প্রদীপ দত্ত
মণিপুরে তেল উত্তোলন, চুনাপাথর কি ক্রোমাইট খনন এবং অয়েল পাম চাষ— সবই হবে মূলত কুকি-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে। কুকিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বীরেনের চক্ষুশূল। নাগারাও এসবের বিরোধী, তবে তারা কুকিদের চেয়ে সংখ্যায় বড় এবং তাদের জন্য নাগাল্যান্ড কথা বলবে। কুকিদের জন্য বলার কেউ নেই। তাই কুকিরাই টার্গেট। কুকিদের সঙ্গে মেইতেইদের সখ্যতা এখন দূর অস্ত, মণিপুরে শান্তিও তাই। শাসক দল যে খেলায় দড় তাই খেলেছে, ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার, মানুষে মানুষে শত্রুতার চাষ, পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা। মণিপুরের জনগণ তো খেলার পুতুল, তাদের হায় হায় করা ছাড়া উপায় কী!
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনিতে মণিপুর ভরে আছে এবং আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট, ১৯৫৮ চালু রয়েছে। তারপরও মেইতেই, কুকি সমাজ এবং নিরাপত্তা বাহিনির মধ্যে ক্রমাগত চরম হিংসা চলছে। পাঁচ মাস হতে চলল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার স্পিকটি নট অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মহিলা বিল নিয়ে একদিনে তিনবার লম্বা লম্বা ভাষণ দিলেও মণিপুর নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে বিভাজন, শত্রুতা এবং অবিশ্বাসের বাতাবরণে মণিপুরবাসীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
আগের পর্বে উল্লেখ করেছি, সে রাজ্যে বর্তমান অবস্থার তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি, এপ্রিল মাসে হাইকোর্টের রায়। দ্বিতীয়, মায়ানমার থেকে শরণার্থী প্রবেশ এবং কুকিদের জনসংখ্যা, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে— এই পরিকল্পিত রটনা– সঙ্গে মেইতেই জঙ্গি বাহিনি আরামবাই টেঙ্গল ও মেইতেই লুপেনকে বীরেন সিং-এর মদত। তৃতীয় কারণ, পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে ‘বেআইনি দখলদার’ হিসাবে কুকিদের আফিমক্ষেত ধ্বংস করে সেই জমিকে সংরক্ষিত অরণ্য বলে ঘোষণা করা এবং কুকিরা ড্রাগের ব্যবসা করছে বীরেনের এই অভিযোগ।
কিছুকাল আগে সরকার পাহাড় ও উপত্যকার অংশের হিসাবে বদল এনেছে। আগে পাহাড়ের অংশ ছিল এমন অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন উপত্যকায় মিশেছে। এতেও সরকারের উপর আদিবাসীদের সন্দেহ বেড়েছে। অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্যে সরকার ভোটের দিকে তাকিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের খুশি করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে চরম বিভাজন ঘটিয়ে, কুকিদের উৎখাত ও হত্যা করতে এই কোনঠাসা আক্রমণের কারণ কি শুধু তাই? মনে হয় ৩ মে থেকে শুরু হওয়া জাতিগত হিংসার উদ্দেশ্যই ছিল পাহাড়ের মানুষের মধ্যে হাড় হিম করা ভয় ধরানো। এ হল মাটির নিচের তেল ও খনিজ তুলে আনতে এবং অয়েল পাম চাষের জন্য পাহাড় দখল না করলেই নয়।
ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি নিয়ে এগোনোর জন্য আদিবাসীদের জমিতে মাইনিং, তেল ও গ্যাস অন্বেষণ, রাস্তা, রেলওয়ে, বাঁধ ইত্যাদি তৈরির মতো পরিবেশধ্বংসী কাজ করে আদিবাসীদের জমি থেকে সরিয়ে বিস্থাপন গভীর চিন্তার বিষয়। কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রাঞ্জিট প্রজেক্ট, ট্রাই ল্যাটারাল হাইওয়ে প্রজেক্ট, মায়ানমারের চিন প্রদেশের সিটয়ে থেকে গয়া পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন ইত্যাদি সব কাজেই প্রভাবিত হবে কুকিপ্রধান অঞ্চল। জনজাতিদের মধ্যে এইসব প্রকল্প জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়েছে। ওদিকে নিজের পরিকাঠামো এবং বিনিয়োগ রক্ষার জন্য ভারত মায়ানমারের চিন প্রদেশের কুকি-চিন সমাজের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে বিভাজনের রাজনীতি করছে।
মাটির নিচে মজুত তেলের বিচারে মণিপুর গোল্ডেন ল্যান্ড। ২০১০ সালে কেন্দ্রের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক জুবিল্যান্ট অয়েল অ্যান্ড গ্যাস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে সে রাজ্যের জিরিবাম (পূর্ব ইম্ফল), তামেংলং এবং চূড়াচাঁদপুর জেলার দুটি ব্লকে তেল অন্বেষণ ও ড্রিলিং-এর লাইসেন্স দেয়। কুকিরা তার বিরোধিতা করছে। খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যেখানে হিংসাত্মক ঘটনা বেশি ঘটেছে সেই সব অঞ্চলেই জমি দখল ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বেশি ছিল।
২০০৬ সালের ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট বদলে, আদিবাসীদের বিধিবদ্ধ অধিকার অগ্রাহ্য করে রাজ্যে লাইমস্টোন, ক্রোমাইট, তামা ও নিকেল খননের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পরিবেশগতভাবে ভঙ্গুর মণিপুরের পাহাড়ে এই খনন আদিবাসীদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে। কুকিরা এসবেরও বিরোধিতা করছে। যে-সব পাহাড়ি জেলায় তীব্র হিংসা হয়েছে এবং যেখানে খনিজ রয়েছে সেই অঞ্চলে শতকরা ৮০-৮৫ শতাংশ খ্রিস্টানদের বাস। তাই তাদেরই যে আক্রমণ করা হয়েছে তা কাকতালীয় নাও হতে পারে। তাই মনে হয় এই সংঘর্ষের পিছনে অশুভ খেলা চলছে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই) এবং মিনিস্ট্রি অফ মাইন্স অ্যান্ড মিনারেলস মণিপুরের ভূতাত্ত্বিক ম্যাপ তৈরি করেছে। চুনাপাথর, ক্রোমাইট, নিকেল, তামা, ম্যালাসাইট, অ্যাজুরাইট, ম্যাগনেটাইট এবং প্ল্যাটিনাম গ্রুপের নানা খনিজ চিহ্নিত হয়েছে। জিএসআই-এর হিসাবে সে রাজ্যে ২ কোটি টন চুনাপাথর রয়েছে। উখরুল জেলায় তিনটি, তেংনৌপাল ও চ্যান্ডেল জেলায় সাতটি গ্রামের মাটির নিচে তা রয়েছে। ব্যুরো অফ মাইন্সের হিসাবে ওই তিনটি জেলাতেই ৬৬.৬ লক্ষ টন ক্রোমাইট মজুত রয়েছে।
এছাড়া ইম্ফল পশ্চিম, থৌবল, বিষ্ণুপুর, চূড়াচাঁদপুর, চ্যান্ডেল এবং উখরুলে— মোট ছটি জেলার ৬৬,৬৫২ হেক্টর জমিতে অয়েল পাম গাছ লাগানো হবে। এছাড়া জিরিবাম জেলায় একই গোত্রের গাছ ও নারকেল চাষের জন্য আরও ৭,৭১৫ হেক্টর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। পাহাড়ি জেলায় এসবের বিরুদ্ধে কুকিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
পাহাড় ও সমতলের ভাগ
