলেছে নিজের নিয়মে।

কিন্তু এই ‘রাজনৈতিক ইভেন্ট’ শুধু সংসদীয় ব্যবস্থার ওঠাপড়ার ভিতরে এক তুচ্ছ ঘটনা হয়েই থাকতে পারত। কত রাজ্যে ভোট হয়, একদল জেতে অন্যদল বিরোধী আসনে বসে— এ আর নতুন কী? কিন্তু এখানেই ঘটে গেল এক প্যারাডাইম শিফট, অন্তত এই শহরে তো বটেই— যেহেতু গোটা রাজ্যের সংবাদ আমার জানার বাইরে তাই অতদূর অবধি বলা ঝুঁকির কথা। তবে শহর পুড়লে যেহেতু দেবালয় বাঁচে না, তাই অনুমান করা যায়, বাকি রাজ্যের ছবি তেমন কিছু আলাদা সত্যিই হয়তো নয়। তবে আজ এই কথা স্বচ্ছন্দে বলা যায়, বিগত নির্বাচনে প্রবল পরাক্রান্ত মৌলবাদী শক্তি রাজনৈতিক জয় না পেলেও তাদের আরাধ্য ‘সংস্কৃতি’ কিন্তু অটুট আছে জনমানসে, তারা যেমনটি চায় প্রায় তাই ঘটছে আমাদের এলাকায় এলাকায়। বহুকাল আগে বৃন্দাবন শহরে গিয়ে দেখেছিলাম, শহরটির অনুষঙ্গেই যেন একটা গদগদ ধর্মীয় অবয়ব— মন্দির, সাধু, সন্ত, মঠ, আশ্রম, নিরামিষ ভোজন, গোমাতার প্রতি নিদারুণ প্রশ্রয় ও ভক্তি। শুনেছি হরিদ্বার বা বেনারস শহরেও নাকি এরকম এক ধর্মীয় পরিবেশ যা নাকি আর্যাবর্তের গোঁড়া হিন্দুত্বের মাথায় আরও আরও জলধারা ঢেলে দেওয়ারই নামান্তর। যেন বা এই শহরগুলি তাঁদের আধুনিক ও স্মার্টত্ব অতিক্রম করেও কোনও প্রাচীন মধ্যযুগের জনপদ এবং তা নিয়ে নাগরিকদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, তাঁরা তো ওইরকমই! আজ কলকাতার পথে পথে ঘুরে মনে হয় প্রায় যেন সেইরকমই এক অভিজ্ঞতার শরিক হয়ে পড়ছি আমরা।

কেন বলছি এই কথা? আজকের কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় এক বিচিত্র বাস্তবতার সামনে চোখ আটকে যায় আমাদের। প্রায় প্রতিটি পাড়ার ভিতর অধিষ্ঠিত একটি ছোট/বড়/মাঝারি মন্দির— এখানে দেব-দেবীর নামাঙ্কন আদৌ প্রধান নয়, যে-কোনও মূর্তির অধিষ্ঠান হতে পারে সেখানে। প্রচলিত কালী বা শনি বা দেবাদিদেব তো আছেই, থাকতে পারে নানা গৌণ দেবী— মনসা বা সন্তোষীমাতা এমনকি লোকনাথবাবা কিংবা হনুমান বা রামেরও প্রস্তরমূর্তি। বড় কথা এটা নয়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে শনিঠাকুরের ‘থান’গুলির বেড়ে ওঠা ও বিকাশের সঙ্গে বাঙালি বামপন্থার যোগ ছিল, এটা আমরা ভুলিনি। আশির দশকে পাড়ার রিকশ স্ট্যান্ড বা বড় মোড়গুলিতে সদ্য-প্রাক্তন ইতিহাসের স্মৃতি-চিহ্নিত ‘শহিদ বেদি’গুলি যখন ক্রমশ সচকিত ‘ভুলিনি, ভুলব না’র কম্পাঙ্ক পেরিয়েও আদপে ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই তাদেরই আশেপাশে ‘দেবতার জন্ম’ দেখেছি আমরা অনেকেই। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আর ‘বাবা তারকনাথ’ ছবির প্রকাশকাল, যার সূত্রে বাঁক কাঁধে তারকেশ্বর যাওয়াটা আস্তে আস্তে একটা সিজনাল উৎসব হয়ে উঠতে লাগল আজ যা কার্নিভালে পরিণত। মৃণাল সেন মশাই রাগ করে বলেছিলেন, বামফ্রন্ট আর বাবা তারকনাথ একসঙ্গে চলতে পারে না! পারে না বললে তো হবে না, তারপরেও বহু বহুকাল তাইই চলেছে! মাঝখান থেকে মৃণাল সরে এসেছেন ফিল্ম তৈরি থেকে আর বামফ্রন্টের ‘জনদরদী’ জনগণতন্ত্রের বাহকরা ঢুকে পড়েছেন দুগগাপুজোর কমিটিতে! মানতেই হবে বারোয়ারি পুজোর এক সামাজিক অর্থনৈতিক মাত্রা আছে, কিন্তু ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’ যদি তাতে ঢুকতেও চায়, তার তো একটা অভিপ্রায় থাকবে এই অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ‘জনচেতনার উত্তরণ’— অন্তত মুখে তা তারা বলত।

