Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চন্দ্রবিজয়, হিন্দুত্ব এবং আমাদের বিজ্ঞান-ভবিষ্যৎ

চন্দ্রবিজয়, হিন্দুত্ব এবং আমাদের বিজ্ঞান-ভবিষ্যৎ | দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

 


বিজ্ঞান তথা যাবতীয় গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে এবং বিচিত্র আইনকানুনের জালে জড়িয়ে তাকে বিকলাঙ্গ করে তোলা হবে, বিজ্ঞান-গবেষণাকে আটকে ফেলা হবে বাণিজ্যিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, মুক্তচিন্তা অনুসন্ধিৎসা জ্ঞানচর্চাকে প্রতিহত করা হবে, সরকারি শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলো বেচে দেওয়া হবে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হবে পৌরাণিক মিথ্যা-নির্ভর ও অন্তঃসারশূন্য। এবং, এই ধ্বংসলীলাকে আড়াল করার জন্য লাগবে চন্দ্রবিজয়ের মতো দু-একটি বড়সড় গণমাধ্যম-বান্ধব সাফল্য, যে সাফল্য হিন্দুরাষ্ট্রের যাথার্থ্য ও হিন্দুবীরের শৌর্যকে নস্যাৎ করবে না, বরং তাকে এনে দেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইজ্জত

 

ভারতীয় মহাকাশযান চাঁদে নেমেছে, দেশ উত্তাল, সে তো হওয়ারই কথা বটে! পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশীয় দূরত্ব অতিক্রম করে উপগ্রহের মাটিতে সফলভাবে স্বয়ংক্রিয় যান নামানো, যা নাকি আবার চান্দ্র-উপরিতলের গর্ত ও বাধা এড়িয়ে নিজে নিজেই বহুদূর অতিক্রম করবে, অসংখ্য মহামূল্যবান ছবি তুলে পাঠাবে, নানা জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে, এবং তার ফলাফল ফেরত পাঠাতে থাকবে আমাদের কাছে— আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশের পক্ষে অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত এসব ছিল স্বপ্নেরও অতীত। আর তার ওপর, এইসব করা গেছে দেশে তৈরি প্রযুক্তিতে, এবং অনেক কম খরচেও। এর আগে আর মাত্র তিনটে দেশ এইটা পেরেছিল— আমেরিকা, রাশিয়া আর চিন, তাও এর চেয়ে বহু বহু বেশি খরচাপাতি করে। ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি তাদের জিনিস চাঁদে নামাতে পেরেছিল, কিন্তু ‘সফট ল্যান্ডিং’ পারেনি। এরা সকলেই অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তার মধ্যে রাশিয়া আবার ঠিক এই সময়েই আরেকবার একই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা ভেঙে পড়েছে, যদিও ভারত সফল হয়েছে। সাফল্য, অতএব, কম নয় মোটেই!

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, আমাদের মতো গরিব দেশের কাছে তো মহাকাশ-গবেষণা এক শ্বেতহস্তী পোষার মতো ব্যাপার— কী হবে এই শ্বেতহস্তী পুষে, দেশ যেখানে জর্জরিত দারিদ্র্যে, বেকারিত্বে, অসাম্যে, অশিক্ষায়, ধর্মান্ধতায়? এ প্রশ্নে অনেক সংবেদনশীলতা থাকলেও, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না সব সময়ে। এইসব সমস্যা যতদিন না দূর হবে ততদিন বিজ্ঞান দর্শন শিল্প সাহিত্য এইসব থামিয়ে রাখা উচিত তো নয়ই, এবং সম্ভবও নয়, চাইলেও পারা যাবে না। আর, এইসবের অনুশীলন যদি বন্ধ হয়ে যায়, সমাজের অন্যায় অযুক্তি অক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইটাই বা হবে কী দিয়ে? কাজেই, দেশে প্রবল সমস্যা থাকলেই জ্ঞানের দুয়ার বন্ধ করতে হবে, কথাটা বোধহয় ঠিক সে-রকম না। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও স্বপ্নদ্রষ্টা জে ডি বার্নাল একদা বলেছিলেন, বৃক্ষের যেমন মুকুল, সমাজের তেমনি গবেষণা। সব মুকুল ছেঁটে দিলে গাছ বেঁচে থাকবে কিন্তু তার বাড়বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, গবেষণা বন্ধ করে দিলে সমাজ টিকে থাকবে, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়াবে স্থবির, শিলীভূত।