‘দ্য ওয়ারে’ লিয়েন চোংলোই লিখেছেন, ইতিহাসে দেখা গেছে কুকিরা বরাবর মেইতেই রাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে। রাজার বাহিনিতে কুকিদের না নিয়ে কোনও অভিযান সফল হয়নি। পাহাড়ি অঞ্চল কোনওকালেই পুরোদস্তুর মণিপুরি রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। ওদিকে ব্রিটিশ আমলে উপত্যকার রাজত্ব পরিণত হয়েছিল ‘স্টেট দরবার’-এ, সেখানে মেইতেই রাজা ছিলেন প্রেসিডেন্ট। পাহাড় এক ব্রিটিশ অফিসারের অধীনে স্বতন্ত্রভাবে শাসিত হত।
অশীতিপর লেখক ও গবেষক এবং গুয়াহাটির নর্থ ইস্টার্ন সোশাল রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর ফাদার ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লিখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কুকিরা ইউরোপে গিয়ে ব্রিটিশ সেনার কুলি হতে না চাইলে ব্রিটিশরা তাদের আক্রমণ করে। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর অ্যাংলো-কুকি যুদ্ধে ব্রিটিশরা উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে তাড়িয়ে কুকিদের যাযাবর বানিয়ে ফেলে। পরে মিথ তৈরি করে কুকিরা আদিবাসীদের জমি দখল করেছে। মিথকে সত্যি ভেবে মণিপুরের বহু মানুষ এখনও মনে করে কুকিরা শরণার্থী। এর ফলে জাতিগত সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং ধারণা তৈরি হয়েছে যে, পাহাড়ে তাদের জমির অধিকার ছিল না।
রাজ্যের যা কিছু সম্পদ ভোগ করে মূলত ইম্ফল উপত্যকার মেইতেই সম্প্রদায়। দীর্ঘকাল ধরে মণিপুরের সরকার, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনে মেইতেই প্রাধান্য বজায় রয়েছে। সরকারি ভবন, গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অফিস, অন্যান্য পরিকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব— সবই রয়েছে মূলত উপত্যকায়। মেইতেই সমাজের উন্নতি পাহাড়ের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি।
ভারতের ডেভেলপমেন্ট অফ নর্থইস্ট রিজিয়নের (ডিওএনইআর) হিসাবে সামগ্রিকভাবে মণিপুরের পাহাড়ের মানুষের অবস্থা উপত্যকার তুলনায় বেশ করুণ। মেইতেইরা আইনসভা, প্রশাসন এবং বিচারবিভাগের সিংহভাগ পদে রয়েছে। কুকিরা মনে করে, মেইতেইরা তাদের সম্পদে ভাগ বসাতে চায়। তারা তফসিলি উপজাতি (এসটি) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে পাহাড়ে বসবাস শুরু করলে বনজ সম্পদ ধ্বংস হবে, জমির উপর চাপ বাড়বে। পড়াশোনা ও চাকরির জন্য সংরক্ষণের যে সুবিধা রয়েছে তাতে ভাগ বসাবে। তবে রাজ্যে দুর্নীতি যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তাতে আদিবাসীদের চাকরি পাওয়াই মুশকিল। তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি চাকরিও অন্যদের দেওয়া হয়েছে।
নানা অসুবিধার কারণে কুকিদের মধ্যে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারাও পাহাড়ে থাকত না। সেখানে রাস্তা, ব্রিজ, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং চাকরি নেই। বিধানসভার পাহাড়ি অঞ্চলের কমিটির (এইচএসি) ক্ষমতা কম, সাংবিধানিক কাজও করতে দেওয়া হয় না। উন্নত উপত্যকা ছেড়ে মেইতেইরা কী করে পাহাড়ে থাকবে? কেউ মনে করে না জমি কিনে মেইতেইরা কখনও পাহাড়ে এসে থাকবে।
মণিপুর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট এবং সংবিধানের ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট ১৯৬০-এর ৩৭১সি ধারায় পাহাড়ে কুকি, নাগা ইত্যাদি উপজাতির ভূমি সংরক্ষিত। একমাত্র এসটি ঘোষিত হলেই মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে এবং বেচতে পারবে। আদিবাসীদের বৃহৎ অংশ গরিব, অশিক্ষিত, রাজনৈতিক প্রভাবও কম। তাদের ভয় ছিল, তুলনায় ক্ষমতাশালী ও অবস্থাপন্ন মেইতেইরা এসটি স্বীকৃতি পেলে পাহাড়ের জমি কিনতে প্রভাব খাটাবে। উপত্যকায় বসবাসকারী মেইতেইদের সভ্যতা ২০০০ বছরের। তারা মণিপুরের অগ্রণী জাতি। রাজ্যের উন্নয়নের কাজ হয় মূলত সমতলকে ঘিরে। মেইতেই ভাষা ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম শিডিউল অনুযায়ী ২২টি ভাষার একটি। এহেন মেইতেইদের নেতারা ঠিক করেন যে, পাহাড়ে আদিবাসীদের জমি পেতে হলে নিজেদের সম্প্রদায়কে এসটি হতে হবে। তাই ২০১২ সাল থেকে তারা এসটি তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে (তবে এসসি এবং ওবিসি হিসাবে মেইতেইদের জন্য সংরক্ষণ রয়েছে)।
মেইতেইরা দাবি করে যে, প্রেসিডেন্টস কনস্টিটিউশন (শিডিউলড ট্রাইব) অর্ডার, ১৯৫০-এ তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ যখন প্রথম ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশন (বিসিসি বা কেলকার কমিশন) প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শিডিউলড ট্রাইব (মডিফিকেশন) লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়া জনজাতিদের নাম চেয়ে পাঠায়, মেইতেইরা তা চায়নি বলে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেনি। তারা বলতে পারে না সে সম্বন্ধে কিছু জানত না। কারণ তাদের একাংশ ওই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিডিউলড কাস্ট হয়েছে। পরিবর্তিত লিস্ট ১৯৫৬ সালে তৈরি হয়। ছয় দশক পেরিয়ে তারা আজ দাবি করছে, তারাও পিছিয়ে থাকা জনজাতি এবং যাদের তারা অপমানজনক ভাবে ‘হাও’ (উপজাতি) বলে ডাকে তারা তাদের সমগোত্রীয়।
কিন্তু তারা কেন এসটি হতে চাইছে? ‘দ্য ওয়ার’-এর সাংবাদিক করণ থাপারকে এক সাক্ষাৎকারে মেইতেই এমএলএ নিশিকান্ত সপম পরিস্কার বলেছেন, দ্য জব ইজ অ্যানাদার থিং, দ্য মেন থিং ইজ ল্যান্ড।
সংবিধান অনুযায়ী কোনও সমাজ বা জনজাতির এসটি লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কেলকার কমিশন বিষয়টা পুরোপুরি ছেড়ে রেখেছিল রাজ্যের হাতে। কমিশন প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিল। অনেক প্রশ্নের মধ্যে কয়েকটি ছিল: আপনি কি মনে করেন প্রেসিডেন্টের অর্ডারে এসসি বা এসটিদের যে লিস্ট রয়েছে তাতে কোনও পরিবর্তন দরকার? তা যদি হয় তাহলে উপরে উল্লেখ করা দুটি লিস্টের (এসসি এবং এসটি) মধ্যে কোন জাতি বা সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে বা বাদ দিতে চান? দয়া করে কারণ বলুন… আপনার রাজ্য সরকার কি বর্তমান লিস্টে কোনও উপজাতি, জাতি বা সমাজের অন্তর্ভুক্তির জন্য অথবা বাতিল করার সুপারিশ করেছে?
