Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৪ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

Wren House

এক.

হীরককে বোঝার চেষ্টা করে জিনি। ছুঁতে চায় ওর মনের অন্দরমহল। পুজোর দিন অনিকেতকে পেয়ে হীরককে খুব খুশি হয়ে উঠতে দেখেছিল। হয়তো পুরনো বন্ধুদের মিস করে, তাই বারবার দেশে ফেরার কথা বলে। অন্তত একজন বন্ধু এখন এত কাছে। পুরনো কথা বলতে পেরে মন ভাল থাকবে। জিনি নিজেই জোর করল। ওদের ডাকো না একদিন? সেদিন তো নিবেদিতার সঙ্গেও ভাল করে কথা বলতে পারিনি।

সত্যিই মুখে একটা খুশির হাসি খেলে গেল। তোমার ভাল লেগেছে ওদের? জিনির সার্টিফিকেট কেন দরকার হীরক নিজেও কি জানে।

—আরে, পরিচয় হলে তবে তো ভাল আর খারাপ। পুজোর ভিড়ে কথা হল কোথায়?

এই শনিবার আসছে ওরা। কিন্তু জিনিকে দোকান সামলে সব কিছু করতে হবে। শনি-রবিবারে ওর দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। তাই মঙ্গলবার থেকে রান্না শুরু করেছিল। হীরককে জিজ্ঞেস করল, কী খেতে পছন্দ করে কিছু জানো?

—আমি কি করে জানব?
—একসঙ্গে চার বছর হস্টেলে কাটালে। এক ঘরেই তো থাকতে তোমরা? তবু জানো না!

অনেকদিন পরে প্রাণ খুলে হাসল হীরক। মেরি বিস্কুট। মেরি বিস্কুট খেতে খুব ভালবাসে অনিক।

—মানে? লেগ পুল করছ? আমি সিরিয়াস।
—দেখো, আমরা তো যাদবপুরের হস্টেলে থাকতাম। আন্দামানের জেলে কী দিত জানি না। হয়তো তার চেয়ে বেটার। আমাদের খাবারের রং বেশিরভাগ দিন হত সবুজ রঙের, অনেকটা জিয়ার্ডিয়া হলে যেমন পায়খানা হয় সেইরকম।
—ডিসগাস্টিং, খাবার জিনিস নিয়ে এমন নোংরা কথা কী করে বলো যে তুমি।

হীরকের মুখে হাসিটা তখনও নেভেনি। যাবাব্বা, ওটা দেখলে এছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতে না তুমিও। আমরা তো ছুঁতেও চাইতাম না। ডালের জল দিয়ে একটু ভাত নেড়েচেড়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে মেরি বিস্কুট কিনে খেতাম। অনিকের জন্য ওটা ছিল ডেজার্ট, বিস্কুটের উপর চিনি ছড়িয়ে নিত।

—বাইরে তো কিছু খেয়েছ কখনও?
—যমুনার পাশে বিফরোল, সেলিমপুরে পরোটা আর আন্ডা ভুরজি। বানাবে? দারুণ একটা নস্টালজিক রিইউনিয়ান হবে তাহলে।

জিভ ভেঙাল জিনি। এটাও অনেকদিন পরে। কিন্তু একে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। জিনি নিজের মতো করেই মেনু তৈরি করেছিল। আর যাই হোক তাদের কমে যাওয়া কথায় কিছু ঢেউ তো উঠল।

অনিকেত আর নিবেদিতা বেশ মিশুকে। সঙ্গে প্র্যাম নিয়ে এসেছিল। ঘুমন্ত ছেলেকে প্র্যামে করে হীরকের লাইব্রেরিতে শুইয়ে রাখা হল। তিস্তার ভয়ানক উৎসাহ। তার থেকেও অনেকটা ছোট একটি শিশুকে পেয়ে খুব দায়িত্বশীল ভঙ্গিতে প্র্যামের পাহারায় বসে নিজের পুতুল নিয়ে খেলছিল। মাঝে মাঝে দৌড়ে আসছিল ভাই নড়ল, হাসল, পাশ ফিরল এইসব খবর নিয়ে।

