Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিবর্ণ জীবনের রং

বিবর্ণ জীবনের রং | বিভূতি পট্টনায়ক

বিভূতি পট্টনায়ক

 


মূল ওড়িয়া থেকে অনুবাদ: লায়লী দাস

 

 

 

বিভূতি পট্টনায়কের জন্ম ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার ডিঙ্গেশ্বর গ্রামে ১৯৩৭ সালের ২৫ অক্টোবর।

তিনি উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ‘ওড়িয়া উপন্যাসের সমাজতাত্ত্বিক রূপরেখা’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ভুবনেশ্বর-এ সরকারি বিজেবি কলেজ থেকে ওড়িয়া ভাষা সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান এবং প্রধ্যাপকরূপে ১৯৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

চপলছন্দা’, ‘বধূ নিরূপমা’, ‘ধূলিঘর’ প্রভৃতি অর্ধ শতাধিক উপন্যাস ও ‘জগন্নাথের ঘরবাড়ি’, ‘আঁখি বুজি দেলে’, ‘সত্যযুগ’, এবং ‘ঝিঅ জন্ম’ প্রভৃতি পঁচিশটির অধিক গল্পসঙ্কলনের লেখক হিসেবে আধুনিক ওড়িয়া সাহিত্যে তিনি অক্ষয় কীর্তির অধিকারী।

অশ্বমেধের ঘোড়া’ উপন্যাসের জন্য ওড়িয়া সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ‘মহিষাসুর মুঁহ’ গল্প সঙ্কলনের জন্য কেন্দ্র অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। সামগ্রিক সাহিত্যসৃজনের জন্য তিনি পেয়েছেন মর্যাদাজনক বিষুব, শারলা এবং উৎকল ভারতী পুরস্কার। ওড়িশা সাহিত্য অ্যাকাডেমির সর্বোচ্চ সম্মান (সারস্বত) অতিবড়ি জগন্নাথ দাস পুরস্কারেও সম্মানিত তিনি। ‘নতুন দ্রৌপদী’ তাঁর সদ্যতম ভিন্ন ভাবনার স্মরণীয় উপন্যাস।

 

গত দুদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি। ভিখু বাইরে বেরোতে পারছে না। ভিক্ষে না করলে উপোস। সে-কথা এই শ্রাবণের বৃষ্টি কেন যে বোঝে না?

মা তাকে তিন-চারবার গাল দিয়ে শাপশাপান্ত করে নারকেলপাতার চাটাইয়ের ওপর নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েছে। সারাদিন উপোস করে শুলেই তার ঘুম পেয়ে যায়। গভীর ঘুম।

কাল রাতে ভিখুর মায়ের টিনের বাক্স থেকে চার আনা পয়সা চুরি হয়ে গিয়েছিল বলে সে চোরের উদ্দেশ্যে অনেক অশ্রাব্য গালিগালাজ বর্ষণ করেছিল। সেগুলো সে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছিল। তা না করলে আজ সকালে চার আনার ডালের বড়া কিনে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে পারত না সে।

নিজের পেটের জন্য মাঝে মাঝে ভিখুকে মায়ের পয়সা চুরি করতে হয়। তার কোনও বিবেক নেই। তাই পয়সা চুরির জন্য গালাগালি শুনতেও কষ্ট হয় না। আর কোন মা-ই বা দুদিন উপোস করে থাকার পর সুস্থ সবল ছেলেকে আদর করবে?

তবু বৃষ্টি চলছেই। মাঝে আধঘণ্টার জন্য একটু ঝিমিয়ে গিয়েছিল। ব্যস, তারপর আবার ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির ওপর খুব রাগ হয় ভিখুর। কিছুক্ষণ বর্ষণমুখর আকাশের দিকে চেয়ে থেকে নিজের নিদ্রিতা মাকে বলে— মা, যাচ্ছি।

বুড়ি মা চোখ মেলল। বলল— যাবি? এই বৃষ্টিতে?

—কী করব? বাবুদের গিন্নির ছেলে তো নই যে বৃষ্টির দিনে বসে বসে খিচুড়ি আর মাংস খাব। ভিখারির ছেলে…

মা আপনমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। তারপর পাশ ফিরে শুল।

 

বেলা দ্বিপ্রহর।

মাথায় একটা পুরনো খবরের কাগজ জড়িয়ে ভিখু স্টেশনে গিয়ে হাজির হল। কী যেন একটা ট্রেন ধরবার জন্য সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সে পয়সা চাইল। কেউ দিল না। একজন ওর দিকে কটমট করে চেয়ে বলল— জোয়ান ছেলে, ভিক্ষে করছিস! লজ্জা করছে না? চল, আমাদের বাড়িতে কাজ করবি।

প্রস্তাবটা শুনে ভিখুর চোখদুটো লোভে চিকচিক করে ওঠে। বাবুদের বাড়ি কাজ করলে রোজ রোজ আর তাদের কাছে হাত পেতে দাঁত কেলিয়ে ভিক্ষে করতে হবে না। রোজ পেট ভরে খাবার পাওয়া যাবে। এর চেয়ে আর ভাল প্রস্তাব কী হতে পারে?