বেশিরভাগ মেইতেইরা নিজেদের সনামহি মেইতেইদের[1] (অস্পৃশ্য এবং প্রথাগত ধর্ম মেনে চলে) একই স্তরের মনে করে না। অস্পৃশ্যতার বিচারে মেইতেই সমাজের সনামহিদের এসসি লিস্টে নাম রয়েছে। তারা মেইতেই হলেও বাকি দ্বিজদের (দ্বিতীয়বার জন্ম হয়েছে বলে যাদের বিশ্বাস) তুলনায় অস্পৃশ্য। দ্বিজদের জন্য এসটি স্টেটাস চাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
এই অবস্থায় নিজেদের এসটি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করলে কোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়, মেইতেইদের এসটি করার সুপারিশ যেন কেন্দ্রের মিনিস্ট্রি অফ ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্সের কাছে পাঠানো হয়[2]। পরে অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় হাইকোর্টের ওই নির্দেশকে ‘কমপ্লিটলি ফ্যাকচুয়ালি রং’ বলে জানান। কারণ ওই রায়ের ক্ষেত্রে এসটি লিস্টে নাম তোলার যে পদ্ধতি সংবিধানে খুব পরিষ্কারভাবে বলা আছে তা মানা হয়নি।
তার আগে, কুকিদের জমি ও জীবিকা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় কয়েকটি গির্জা ভেঙে ফেলার জন্য বিষয়টি হিন্দু-খ্রিস্টান সাম্প্রদায়িক রং নিয়েছিল। তারপর কুকি, নাগা-সহ[3] পাহাড়ের বিভিন্ন আদিবাসী— একই ধর্মবিশ্বাস খ্রিস্টধর্মকে কেন্দ্র করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল।
হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে ৩ মে পাহাড়ি অঞ্চলের সমস্ত জেলার হেডকোয়ার্টারে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুর’ ‘সলিডারিটি মার্চ’-এর ডাক দিয়েছিল। ওই ইউনিয়নে নাগারাও রয়েছে। কিন্তু আক্রমণ করা হয়েছে শুধু কুকিদের। এরপর ৩ মে-র ঘটনা কুকিদের চোখ খুলে দেয়। তাদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে তার প্রতিবাদে ১০ জন কুকি বিধায়ক যৌথ বিবৃতিতে নিজেদের জন্য ‘স্বতন্ত্র প্রশাসন’-এর দাবি জানায়। তবে স্বতন্ত্র প্রশাসন নতুন কোনও দাবি নয়। স্বশাসিত জেলা কাউন্সিল, যা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে, পর্যবেক্ষণে এবং অর্থে চলবে— তা আইন অনুযায়ী পরিচ্ছন্ন প্রশাসন। প্রশাসনের নির্বাচন সরকারের হাতে থাকে। কিন্তু সরকারের সে ব্যাপারে আগ্রহ নেই। অথচ আদিবাসী এলাকা যদি পুরোদস্তুর স্বশাসিত হত এবং জেলা কাউন্সিল থাকত তাহলে আদিবাসীরা ভাল থাকত।
ছলচাতুরি
দেড় বছর আগে, ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চূড়াচাঁদপুরের নির্বাচনী জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, সরকার সমস্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলবে। কুকি জঙ্গিগোষ্ঠীদের সঙ্গে কথা বলে সরকার পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের সমস্যার সমাধান করবে— অসম, ত্রিপুরায় যেমন হয়েছে। তিনি দাবি করেন, বিজেপি অসমের বড়োল্যান্ড সমস্যার সমাধান করেছে। আমরা আজ তাদের (বড়ো বিদ্রোহীদের) উন্নয়নের পথে এনেছি। আজ কোনও বিদ্রোহী যুবকের হাতে অস্ত্র নেই, বরং রয়েছে মোটরসাইকেলের চাবি, ল্যাপটপ এবং শিল্পের চাবি। আমরা ব্লকেড ও বনধ মুক্ত মণিপুরের যে কথা দিয়েছিলাম, তা রেখেছি। আমার গর্ব হয় বীরেন সিং সরকার মণিপুরকে শান্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে।
আদিবাসীরা অমিত শাহ-র কথায় বিশ্বাস রেখেছিল। বিজেপি বলেছিল জিতলে অনেক কাজ করবে, তা হয়নি। নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন মেইতেইদের সঙ্গে মিটিং করেন। তিনি বলেন, মুসলমান, আদিবাসী এবং বাইরের লোকের সঙ্গে জমি ভাগ করবেন না। তাঁর ওই কথা মেইতেইদের জনজাতি-বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
আজ যাদের কুকি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী বলা হয় তাদের সঙ্গে সরকারের সাসপেনশন অফ অপারেশন (এসওও) চুক্তি হয়েছিল। তারা সরকারকে অস্ত্রসমর্পণ করেছিল, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলেছে। সরকার তাদের টাকা দিয়েছে, নির্ধারিত ক্যাম্প দিয়েছে। ভোটের আগে বিজেপি দিল্লি এবং গুয়াহাটিতে এসওও গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করে প্রার্থী ঠিক করেছে। সরকার তাদের টাকা দিয়েছে, নির্ধারিত ক্যাম্প দিয়েছে। এছাড়া ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে বিধানসভা ভোটের সময় বেশি আসন পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিজেপির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কুকি এসওও-ভুক্ত জঙ্গিদের বহু টাকা দিয়েছিলেন। তারা ভয় দেখিয়ে বিজেপির পক্ষে ভোট টেনেছে। বিজেপির প্রার্থীকে সমর্থন করে জঙ্গিরা প্রাক্তন সাংসদ কিম গাংটেকে অপহরণ করেছিল।
ক্ষমতায় আসার পরে বীরেন সিং তাদের সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে এসওও বাতিল বলে ঘোষণা করেন। সরকার এসওও থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এখন জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ হয়ে গেছে। কুকি জঙ্গিরা ফের অস্ত্র ব্যবহার করছে। অনেক বছর ধরে মেইতেই, নাগা ও কুকি সম্প্রদায়ের নাগরিক সংগঠন ওইসব জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাদের আর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। হিংস্র দল বা গোষ্ঠী তাদের জায়গা নিয়ে জাতিগত বিভাজন চাড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছে।
কিছুকাল ধরে সংগঠিতভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, মণিপুরে কুকিদের সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়ছে, তারা মণিপুরে রাজত্ব করতে চায়। কুকিদের বিরুদ্ধে মেইতেইদের প্ররোচিত করতে প্রচার করা হয়েছে যে, কুকিদের জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে ২০১১ সালে হয়েছে ২৯ শতাংশ, যা পুরোপুরি মিথ্যা প্রচার। ওই প্রচার উপত্যকার মানুষ, বিশেষ করে যুবাদের কুকিবিদ্বেষী করে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘দ্য ওয়ার’-এ লিয়েন চোংলোই জানিয়েছেন, ১৯০১ সালে মণিপুরের জনসংখ্যা ছিল ২,৮৪,৪৮৮, কুকিদের সংখ্যা ছিল ৪১,২৬২। অর্থাৎ কুকিরা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৪.৪ শতাংশ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮,৫৫,৭৯৪ আর কুকিদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪,৪৮,২১৪। অর্থাৎ ১১০ বছরে কুকিদের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।
