Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনুবাদের সমস্যা, বাংলা ভাষার, বাংলায়

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 


আমাদের ভাষায় সাহিত্য রচনা হয়, কাজ হয় না। ফলত এই ভাষার চ্যালেঞ্জ অনেকটাই বেশি। অনুবাদ তখনই কাজে দেয় যখন ভাষায় একটা প্রবাহ থাকে। একটু দর্শকের ভূমিকায় থেকে ভাষার গতিবিধি দূর থেকে দেখলে স্পষ্ট হবে— এ ভাষায় সাধারণতম পরীক্ষামূলক কবিতা বা আখ্যান গ্রাহ্যতা পায় না। আর তার প্রধান কারণ আমাদের ভাষার প্রবাহহীনতা। আমরা এক বদ্ধ জলায় পরিণত হয়েছি

 

আমি গোড়াতেই ভাবতে বসি আমার যোগ্যতা নিয়ে। পরে ভাবি ভাষা-শিক্ষক হিসেবে, কবিতা-লিখিয়ে হয়ে বহু অনুবাদ-প্রকল্পের সঙ্গে থেকেছি, উসকে দিয়েছি, নিজে অক্ষম অনুবাদক হলেও বোধহয় খানিকটা অধিকার জন্মেছে সহকর্মীদের দুঃখ নিয়ে কথা বলবার। খানিকটা স্থিত হয়ে কিছু কথা এখানে তুলে ধরি।

 

সমস্যা ১

ভাষা। আমাদের অনুন্নত দেশে উৎস-ভাষা বা source language এবং লক্ষ্য-ভাষা বা target language এই দুইয়ের মধ্যে সমতা বিধানের এক প্রধান পাঠ— অনুবাদ বিষয়ক পাঠ্য বইগুলি একটু নেড়ে দেখা— আমাদের নেওয়া হয়ে ওঠে না। ফলত দেখা যায় আমাদের লক্ষ্য-ভাষা, অর্থাৎ বাংলায় সেই অনুবাদ ভীষণ কাঠ-কাঠ— অনেক ক্ষেত্রে অপাঠ্য হয়ে ওঠে। অথচ দেখা যায়, জনপ্রিয় ক্ল্যাসিক উপন্যাস অনেক সময় দারুণ অনুবাদ হয়। সাহিত্যপাঠক হিসেবে এরিক মারিয়া রেমার্ক আমি বাংলা অনুবাদেই পড়েছি কৈশোরে। কোথাও ঠেকেনি সেইসব অনামী অনুবাদকের বাংলা— আমি ধরেই নিলাম তিনি উৎস-ভাষা জানতেন না। তেমনই পড়েছি অখ্যাত যে-কোনও-একটি-নামধারী অনুবাদকের ঝরঝরে বাংলায় শিশুপাঠ্য বিদেশি ক্লাসিকের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় বিদেশি একটি ভাষা সামান্য শিখে বা শেখবার ভান করে বস্তুত ইংরেজি থেকেই সমসাময়িক কবিতা ও উপন্যাস অনুবাদ করা হচ্ছে— তাতে কারও ক্ষতি নেই। আমার কষ্ট তারিয়ে তারিয়ে বাংলা পাঠসুখ না-পাওয়ার। গার্সিয়া মার্কেজের এস্পানিওল ভাষার অন্বয় বা উদয় চক্রবর্তীর থেকে ধার করে বলি ‘পদগুচ্ছের সংগঠন’ অভিনব তাঁর নিজের ভাষার ক্ষেত্রে। দীর্ঘ সুদীর্ঘ সেইসব সংগঠনকে বিদেশি পাঠকরা— যাঁরা দক্ষিণ ইউরোপের কোনও ভাষায় কথা বলেন না তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কারণ উত্তর ইউরোপের ভাষাসমূহের পদগুচ্ছের সংগঠন অন্যরকম। তাই ইংরেজি অনুবাদে সেইসব দীর্ঘ বাক্যবিন্যাসকে অনেক সময় ভেঙে দেওয়া হয়েছে— কারণ লক্ষ্য-ভাষার পাঠক তাঁর পাঠাভ্যাস সহজে বদলাবেন না। এমন অজস্র উদাহরণ বিদ্যমান। আমার সাহিত্য-সাক্ষর জীবনে দেখেছি বাংলা ভাষায় পৃথিবীর সাহিত্য কম অনুবাদ হয় এবং যা হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উৎস এবং লক্ষ্য উভয় ভাষায় সম্যক দখলের অভাবে আমার মনে দাগ কাটতে পারে না। এখানে স্মরণ করা দরকার মূল পাঠ্য না পড়েও বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার একটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে এমন ঘটনা বিরল।

 