অনিক আর নিবেদিতা সোফায় এলিয়ে বসেছিল। দুজনের হাতে ওয়াইনের গ্লাস। অনিকের মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন দেখছে না হীরক। নিবেদিতা আগের দিন পূজা উপলক্ষে শাড়িতে এসেছিল। আজকে জ্যাকেট ঝোলাতেই বেরিয়ে এল জিন্সের উপর লোকাট রক্তরঙ্গা টপ।

—কেমন লাগছে অনিক আমাদের এই মিশিগান?

অনিকেতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিবেদিতাই উত্তর দিল, আমেরিকা আসা নিয়ে আমার যে স্বপ্ন ছিল সমস্ত চুড়চুড় হয়ে গেল হীরকদা।

—কেন, খারাপ কীসে? তুমি ক্যান্টনে আছ, বেশ অর্গানাইজড টাউনশিপ। হীরক একটু অবাক না হয়ে পারল না।

নিবেদিতা খুব মুখফোঁড়। তড়বড় করে বলে উঠল, শহর কোথায়? হলিউডের ছবিতে যে শহর দেখে বড় হলাম তার বদলে মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি। সে জমি সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকতে পারে, রাখাল হলে গরু চড়াতাম। কিন্তু আমি কোথায় যাই।

—এখন আর ঘাস কোথায়? যেদিকে চোখ যায় বরফ।
—ওই আর এক অশান্তি। যেদিকে তাকাই ধু ধু সাদা। বাড়িতে বসে বসে জানালা দিয়ে বরফের পাহার দেখে দেখে চোখ পচে যাচ্ছে।
—এখন তো সবে নভেম্বর। এরকম চলবে মার্চ অবধি। Brace yourself Nivedita.

নিবেদিতার কথাটাকে চাপা দেওয়ার ইচ্ছায় অনিকেত বলল, আসলে ও এখনও গাড়ি চালাতে শেখেনি তো। আমি একবার অফিসে চলে যাওয়ার পরে আর কিছু করার থাকে না। কোনও পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট নেই, হেঁটে যাওয়ার মতো কোনও জায়গাও নেই।

—আমি এমন ঠান্ডাও সহ্য করতে পারি না একদম। ব্যাঙ্গালোরে চার বছর ছিলাম, কী দারুণ ওয়েদার। ঠান্ডাও নেই, গরমও নেই। যে কোনও সন্ধ্যায় মিনিস্কার্ট পরে এমজি রোডে হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো যায়।

এবার শব্দ করে হেসে উঠল জিনি। Michigan is all about layers. কত টেম্পারেচার দেখে দেখে লেয়ার চুজ করতে হয়। তারপর আবার বাড়ি ফিরে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো নিজেকে খুঁজে পাওয়া।

হীরক কথার মোড় বাঙ্গালোরের স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল। ওরা কলেজের ফাইনাল ইয়ারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোর আর মাইসোর। দশ বছর হয়ে গেছে তার। মনে আছে অনিক, আমরা এমজি রোডে একটা বারে বসে বিয়ার খেয়েছিলাম। ওখানে যেন লাইন দিয়ে বার।