এই হিংসায় বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদের অবদান রয়েছে। চার্চের উপর আক্রমণ বিজেপির নীতির প্রতিফলন। শুধু মণিপুরেই যে তিনশোর বেশি চার্চ পুড়ছে তা নয়, সারা দেশেই তারা খ্রিস্টানদের আক্রমণ করছে। মানবাধিকার আইনজীবী নন্দিতা হাকসারের মতে, সবরকমের আইডেন্টিটি পলিটিক্স— ব্যাপ্টিস্ট বনাম ক্যাথলিক, খ্রিস্টান বনাম মেইতেই, মুসলিম বনাম হিন্দু— মণিপুরের বন্ধন ছিঁড়ে ফেলছে।
তারপরও এই সংঘর্ষ এমন বিধ্বংসী আকার নিত না যদি সরকার ও প্রশাসন সম্প্রদায়গতভাবে পক্ষপাতহীন হত। বীরেনের আমলে পক্ষপাত চূড়ান্ত পর্যায়ে গেছে। আগের পর্বে বলা হয়েছে তিনি মেইতেইদের মৌলবাদী গোষ্ঠী আরামবাই টেঙ্গল এবং মেইতেই লুপেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ- যারা কুকি সম্প্রদায়ের জাতিগত নির্মূলীকরণে (এথনিক ক্লেনসিং) মূল অভিযুক্ত।
বীরেনের আফিম ও ড্রাগ নীতি এবং কুকিদের উপর হামলা
২০২১ সালের ডিসেম্বরে নেদারল্যান্ডভিত্তিক এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, মণিপুরে সবচেয়ে বেশি পপি চাষ হয় তিনটি জেলায়— সইকুল, উখরুল এবং চ্যান্ডেলে। সইকুলের অধিকাংশই কুকি। তবে বাকি দুটি জেলায় বেশি থাকে নাগারা। মণিপুরে বিজেপির প্রথম মেয়াদ শুরু হয় ২০১৭ সালে। সেই থেকে সরকার ১৫,৫০০ একর পপি ক্ষেত ধ্বংস করেছে। শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেতই কুকিদের।
২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বন দপ্তরের এক নোটিস অনুযায়ী চূড়াচাঁদপুর ও নোনে জেলার সীমান্তের কে সঙ্গজাম গ্রামের মানুষকে উৎখাত করা হয়। নোটিসে বলা হয় গ্রামের মানুষ চূড়াচাঁদপুর-খৌপুম সংরক্ষিত অরণ্যে ঢুকে পড়ছিল। চূড়াচাঁদপুর জেলার কুংপিনাওসেন গ্রামের মানুষদেরও একই কারণে গ্রাম খালি করে দিতে নোটিস দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার এইভাবে বনবাসী আদিবাসীদের উৎখাত করছে। কুকিদের উৎখাত করার জন্য প্রতিবাদ চলছিল।
১৯৬৬ সালে ওই অরণ্যকে সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সরকারের মতে, ওইসব বসতির অনুমতি দিয়েছিলেন যে আধিকারিক তাঁর সে যোগ্যতা ছিল না, সরকার বেআইনি দখলদার উচ্ছেদ করেছে। কুকিদের অভিযোগ— নিয়ম মেনে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ওই অভিযানে অনেক বাড়ি ও গির্জা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জনজাতিরা মনে করে তাদের বংশানুক্রমিক ভিটে থেকে কোনও আলোচনা ছাড়াই, অকারণে সরকার জোর করে উৎখাত করেছে। যাকে সরকার বলছে এনক্রোচমেন্ট জনজাতিরা তাকে বলে সেটেলমেন্ট। মার্চ মাসে এর বিরুদ্ধে ইন্ডিজিনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরাম (আইটিএলএফ) এবং কুকি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (কেএসও) পাহাড়ি জেলা চূড়াচাঁদপুর, উখরুল, টেংনৌপাল ও জিরিবামে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। দিল্লির যন্তরমন্তরেও একই সমাবেশ হয়।
এ বছর মার্চ মাসে এক সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এইসব লোকেরা সর্বত্র অনধিকার প্রবেশ করছে, রিজার্ভড ফরেস্ট, প্রোটেক্টেড ফরেস্টে পপি চাষ করছে। বীরেনের ‘ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে কুকিরা মনে করে তাদের টার্গেট করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মেইতেইদের আক্রমণ। মুখ্যমন্ত্রী পপি চাষের সঙ্গে অবৈধ মাইগ্রেশন এবং বনাঞ্চলে অনধিকার প্রবেশের কথা বললে কুকিরা আরও নিশ্চিত হল। ‘ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে যেভাবে কার্যকর করা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে কুকিদের প্রতি যেসব কথা বলেছেন তাতে মেইতেইদের মনোভাব বিরূপ হয়েছে।
পপিচাষিদের দুষ্কৃতি বলে দাগিয়ে দিয়ে সমাজে ভুল ধারণা ছড়ানো হয়েছে। ওই চাষে পোস্ত এবং আফিম— দুইই পাওয়া যায়। পপিগাছের বীজ পোস্ত খাবার হিসাবে অতি উপাদেয়। ওদিকে আফিম ড্রাগ না হলেও তা থেকে ড্রাগ তৈরি করা যায়। মরফিন-সহ নানা ওষুধ তৈরিতেও কাজে লাগে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ-সহ আরও কিছু রাজ্যে তা চাষ করা হয়। পাহাড়ে বসবাসকারী কুকি, নাগা ও অন্য সম্প্রদায় পপি চাষ করে কারণ, জুম চাষে তেমন লাভ হয় না। অন্য কোনও চাষে তাদের দুবেলার খাবার জোটানোই মুশকিল। শুধু দরিদ্র চাষিদের দিকে আঙুল তুলে মাদক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সমাজবিজ্ঞানী ধনবীর লাইশ্রাম জানিয়েছেন, কিছু বড়লোক মেইতেই পপি চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি টাকার জোগানদার। এক একর জমিতে পপি চাষ করলে ১.২ লাখ টাকা পাওয়া যায়। পপি চাষে যা বিনিয়োগ হয় লাভ তার পাঁচগুণ। অনেক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই চাষই মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস। তা যদি বন্ধ করতে হয় সরকারকে চাষিদের সাহায্য করা দরকার। বিকল্প লাভজনক চাষ শেখাতে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। কী করা যাবে, কী যাবে না তা বলে দিয়ে সরকারের বরং তাদের লাইসেন্স দেওয়া দরকার।
পাহাড়ের সংরক্ষিত অরণ্যে কুকিদের অনধিকার প্রবেশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে ১২ এপ্রিল বিজেপি বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপ চূড়াচাঁদপুর-খৌপুম সংরক্ষিত অরণ্য জরিপ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানান, বিষয়টি সেখানকার মানুষের বিপুল ক্ষোভের কারণ। যেহেতু সেখানে ফরেস্ট সেকশন অফিসার (এফএসও) নেই তাই আইন অনুযায়ী অ্যাসিস্ট্যান্ট সেটেলমেন্ট অফিসারই (এএসও) সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধিবদ্ধ অধিকারী। সরকার ওই সংরক্ষিত অরণ্য থেকে অনেকগুলি গ্রামকে বাদ দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (এএসও) সেই নির্দেশ খারিজ করার জন্য ফের সরকারি অনুমোদনের দরকার হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে দেরিতে খারিজ করার যে কথা বলা হয়েছে তার জন্য জমির মালিক দায়ী নয়। তিনি বিধানসভায় তাঁর বক্তব্যে এবং চিঠিতে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। তারপরও ২৬ এপ্রিল চূড়াচাঁদপুরে বেশ কয়েকটি কুকি পরিবারকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