সমস্যা ২

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার অবস্থা। প্রতিটি কলকাতাবাসী জানেন ‘আজকাল’ বাংলাটা একটু দুর্বল! দীর্ঘ চর্চার অভাবে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালি অর্থাৎ যাঁরা আগে বই পড়তেন বাংলায় তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এমনিতেই পড়েন কম, এবং যদিও-বা পড়েন সেটাও ইংরেজিতে। বাংলা আমাদের কাছে শুধু আদিখ্যেতার ভাষা হয়ে উঠছে। ভাষাশিক্ষক মাত্রেই জানেন ভাষা অর্থনীতি-নির্ভর। যে-ভাষায় বাজার কথা বলে সেটাই ভাষা! ১৯৭০-এর দশক (টেনেটুনে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত)-এ জন্মানো বঙ্গসন্তান ছাড়া বাংলা মাধ্যমে পড়ার ফলে পাওয়া বিয়োগফলের মতো বাংলা-নির্ভরতা খুব একটা দেখা যায় না। এর ফলে বিদেশি বই বাংলায় পড়ার চাহিদা লোপ পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ফলত ইংরেজিতে সহজলভ্য বইয়ের বাংলা অনুবাদ অপ্রয়োজন। অর্থাৎ বইয়ের, বিশেষত সাহিত্য, এমনকি, ‘আত্মবিশ্বাস বাড়ানো’ গোছের বইগুলোর বাজার-সম্ভাবনা ক্ষীণতর হচ্ছে, ফলত অনুবাদকে পেশা হিসেবে নেওয়া যাচ্ছে না— যা কিনা পৃথিবীর সমস্ত আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ভাষার ক্ষেত্রে ঘটে— শুনেছি বাংলাদেশেও এই কাজ অনেকাংশে সম্ভব। এই ঘটনা আমাদের অনুবাদের জগৎকে সঙ্কুচিত করেছে। আমি আমার কোনও ছাত্রছাত্রীকে জোর দিয়ে ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের কথা বলতে পারি না অনুবাদ কর্মশালায়, কারণ কাজের জগতে তাকে ইংরেজিতেই খটমট বাজারনির্ভর পাঠ্য অনুবাদ করতে হবে। অর্থাৎ সমস্যাটা বা সমস্যাগুলো ক্রমশ মিছরির ছুরি বা শাঁখের করাত। সঙ্কট দ্বিমুখী এবং ধারালো, শাণিত। বাজার নেই বলে, পেশা করা যায় না বলে অনুবাদক শেখায় এত মন দিতে পারবেন না। আবার উল্টোদিকে সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রে এই ‘শেখার’ অভাব অনূদিত পাঠ্যবস্তুকে অপাঠ্য বা দুষ্পাঠ্য করে তুলেছে।

 

সমস্যা ৩

বাংলা সাহিত্যের পশ্চিমা ভাষায় অনুবাদ। আমরা বাংলায় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ দেখতে পেলেও বাংলা থেকে অনুবাদ? প্রায় হয় না বললেই চলে। সমসাময়িক কিছু উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হলেও মূলত তা ভারতীয় বাজারেই উপলব্ধ। সেইসব অনুবাদের একটা সামান্য অংশই বিদেশে যায়। অবশ্য এ-কথা অনেকাংশে ভারতে প্রকাশিত ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সত্য। বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে। ভারতীয় ভাষার সাহিত্য ইংরেজি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ প্রায় হয় না তার প্রধান কারণ সাহেবদের উন্নাসিকতা। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি ওঁরা খুব কম শেখেন আমাদের ভাষা। সেখানে কাজ করে অর্থনীতি। দ্বিতীয়ত, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালের সাহিত্য পড়ার জন্য ইংরেজিতে রচিত ভারতীয় সাহিত্য, মূলত বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখকের কৃতিকেই বেছে নেন। অর্থাৎ তাঁদের মানসে এই উপমহাদেশ হয় অতীত নয় বাদামি সাহেব। গভীরে দেখলে হয়তো অর্থনীতির দুর্বলতা স্পষ্ট হবে। সাহেবদের পরিশ্রম করার পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি যে অর্থনীতি, বাণিজ্য তা আর ভারতীয়রা ছাড়া এত গভীরে কে বা কারা বুঝবেন!