কিন্তু এখন যা চলছে তাতে অভিপ্রায় ইতিমধ্যেই অভিসন্ধিতে পরিবর্তিত। কারণ, এই প্রথম আমরা খেয়াল করলাম পাড়ার মন্দিরগুলো আড়ে-বহরে আর সাজসজ্জায় কী পরিমাণ বিকশিত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি পাড়ার মন্দিরে আজ মার্বেল পাথর বসানো চাতাল, টাইলস বসানো দেওয়াল, প্রকাণ্ড সাইনবোর্ডে মন্দিরের নিত্যকর্মের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার অনুপ্রেরণা বা অর্থানুকূল্যের ঘোষিত বার্তা। কোনও কোনও মন্দিরে এমনকি বিগ্রহকে রাখা হয়েছে শীতাতপ যন্ত্রের আওতায়, বাহারি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চাতাল, কোথাও স্থায়ীভাবে বসানো হয়েছে মাইক বা সাউন্ডসিস্টেম, বেশিরভাগ জায়গায় পুজোর জন্য আছেন এক পূজারি, অবশ্যই অবৈতনিক নন— যেন এক স্থায়ী আমোদের হাতছানি, তার সামনে ‘ধর্মীয়’ বিশেষণ বসানো বা না-বসানোয় কিছু যায় আসে না এর ভোক্তাদের। শুধু এই পোক্ত কাঠামোই নয়, বছরের এক বা একাধিক সময়ে সেই মন্দির ঘিরে ভক্তের স্বার্থে চলে বিশেষ পুজোপাঠ, অঢেল ভোগ-বিতরণ— রিকশভ্যানে করে বস্তায় বস্তায় আসছে চাল-ডাল-মশলা, আসছে দুধ-মিষ্টি, মন্দির চত্বরে ত্রিপল খাটিয়ে বসেছে ভিয়েন, ব্যস্ত রাঁধুনিরা সেখানে বিরাট গ্যাসস্টোভে হাঁড়ি-কড়াই চাপিয়েছেন, নেমে পড়েছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা— এলাকায় এলাকায় সে এক বাড়তি উৎসবের পড়ে-পাওয়া বিনি পয়সার ভোজ। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এইসব বাড়তি আড়ম্বরের জন্য এলাকার বাসিন্দাদের থেকে কোনও বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করা হয় না, তাই বোধহয় বাসিন্দাদের ভক্তি ও বিশ্বাস আরও আরও প্রণত। ‘উনি’ না থাকলে যে কী হত আমাদের! এইসব ‘উনি’ বা ‘তিনি’দের দাপট প্রশস্ত হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, মন্দিরের চুড়োর মতোই তা তীক্ষ্ণ ও আগ্রাসী।