কুকি জঙ্গিরা সংগঠিতভাবে মাদকের জন্য তোলা আদায় করে। তা নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে তোলার টাকা কম হয়, জঙ্গিগোষ্ঠী বেকায়দায় পড়ে। তাই তারাও সরকারের ওপর রুষ্ট। অনেকে এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে বলে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কুকি জঙ্গিগোষ্ঠীরা সাসপেন্স অফ অপারেশনস-এ (এসওও) স্বাক্ষরকারী। তারা পোস্ত চাষের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে বিবৃতি দিয়েছে। এসওও-র স্বাক্ষরকারী কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন পোস্ত চাষ নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে সাত বছর আগেই ওই চাষ নিষিদ্ধ করেছে, এ কথা ঠিক। সতর্কতা না মানলে পরিণাম খারাপ হবে বলেও জানিয়েছে। তবে যারা এসওও-তে স্বাক্ষরকারী নয় সেইসব জঙ্গিগোষ্ঠী পপি চাষ সমর্থন করে এবং ওই চাষে বাধা সৃষ্টির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারও দেয়। আর্থিক স্বার্থের জন্য এসওও স্বাক্ষরকারী অথবা তা নয় এমন অনেক জঙ্গিগোষ্ঠীই পপি চাষে মদত দেয়।
মাদকের ব্যবসা
বলা হয় কুকিরাই নাকি মাদকের ব্যবসায় লিপ্ত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ এ-ব্যাপারে গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছে। লিয়েন চোংলোই দ্য ওয়ার-এ লিখেছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের এএসপি থৌনাওজাম ব্রিন্দা এক মাদকের চাঁইকে গ্রেফতার করার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্য পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। ২০১৯ সালে মুম্বাই পুলিশ বান্দ্রাতে অস্ট্রেলিয়ার রেজা বোরহানিকে ১.৮ কোটি টাকার এলএসডি-সহ গ্রেফতার করে। ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার মণিপুর’ জানিয়েছে যে, বীরেন সিং সরকার বোরহানিকে মণিপুর থেকে গাঁজার বীজ, ফুল ও পাতা পরিবহনের লাইসেন্স দিয়েছিল। ইম্ফলের এক মেইতেই বিধায়ক রাজ্য সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ২০১৯ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে ৫০ কেজি আফিং-সহ দুই মেইতেই নাগরিককে দিল্লি পুলিশের গ্রেফতার করা নিয়ে ওই বিধায়ক রঘুমনি সিং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখে জানান, মাদকের ব্যবসায় “অতি প্রভাবশালী পরিবার এবং খুব শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিবাররা জড়িত।”
ড্রাগ বা মাদকের সমস্যা মণিপুরবাসীর কাছে গুরুতর সমস্যা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে হিরোইন থেকে এইচআইভির সংক্রমণে মণিপুর বিধ্বস্ত হয়েছিল। তাই রাজ্যের মানুষের কাছে মাদকের সমস্যা খুবই বাস্তব। মণিপুরের অবস্থানগত বৈশিষ্টের জন্য রাজ্যটি মাদকদ্রব্য পরিবহনের সুবিধাজনক স্থান। গত দুই দশকে মণিপুরের মিয়ানমার সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে পোস্ত চাষের অঞ্চল বেড়েছে, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে জোরদার হিরোইনের ব্যাবসা শুরু হয়েছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের কুখ্যাত অঞ্চল থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়া। দীর্ঘকাল ধরেই ওই তিন দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। বর্তমানে থাইল্যান্ড ও লাওস মাদকদ্রব্যের চোরাচালান থেকে সরে আসার চেষ্টা করলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনি দেশের নানা জাতিগত সশস্ত্র চরমপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তির বিনিময়ে ড্রাগের চোরাচালানে ছাড় দেয়। নব্বইয়ের দশক থেকেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনি জুন্টা মাদকদ্রব্যের উপর নজরদারিতে গুরুত্ব কম দেয়। গত দশকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। জাতিগত মিলের জন্য সে দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে এ পারের জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। পূর্ব মণিপুরের পাঁচটি জেলা মিয়ানমার লাগোয়া। সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটারের বেশি হলেও মাত্র ১০ শতাংশে তারকাঁটার বেড়া রয়েছে। তাই অঞ্চলটি মাদক চালানের খোলা হাট। অভিযোগ, কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীরা মিয়ানমার থেকে আসা অবৈধ কুকি অভিবাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তারা আগে থেকেই সে কাজে লিপ্ত ছিল বলে বেশি দক্ষ। তারাই স্থানীয় মানুষকে পপি চাষ এবং আফিম কীভাবে তৈরি করতে হয় তা শেখাচ্ছে।
মিয়ানমারের চিন প্রদেশে পপি চাষের রমরমা। চিন-সংলগ্ন বর্ডারের এপারে মণিপুরের দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে পপি চাষ যে কতটা বেড়েছে তা স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। আগে যেখানে আনারস চাষ হত, এখন হয় পপি চাষ। পাহাড়ে পপি চাষ বেশি হলেও, আফিমের ব্যবসায় মুসলমান, কুকি, মেইতেই, নেপালি— সবাই যুক্ত। তারা পাহাড় থেকে আফিম কিনে এনে আন্তঃরাজ্য পরিবহনের সাহায্যে আফিম পাঠায় অসমে। সেখান থেকে এজেন্ট মারফৎ তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
মণিপুর পুলিশ ২০১৭ সাল থেকে ড্রাগ সংক্রান্ত মামলায় ২৫১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে ১০৮৩ জন পঙ্গাল[4], ৮৭৩ জন কুকি আর ২৮১ জন মেইতেই, বাকিরা অন্যান্য জাতির লোক। কুকি নাগা এবং মেইতেইরা ব্যপকভাবে পপি চাষ করে, কিন্তু নিন্দা হয় শুধু কুকিদের। সব সম্প্রদায়কে নিয়েই এর সমাধান খুঁজতে হবে।
শরণার্থী সমস্যা
সরকার এবং মেইতেইরা বলে, রাজ্যে বার্মিজ এবং অন্য প্রদেশের মানুষের অবৈধ অনুপ্রবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিপন্ন হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর হিসাবে সে রাজ্যে প্রায় ২০০০ জন বার্মিজ রয়েছে। তা যদি সত্যি হয় তাহলেও ২০১১ সালের জনসুমারি অনুযায়ী ২৮ লক্ষ মণিপুরবাসীর তুলনায় সংখ্যাটা খুবই কম। তাছাড়া উত্তরপূর্বে মণিপুর সুরক্ষিত রাজ্য। কারণ সেখানে ইনার লাইন পারমিট ব্যাবস্থা চালু রয়েছে, তাই সে রাজ্যে ঢোকা এবং থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। থাকতে গেলে বিশেষ পারমিট নিতে হয়।
অনেকদিন ধরে প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক জান্তার শাসন চলছে। মিয়ানমারের নিষ্ঠুর সামরিক আমলে সে-দেশের চিন উপজাতির কয়েক হাজার মানুষ পালিয়ে উত্তরপূর্বের মণিপুর ও মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৯০ সালে সে-দেশে কঠোর মিলিটারি শাসন চালু হলে সেখানকার চিন জনজাতির অনেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের সেনা অভ্যুথ্যান হলে ফের চিন জনজাতির বহু মানুষ মণিপুরে চলে আসে। তাদের বেশিরভাগই রয়েছে কুকি জনজাতি অধ্যুষিত পাহাড়ি জেলা চূড়াচাঁদপুর, চ্যান্ডেল ও কাংপোকপিতে। সে-দেশের চিনা জনগোষ্ঠী এবং মিজোরামের মিজো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মণিপুরের কুকিদের নৃতাত্ত্বিক মিল রয়েছে। তারা বেশিরভাগই কুকি এবং সীমান্ত অঞ্চলেই থাকে। তাদের স্বীকৃত শরণার্থী করা দরকার। তাহলে তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে কিছু সাহায্য পাবে। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশে বীরেন সিং সরকার তাদের কোনওরকম সাহায্য করে না। মিজোরাম সরকার কিন্তু তাদের শরণার্থী হিসাবেই আশ্রয় দিয়েছে।
