Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনুবাদকের সমস্যা

নবনীতা সেনগুপ্ত

 


সংস্কৃতি ভাষা জোগায় না ভাষার মাধ্যমে তৈরি হয় সংস্কৃতি? নাকি এরা একে অপরের পরিপূরক? অনুবাদ-সাহিত্যের মান কতটা? মৌলিক রচনা আর অনুবাদের মধ্যে কাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? এই প্রশ্নগুলোর হয়তো কোনও সঠিক উত্তর হয় না। কিন্তু তবুও উত্তরের খোঁজ চলতে থাকে। অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝেছি যে সংস্কৃতিগত তফাতের হাত ধরেই আসে অনুবাদের সমস্যা, অথবা বলা ভাল, অনুবাদকের সমস্যা। আর কিছু সমস্যা তৈরি হয় ভাষাগত বৈশিষ্ট্য থেকে। সব ভাষার কিছু নিজস্বতা থাকে, যেটা অন্য ভাষায় ফুটিয়ে তোলা অনেক সময় প্রায় অসম্ভবই হয়ে দাঁড়ায়

 

কেন অনুবাদ করি— মাঝেমাঝেই এই প্রশ্ন মনের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কী দরকার এক ভাষার গল্প আর এক ভাষায় বলার? কেন একই কবিতা বা প্রবন্ধকে অনেক ভাষায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়? উত্তর খুঁজতে গিয়ে পৌঁছে যাই ছোটবেলায়। বিহারে বড় হওয়ার ফলে, বাড়িতে বাংলা, স্কুলে ইংরেজি আর খেলার সময় হিন্দি, এই ছিল জীবন— ভাষার কয়েক খণ্ডে ভাগ হয়ে যাওয়া সময়। আর একই সঙ্গে তখন চলছে তিনটি ভাষায় গল্পের বই পড়া। শুধু পড়া নয়, সেগুলো নিয়ে আবার বন্ধুদের সঙ্গে গুরুতর আলোচনাও। সব ওলটপালট হল যখন দেখলাম কাউকেই আমি প্রফেসর শঙ্কু বা লালকমল-নীলকমলের সঙ্গে আলাপ করাতে পারছি না। তারা বন্দি থাকত আমার মনেই, অথচ চাচা চৌধুরী বা চম্পকের গল্প অনায়াসে ভাগ হয়ে যেত টিফিনবাক্সের খাবারের সঙ্গে সঙ্গে। সেই থেকে শুরু হল অনুবাদ-জীবন— খেলার সাথীদের সঙ্গে পছন্দের চরিত্র ভাগ করে নেওয়া, গল্প-গল্প খেলার মাধ্যমে। বাংলায় পড়ে, হিন্দি বা ইংরেজিতে সেগুলো বলা। তাহলে একেই কি অনুবাদ বলে? অনুবাদ কি আসলে এতটাই সহজ? শুধু একটা খেলা?

শৈশবের সেই প্রচেষ্টাগুলোয় ভাষার রাজনীতি ছিল না। তখনও জানতাম না হেজেমনি কাকে বলে এবং তা ভাষার মাধ্যমে কীভাবে প্রকাশ পায়। তখন ভাষা ছিল শুধুই প্রয়োজনের তাগিদে। ২১ ফেব্রুয়ারি অথবা ১৯ মে বলতে বুঝতাম ক্যালেন্ডারের তারিখ। তবে তখনও আসল প্রয়োজনটা বোধহয় ছিল একই— নিজের ভাষায় রচিত সাহিত্য সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। কিন্তু কেন এই তাগিদ?

তাগিদের কারণ বুঝেছিলাম আরও পরে, ভাষার নানারকমের রাজনীতির মাধ্যমে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার সময় প্রশ্ন জাগল, বিশ্বসাহিত্যে ভারতীয় সাহিত্যের অবস্থান কী? অনুবাদের মাধ্যমে আমরা কতটা বিশ্বের দরবারে পৌঁছতে পেরেছি? দেখা গেছে, বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে ভারতীয় সাহিত্যের উপস্থিতি খুবই কম। আর বিশেষ করে সাহিত্যের স্রষ্টা যদি মহিলা হন, তাহলে তাঁর অনুবাদ আরও বিরল। খুব অবাক হয়েছিলাম জেনে যে আশাপুর্ণা দেবীর ট্রিলজির প্রথম দুই ভাগ ইংরেজিতে আগে অনূদিত হলেও, তৃতীয় খণ্ড, অর্থাৎ বকুলকথা, খুব সম্প্রতি ২০২১-এ লোপা ব্যানার্জীর কলমে অনূদিত হয়েছে। যদিও দুই খণ্ড আগে অনূদিত হয়েছে বলছি, তবে সুবর্ণলতার যে অনুবাদটি ম্যাকমিলান থেকে বেরিয়েছিল, তাতে অনেক সমস্যা ছিল, সে-কথায় পরে আসছি। তবে অনুবাদের এই অপ্রতুলতার উদাহারণই স্পষ্ট করে দেয় পাঠকসমাজে মহিলাদের লেখার অবস্থান।