এতেও আমাদের কোনও বিস্ময় নেই। পাড়ার দাদারা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন অনেক আগেই। প্রশ্নটা হল এই বিপুল অর্থের উৎসটা ঠিক কোথায়? এই ভবঘুরে প্রশ্নটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আসুন আরও দু-একটা দেখা-শোনার কথা বলি। এইসব মন্দির তো চোখে দেখা যায়, আসতে যেতে দেখা যায় তার প্রকাণ্ড প্রাকার— কিন্তু এর বাইরে আছে এক অন্য আয়োজন। গত কয়েকবছরে সারা বছরের নানা সময়ে রাত দশটা-সাড়ে দশটার কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাত এগারোটার সময়ও শুনতে পাই প্রবল এক শব্দপুঞ্জ ধেয়ে আসছে বড় রাস্তা ধরে। ক্রমশ কাছে আসে সেই পিণ্ডবৎ নাদ, জানলার বাইরে তাকাই বা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই— চোখে পড়ে তুমুল আলোকসজ্জিত একেকটা ভ্যান, ম্যাটাডোর— তার একটিতে এক প্রবল দেবীমূর্তি— সব ক্ষেত্রে যার আদল চেনা যায় না, পেছনে জেনারেটর, তার পরে চারফুট উঁচু উচ্চনাদী বক্স, যার ডাকনাম ডিজে, তার পেছনে নৃত্যরত যুবক-যুবতী-তরুণী-গৃহবধূ-মাঝবয়সি কর্তা, কখনও কখনও তারও পেছনে ব্যান্ডপার্টি! অনেক ভেবেও তল পাই না এটা কোন পুজোর ভাসান? কোথায় কোন আড়ালে ছিল এই ভৈরব আয়োজন? কারা করল এই পুজো? কখন করল? চমকে উঠি ভিতরে ভিতরে। কোনও কোনও ‘উৎসব’কে বোধহয় ‘বিসর্জন’-এর বাজনাতেই চেনা যায়! সদ্য পেরিয়ে আসা শ্রাবণ মাসে শহরের প্রায় সর্বত্র রাস্তার পাশে পাশে দেখি বিশালাকার মঞ্চ এবং ডিজে, বাঁক কাঁধে পুণ্যার্থীদের জন্য এগুলি নাকি অস্থায়ী জলসত্র যা শহর পেরিয়ে চলে গেছে শহরতলির ভিতর দিয়ে। শ্রাবণ মাসের প্রতি শনিবার বিকেল থেকে রাস্তার এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে শুরু হয় এগুলির অফিসটাইম, সারারাত চলে, যার বিস্তার রবিবার সন্ধে অবধি তো বটেই। নিছক জলপান নয়, এখন এতে থাকে ঠান্ডা শরবত, লাড্ডু বা মিঠাই— যেগুলো অন্তত বিনে পয়সায় পাওয়া যায় না। কারা টাকা জোগায় এদের? অত বড় মাপের প্যান্ডেল, আলো, শব্দদানব, অবাক জলপানের অঢেল আয়োজন— এগুলি কি জনগণের থেকে চেয়েচিন্তে হয় নাকি?

না, হয় না। আর সেইখানেই ওই জিজ্ঞাসার জন্ম। আসলে কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছে এবং আজও ঘটছে। শিবরাত্রির মতো একেবারে পাড়া-ইভেন্টে যেদিন সরকারি ছুটির লাল চিহ্ন পড়ল তারপর থেকেই পাড়ার কচি কচি শিবমন্দিরগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটল চোখের ওপর— মা বোনেদের ‘লিঙ্গপুজো’র জন্য আঞ্চলিক দাদা-ভাইদের সে কী প্রাণপাত! এখানেও অর্থের অভাব নেই। মাত্র কদিন আগে দেখলাম উত্তর কলকাতার এরকম একটি পাড়ার মন্দিরকে ঝাঁ চকচকে করে তাতে বসানো হয়েছে দুর্গাপ্রতিমা— শুধু সেই মন্দিরটি স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি ও বিধায়ক ‘উদ্ঘাটন’ করবেন বলে তৈরি হয়েছে বিশাল একটি মঞ্চ যাতে অন্তত হাজারজনের মানুষ দিব্যি বসতে পারেন। খরচ কে দিলেন, জানা নেই। ‘ভোলে বাবা/পার করেগা’-দের জন্য দেখলাম এবার একটি সংগঠন বেশ উদার স্পনসরশিপ দিয়েছে। তাদের নাম ‘রাষ্ট্রীয় হিন্দু সেবা সমিতি’। কস্মিনকালেও এই প্রতিষ্ঠানের নাম শুনিনি। ওই একই সময়ে অনেক পাড়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘মহাদেবের রুদ্রাভিষেক’— এই অনুষ্ঠানের কী অর্থ জানি না, নামটা কপি-পেস্ট করলাম অনুষ্ঠানের হোর্ডিং থেকে। এই অনুষ্ঠানগুলির আয়োজক ছিলেন স্থানীয় পুরপিতা বা মাতারা, এই খবরও জোগাড় করা গেছে ওই হোর্ডিং থেকেই।