মানবাধিকার আইনজীবী নন্দিতা হাকসার জুন মাসে এক প্রবন্ধে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ওই শরণার্থীদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মিল রয়েছে বলে মণিপুর ও মিজোরামের মানুষ এবং দুই রাজ্য সরকার শরণার্থীদের সাহায্য করতো। মণিপুরে মেইতেই সহ সমস্ত সম্প্রদায়ই শরণার্থীদের সাহায্য করত। শরণার্থী প্রবেশ বেড়ে যাওয়া এবং পরিচয়পত্র না দেওয়ার জন্য অনেক মানুষের ধারণা হয়েছে শরণার্থীরা হয়তো তাদের জমিতেই আশ্রয় নেবে এবং তাদের সংখ্যার চাপে স্থানীয়রা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে।
ভারতে শরণার্থীদের অধিকার সুরক্ষার কোনও আইন নেই। তাই তারা অবৈধভাবে পরিচয়পত্র জোগাড় করে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ যাদের শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাদেরও বসবাসের পারমিট দেওয়া হয় না। সেই ব্যবস্থা ২০১৫ সালের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর কেন্দ্র রাজ্যকে শরণার্থীদের পরিচয়পত্র দিতে নিষেধ করে দিয়েছে। বলেছে, তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে দেখতে হবে। সীমান্তা পেরিয়ে তারা যেন না আসতে পারে তাই মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের সরকারকে সীমান্তে নজর রাখতে বলেছে। সংহতিকে উৎসাহ না দিয়ে, তাদের মানবিক সাহায্য না করে কেন্দ্র মানুষের মধ্যে ‘বহিরাগত’ ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। বীরেন এবং মেইতেই চরমপন্থী গোষ্ঠী এই বিষয়টাকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গেছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘর্ষের এটাও একটা কারণ।
নন্দিতার মতে, মণিপুরের বর্তমান অবস্থা থেকে বোঝা যায় দেশে শরণার্থী সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার, যেখানে শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অধিকারের কথা বলা হবে। তাদের জন্য পরিচয়পত্র চালু করা দরকার, তাহলে তাদের সঠিক সংখ্যাও জানা যাবে। কাজের অধিকার, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং লাইসেন্স পাওয়া তাদের বুনিয়াদি অধিকার, যা সংবিধানের ২১ এবং ১৪ নম্বর ধারার অন্তর্ভুক্ত। ১৪ নম্বর ধারা আইনের চোখে সমানাধিকারের কথা বলে, ২১ নম্বর ধারা জীবনরক্ষা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে। শরণার্থী, পরিযায়ী, ভ্রমণকারী— যেই হোক না কেন এই দেশের মধ্যে যাঁরাই রয়েছেন সবার এই অধিকার রয়েছে।
তেলের সন্ধান
মাটির নিচে মজুত তেলের বিচারে মণিপুর গোল্ডেন ল্যান্ড। সবচেয়ে বেশি রয়েছে জিরিবাম (পূর্ব ইম্ফল), তামেনলং এবং চূড়াচাঁদপুর জেলায়। ২০১০ সালে কেন্দ্রের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক নেদারল্যান্ডের জুবিল্যান্ট অয়েল অ্যান্ড গ্যাস প্রাইভেট লিমিটেডকে পূর্বোক্ত তিন জেলার দুটি তেলের ব্লকে অনুসন্ধান ও ড্রিলিং-এর অনুমতি দেয়। এরপর ওই কোম্পানি ও রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের মধ্যে প্রোডাকশন শেয়ারিং চুক্তি হয়। ওই বছরই মণিপুর সরকার পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন লাইসেন্স দিয়েছে। জুবিল্যান্টের পরিকল্পনা ছিল তেলের সন্ধানে ৩০টি জায়গায় ড্রিল করবে। ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তেল অনুসন্ধান করা হবে। কোম্পানির বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় দুটি ব্লকে ৩৮,৮০০ থেকে ১,৪৩,০০০ কোটি কিউবিক ফুট তেল পাওয়া যাবে। পরিকল্পনা ছিল ২০১৩ সালে তারা উত্তর ও দক্ষিণ মণিপুরে মোট তিনটি অন্বেষণ ড্রিল করবে।
প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার কার তা উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী অঞ্চলে বিতর্কিত। তারা মনে করে জমি যার খনিজও তার। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণায় অবশ্য তাইই বলা হয়েছে। জমির মালিক আদিবাসীরাই তাদের প্রাকৃতিক সম্পদেরও ব্যাবস্থাপনা করবে। ভারত সেই ঘোষণার পক্ষেই ভোট দিয়েছিল।
২০১২ সালে জুবিল্যান্ট এনার্জি সিসমিক সার্ভের কাজ শুরু করতে গেলে আদিবাসীদের প্রবল বাধায় পিছু হটে। তারা এসবের কিছুই জানত না বলে এই প্রক্রিয়া এবং তেল অন্বেষণের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। শেষে মণিপুর পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড ২০১২ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে তেল অন্বেষণ নিয়ে জিরিবাম, পারবুং এবং নুংবা শহরে জনশুনানির আয়োজন করে। সেখানে আদিবাসীরা বিপুল প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের জেরে নুংবাতে শুনানি বাতিল করতে হয়। শেষ পর্যন্ত জুবিল্যান্ট নির্ধারিত কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
২০১৭ সালে রাজ্যের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী থোঙ্গাম বিশ্বজিত সিং ফের জানান, রাজ্য সরকার তেল অন্বেষণের কাজ শুরু করতে চায়, তাই জুবিল্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তিনি রাজ্যে মজুত তেল ও গ্যাসের অন্বেষণ অনুমোদন করেছেন। আরবের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে তেল উত্তোলনের জন্য কোনও বিপদই হয়নি। সরকার বর্ষার পর রাস্তাঘাট ও ব্রিজ শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে চায়, যেন রাস্তা দিয়ে ভারী মেশিনপত্র পরিবহন করা যায়।