কিন্তু পরমুহূর্তেই তার চোখে ঝলসে ওঠা আলো নিমেষের মধ্যেই নিভে গেল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল— যদি বাবু তোমাদের বাড়ি থেকে কোনও জিনিস চুরি যায়, আমাকে মারবে না তো? পিঠে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেবে না তো? এই দ্যাখো, এক বাবুর বাড়িতে কাজ করতাম, তারা আমার পিঠে কেমন গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়েছে।

ভিখু তার পিঠের গরম লোহার পোড়া দাগটা দেখানোর জন্য গেঞ্জি তুলতেই বাবু ধমকে ওঠে— কী বললি? চুরি করলে মার খাবি না? শুধু মার নয়, তোর গলা টিপে দেব। শালা চোর।

এই সময়ে সশব্দে একটা ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বাবু তড়বড় করে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়লেন।

শালা চোর ভিখু প্ল্যাটফর্মের সেই সিমেন্টের বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল। মনে মনে হাসল। সে জানে, কেউ তাকে চাকরি দেবে না।

একবার তো সে মায়ের কথা শুনে এই শহরের এক বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজত। ঘর মুছত। একদিন কে যেন বাবুর পকেট থেকে দশ টাকা চুরি করে নিয়েছিল। সকলে ভিখুকে ধরে মার দিল। লোহার শিক পুড়িয়ে পিঠে ছ্যাঁকা দিল। দু-মাসের মাইনে না দিয়ে বিদায় করে দিল।

চাকরির চেয়ে ভিক্ষে করা ভাল।

পেলে খুশি, না পেলে উপোস। কিন্তু মারের ভয় নেই। এই কদিন অসুখের পড়ে মা ভিক্ষে করতে যেতে পারছে না। মা ভালই ভিক্ষে পায়। তার চাওয়ার ভঙ্গি, কায়দা, গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কান্নার অভিনয়— কৃপণের মনও গলিয়ে দ্যায়। একবার তো মায়ের সেই কান্না দেখে সে নিজেই কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল— মা, তুমি এমন করে কেঁদো না। আমি বরং উপোস করে থাকব।

মা কান্না বন্ধ করে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওর কান ধরে বলেছিল— কান্না না পেলেও কেমন করে চোখের জল ঝরিয়ে কাঁদতে হয়, শিখে নে। রাজার বাড়িতে জন্মেছিস নাকি যে না কেঁদেই খেতে পাবি। তোর বাবা তো মরে গিয়ে তরে গেল, আমি নরকযন্ত্রণা ভুগছি।

মায়ের কাছ থেকে ভিক্ষে করার কোনও কৌশল সে শিখতে পারেনি। তাই ওকে কেউ ভিক্ষে দেয় না। কাজ করে রোজগার করার উপদেশ দেয়। কাজও তো মেলে না।

ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেছে। ভিড় পাতলা হয়ে এল। ভিক্ষে দেওয়ার লোকের সংখ্যাও কমে গেল। ওই ঝুপড়ি ঘরে মা তার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকবে। নিজের পেটও খিদেয় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। ভিখু দেখে, পাগলা একটা ঠেলাগাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পাউরুটি কিনছে।

এই পাগলা ভিখিরি বুড়ো রেললাইনের ওপারে বটগাছতলায় একটা মাটির ঝুপড়ি ঘরে থাকে। গত বছর বিয়ে করে সে ওদিককার সব ভিখিরিদেরই ঠাকুরের অভড়া ভোগ, মানে প্রসাদ খাইয়েছিল।

পাগলা বুড়ো কখনও সন্ন্যাসী সেজে ভিক্ষে করে আবার কখনও বা পাগলা।

বুড়োর কাছে গিয়ে ভিখু বলল— দাদু, খুব খিদে পেয়েছে। কিছুই পাওয়া গেল না। আমায় খানিকটা দাও না।

বুড়ো খানিকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইল। তারপর পাউরুটির থেকে বেশ বড় একখণ্ড ছিঁড়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিল— নে। আর চাইবি না। ভিক্ষে তোকে কোনও শালা দেবে না। ভিক্ষে করা ছাড়।

—আর কী করব?
—চুরি, খুন, ডাকাতি। তেরো চোদ্দ বছরের জোয়ান ছেলে। তোকে ভিক্ষে কে দেবে?