—এখন আরও অনেক অনেক বেশি। আর তাদের চেকনাই পুরো অন্যরকম। চার্চ স্ট্রিটে নাসা বলে একটা বার হয়েছে। মনে হবে ডিজনি রাইডে স্টার ওয়্যারের সেটে ঢুকে পড়েছিস। জনগণ বদলে গেছে। এখন সব নতুন চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে আসা একুশ-বাইশ বছরের সদ্য গোঁফ ওঠা ছেলেরা। থিকথিক করছে।
—আমার ফেভারিট ছিল বেভারলি হিলস বার।
—তোমার বিয়ার খেতে ভাল লাগে? I find it very bitter.
—অ্যাঁ ম্যা, বিয়ার কে খাবে! তেতো! আমি যেতাম অ্যাম্বিয়েন্সের জন্য। ওরা অবশ্য ককটেলও সার্ভ করত।
—কদিন আগে ব্যাঙ্গালরে কেএফসি খুলল। সেও খুব হইচই ব্যাপার।
—পপুলার হয়েছে?
—পপুলারও হচ্ছে, সঙ্গে সমানে পলিটিক্সও চলছে। অবরোধ, ঘেরাও। কন্নড়রা ক্ষেপেছে। ওদের কালচার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেএফসির আউটলেটে ইটপাটকেল কম পড়েছে? আমি আসার আগে দেখেছি প্রতিটা আউটলেটের বাইরে একটা করে পুলিশের জিপ। প্রোটেকশানের জন্য।
—এখানের কেএফসির মতোই?
—অনেকটা একই। তবে ইন্ডিয়ান ফ্লেভার দিচ্ছে।
—ইন্ডিয়াতে কেএফসি নিয়ে এত হইচই, যেন কোনও হাই এন্ড ব্র্যান্ড। আমার একদম ভাল লাগে না। চামড়ার মতো চিকেন। নাক কুঁচকাল নিবেদিতা।

হীরকের মনে হল নিবেদিতার না-ভাল লাগার তালিকাটা বেশ লম্বা। অথবা সব কিছুতেই খুব স্ট্রং ওপিনিয়ান।

অ্যাকচুয়ালি কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড তো লো কস্ট অপশন এখানে। আমরা বেশি যাই না। তবে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেলে প্রতি এক্সিটে এদের আউটলেট থাকে, দেশের যে কোনাতেই যাও না কেন। চটজলদি খেয়ে নেওয়ার জন্য ভাল অপশন। তাই না বলো? জিনির দিকে তাকিয়ে বলল হীরক। জিনি আনইউজুয়ালি চুপচাপ। এদেশ নিয়ে নিবেদিতার মন্তব্যগুলো হয়তো তেমন ভাল লাগেনি। এবার মুখ খুলল।

—এখানে কিছুই তাহলে ভাল লাগছে না তোমাদের? আমরা মনে হয় তোমরা নতুন এসেছ তো। এখনও বাইরে থেকে দেখছ। যখন এখানের বাসিন্দা হয়ে যাবে, এখানকার মানুষের সঙ্গে আলাপ বাড়বে, রাস্তাঘাটে সড়গড় হয়ে যাবে, তখন হয়তো অন্যরকম লাগবে তোমার। শব্দে উষ্ণতা ঢালার চেষ্টা করলেও, সেটা ঢেকে গেল বলবার শীতলতায়।

জিনির কথায় লুকোনো খোঁচাটা নিবেদিতা সেরকম গায়ে মাখল না। উল্টে সায় দিল। ঠিক বলেছ জিনি। এই যেমন তোমাদের এই শহরটা আজ প্রথম এলাম। অনেক বেটার। একটা টাউন-টাউন ভাব আছে। ভেরি লাইভলি। এই, চলো না গো আমরা এখানে শিফট করে যাই।

জিনি নিবেদিতাকে বোঝার চেষ্টা করছিল। সে নিজে চুঁচুড়া থেকে সোজা এসেছে। কলকাতাতেও সেরকম যাতায়াত ছিল না। মিশিগানে এসে ভালটা আগে চোখে পড়েছে। নিবেদিতার ব্যাপারটা হয়তো অন্যরকম। সেটা বুঝে একটু নরম হয়ে হাসতে হাসতে বলল, আসলে তোমরা তো সদ্য ব্যাঙ্গালোর থেকে এলে। ওটা তো অনেক বড় শহর, ক্যান্টনে পঞ্চাশ হাজার লোক হবে কিনা সন্দেহ। শকটা বেশি হয়ে গেছে। ভাবছ কোথাকার গণ্ডগ্রামে এসে পড়লাম রে বাবা।