নিজের পড়াশোনার জীবন বাংলার বাইরে কাটাবার ফলে ছোটবেলায় বাংলা পড়ার বিশেষ সুযোগ হয়নি। যেটুকু পড়তাম, সেটাই বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতাম। চাতকের মতো বসে থাকতাম বাবার কলকাতা যাওয়ার অপেক্ষায়, কারণ কলকাতা থেকে ফেরা মানেই নতুন বাংলা গল্পের বই আমার হাতে আসা। একটু বড় হওয়ার পর থেকে আরও একটা ব্যাপার লক্ষ করতে শুরু করলাম— আমারই কাছাকাছি বয়সী বাঙালিদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই স্কুলের পাঠক্রমের দুটো ভাষা— ইংরেজি আর হিন্দি শিখে আর তৃতীয় ভাষা, সেটা নিজের মাতৃভাষা হলেও, শেখার ইচ্ছে বা উৎসাহ কোনওটাই থাকত না। শৈশবের পর, তখন আর একবার, অনুভব করেছিলাম সাহিত্যে অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা।

ক্রমে, ভাষা যখন পড়াশোনার বিষয় হয়ে উঠল, তখন আরও নানারকমের প্রশ্ন জন্ম নিতে শুরু করল— সংস্কৃতি ভাষা জোগায় না ভাষার মাধ্যমে তৈরি হয় সংস্কৃতি? নাকি এরা একে অপরের পরিপূরক? অনুবাদ-সাহিত্যের মান কতটা? মৌলিক রচনা আর অনুবাদের মধ্যে কাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, ইত্যাদি। এই প্রশ্নগুলোর হয়তো কোনও সঠিক উত্তর হয় না। কিন্তু তবুও উত্তরের খোঁজ চলতে থাকে। অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝেছি যে সংস্কৃতিগত তফাতের হাত ধরেই আসে অনুবাদের সমস্যা, অথবা বলা ভাল, অনুবাদকের সমস্যা। আর কিছু সমস্যা তৈরি হয় ভাষাগত বৈশিষ্ট্য থেকে। সব ভাষার কিছু নিজস্বতা থাকে, যেটা অন্য ভাষায় ফুটিয়ে তোলা অনেক সময় প্রায় অসম্ভবই হয়ে দাঁড়ায়। তখন অনুবাদক হিসেবে আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজির— ক্ষেত্রবিশেষে নানা কৌশল অবলম্বন।

 