চুরির কথা শুনে ভিখুর পিঠের সেই পোড়া দাগটা আবার পুড়ে যাওয়ার মতোই জ্বালা করে উঠল।

—না দাদু, পারব না। বুকে দম নেই। আমার বাবা ভাল লোক ছিল। খেটে খেত। একদিন তাঁর গায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেল।

ওর কথা শুনে ভেংচে উঠে বুড়ো বলল— যা, যা, বাবার নাম ধুয়ে খেতে থাক। শালা হারামজাদা।

ভিখু কোনও প্রতিবাদ করল না। বুড়োটা মুখে খারাপ ভাষায় গালাগাল করলেও মনে মনে খুব দয়ালু। মাথা ঠিক থাকলে, ভাল ভাল কথা বলে। তার কেমন অনেক জমি বাড়ি ছিল, তার বড়ভাই সেই সম্পত্তি দখল করে, ভাগ দেবে না বলে গুণিন লাগিয়ে ওকে পাগল করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেসব কথা বেশ বানিয়ে-টানিয়ে বলতে পারে। ছোটবেলায় সব ভিখিরির ছেলেমেয়েরা বটগাছের তলায় বুড়োর কাছে বসে এসব গল্প শুনেছে।

একদিন এক খোঁড়া ভিখিরিনিকে বুড়ো বিয়ে করে ফেলল। খোঁড়া মেয়েটির মাথায় ঘোমটা টেনে বুড়োর সঙ্গে ওই মাটির ঝুপড়ি ঘরে থাকতে লাগল বলে আর সব ভিখিরি ও ভিখারিনী বুড়োর কাছে খেতে চাইল।

ভিখুর মনে আছে মায়ের সঙ্গে সেদিন সে-ও বুড়োর হাত থেকে অভড়া ভাত ও ডেলা ডেলা ডাল খেয়েছিল।

পাগলা বুড়ো তার সাত-তালিমারা ছেঁড়া কোটের পকেট থেকে বিড়ির বান্ডিল বের করে একটা বিড়ি টানতে লাগল। ভিখু ভাবছিল একটা বিড়ি চাইবে। তারপর কী মনে করে আর চাইল না।

বাইরের দিকে তাকায় ভিখু। বর্ষার বেগ কমে গেলেও আকাশ থেকে সরু সরু বৃষ্টির ধারা ছুটেই চলেছে।

ভিখু জিজ্ঞেস করল— দাদু, দিদা কেমন আছে? তাকে কেন সঙ্গে নিয়ে এলে না?

বুড়োর দাড়িভরা মুখ নড়ে উঠল। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ জ্বলে উঠল, সে জিজ্ঞাসা করল— কোন দিদা?

—খোঁড়া, ঘোমটা মাথায় দিদা…
—পাখি ফুরর…

বুড়োর মুখে ফুরর শব্দটি পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দের মতোই মনে হয় ভিখুর। সে জিজ্ঞেস করে— তুমি তো এখন আর পাগলা নও! দিদা কেন চলে গেল?

ভিখুর কথা শুনে বুড়ো হঠাৎ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখ বিকৃত করে নেচে নেচে মুখে হুইসল দেওয়ার ভঙ্গি করে চিৎকার করে উঠল— বুঝলি রে মায়ের ছেলে, শালা সবাই হারামজাদা। ভাই দুশমন… বউ ডাইনি… এই দুনিয়া গোল… নে নে, এই ছুরিটা নে, খোঁড়া বউয়ের জন্য রেখেছিলাম… সে তো ছু… এটা তোর কাছে থাক। যদি কোনওদিন ঘরে বউ আনিস— এই ছুরির ডাঁটিটা শক্ত করে ধরবি… বুঝলি বুড়ির ছেলে! তা নইলে তোর বউও ফুরর… হা হা!

ছুরিটা বুড়ো সিমেন্টের বেঞ্চের পাশে ফেলে দিয়ে চলে গেল।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল ভিখু। বুড়ো যে সত্যিই সিংয়ের ডাঁটিওলা ছুরিটা ওকে দিয়ে গেল, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সে ভাবছিল আধরাস্তা থেকে ফিরে এসে বুড়ো আবার হয়তো ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে কোটের পকেটে পুরে ফেলবে। বুড়ো রেললাইন ডিঙিয়ে ওপারে চলে যাওয়ার পর সে চোখের নিমেষে ছুরিটা তুলে নিয়ে নিজের পকেটে রেখেছিল।