নব্বই দশকের শেষদিকে যখন কলকাতায় সরকারি বদান্যতায় ‘হকার উচ্ছেদ’ হয়েছিল, সেই সময়ে এই ঘটনা নিয়ে একটা বাংলা ছবি হয়েছিল। সেই ছবির এক দৃশ্যে যখন পে লোডার দিয়ে হকারদের দোকান ভাঙা হচ্ছে তখন ছবির সাউন্ডট্র্যাকে ছিল দুই পথচারীর কথাবার্তা।

—আমাদের রাস্তা দখল করে কী অসুবিধায় ফেলেছেন দেখেছেন!
—আরে মশাই সে তো রাস্তার ওপর মন্দিরগুলোও আছে, ওগুলো ভাঙছে না কেন?
—মন্দির ভাঙবে কি মশাই! ওগুলো সব পার্টির দাদাদের ব্যাপার…

ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন ‘পার্টি’ শব্দটার যা অর্থ ছিল আজ আর তা নেই। কিন্তু মন্দির ভাঙার কথা আজ আর মুখে উচ্চারণ করাও পাপ শুধু নয়, যে-কোনও সময়ে তা ‘আইনশৃঙ্খলা’র বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া এখন তো সরকারি সংস্থাই এই রাজ্যে মন্দির বানানোর বরাত পেয়েছেন। পাড়ায় পাড়ায় চকমিলানো মন্দির, যে-কোনও ইসুতে দেদার খরচ করার কাঁচা টাকা, সামান্য কোনও তাৎপর্যহীন দেবতাও আজ মুহূর্তে ‘ইভেন্ট’ হিসেবে উঠে আসতে পারেন। সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি ‘গণেশপুজো’র নির্দিষ্ট তিথি— বললে বিশ্বাস করবেন না, অনেক পাড়ার ক্লাব জাঁক করে গণেশপুজো করবেন বলে আগস্টের মাঝামাঝি থেকেই প্যান্ডেলে বাঁশ ফেলতে আরম্ভ করে দিয়েছেন! জানি না, আঞ্চলিক অর্থনীতির চাকা এইসব আয়োজনের মাধ্যমে কীভাবে কতটুকু ঘোরে, কিন্তু বেশ বোঝা যায়, ধর্মীয় উৎসব পালনে টাকার অভাব নেই, সেই টাকা জোগানোর গৌরী সেন কারা তা বুঝতেও পারি— তবে কি, সব কথা বলতে নেই!