 

সমস্যা ৪

কবিতার অনুবাদ। কাজটি অসম্ভব যদি অনুবাদক নিজে কবি না হন। কিন্তু বাংলা ভাষায় সে সমস্যা নেই। কারণ আমরা মূলত কবি। সকলেই। যেমন আমরা মুখ্যত স্বভাব-কবিতায় আস্থাশীল, তেমনই আক্ষরিক অনুবাদে। যেহেতু কবিতা লেখা সহজ অতএব তার অনুবাদও। এখন এই ভুবনজোড়া যোগাযোগের দেশে বিদেশি কবিতা সহজলভ্য। ফলত…

সম্যক ধারণা— বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক— আমাদের সাধারণ প্রবৃত্তিতে নেই। ফলত পরিশ্রমবিমুখ এই জাতির জীবনে কবিতা রচনা এক জাতীয় ক্রীড়া। যে-কোনও পেশায় যুক্ত মানুষ এখানে কবি হতে চান, দেশে বিদেশে সর্বত্র মানসিক স্থিতি লাভের এক প্রধান চর্চা কবিতা। এ-সবই জানা তথ্য। কিন্তু একটা জিনিস আমরা ভুলে যাই— এখন প্রকাশমাধ্যম সহজ হওয়ার ফলে, বই ছাপার খরচ এখনও মাসমাইনের চেয়ে বেশি হয়ে যায়নি বলে আমাদের ভাষায় কবিতার চাহিদার তুলনায় জোগান এক হাজার গুণ বেশি। এই ভিড়ে অনুবাদ— ভাল বা খারাপ বিবেচ্য নয়— স্রেফ ভিড়ে হারিয়ে যায়।

 

সমস্যা ৫

সমস্ত সমস্যা জুড়ে যে অদ্ভুত আঁধার এক তৈরি হল তার মধ্যে দাঁড়িয়ে যিনি বিদেশি ভাষা শিখবেন তিনি সাহিত্য অনুবাদে আসবেন না কারণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশক অব্দি পৌঁছনো গেলেও যেহেতু সেখানেও চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি ফলত কোনও অর্থের মুখ তিনি দেখবেন না। বরং নিজের পয়সায় বই ছাপানোর সম্ভাবনা বেশি। এই পুরো ঘটনাক্রমের মধ্যে চাহিদা শব্দটা একটু জোর দিয়ে ভাবা যাক। আমার এই দীর্ঘ অভিযোগরাশির মধ্যে এই শব্দটার জোর সবচেয়ে বেশি। কারণ বাজার দাঁড়িয়ে থাকে চাহিদার ওপর। আমাদের ভাষায় সেই সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। আজ যাঁরা চল্লিশের কোঠায় সেই প্রজন্ম মারা গেলে, অর্থাৎ আজ থেকে মোটামুটি চল্লিশ বছর পর, শহরাঞ্চলে বাংলা বইয়ের চাহিদা শূন্যে ঠেকবে। ৮০-র দশকে বেদের মেয়ে জোসনা যে অবজ্ঞা পেয়েছে, এই ইংরেজি শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে বাংলা সমগোত্রীয় অবহেলা পাবে। এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়। আজন্ম চেন্নাইবাসী আমার এক কবিবন্ধু আমাকে ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখান। তিনি ইংরাজিতে লেখেন, ভারতবর্ষে সুপরিচিত। তাঁর মা তামিল ভাষার এক প্রধান লেখক। একই ঘটনা দেখেছি হিন্দি, মালয়ালম, মারাঠি… সমস্ত ভাষায়। আমাদের ভাষায় এই প্রবণতা একটু দেরিতে হলেও আসতে চলেছে। মফসসল বা আধা-শহরাঞ্চলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া শিশুদের বাংলা শেখার প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে না, ফলত বাংলা বই এক প্রজন্ম পরে— একান্ত সহজপাঠ্য চাপ তৈরি না-করা বই ছাড়া— আর বোধহয় গ্রন্থাগার ব্যতীত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

সমস্যা ৬

সঙ্কট। এইবার যে-বিষয়ে উপনীত হলাম, সেটাই আসল সঙ্কট। এর আগে বর্ণনা করা সমস্ত সমস্যাই কাটিয়ে ফেলা সম্ভব— কিন্তু সঙ্কট কঠিন। বিশেষ করে ভাষা যখন বিপন্ন।