—ঠিক, ঠিক। ব্যাঙ্গালোর এখন পাঁচ মিলিয়ন লোকের শহর। সিলিকন ভ্যালি অব ইন্ডিয়া বলে কথা। রোজ দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বাড়ছে।
—আমরা যখন গেছিলাম ছবির মতো ছিল শহরটা। তাই না?
—সেই ছবিতে ধুলো ধোঁয়া আর গাড়ি ঢুকিয়ে দিতে হবে রে। দিন দিন ভিড় বাড়ছে। সারা ভারত থেকে লোক আসছে। পুরনো সেই শহরটা ছোট হতে হতে একটা মাল্টিস্টোরিজ জঙ্গলের পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। টিসিএস, উইপ্রো, সত্যম, ইনফোসিস সব সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো নিত্যনতুন অফিস বিল্ডিং বানাচ্ছে। মাল্টিন্যাশানালও আসছে অনেক। এই তো টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস অফিস খুলল।
—সত্যিই আইটিতে এতটা এগিয়েছে ইন্ডিয়া? হীরকের মনে নতুন উৎসাহ।
—ব্যাক অফিসের অনেক কাজ ওখানেই হচ্ছে। হবে না কেন বল? ব্যাঙ্গালোরের একটা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যে টাকায় কাজ তুলে দেবে, আমেরিকায় বসে করতে হলে তার পাঁচগুণ স্যালারি দিতে হবে। মার্জিনটা একবার ভাব। যদিও স্যালারি লেভেল বাড়ছে, তবুও ডেভেলপড কান্ট্রির মতো তো হবে না। অন্তত আগামী কুড়ি বছরের জন্য তো নয়। কস্ট অ্যাডভান্টেজ ম্যাসিভ।
—কীরকম স্যালারি লেভেল ওখানে?
—বললাম যে করেস্পন্ডিং লেভেলে তোদের দেশে পাঁচগুণ বেশি। কারণ আমাদের কস্ট অব লিভিং তো কম। তবে ব্যাঙ্গালোরে জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। স্যালারিও সেইভাবে বাড়বে। কমপ্যারেটিভলি কলকাতায় পে চেক ছোট। ইনফোসিস তো বেশ হাই স্যালারি দেয়, এই দেশের ধাঁচে স্টক অপশন দিতে শুরু করেছে। আমাদের কম্পানিতে অত নয়।
—তোমাদের চাকরির কচকচিটা থামাও তো। নিবেদিতাকে আর আটকে রাখা গেল না। আসল কথা হচ্ছে লাইফস্টাইল। আমি ওখানে যে লাইফস্টাইল মেইনটেইন করতে পারতাম, এখানে পারছি?
—কেন? এখানে তো নিশ্চয় ডলারে অনেক বেশি পাচ্ছ।
—কিন্তু সেটা দিয়ে কী কিনতে পারছি? আমরা ব্যাঙ্গালোরে শুরুতেই অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নিয়েছিলাম। আঠেরোশো স্কোয়ার ফুটের। প্রাইম লোকেশানে। এখানে একটা কন্ডোতে আছি, বারোশো স্কোয়ার ফুট।
—একদিকে ছোট বাড়িতে থাকাটা ভাল নিবেদিতা। এখানে তো কাজের লোক নেই। এই দেখো না আমরা বছর খানেক আগেও অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম, সে একরকম। এই বাড়িতে আসার পর সিঁড়ি উপর করতে করতে হয়রান হয়ে গেছি। একা হাতে সামলাতে হয় সবকিছু।
—সত্যি জিনি, কাজের বাই না থাকাটা একটা নুইসেন্স। আমি তো ওকে বারবার বলেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাঙ্গালোরে ফিরে চলো, আমেরিকার সাধ আমার মিটে গেছে।
—প্রথম প্রথম এরকম মনে হয় নিবেদিতা। এটা একরকমের বিষক্রিয়ার মতো। ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায় আর আমরা এই দেশের আনন্দে বুঁদ হয়ে যাই। হীরকের এই কথাটা জিনির যে পছন্দ হল না সেটা ওর দিকে না তাকিয়েও হীরকের বুঝতে অসুবিধা হল না।