ধর্ম মানে সাম্প্রদায়িকতা নয় নিশ্চয়ই। ঠিক। কিন্তু পাবলিক হেলথ যেমন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একটা শাখা, তেমনি পাবলিকের মন, যাকে বলি গণমানস, তাকেও ঠিক ব্যক্তিমনের নিরিখে হিসেব করা যায় না। আর এই পাবলিক-ই আসলে ভোট দেয়, নিজেদের প্রতিনিধি ঠিক করে। গত বিধানসভায় তাঁরাই ভোট দিয়ে রুখে দিয়েছেন মৌলবাদীদের আস্ফালন, বেশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সেই ‘বিজয়’কে পরিবর্তে আমরা কী ফিরিয়ে দিলাম? কাল যদি আবার ভোট হয়, তাঁরা হয়তো আঞ্চলিক প্রভুদের দিকে তাকিয়ে আবারও ভোট দেবেন কোনও একটি বিশেষ রঙে। কিন্তু তাতে রাজনীতি জিতলেও জিততে পারে, বাংলার সংস্কৃতি জিতবে কি? রাজতন্ত্রের যুগে যে বাংলায় কোনও আর্য রাজা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেই বাংলাকে আজ টেনে আনা হচ্ছে আর্যাবর্তের ভক্তি-প্যাচপেচে মডেলে, যে ভক্তি আসলে কেড়ে নেয় মানুষের উদ্যোগ আর উদ্যম, পরিবর্তে এক টলটলে দৈব নির্ভরতায় তাঁকে নতজানু করিয়ে দেয়— ওপরওয়ালা আছেন, তিনিই দেখবেন! কালক্রমে এই ওপরওয়ালার ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমে পড়েন এলাকার নিয়ন্ত্রকরা— তাঁদের দৈবী ভূমিকায় আস্থা রাখা ছাড়া নাগরিকের আর কীই বা করার আছে?

ঠিক তাই। পাড়ায় পাড়ায় আজ প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় ধোঁয়া ছড়ানোর মরশুম। আমার শহর কোনওদিন এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়নি, গত ষাট-সত্তর বছরে কলকাতা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। শহরে ‘রামমন্দির’ ছিল নেহাতই একটা বাসস্টপের নাম, পাড়ার পুরনো মন্দিরগুলো বিশেষ কোনও উপলক্ষ্যে সামান্য সেজে উঠত পাড়ারই কিছু মাতব্বরের উদ্যোগে, ব্যস ওইটুকুই তার পরিধি। দুয়েকজন রাজনৈতিক নেতা নিজেরা দুর্গা বা কালীপুজো করতেন, এই পর্যন্ত। কিন্তু এর একটা সীমাবদ্ধতা ছিল নিশ্চয়ই, তা এইভাবে ‘জনগণের’ পুজো হয়ে ওঠেনি, আজ যাকে আমরা বিকশিত হতে দেখছি এপাড়ায়-ওপাড়ায়। পুজো-আচ্চা যে খুব খারাপ ব্যাপার এই কথা চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে নই, কিন্তু ভয় হয় এইখানে যে, সুদূর গুজরাতের ভক্তিপ্রধান রাজ্যে যখন সংখ্যালঘুদের এথনিক ক্লিঞ্জিং হচ্ছিল, সংখ্যাগুরুর ভক্তসমাজ অন্তত ধর্মের দিব্যি কেটেও কাউকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। উত্তরপ্রদেশে ধর্মীয় মেরুকরণের ধোঁয়াশায় সংখ্যালঘু-পীড়ন যখন এক কিংবদন্তির পর্যায়ে উপনীত, ধর্মপ্রিয় সাধারণ মানুষের স্বর সেখানে কোথায়? হায় ধর্ম!

ভয় হয়, এই রাজ্যেও ইদানিং সাম্প্রদায়িকতার চাষবাস নেহাত কম নয়, এখানে-ওখানে গোষ্ঠীসংঘর্ষ নিয়ে প্রশাসনকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে প্রায়ই— প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় উৎসবের প্রোমোটারি এই অসুখের ওষুধ নয়, এটা অনেকেই জানেন। প্রশাসন দিয়ে দাঙ্গা থামানো গেলেও সাম্প্রদায়িকতার জলতরঙ্গ আটকানো মুশকিল। এইসব কথা একদা বামপন্থীরা বলতেন ও মানতেন, এখনও যে বলেন না তা নয়। তবে সর্বগ্রাসী লাল পতাকা ইতিমধ্যে বিপত্তারিণীর লালসুতো হয়ে আজ আমজনতার কব্জিতে শোভা পাচ্ছে— ভুল বুঝবেন না, কমরেড!