আমাদের ভাষায় সাহিত্য রচনা হয়, কাজ হয় না। ফলত এই ভাষার চ্যালেঞ্জ অনেকটাই বেশি। অনুবাদ তখনই কাজে দেয় যখন ভাষায় একটা প্রবাহ থাকে। বাংলা ভাষার রক্ষকরা সম্পূর্ণ অবিশ্বাসে এই কথা ছুড়ে ফেলে দেবেন। কিন্তু একটু দর্শকের ভূমিকায় থেকে ভাষার গতিবিধি দূর থেকে দেখলে স্পষ্ট হবে— এ ভাষায় সাধারণতম পরীক্ষামূলক কবিতা বা আখ্যান গ্রাহ্যতা পায় না। আর তার প্রধান কারণ আমাদের ভাষার প্রবাহহীনতা। আমরা এক বদ্ধ জলায় পরিণত হয়েছি। অসম্ভব স্বর্ণযুগপ্রবণ। একটা গতিশীল ভাষায় নবীনতর স্বর্ণযুগ নির্মাণ-প্রচেষ্টা থাকে। পুনরাবৃত্তি থাকে না— থাকলেও সে বহু প্রাচীন কোনও যুগচিহ্ন সমকালের শরীরে চালান করে দেওয়া ও তার লক্ষণসমূহের পুনর্নবীকরণ ঘটানো। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বা বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে ‘স্বর্ণযুগে’র নিবিড় অনুকরণ ছাড়া আর কিছু নেই। কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে থেকে বুঝেছি বাংলা কবিতার বুদ্ধদেব বসু-প্রণীত আভাঁগার মডেলই আমাদের। যেহেতু ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় সামাজিক কবিতার চল বেশি তাই আমরা নিজেদের ‘এগিয়ে থাকা’ প্রাণী মনে করি। অর্থাৎ এই মানসিকতা ভারতীয় ভাষা থেকে কবিতা অনুবাদের প্রধান বাধা। আমাদের ভাষা পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত আধুনিক ভাষার মতো কবিতাকে কবিদের মধ্যেই রেখেছে (যদিও এখনও দু-একটি জনগ্রাহ্য বিদ্বজ্জন কবি আছেন, যাঁদের কবিতা না-পড়লেও লোকে কবি বলে জানেন তাঁকে বা তাঁদের)। ফলে কবিতার সীমাবদ্ধ সম্ভাবনা বুঝে অনুবাদক কখনওই রুচি-বহির্ভূত অনুবাদে হাত দেবেন না। অর্থাৎ ভারতীয় অন্যান্য ভাষার কবিতা আমাদের অধরা। প্রসঙ্গত মনে করাই তিন নম্বর সমস্যাটির কথা যেখানে ইউরোপীয় ভাষার নাকুবাবুরা প্রাক্তন উপনিবেশের সাহিত্যের অনুবাদ পড়তে চান না— সেই একই মন আমাদের মধ্যে কাজ করে ভারতীয় অন্যান্য ভাষা থেকে অনুবাদের ক্ষেত্রে— এক্ষেত্রে আমরা নিজেদের ‘এগিয়ে থাকা’ জাতীয় পরিচয় নিয়ে দরজা বন্ধ করি। আরেকবার স্মরণ করা দরকার বুদ্ধদেব বসু তাঁর অনুবাদের কবিদের বেছেছিলেন তাঁর সমসময় থেকে প্রায় একশো বছর পেছনে। অর্থাৎ আমাদের আধুনিকতা প্রেরণা নিচ্ছে ইউরোপীয় ১৯ শতক থেকে। যদিও বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে প্রায় তাঁদের সমসাময়িক এলিয়টও ছিলেন। আশ্চর্যভাবে মার্কিন কবিতার সেই সময়কার আরেক বিস্ময় ওয়ালেস স্টিভেন্স বাংলায় আসেননি, মানে তাঁর কবিতা। আমি যে সঙ্কটের কথা বলছি সেটা হল পরীক্ষাবিমুখ অমরত্বপ্রবণ বাংলা সাহিত্যের বাঁধা ফর্মুলায় সমসাময়িক পশ্চিমা সাহিত্যের পশ্চিমবাংলায় অনুবাদ বা পাঠকগ্রাহ্যতা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পাঠকরুচি ক্রমশ ছকবাঁধা, আর পশ্চিমা সাহিত্য— বিশেষ করে দুই আমেরিকা মহাদেশে— মারাত্মক পরীক্ষাপ্রবণ। ফলত দূরত্ব অবশ্যম্ভাবী। এখানে অবশ্য তর্ক উঠবে অনুবাদের কাজই হল অন্য ভাষার প্রবণতার সঙ্গে পরিচিতি ঘটানো— কিন্তু এখানে আমরা বাংলা ও বাঙালি বিষয়ে, তার পাঠরুচি বিষয়ে কথা বলছি। স্মরণ করা উচিত আমাদের পিনোকিও-সদৃশ নাক কী করে সমস্ত রকমের নতুনকে নস্যাৎ করে দিতে পারে এবং দেয়। উদাহরণ হিসেবে সহজেই দেখা যেতে পারে গত ৫০ বছরের অনূদিত সাহিত্য ও তার প্রভাব বাংলা ভাষার সাহিত্যে— গবেষক না হলেও বলা যায়— প্রায় শূন্য। কারণ আমরা সাধারণত পরিবর্তন বা নবীন কোনও গভীরতা থেকে বহু দূরে। জাতিগতভাবে।