অনুবাদজগতে আমার প্রথম বড় কাজ রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ প্রবাসীর পত্রের পাঁচটি চিঠির অনুবাদ, আর তার পরেই কৃষ্ণভাবিনী দাসের ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা বইটির অনুবাদ। দুটোই বাংলা থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর। দুটোই উনিশ শতকের কাজ, বলা যেতে পারে বাংলার রেনেসাঁ যুগ থেকে উঠে আসা দুটি অত্যন্ত জরুরি লেখা। দুটো কাজেরই পটভূমি ইংল্যান্ড, সেখানকার মাটিতে লেখকদের অভিজ্ঞতা। অতএব এগুলোও একধরনের অনুবাদ। লেখক তাঁর বিলেতের অভিজ্ঞতার কথা বাংলার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছেন। সেই অভিজ্ঞতার ভাষা অনেকাংশেই ইংরেজি, অথচ সেগুলো ব্যক্ত হচ্ছে বাংলা ভাষার মাধ্যমে। প্রথম স্তরেই একটা অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে অনুবাদক হিসেবে, আমি যখন বাংলা থেকে ইংরজিতে তর্জমা করছি, সেটা দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ইংরেজি থেকে বাংলা থেকে ইংরেজি— ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার গল্প। তাহলে তো এই অনুবাদ একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট হওয়ার কথা। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম কাজটা এতটাও সহজ নয়। উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে বাংলা আর ইংরেজির খুব নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও, বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়। ভাষাগত বৈশিষ্ট্যগুলো এমনভাবে রুখে দাঁড়ায়, যেন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচ্যগ্র মেদিনী’, যেন জায়গা দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। কিন্তু অনুবাদের মানে আমার কাছে অন্তত জবরদখল নয়। অনুবাদের প্রধান লক্ষ্যই হল ব্যাপ্তি বাড়ানো। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে অন্যান্য ভাষার পাঠকদের মধ্যে একটি কাজকে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে এই দায়িত্ব অনুবাদকেরই থেকে যায়, যেন অনুবাদটি অনূদিত ভাষার পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে গিয়ে‌ মূল ভাষার বৈশিষ্ট্য না হারিয়ে ফেলে। এইটা ঠিক ব্যালেন্সের খেলার মতো, একটু এদিকওদিক হলেই, পতন নিশ্চিত। তবে এটা সব ক্ষেত্রে ঠিক রাখাও কঠিন হয়। সেই সমস্যার জায়গাগুলোই লেখার পরবর্তী অংশের আলোচনার বিষয়।

ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা অনুবাদ করতে গিয়ে বারবার থমকে যেতে হয়েছে যেখানে লেখক কোনও পূজা-পার্বণ বা খাবার ইত্যাদির কথা বলছেন। ষষ্ঠীপুজো কী এবং তখনকার বাংলা সমাজে তার গুরুত্ব কতখানি, যে জানে না, তাকে সেটা বোঝানো এক দুরূহ ব্যাপার। এইরকম উদাহারণ আরও অনেক আছে— যেমন গৌরীদান, সতীত্ব, ইত্যাদি। অনুবাদক বাধ্য সেখানে বাংলা কথাটিকে সেইভাবেই রেখে, তাকে ফুটনোটে বুঝিয়ে বলা। তবে সেখানেও সমস্যা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশকের মনে হয় এই নোটগুলো বইয়ের সৌন্দর্য খর্ব করছে, অথবা এগুলোর খুব একটা প্রয়োজন নেই। তখন আর একটা নতুন প্রশ্ন উঠে আসে, তাহলে প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠি কে নির্দিষ্ট করে দেবে? আন্তর্জাতিক লেখকদের কাজ যখন পড়ি, যেমন গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, বা ওর্হান পামুক, এটা ঠিক যে আমরা খুব বেশি ফুটনোট পাই না। আন্তর্জাতিক স্তরেও তার মানে ফুটনোট নিয়ে প্রকাশকদের অনীহা/আপত্তি আছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে, মাই নেম ইজ রেড পড়ার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, একটু টীকা থাকলে অনেক ব্যাপার বুঝতে সুবিধে হত। তাদের পরম্পরাগত রীতিনীতি, ইতিহাস বুঝতে পারা যেত এবং তার ফলে পড়াটা আরও সর্বাঙ্গীন সুন্দর হত। সেই মানসিকতা থেকেই, নিজে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় মনে হয়েছিল যে বাংলা শব্দগুলির উপযুক্ত তর্জমা সেই অর্থে সম্ভব নয় বলে যদি বাদ দেওয়া  হয়, তাহলে পাঠকের কাছে তৎকালীন সমাজের অসম্পূর্ণ ছবি তুলে ধরা হয়। সেটা করলে লেখকের প্রতিও অবিচার করা হয়। যদি পারস্পরিক আদানপ্রদানই অনুবাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে টীকার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলার অনুবাদ করতে গিয়ে আমাকে একাধিক জায়গায় ফুটনোটের ব্যাবহার করতে হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল যে মূল গ্রন্থের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে প্রকাশ করতে গেলে সেটা টীকা ছাড়া সম্ভব নয়। আর কতটা নোটের প্রয়োজন আছে, এটা অবশ্যাই লেখক এবং প্রকাশকের আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা উচিত।

 