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ শুরু হয়। বিপদ বুঝে বিজেপি ও মণিপুর সরকার ওই বিষয়ে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। তার আগে এশিয়ান অয়েল ফিল্ড পশ্চিম ইম্ফলের খাইদেম গ্রামে বিস্ফোরক ফাটিয়ে তেল অন্বেষণ শুরু করে। তেলের সন্ধান চলছে বুঝে স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। তারা স্থানীয় নেতাদের ঘুষ দিয়ে পাওয়া নো অবজেকশন সার্টিফিকেট মানেনি। তারা মনে করে ওই কাজে তাদের জমি ও পরিবেশ দূষিত হবে। বলে, স্থানীয় মানুষের অনুমতি না নিয়ে তেল অন্বেষণ করা চলবে না, ওই প্রকল্পের কথা বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে এবং তার পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাবের মূল্যায়ন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা, ভারত সরকার ও মণিপুর সরকারের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তির কথাও তাদের বিস্তারিত জানাতে হবে। প্রবল বাধায় এশিয়ান অয়েলফিল্ড কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এরপর ২০২০ সালে অসমের বাঘজান গ্রামে অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল) ড্রিলিং-এর কূপ থেকে তেল উপচে পড়ে আগুন লাগার দুর্ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে মণিপুরের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিআরএ) তেল অন্বেষণ ও সার্ভের কাজ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানায়। তারা বলে, ওআইএল বাঘজানের আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। সংবেদনশীল ডিব্রু-সইখোয়া ন্যাশনাল পার্কের বিরাট জলাভূমি দূষিত হয়েছে। মণিপুরে একইরকম তেল উপচে পড়ার ঘটনা ঘটলে পৃথিবীর দুই পরিবেশ-সংবেদনশীল এলাকা— ইস্টার্ন হিমালয়াস বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট এবং ইন্দো-বার্মা হটস্পটের বাস্ততন্ত্রের ক্ষতি হবে। ওআইএল তেল উপচে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে যে সিঙ্গাপুরের অ্যালার্ট ডিজাস্টার কন্ট্রোলের পরামর্শ নিচ্ছে তাতেই বোঝা যায়, এইরকম বড় দুর্ঘটনা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এবং তেল ক্রমাগত উপচে পড়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারা থেকে শিক্ষা নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে তেল অন্বেষণের কাজ পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
পাশের রাজ্য নাগাল্যান্ডে প্রায় ৬০ কোটি টন তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আছে বলে অনুমান করা হয়। তার মালিকানার জন্য প্রায় তিন দশক ধরে আদিবাসীদের প্রতিবাদ চলেছিল। সেখানে স্থানীয় মানুষ ও জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরোধিতায় ১৯৯৪ সাল থেকে ওএনজিসি-র অন্বেষণ বন্ধ ছিল। নাগাল্যান্ড ট্রাইবস কাউন্সিল (এনটিসি) ওই কাজের কিছু শর্ত রেখেছিল। প্রাকৃতিক সম্পদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আদিবাসী ও ছাত্র-ছাত্রী গোষ্ঠী এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংবিধানের অধিকার এবং সমাজের অধিকারের কথা বলেছে, যা ছিল নাগা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংশ। তবে দীর্ঘদিনের আলোচনায় সমস্যা অনেকটাই মিটেছে। এখন অসম ও নাগাল্যান্ড নীতিগতভাবে তাদের সীমান্তের বিতর্কিত অঞ্চলে তেল অনুসন্ধানের জন্য মেমোর্যান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (মৌ) স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে, যেন দুই রাজ্যই উত্তোলিত তেলের রয়্যালটির অর্থ পায়।
ক্রোমাইট ও চুনাপাথর খনন
ইউনাইটেড নেশনস ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস-এর ২৬ নম্বর আর্টিকেলে রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানিয়েছে, আদিবাসীদের টেকসইভাবে জমি ও সম্পদ রক্ষায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকা জরুরি। ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসীরা যে জমির মালিক এবং যার ব্যবহার, উন্নয়ন ও দেখাশোনা করেছে— সেই জমিতে, অঞ্চলে, সম্পদে তাদের অধিকার রয়েছে। কর্পোরেটরা তাদের লাভ লোকায় এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চায় না।
ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে ফ্র্যাঙ্কি ভারা লিখেছেন, ভারতের সংবিধানে বলা হয়েছে যে আদিবাসীদের জমি ও বনকে সুরক্ষা করতে হবে। ২০০৬ সালের ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসী এবং বনে যারা বাস করে তাদের সমাজ প্রাকৃতিক সম্পদের দেখভালের বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলবে। সংবিধানের সংযোজিত পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শিডিউল অনুযায়ী আদিবাসী নয় এমন কাউকে বা শিল্পের জন্য জমি দেওয়া যাবে না। এসব সত্ত্বেও মণিপুর সরকার আদিবাসীদের অধিকার না মেনে খনিশিল্পকে পথ করে দিচ্ছে।
এক যুগ আগে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই), ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স এবং মণিপুর সরকার খনিজ খুঁজতে সার্ভে শুরু করেছিল। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি, বিনিয়োগ এবং খননের কাজে পরিবেশের বাধা আইন করে কাটানোর পর এই কাজকর্ম বেড়েছে। এখন লক্ষ্য রাজ্যের পূর্বদিকের ক্রোমাইট ও চুনাপাথর খননে। বিশেষ করে মায়ানমারের সীমান্তে উখরুল, কামজং, তেংনৌপাল এবং চ্যান্ডেল জেলায়। ২০১৩ সালের ইন্ডিয়ান ব্যুরো অফ মাইন্সের হিসাবে মণিপুরে ৬৬.৬ লক্ষ টন ক্রোমাইট রয়েছে। ৫৫ লক্ষ টন রয়েছে উখরুল ও কামং জেলায়[5]। ১১ লক্ষ টন রয়েছে তেংনৌপাল ও চ্যান্ডেল জেলায়। উখরুলের তিনটি গ্রামে এবং তেংনৌপালে ও চ্যান্ডেলের চারটি গ্রামে।
রিফ্র্যাক্টরি, মেটালার্জিকাল, রাসায়নিক, অ-লৌহঘটিত খাদ-শিল্পে ক্রোমাইটের প্রয়োজন হয়। তার সামরিক ব্যবহারও রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অর্ধেক ক্রোমাইটের জোগান আসে। তারপরেই রয়েছে কাজাকস্থান। ভারত পৃথিবীর ১৭ শতাংশ ক্রোমাইট উৎপাদন করে। দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে তা রপ্তানিও করে। ৯৩ শতাংশ ক্রোমাইট মজুত রয়েছে ওডিশায়। মূলত কটক ও জাজপুরের সুকিন্দা উপত্যকায়। ভারত পৃথিবীর ১৭ শতাংশ ক্রোমাইট উৎপাদন করে। দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে তা রপ্তানিও করে।
২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইন্ডিয়ান বুরো অফ মাইনস এবং মিনিস্ট্রি অফ মাইনসের মাধ্যমে কেন্দ্র বেসরকারি কোম্পানিকে উখরুল ও চ্যান্ডেল জেলার খননের লিজ এবং লাইসেন্স দিয়েছিল। তারপরে মণিপুর সরকার এবং নানা বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে জমি, জল, কাঁচামাল এবং মাইনিং-এর অধিকার নিয়ে মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আরও পরে, ২০১৭-র নভেম্বরে ইম্ফলে নর্থইস্ট বিজনেস সামিটের সময় ক্রোমাইট ও চুনাপাথরের অন্বেষণ ও খননের জন্য ন-টি প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে মৌ স্বাক্ষরিত হয়।
তার মধ্যে দুটি জেলা মিয়ানমারের সীমান্তের কাছে– উখরুল ও চ্যান্ডেল। পরিবেশের উপর খননের প্রভাব কেমন হবে তার মূল্যায়ন যেমন করা হয়নি, খননে স্থানীয় আদিবাসীদের সম্মতিও চাওয়া হয়নি। কংগ্রেসের বিধায়ক সুরজকুমার আথোকপম সরকারকে সতর্ক করে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বীকার করেছিলেন ক্রোমাইট মাইনিং-এর জন্য ভারতের গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে গরিবরা ওডিশায় থাকে। ক্রোমাইট খননের জন্য মণিপুরের আদিবাসীরাও ওডিশার মতো দরিদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। তাই রাজ্যের সাবধান হওয়া এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু ওডিশার ক্রোমাইট মাইনিং-এর জন্য জমি থেকে আদিবাসীদের উৎখাত হওয়া এবং পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ভয়ানক ক্ষতি থেকে মণিপুর শিক্ষা নিতে চায় না।