এবং তবুও, মানুষের অন্য সবকিছুর মতোই, বিজ্ঞান গবেষণার পেছনে কিছু মোদ্দা নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি তো থাকতেই হয়, না থাকলেই চলে না। সে নিয়েও দু-চার মন্তব্য করাটা খুব জরুরি এখানে। কিন্তু তার আগে একটা জিনিস একটু ছোট্ট করে ভেবে দেখা দরকার। ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘প্রযুক্তি’, যে দুটো আলাদা কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত জিনিসকে আজকে আমরা মোটা কথায় একসঙ্গে ‘বিজ্ঞান’ বলে থাকি, সে তো আর আকাশ থেকে পড়ে না, এবং কিছু প্রাজ্ঞ মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর সদিচ্ছা থেকে আপনা-আপনি গজিয়েও ওঠে না। তার জন্য বড় বড় ঘরদোর লাগে, নানা বিচিত্র ও দামি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ লাগে, নামীদামি পত্রিকা ও বইপত্তর লাগে, উচ্চশিক্ষিত মেধাবী লোকবল লাগে। আবার, এইসব জোটাতে গেলে অনেক অনেক টাকা লাগে, সামাজিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক সমর্থন লাগে, এবং বিজ্ঞান গবেষণার উপযোগিতা ও নৈতিকতার প্রসঙ্গ এর থেকে খুব দূরে নয়। তো তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কোথা থেকে কীভাবে আসে এইসব সমর্থন? এবং, এইসবের ওপরে বিজ্ঞানের ভালমন্দ ঠিক কীভাবে কতটা নির্ভর করে? এই বিষয়টা সামান্য একটু ঝালিয়ে নিয়েই ফিরব চন্দ্রযানের প্রসঙ্গে।

বিজ্ঞান গবেষণায় একটা খুব জানা কথা এইটা যে, এই জিনিসটার প্রায় সবটাই হয় অল্প কয়েকটি মাত্র ধনী দেশে, এবং বাকি যাবতীয় দেশে যৎসামান্য। কেন? উত্তরটা একদমই সোজা। গবেষণাতে টাকা লাগে, এবং যাদের তা আছে তারা পারে, বাকিরা পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো একটা গরিব দেশ তবে এতবড় একটা ব্যাপার করে উঠতে পারল কীভাবে? সেটা বলছি, কিন্তু তার আগে একটু বলে নিই, ভারত ঠিক কতটা গরিব এবং পিছিয়ে থাকা দেশ। এইসব ব্যাপার মাপবার নানা মাপকাঠি বেরিয়েছে আজকাল, এবং তার হালচাল সংক্রান্ত তথ্যাবলি অন্তর্জালে বেশ সুলভ। কাজেই, এখানে যা যা বলব সে সব সকলে খুব সহজেই নিজে নিজে যাচিয়ে নিতে পারবেন।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সবচেয়ে পরিচিত যে মাপকাঠি, সেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান একশো চল্লিশতম, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিতের শতাংশের নিরিখে একশো উনষাট, রোজগেরে কর্মক্ষমদের নিরিখে পঞ্চাশ, চরমভাবে দরিদ্র নয় এমন জনসংখ্যার শতাংশের নিরিখে একশো বারো, ক্ষুধিত জনসংখ্যার মাপকাঠিতে একশো সাত (পাকিস্তান নেপাল বাংলাদেশের পেছনে), রোজগারের অসাম্যের নিরিখে পঁচাত্তর, মানবোন্নয়ন সূচকে একশো বত্রিশ। অর্থাৎ, সবক্ষেত্রেই একেবারে তলানিতে।