ছুরিটা বিক্রি করলে অন্তত দু-তিন টাকা পাওয়া যাবে। মায়ের দুশ্চিন্তা দূর হল।

বৃষ্টি থামতে থামতে সেই সন্ধে।

ভিখু প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। নীল পোশাক পরা রেলওয়ের ঝাড়ুদারের পায়ের ঠেলা খেয়ে ওর ঘুম ভাঙল।

মনে পড়ে গেল বুড়োর ছুরিটার কথা। পকেটে হাত দিয়ে দ্যাখে— না, ঠিক আছে।

এবার এটা বিক্রি করতে হবে। সেই টাকায় কিছু চাল ডাল ও সবজি কিনে নিতে হবে। মা পথ চেয়ে বসে থাকবে।

তারপর ভাবল, উনুনে নিশ্চয়ই জল ঢুকে গিয়ে থাকবে। জ্বালানিও ভেজা চুপচুপে। চাল, ডাল নিয়ে সে কী করবে? না, না। সে বরং একটা বড় পাউরুটি কিনে নেবে। মিষ্টি পাউরুটি। আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্ম ডিঙিয়ে রেললাইনের ধার দিয়ে চলতে আরম্ভ করল ভিখু।

আকাশ থেকে মেঘ কেটে গেছে। চাঁদ উঠেছে। ফিকে জ্যোৎস্না। রেললাইন, পাশের মাঠ, গাছপালা চাঁদের আলোয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পকেটের ভেতর ছুরিটা নিরাপদেই আছে। যে-কোনও সময় সেটা বিক্রি করে দু-তিন টাকা পাওয়া যেতে পারে। সেজন্য পেটের ভেতরের খিদে ওকে আর অস্থির করছে না।

স্টেশন থেকে অনেকদূর এসে পড়েছে ভিখু। নির্জন রাস্তা। জ্যোৎস্নাভরা রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। সারাদিন বৃষ্টির জন্য পথে মানুষ নেই। কাকে সে ছুরিটা বিক্রি করবে?

এই সময়, বাঁদিকের গলি থেকে বেরিয়ে একজন স্ত্রীলোক তার আগে আগে চলতে শুরু করল।

ভিখু স্ত্রীলোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। পেছন থেকে তার লম্বা বেণী, কাঁধে ঝুলতে থাকা ব্যাগ দেখে সে বুঝতে পারছি, ইচ্ছে করলে স্ত্রীলোকটি ছুরিটা নিয়ে তাকে দু-তিন টাকা দিতে পারে।

ঝুপড়িঘরে তার মা অপেক্ষায় উপোসী শুয়ে আছে। ভিখুর ফিরতে দেরি দেখে হয়তো শাপ-শাপান্ত করছে।

—একটু শুনবেন?

ডাক শুনে স্ত্রীলোকটি পিছন ফিরে তাকাল।

না, ঠিক স্ত্রীলোক বলা চলে না। মেয়ে, ভিখুর চেয়ে তিন-চার বছরের বড় হতে পারে। চাঁদের আলোয় তার মুখটি বড় সুন্দর দেখাচ্ছে।

ছুরির কথা, টাকার কথা বলবে কি না দোনোমোনো করছিল ভিখু।

মেয়েটা রাগ করার মতো মুখভঙ্গি করে বলল— ডাকছিস কেন?

পকেট থেকে ছুরিটা বের করে মেয়েটিকে টাকার কথা বলতে না বলতেই সে হঠাৎ ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। তার চোখদুটি বিস্ফারিত। মুখের রং কাগজের মতো সাদা।

ভিখুর হাতে চাঁদের আলোয় ছুরিটা চিকচিক করছিল। নির্জন রাস্তা। আশেপাশে জনমনিষ্যি নেই। মেয়েটি হঠাৎ তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে দুটো দশটাকার নোট ভিখুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল— আর কিছু নেই। এই আছে… আমায় ছেড়ে দাও… আর কোনওদিন এইপথে একা আসব না…

এবার মেয়েটি ছুটে চলে গেল। চাঁদের আলোয় তার দোলায়িত লম্বা বেণী, বাতাসে উড়ন্ত নীল শাড়ির আঁচল… আঃ… খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

মেয়েটি দু টাকা নয়, কুড়ি টাকা দিয়ে চলে গেল। কিন্তু— ছুরিটা নিল না। ছুরিটা রেললাইনের ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভিখু হাঁফাতে হাঁফাতে মেয়েটা যেদিকে গিয়েছে, তার উল্টোদিকে ছুটতে লাগল।

দিগন্তব্যাপী চাঁদের আলোয় তার কুড়ি টাকা পাওয়ার আনন্দ এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ছিল।