এছাড়াও আরও একটা গুরুতর সমস্যা হল বাংলা লেখায় সংস্কৃত বা উপভাষার প্রয়োগ। দুই ক্ষেত্রেই একই সমস্যার উৎপত্তি হয়। মানসিক বা সামাজিক অবস্থান বোঝাতে উপভাষার প্রয়োগ বাংলা এবং অন্যান্য অনেক ভারতীয় ভাষাতেই এক বহু প্রচলিত কৌশল। ইংরেজির এই সুবিধে নেই, তাই শুধু ভাষার মাধ্যমে চরিত্রের প্রভেদ দেখানো সম্ভব হয় না। তাই অনুবাদককে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হয়। ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলার অনুবাদ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক সময় কিছু অভিনব বিষয় চোখে পড়লে এবং সেটা লেখিকাকে আপ্লুত করলে, ভাষায় সংস্কৃতের আধিক্য দেখা দেয়। কিন্তু ইংরেজিতে অনুবাদের সময় ভাষার এই সূক্ষ্ম হেরফেরগুলো বোঝানো একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার এই বিশেষত্ব ইংরেজি ভাষার পরিকাঠামোতে নেই। একটা উপায় হয় যদি তৎসম শব্দগুলোকে ল্যাটিনাইজ করে অনুবাদ করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক আর্কেইক অর্থাৎ প্রাচীন এবং এখন অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে হয়। বাংলায় এতে পড়ার গতিবেগ কিছুমাত্র খর্ব না হলেও ইংরেজির ক্ষেত্রে এই ধরনের শব্দ ব্যবহার পাঠককুলকে অসুবিধায় ফেলে। পড়ার ছন্দ নষ্ট করে, যা কোনও মতেই কাম্য নয়। আমি অনুবাদ করার সময়ে প্রচলিত ইংরেজিতেই পুরো কাজটা করেছি। ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলার একটি ছোট উদ্ধৃত অংশ এবং তার অনুবাদ পাঠকদের জন্য দিলাম ভাষাগত সমস্যার উদাহরণ হিসেবে।

শতশত ধূম্ররাজি-বিনির্গত অগ্নিদ্যুতি তমসি নিশা ভেদিয়া লোহিত ময়ুরপুচ্ছের শোভা বিস্তার করিতেছে; স্তূপাকার জ্বলন্ত লৌহ পাথরের নিষ্প্রভ দ্যুতি নিরখিয়া ভ্রম হয়ে যেন পৃথিবীতে প্রলয় উপস্থিত হইয়াছে এবং সমস্ত জগত মহাগ্নি দ্বারা ভস্মীভূত হইয়া যাইতেছে।”

অনুবাদ: Flames emitted by those hundreds of chimneys shoot upward through the dark sky and look like red feathers of a dancing peacock. Looking at the heaps of burning hot iron it seems that the world is about to end in a great fire.

 

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সংগৃহীত যমপুকু্রের ব্রত অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষার এক অন্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হল। দুই ধরনের সমস্যা দেখা গেল, এক হল ব্রতকথার মধ্যে ছড়ার বহুল প্রচলন এবং দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত দেশজ কিছু গাছপালার ব্যাবহার। এই ব্রতগুলির প্রচলন যেহেতু অন্দরমহলের বাসিন্দাদের মধ্যেই ছিল, ব্রতের ভাষায় অত্যন্ত স্থানীয় প্রসঙ্গের উল্লেখ অনেক বেশি পাওয়া যায়। সেইগুলো অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব হলেও, তাদের বাদ দিয়ে অনুবাদটাও যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ তাহলে মূল লেখার থেকে অনুবাদ অনেকটাই সরে যায়। তাছাড়াও, এই ধরনের রচনার অনুবাদ করার প্রধান উদ্দেশ্যই তখনকার দৈনন্দিন জীবন এবং মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত রীতিরেওয়াজ তুলে ধরা। শুধু সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, নৃতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতেও এই ধরনের রচনা অমুল্য। অনুবাদ থেকে যদি এগুলোই বাদ চলে যায় তাহলে যেটা পড়ে থাকে, তা হল একটি প্রাণহীন খাঁচা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বহু বছর আগে সিআইআইএল আয়োজিত একটি সেমিনারের কথা। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল সুবর্ণলতার অনুবাদ, যেটা শুরুর আলোচনায় উল্লেখ করেছি। এক বড় আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে ছাপা সুবর্ণলতার অনুবাদে বাংলার ঘরের দৈনন্দিন জীবনচর্চার যে একক উদাহারণগুলো ছিল, এবং তার থেকে যে তৎকালীন নারীসমাজের ও তৎকালীন বাংলা-সমাজের ছবি পাওয়া যেত, সেইরকম অনেক অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপও অনূদিত উপন্যাসে স্থান পায়নি। যার ফলে সুবর্ণলতার অনুবাদটি মূল উপন্যাসের তুলনায় অনেকটাই নিকৃষ্ট মানের হয়। সেই সেমিনারে কোনও উৎকৃষ্ট মানের অনুবাদের সঙ্গে পরিচয় হয়নি ঠিকই, কিন্তু অনুবাদ করতে গেলে কী কী করা যায়, কী কী যায় না, সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল। সেই ধারণাই মনে গেঁথে যায় পরবর্তীকালে হরিশ ত্রিবেদী বা সুসান ব্যাসনেটের লেখায় উত্তর-ঔপনিবেশিক অনুবাদে ‘কালচার’-এর প্রয়োজনীতার কথা পড়ে।