তো, এই যদি সামগ্রিক দশা হয়, তাহলে বিজ্ঞানের অবস্থাও খুব একটা ভাল হওয়ার কথা না, এবং তা নয়ও। জাতীয় আয়ের কত শতাংশ বিজ্ঞানের গবেষণায় খরচ করা হচ্ছে সেটা বিজ্ঞানের অবস্থা বোঝবার পক্ষে একটা ভাল মাপকাঠি বলে ধরা হয়, তাতে ভারতের স্থান আটান্নতম। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যাপিছু প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আরেকটি পরিচিত মাপকাঠি, এবং তাতে ভারতের স্থান বিরাশিতম। এই যে এখুনি বললাম, জাতীয় আয়ের যে শতাংশ আমরা গবেষণায় খরচ করি সেটা খুব ভাল নয়, এ ব্যাপারে অল্প করে  আরেকটু বিস্তারে যাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলো গবেষণা খাতে মোটামুটিভাবে জাতীয় আয়ের দুই থেকে চার শতাংশ খরচা করে। একটা সুস্থ সবল অর্থনীতিতে গবেষণার জন্য কত ব্যয় করা উচিত, মোটা দাগে তার নিয়ম ওটাই— যাকে ইংরেজিতে বলে ‘রুল অফ থাম্ব’। যারা বিজ্ঞানকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, সেইরকম অল্প কয়েকটা দেশ ওর চেয়েও বেশি খরচ করে। যেমন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো সাড়ে চার, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় পাঁচ, ইজরায়েল প্রায় ছয়— এইরকম। যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে কখনও চর্চা করেননি তাঁরা জানলে হয়তো খুবই অবাক হবেন যে, ওই খাতে ভারতের খরচের মাপটা হচ্ছে দশমিক সাত শতাংশ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, ০.৭%! এই তালিকায় সলজ্জ আটান্নতম স্থানটি, বলা বাহুল্য, সেই কারণেই। নোবেল প্রাপকদের তালিকায় কেন আমাদের বিজ্ঞানীদের নাম থাকে না, এবং যদি বা থাকে তো কেনই বা সেটা সাধারণত অন্য দেশের নাগরিক হিসেবে, সেটা এ থেকে বোঝা যায়। তাহলে, এই প্রেক্ষিতটা একটু মাথায় রেখে আমরা এবার ওপরের প্রশ্নে ফিরে আসি।

অবস্থা যদি এতই খারাপ, তো তাহলে আমরা এই অসাধ্য সাধন করতে আদৌ পারলাম কীভাবে? তার উত্তরটা হচ্ছে, উপরোক্ত যাবতীয় দুর্দশা সত্ত্বেও, আমাদের অর্থনীতির আয়তনটা বেশ বড়সড়। বড় দেশ, বিপুল জনসংখ্যা, অতএব তাদের মোট বাৎসরিক আয়ের যোগফলটাও বড়সড় হবে, এই আর কি। ফলত, তার থেকে সামান্য একটা অংশ সরিয়ে রাখলেও মোট অঙ্কের হিসেবে সেটা বেশ খানিকটা টাকা হবে। এখন, একটা বিশেষ গবেষণার জন্য বিশেষ একটা পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করলেই চলে, জনগণ কেমন রোজগার করতে পারছে বা দুবেলা খেতে পরতে পাচ্ছে কিনা সে সব তো আর দেখার দরকার পড়ে না। ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে এই পরিমাণটি প্রায় পঁয়ষট্টি বিলিয়ন ডলার। জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে এই অঙ্কটা যৎসামান্য (০.৭) হলেও, টাকার মোট অঙ্কে কিন্তু মোটেই তা নয়। ফলত, জাতীয় আয়ের শতাংশ হিসেবে এ বরাদ্দ সারা বিশ্বে আটান্নতম স্থানে থাকলেও, গবেষণা-ব্যয়ের মোট অঙ্ক হিসেবে বিশ্বে সাত নম্বর, ব্রিটেন সহ বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশকে পেছনে ফেলে। তার মানে হচ্ছে, জাতীয় আয় একটুও না বাড়িয়েই ভারত যদি আজ গবেষণায় ইজরায়েলের মতো ছয় শতাংশ ব্যয় করতে থাকে, তাহলে মোট গবেষণা-বরাদ্দের নিরিখে আমরা ঝট করে তালিকার অনেক ওপরের দিকে উঠে আমেরিকার পরেই ঠিক দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে যাব, চিনকে সরিয়ে। এবং ঠিক ওই একই কারণে, প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যাপিছু গবেষণাপত্র প্রকাশে আমরা বিরাশিতম স্থানে থাকলেও (ওপরে বলেছি), মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যায় কিন্তু আমরা চতুর্থ— চিন আমেরিকা আর ব্রিটেনের পরেই। গবেষক প্রযুক্তিবিদ চিকিৎসক এইসবের সংখ্যা যদি হিসেব করি, তাহলেও মোদ্দা ব্যাপারটা ঠিক ওইরকমই দাঁড়াবে। এমনকি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্কীর্ণ পরিসর ছাড়িয়ে আমাদের সমগ্র অর্থনীতির দিকে তাকালেও ওই একই মোদ্দা নকশা দেখা যাবে। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান একশো চল্লিশতম (ওপরে বলেছি) হলেও, বিলিওনেয়ারদের সংখ্যায় তৃতীয়, আমেরিকা ও চিনের পরেই।