অনিকেতের মুখটা একটু কাঁচুমাচু হয়ে গেছিল। মনে হল দুজনের মধ্যে এই নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। এখানে সব সার্ভিস কস্ট খুব বেশি। টিসিএস অত বেশি স্যালারি দেয় না এখানে। Much lower than prevailing market. ওটাই ওদের লো কস্ট স্ট্র্যাটেজি, এখানে আসার ইচ্ছায় আমরা ওই টাকাতেই চলে আসি।

—আসলে তা নয়। তোমাদের অনিক প্রতিটা ডলার খরচ করার আগে টাকায় কনভার্ট করে আঁতকে আঁতকে ওঠে। সবই নাকি ইন্ডিয়াতে সস্তায় পাওয়া যায়, তাহলে এখানে কিনে কী হবে। আচ্ছা বলো, একটা কফি খেতে গেলাম তখন তার দাম দুশো টাকা ভেবে খেলে তেতো তো লাগবেই।

নিবেদিতা এমনভাবে বলল যে হাসির রোল পড়ল ঘরে।

—স্যালারির কথা বলছিস অনিক। মনে আছে আমরা যখন ফাইনাল ইয়ারে? দু-হাজার টাকার স্যালারি দিলে আকাশে চাঁদ পেত ছেলেরা। সেটা ছিল হাই এন্ড। আমি হিন্দমোটরে ঢুকেছিলাম পনেরোশো।
—আইটি ইন্ডাস্ট্রি সেই লেভেলটাকে তুলে দিয়েছে। ইনফোসিসে টিম লিড হলেই সত্তর। সঙ্গে অপশন।
—ও মাই গড। সেটা তো রাজার চাকরি রে।
—এই জিনি চলো তো আমরা যাই। এদের এই আইটির কচকচি আর ভাল লাগছে না। আমাকে তোমার বাড়িটা দেখাও। নিবেদিতা বেশ বিরক্ত হয়েই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল।

বাড়িটাকে মনের মতো সাজিয়েছে জিনি। কেউ দেখতে চাইলে মনে খুশির বান ডেকে যায়। ওরা আসবে বলে সারা বাড়ি ঝাড়পোঁছ করেছে। না দেখাতে হলে পরিশ্রমটাই বৃথা হয়ে যেত।

নিবেদিতার গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। হীরক ভাল হোস্টের মতো রিফিল করল। জিনি আর নিবেদিতা হাত ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় বেডরুম দেখতে চলে গেল।

—ওয়াইন-টোয়াইন ছাড়, হুইস্কি খা বরং।

হুইস্কির সঙ্গে সঙ্গে কথাটাও এবার অন্য খাতে বইল।

—তোর সঙ্গে বুদ্ধর কথা হয়েছে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ তোর কাছ থেকে নাম্বার নিয়েছিলাম। একদিন জমিয়ে কথা হল। ও তো একবার ফিরে গেছিল দিল্লিতে। সি ডটের লাথ খেয়ে আবার ক্যালিফোর্নিয়ায়।
—হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে ভালই করছে শুনি। পিএইচডি হয়ে গেছে ওর।
—মণীশ আর বিজুর সঙ্গেও কথা বললাম। তোর সঙ্গে তো যোগাযোগ আছে। মণীশ বেশ মস্তিতে আছে মনে হল। বিজু সেই কলেজ লাইফের মতোই সিরিয়াস। ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে পাগল।
—বিজু দ্রোণাচার্যের সেই মাছের চোখ ছাড়া কিছু দেখিব না ভাব করে এগোচ্ছে।
—তোর সঙ্গে পেটোর কথা হয়েছে কখনও?
—পেটো?
—আরে, প্রতাপ। সবাই পেটো বলে ডাকত। নিউ ব্লকের। মেকানিক্যাল। চিনতে পারলি? অনিকেত আরও বিশদ করল। ইলেক্ট্রিক্যালের মিতালির সঙ্গে ছক করছিল। মনে আছে মাঠের ধারে লাল চেয়ারে বসে থাকত।