‘যমপুকুর ব্রত’ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তাই সেইদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখার কথা ভেবেছিলাম এবং তার ফলে অনূদিত লেখায় অনেক ফুটনোটের ব্যবহার করতে হয়েছিল, আবার অনেক সময়ে মূল রচনার মধ্যেই সেগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। যেমন, ব্রতের মন্ত্রের অনুবাদ করার সময়, আসলটা রেখে, নিচে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল—

ধান মান কলা কচু তুলসী হলুদায় নমঃ

অনুবাদ:
dhaan Maan kala kochu Tulsi haluday namah
(Obeisance to paddy, taro, banana, arum, Tulsi, turmeric)

যমপুকুরের ব্রত অনুবাদের সময় যমরাজ মৃত্যুর দেবতা হলেও God of Death ব্যবহার না করে যমরাজ রাখাই বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হল, কারণ যমের সঙ্গে যে মনোভাব জড়িত, সেটা God of Death-এ পাওয়া যায় না।

Oh mother of Jomraj! I request you
May your son never be my parents’ enemy, May your son never be my siblings’ enemy.
Jomraj, Dharmoraj, give me this boon,
May I never be persecuted by you.

অনুবাদ একটা চলমান প্রক্রিয়া, এর শেষ নেই। অনুবাদকের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষার বৈশিষ্ট্য, আরও অনেক কিছুরই প্রভাব পড়ে একটি অনূদিত গ্রন্থে। কোনও অনুবাদকেই তাই চূড়ান্ত বলে অভিহিত করা যায় না। একই কারণে এক বইয়ের একই ভাষায় একাধিক অনুবাদ সম্ভব। তবে সব অনুবাদকেরই কিছু দায়িত্ব থেকে যায় যার মধ্যে প্রধান হল মূল লেখাকে যতটা পারা যায় অবিকৃতভাবে অনূদিত ভাষায় তুলে ধরা। এই চেষ্টা করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি, সেইগুলোর আলোচনার চেষ্টা করলাম এই লেখায়। তবে নদীর মতো ভাষা ও সংস্কৃতি ও প্রবহমান। এবং সেই কারণেই অনুবাদেরও কোনও শেষ নেই, কোনও অনুবাদকেই পার্ফেক্ট বলা চলা না। তবু, সেই পার্ফেকশনের খোঁজেই অনুবাদক তার কাজ করে চলে এবং বিভিন্ন ভাষার মধ্যের আদানপ্রদানকে বাঁচিয়ে রেখে, মানবজাতিকে এক সুত্রে বাঁধার চেষ্টা চালিয়ে যায়‌।

 

তথ্যসূচি

  1. ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা – কৃষ্ণভাবিনি দাস, স্ত্রী পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৬
  2. A Bengali Lady in England – An annotated translation of Krishnabhabini Das’ Englandey Bangamahila – Nabanita Sengupta, Shambhabi, New Delhi, Kolkata, 2020
  3. ভারতজোড়া কথন কথা – সঙ্কলন ও সম্পাদনা রামকুমার মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ, ১৫১৮ (বঙ্গাব্দ)
  4. Indian Folk Narratives – edited by Sanjukta Dasgupta, Sahitya Akademi, New Delhi, 2022.