তাহলে, এখন পর্যন্ত যা দেখলাম, সে সব থেকে আমরা কী বুঝব? আপাতত যা বুঝব, তা কিঞ্চিৎ ভীতিপ্রদ হলেও, খুব বেশি অজানা নয়। সহজ কথাটা এই যে, জাতীয় অর্থনীতি থেকে যথেষ্ট টাকা বিজ্ঞানের জন্য সরিয়ে রাখলেই গবেষণায় খানিকটা সাফল্য সম্ভব, দেশ সমাজ জনগণের দশা যা-ই হোক না কেন। বহু সংখ্যক মানুষ যদি দারিদ্র্য রোগভোগ বেকারিত্ব অশিক্ষা অন্ধত্বে ডুবে থাকে, তাতে সমস্যা নেই। তা সত্ত্বেও চন্দ্রবিজয় হতে পারে, হাইড্রোজেন বোমা হতে পারে, সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চমৎকার সব ক্ষেপণাস্ত্রও হতে পারে। ওপরতলার লোকজন যাতে স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে থাকে, যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঠিকঠাক টক্কর দেওয়া যায়, এবং যাতে দেশের জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়— এটুকুর জন্য যতটা বিজ্ঞান-টিজ্ঞান লাগে ঠিক ততটুকুই হবে, তার চেয়ে বেশি নয়— এটাও ক্ষমতাসীন সরকারের বাস্তব নীতি হতেই পারে। এতে নৈতিক সমস্যা তো আছেই। কিন্তু শাসকরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন যে নৈতিকতা বস্তুটিকে একদমই পাত্তা দেবেন না, কিম্বা তাঁরা ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত ভিন্ন কোনও এক সংজ্ঞায় বিশ্বাসী হন, তাহলেই সমস্যা মিটে গেল— গণতন্ত্র মানবাধিকার যুক্তিবাদ এইসব রইল না গেল তাতে কিছু যায় আসে না।

কথাটা ভয়ের কথা তো বটেই, কিন্তু আরও অনেক বেশি ভয়ের হতে পারত, যদি ব্যাপারটা আসলে ঠিক অতটাই সোজাসরল হত। সুখের বিষয় বলে মনে করুন বা দুঃখের, কথাটা আসলে কিন্তু ঠিক অতটা সোজা নয়, এর মধ্যে বেশ একটু জটিলতা আছে। যেমন ধরুন, প্রথমত, মাথাপিছু আয় খুব নিচু হলে অর্থনীতিতে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা হয়, তখন মোটা দাগের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সামলাতেই জাতীয় আয়ের এক বড় অংশ বেরিয়ে যায়, এবং গবেষণার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করাটা প্রায় বিলাসিতার জায়গায় চলে যায়। গরিব দেশগুলো যে জাতীয় আয়ের খুব অল্প এক ভগ্নাংশ মাত্র গবেষণায় ব্যয় করতে পারে, তার কারণ মূলত এটাই। সেই কারণে, ভারত মোট জাতীয় আয়ে প্রথম সারিতে থাকলেও, শতাংশের হিসেবে বিজ্ঞান-বরাদ্দের নিরিখে দরিদ্রতম দেশগুলোর সঙ্গে একাসনে আসীন। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষায় মাথাপিছু ব্যয় কম হলে ভাল  গবেষণার জন্য একান্ত জরুরি উচ্চমানের মানবসম্পদ তৈরি হয় না, ফলে গবেষণার মানও মোটেই ভাল হয় না। আমাদের দেশ থেকে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সংখ্যা যে যৎসামান্য, তার কারণটা হয়তো-বা এটাই। তৃতীয়ত, এই ধরনের অর্থনীতিতে বেসরকারি সংস্থারাও গবেষণায় বেশি খরচ করে না, ফলে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনও অনেক কম হয়, ফলে সফল ‘পেটেন্ট’-ও অনেক কম। আবার তারই উল্টো প্রভাবে, উচ্চমানের প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনের অভাবে অর্থনীতিরও সেভাবে বৃদ্ধি ঘটে না। আমাদের দেশ কেন এখনও মাইক্রোচিপ বানাতে পারে না, এবং কেনই বা এত বড় একটা অর্থনীতি প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন-সূচকে সারা পৃথিবীতে চল্লিশতম, তার উত্তর বোধহয় এর মধ্যে আছে। চতুর্থত, রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতাসীন তারা যদি ভাবে যে, ওপরতলার লোকজনকে স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে রাখা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ঠিকঠাক টক্কর দেওয়া, এবং দেশের জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা— এটুকুর জন্য যতটা বিজ্ঞান-টিজ্ঞান লাগে ঠিক ততটুকুরই ব্যবস্থা হবে, তার চেয়ে বেশি হওয়াটা ভাল নয়— তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটাবার ব্যাপারে তাদের আগ্রহটাও খুব সীমিত হবে। পঞ্চমত, ‘গবেষণা’ ব্যাপারটার মানে হল নতুন জ্ঞানের খোঁজ, এবং তার জন্য পুরনো জ্ঞান পুরনো বিশ্বাস পুরনো ধ্যানধারণাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাওয়া। এখন, ক্ষমতাসীন শাসক যদি মনে করে যে এই প্রশ্ন করার মনোভাব বা সংস্কৃতিটা তার অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক, তাহলে তারা মুক্ত অবাধ জ্ঞান ও যুক্তির চর্চাকে খুব বেশি বাড়তে দেবে না। সেটাও বিজ্ঞানের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। এই বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে দু-এক কথা বলা যাক।

সাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষার (এবং অন্য যে কোনও শিক্ষার) সঙ্গে গবেষণার মৌলিক তফাতটা হচ্ছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যা জানা আছে সেটা যদ্দুর সম্ভব হুবহু আয়ত্ত করে নিতে হয়, আর গবেষণার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যা জানা ছিল না সেইটা জানতে এবং জানাতে হয়। যা জানা আছে তা যতই মোক্ষম হোক, শুধু তার পুনরাবৃত্তি করলে হবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এবং তাতে কিছু যোগ করতে হবে— তবেই একজন গবেষকের প্রবন্ধ প্রকাশের ছাড়পত্র পাবে, নইলে নয়। এই ব্যাপারটা টানা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমেই যা দরকার সেটা হচ্ছে, কী কী জানা নেই অথচ জানা দরকার ছিল— সেই বিষয়ে একটা যথাযথ অভাববোধ। এই অভাববোধটা আসে একটা সুসংবদ্ধ সংশয় ও প্রশ্নশীলতা থেকে। আমি যা ঠিক বলে জেনে এসেছি, সেটা ঠিক তো? কোন অর্থে, কতদূর পর্যন্ত ঠিক? তার অর্থ সবটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে তো? তার মধ্যে কোনও লুকিয়ে থাকা অন্তর্বিরোধ নেই তো? আমার জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মেলে তো? অমুক অমুক ক্ষেত্রে তো মেলে বলে দেখেছি, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটাকে পরীক্ষা করে দেখা যায় কি? বিজ্ঞান এগোয় কঠোর যুক্তি সহকারে ক্রমাগত এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করতে করতে, এই প্রক্রিয়া ছাড়া ‘বিজ্ঞান’ জিনিসটা টেকে না। আর, এই প্রক্রিয়াটাকে ঠিকঠাক চালু রাখতে একটা বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি লাগে। অর্থপূর্ণ প্রশ্ন কাকে বলে সেই বোধ তৈরির সংস্কৃতি, প্রশ্নের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়ার সংস্কৃতি, যুক্তির শৃঙ্খলা আয়ত্ত করবার সংস্কৃতি, স্বাধীন বিচারক্ষমতা নির্মাণের সংস্কৃতি, তর্ক ও মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকার করার সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সত্যের তফাত বিষয়ে সচেতন থাকার সংস্কৃতি, সত্যের স্বরূপ ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারার সংস্কৃতি, অযুক্তি ও মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শেখবার সংস্কৃতি। বলা বাহুল্য, এ সংস্কৃতি আমরা জন্মসূত্রে পাই না, তা হাজার বছরের প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যা নাকি বিজ্ঞানের সঙ্গে এক অমোঘ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক সম্পর্কে আবদ্ধ। এ সংস্কৃতি যেমন আধুনিক বিজ্ঞানকে সম্ভব করে তোলে, তেমনি আবার উল্টোভাবে, বিজ্ঞানের বড়সড় সাফল্যগুলোও একে পুষ্ট ও পোক্ত করে। কিন্তু, বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে এখন এ সংস্কৃতি নির্মিত হচ্ছে না, বরং তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে— প্রবল উদ্যোগে রচিত হচ্ছে সন্দেহ কুসংস্কার অযুক্তি অন্ধত্ব ঘৃণা হিংস্রতার বাতাবরণ। বিজ্ঞানের স্থান কোথায়, সেখানে?