এরকম ভিভিড বর্ণনার পরেও মনে না থাকার উপায় আছে? মাথা নাড়ল হীরক। মনে পড়েছে। তবে ও তো মেকানিক্যালের, অত আলাপ ছিল না আমাদের।

—তখন ছিল না। পরে আমরা একসঙ্গে টিসিএসে ছিলাম, ব্যাঙ্গালোরেই। সেই থেকে আলাপ। এখন শিকাগোতে আছে।
—তুই ঘুরে এসেছিস?
—যাইনি এখনও। ওদের বাড়ি শিকাগোর সাবার্বে, অরোরা। যাব খুব শিগগির, বারবার করে বলছে। শিকাগোটাও দেখা হয়ে যাবে।
—তার মানে পেটোও আইটিতে?
—সে তো এখন সবাই। ইন্ডিয়াতে ম্যানুফ্যাকচারিং-এ লোক পাওয়া দুষ্কর হয়েছে। পাওয়ার প্ল্যান্টে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পাচ্ছে না। আমাদের মতো সবাই আইটিতে জয়েন করে মেনফ্রেমে বিজনেস সফটওয়্যার করছে।

সেটা তো হীরকও। রিসার্চ মাথায় তুলে এখন ডেটাবেস প্রোগ্রাম করছে। পিএইচডি করে কী লাভ হল? শুধু আমেরিকায় থাকার জন্য সব ছেড়ে দিল। বুদ্ধ বরং কিছু ভাল কাজ করেছে। মনে মেঘ জমছিল।

বাড়ি দেখা শেষ করে নিবেদিতা আর জিনি ফিরে এল।

—কেমন দেখলে আমাদের বাড়ি?
—দারুণ হীরকদা। একেকটা বেডরুমে গেলে মনে হয় কোনও হোটেলের ঘরে ঢুকেছি। এমন পরিপাটি সাজানো। ইচ্ছা করে বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে রুমসার্ভিস কল করি। বাড়ি-বাড়ি বলে মনেই হয় না। একমুখ হাসি টেনে বলল নিবেদিতা।

জিনি বুঝতে পারল না এটা প্রশংসা না নিন্দা। সুন্দর করে সাজানো থাকে তার বাড়ি। সেটা তো অন্যায় কিছু নয়।

অনিকের সঙ্গে এতদিন বাদে আড্ডা দিয়ে খুব ভাল লেগেছিল হীরকের। জিনির অতটা নয়। বড্ড নাকউঁচু মেয়েটার। কথায় কথায় তুলনা।

সেটা হীরকও খেয়াল করেছে। আসলে মুখে আর মনে এক, তাই পটপট করে অমনি বলে দেয়।

—ব্যস, তাহলেই তো সাতখুন মাপ। আমিও মুখে-মনে এক, বলে দিলাম। নিবেদিতাকে সহ্য হয়নি একদম। তুমি তোমার ক্যাবলা বন্ধুর সঙ্গে যত পারো আড্ডা দিতে যেও, আমাকে ডেকো না আর তার মধ্যে।

কী বলবে বুঝতে পারল না হীরক। এতগুলো বছর পাশাপাশি বিছানায় কাটিয়েছে হীরক আর অনিকেত। একজন আরেকজনকে চিনত হাতের পাতার মতন। এখন হয়তো আর অতটা চেনে না। জিনিকেও কি চেনে, একসঙ্গে থেকেও? আসলে একটা বয়সে জীবনটা থাকে খোলা পাতার মতো, একজনের আরেকজনকে পড়তে কোনও অসুবিধা হত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জীবনটা এত এত পাতা জুড়ে একেকটা বই। মুড়ে রাখা সেই বই থেকে কেউ আর কাউকে চিনতেই পারা যায় না।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]