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারি ও বেসরকারি উভয় তরফে প্রবল ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও, আমাদের এই চন্দ্রবিজয় আসলে ঘটেছে আমাদের অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতির পোক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে নয়, বরং এক প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। ওপরে যে প্রান্তিক বিজ্ঞান-বরাদ্দের (০.৭ শতাংশ) কথা বলেছি, সেটা কিন্তু আকস্মিক নয়, ধারাবাহিক। বর্তমান সরকারের আমলে এ-বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আগে থেকেই তা ছিল যৎসামান্য, বর্তমান সরকার অতি নিষ্ঠার সঙ্গে যৎসামান্যতর করে তুলছে তাকে ক্রমশই। দশমিক নয় থেকে দশমিক সাত, দশমিক সাত থেকে দশমিক ছয়। তার ওপরে যুক্তিবিরোধী গণতন্ত্র-বিরোধী ঘৃণা ও হিংসাভিত্তিক রাজনীতি, এবং তার ওপরে আবার পৌরাণিক মিথ্যাভিত্তিক এক পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতি নির্মাণের সুসংগঠিত কার্যক্রম।

এবার বরং তবে ফেরা যাক সেই গোড়ার প্রশ্নে। এইরকম এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিজয়ের মতো এক বৃহৎ সাফল্য আদৌ হতে পারল কীভাবে? তার একটা আংশিক উত্তর ওপরে আছে— আমাদের অর্থনীতির বৃহদায়তনের কারণে— কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর কারণগুলো আজ আর খুব অস্পষ্ট নয়।

ক্রমশ বিজ্ঞান তথা যাবতীয় গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে এবং বিচিত্র আইনকানুনের জালে জড়িয়ে তাকে বিকলাঙ্গ করে তোলা হবে, বিজ্ঞান-গবেষণাকে আটকে ফেলা হবে বাণিজ্যিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, মুক্তচিন্তা অনুসন্ধিৎসা জ্ঞানচর্চাকে প্রতিহত করা হবে, সরকারি শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলো বেচে দেওয়া হবে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হবে পৌরাণিক মিথ্যা-নির্ভর ও অন্তঃসারশূন্য। এবং, এই ধ্বংসলীলাকে আড়াল করার জন্য লাগবে চন্দ্রবিজয়ের মতো দু-একটি বড়সড় গণমাধ্যম-বান্ধব সাফল্য, যে সাফল্য হিন্দুরাষ্ট্রের যাথার্থ্য ও হিন্দুবীরের শৌর্যকে নস্যাৎ করবে না, বরং তাকে এনে দেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইজ্জত।

অতএব, চন্দ্রবিজয় দিয়ে হিন্দু-শৌর্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না স্বনামধন্য ইসরো-কর্তা শ্রীধর পানিকর সোমনাথ সায়েব। তিনি চন্দ্রবিজয় অভিযানের সাফল্য কামনায় ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজো দিয়েছেন সোৎসাহে, এবং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর কোনও বিরোধ তিনি আদৌ দেখেন না, কারণ, তিনি নাকি বিজ্ঞানচর্চা করেন বাইরের জগৎকে জানার জন্যে, আর মন্দিরে পুজো দেন অন্তর্জগৎকে জানার জন্যে। নিতান্ত বাজে যুক্তি, সন্দেহ নেই। অন্তর্জগৎকে জানার জন্য শিল্প সাহিত্য সমাজবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান এইসবের চর্চা করতে পারেন, মন্দিরে পুজো দিতে যাবেন কোন দুঃখে? মন্দির কী দিতে পারে আমাদেরকে, শুধু অজ্ঞতা ও আত্মপ্রতারণার পরমতৃপ্তি ছাড়া? ঠিক একইরকম কুযুক্তি তিনি পেশ করেছেন চন্দ্রাবতরণের নাম ‘শিবশক্তি’ রাখার সপক্ষে, যে নামটি স্থির করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদিজি স্বয়ং। সোমনাথ সায়েব বলেছেন, এ নাম চমৎকার, কারণ এর মধ্যে আছে ভারতীয়ত্ব। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক, কারণ এর মধ্যে আছে আমাদের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে নস্যাৎ করে হিন্দুত্বের সঙ্গে ভারতীয়ত্বের সমীকরণ বানাবার ছক। আর, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত মোটাদাগের রুচি ও ঔদ্ধত্য।

মহাকাশীয় কোনও বস্তুর ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা সামরিক নামকরণ করা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার ঘোষিত নীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ, কিন্তু মোদিজি ওসবের তোয়াক্কা করেন না। তিনি জানেন যে, হয় তিনি আন্তর্জাতিক লবির জোরে শেষতক ওই নামের অনুমোদন জোগাড় করে ফেলতে পারবেন, আর যদি একান্তই তা না পারেন সে তো আরও ভাল, তখন তিনি হিন্দুর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানি ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে আরও জমিয়ে জনসমর্থন ও ভোট আদায় করতে পারবেন।

যদি ‘শিবশক্তি’-র বদলে ‘নচিকেতা’ বা ‘মৈত্রেয়ী’ গোছের ঔপনিষদিক নাম আহরণ করা হত, তো তাতে থাকত শৈল্পিক রুচির আড়াল, এবং হয়তো তার পেছনে এ যুক্তি দেওয়া চলত যে, এর মধ্যে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু চরিত্রকেই আসলে সমর্থন করা হচ্ছে, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে। কিন্তু, মোদিজি ইনিয়েবিনিয়ে ওইসব ঢাকঢাক গুড়গুড় করবার লোক নন। তিনি সেইসব গোত্রের লোকজনের বাসনাকে জাতীয় বাসনায় রূপান্তরিত করতে চান, যাদের তিনি প্রকৃত নেতা। এবং তাঁর এক মস্ত গুণ, তিনি কী চান সেটা মোটেই লুকোতে চান না। কপালে তিলক কাটা যে স্থানীয় বিজেপি নেতা যে-কোনওদিন আপনার বাড়ির পাশে একটি হনুমান মন্দির স্থাপন করে মাইক্রোফোনে উচ্চগ্রামে হনুমান চালিশা চালিয়ে দিতে পারেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীজি তাদেরকে চাঙ্গা করে তুলতে চান। তাদের (এবং অন্য সকলেরই) কাছে তিনি এই স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে চান যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদেরই প্রতিনিধি, এবং তাদের বোধবুদ্ধি রুচি আকাঙ্ক্ষা যাতে গোটা দেশ তথা জাতির নির্ধারক বোধবুদ্ধি রুচি আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে, তিনি তার জন্য যথাসাধ্য করবেন।

এখন লাখ টাকার প্রশ্নটা হচ্ছে, এসবের মধ্যে দিয়ে কোথায় যাচ্ছে আমাদের প্রিয় দেশটির বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ? উত্তরটা হচ্ছে, ওটা সম্ভবত যাচ্ছে হিন্দু নরকের সেই ফুটন্ত কড়াইয়ে, যেখানে যমরাজের অনুগত দানবেরা বেয়াদবদেরকে ভাজা ভাজা করেন।

এবং, লাখতর টাকার প্রশ্নটা হচ্ছে, এই ভাজা হতে চলা বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎকে কি আমরা আটকাতে পারি না?

এর সঠিকতম উত্তরটি বোধহয় কারওই জানা নেই। তবে মানুষের ইতিহাস আমাদেরকে শেখায় যে, মানুষের সভ্যতা আর অগ্রগতির সঙ্গে এর কোথাও একটা গিয়ে মৌলিক বিরোধ আছে, তাই শেষপর্যন্ত কোথাও তো থামতেই হবে একে। আধুনিকতার অন্তর্নিহিত কোনও মৌল ভিত্তি ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে কোনও এক পর্যায়ে গিয়ে রাষ্ট্র অবশ্যই তার ন্যুনতম বৈধতা ও শক্তিটুকু হারাবে। দেশ ও জাতির কাছে সে একটা ভয়ঙ্কর সঙ্কট হবে, তাতে সন্দেহ নেই।

সে সঙ্কট ঠিক কবে কোথায় কীভাবে কতটুকু হবে, আর কীভাবেই বা আমরা তা থেকে উত্তীর্ণ হব, সে বোধহয় কেউই জানে না। আমাদের তো শুধু এটুকুই জানা আছে যে, মানুষ চিরকাল চেষ্টা করে চলে, এবং চেষ্টা করে যাবে!