ফ্র্যাঙ্কি ভারা ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে পরিবেশের ক্ষতি ও মানুষের অসুস্থতা নিয়ে দেশের চারটি রাজ্য— ওডিশা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের তিনটি সমীক্ষার কথা বলেছেন। ওডিশার সুকিন্দায় ক্রোমাইটের খোলামুখ মাইনিং হয়। বেশিরভাগ খনিই দামশালা নালা অববাহিকায়। তীরের খনি থেকে জল চুইয়ে নালার জলকে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়ামে দূষিত করে। আশপাশের বাসিন্দাদের জীবনে ভয়াবহ অভিশাপ বয়ে এনেছে।
কুকি, নাগাসহ আদিবাসীরা বেসরকারি কোম্পানিকে খননের জন্য তাদের জমি বিক্রি করতে রাজি নয়। এক্ষেত্রে বিধানসভায় পাশ হওয়া মণিপুর (হিল এরিয়াস) ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (থার্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০০৮ প্রণিধানযোগ্য। ওই আইন এতকাল ধরে জনজাতিদের যৌথভাবে জমির মালিকানার ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছে। গ্রামপ্রধানের হাত থেকে মালিকানা কেড়ে নিয়ে জনজাতিদের সঙ্গে আলোচনা না করেই অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের সভ্যদের হাতে জমিবণ্টন, দখল ও ব্যবহারের ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। এইভাবে জনজাতিদের জমিনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ।
এই আইন আদিবাসীদের জমির যৌথ মালিকানার ধারণাকে নাকচ করে, অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলের সদস্যদের জমি বন্টন, দখল করার অধিকার দিয়েছে। এই আইনের বলে আদিবাসীদের জমি ও অরণ্য রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল।
যাদের জমিতে খনন হবে তাদের না জানিয়েই মণিপুর সরকার ইজারাদারদের (lessees) সঙ্গে চুক্তি করেছে। উখরুল জেলায় ওডিশার তিনটি কোম্পানি— আনন্দ এক্সপোর্টস লিমিটেড ২৪০০ হেক্টর জমিতে, ভিসা স্টিল লিমিটেড ২৫০০ হেক্টর এবং বালাসোর অ্যালয়স লিমিটেড ২০০০ হেক্টর জমিতে মাইনিং-এর অধিকার পেয়েছে। অথচ কোনওটির ক্ষেত্রেই এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করা হয়নি। না জানিয়ে তাদের জমি নিয়ে চুক্তি করেছে বলে স্থানীয় মানুষ এবং নাগরিক সমাজের কয়েকটি সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে।
২০১৩ কেরল রাজ্য বনাম জেনমিস (কেরলের জমির মালিক) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, খনিজের মালিকানা জমির মালিকেরই, সরকারের নয়। জাস্টিস আর এম লোহিয়ার নেতৃত্বে তিন বিচারকের বেঞ্চ রায় দেয়, এই দেশে এমন কোনও আইন নেই যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র জমি বা খনিজ সম্পদের মালিক। যেসব আইন মাটির নিচের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নিয়ন্ত্রণ করে তার উল্লেখ করে বেঞ্চ জানায়, আইনে কোথাও জমি বা তার নিচের প্রাকৃতিক সম্পদে রাষ্ট্রের অধিকারের কথা বলা হয়নি। কোর্ট এই যুক্তি মানেনি যে, মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশনস) অ্যাক্টের ৪২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী পারমিট, লাইসেন্স অথবা মাইনিং লিজ ছাড়া এই দেশে খনন করা যায় না, এবং তাই ব্যক্তিমালিক মাটির নিচের সম্পদের মালিকানার অধিকার দাবি করতে পারে না।
খনিজসমৃদ্ধ রাজ্য ওডিশা, ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডে খনি থেকে আয় স্থানীয় মানুষের কল্যাণে লাগেনি, মানুষ দারিদ্র্যে ডুবে রয়েছে। সরকার এবং কর্পোরেটরা উন্নয়নের মদমত্ততায় আদিবাসীদের বিধিবদ্ধ অধিকার এবং সংবিধানের সুরক্ষা আকছার ভাঙছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াইয়ের সামর্থ্য আদিবাসীদের নেই। ব্যাপক শোষণ এবং আর্থিক বঞ্চনা আদিবাসীদের মধ্যে মাওবাদীর বা জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে।
ক্রোমাইট খননের মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা মণিপুরের অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটানোর পথ নয়। খনন উপলক্ষে জমিতে তাদের অধিকার এবং টেকসই উন্নয়নের কথা উঠে আসা দরকার।
স্বাস্থ্যের ক্ষতি
ক্রোমিয়ামের দূষণে কতটা বিপদ হতে পারে তা প্রথম জানা যায় ষাটের দশকে ক্যালিফোর্নিয়ার হিঙ্কলে শহরে ক্রোমাইট গলানোর (স্মেলটিং) দূষণ থেকে— চামরায় র্যাশ ওঠা, ঘা, শ্বাসের সমস্যা, ফু্সফুসের ক্যান্সার, শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি, জেনেটিক বদল সবই হতে পারে। ক্রোমাইট খননের জন্য পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের কী ক্ষতি হয় তা নিয়ে ভিয়েতনাম, জিম্বাবোয়ে, চিন এবং পাকিস্তানে সমীক্ষা-গবেষণা হয়েছে— সেই দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে ফ্র্যাঙ্কি ভারা। এই ভারী ধাতু খনির আশপাশের জমি, গাছপালা এবং জলকে ভয়ানক দূষিত করেছে। খনি থেকে পাওয়া আকরিক যেখানে গলানো (স্মেলটিং) হয় সেখানে ভয়ানক দূষক হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম বা ক্রোমিয়াম ৪ উৎপাদিত হয়। তা ক্রোমিয়ামের সবচেয়ে দূষণকারী রূপ।
ওডিশা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্রে ক্রোমাইট খননের জন্য ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ এবং স্বাস্থ্যের বিপদের কথা নানা সমীক্ষা থেকে জানা গেছে। ওডিশার সুকিন্দাতেই সবচেয়ে ব্যাপক ভাবে ক্রোমাইট খনন করা হয়েছে। সুকিন্দা উপত্যকা পৃথিবীর ৩০টি সবচেয়ে দূষিত স্থানের প্রথম দশটির মধ্যে রয়েছে। খননের দূষণ থেকে বহু মানুষ ফুসফুস, সাইনাস, নাকসংক্রান্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। সুকিন্দায় খোলামুখ খনন হত। বেশিরভাগ খনিই ছিল দামাশালা নালার উপরের অববাহিকায়। খনি থেকে জলের মাধ্যমে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতু চুইয়ে আসত নালায়। ১৯৯৫ সালে ওডিশা ভলান্টারি হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের (ওভিএইচএ) সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, খনি অঞ্চলের ৮৫ শতাংশ এবং কাছাকাছি গ্রামে ৮৬ শতাংশ অসুস্থতা এবং মৃত্যু হয়েছে ওই খনির দূষণের জন্য। জানা যায়, খনি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে যে-সব গ্রাম রয়েছে সেখানকার মানুষই সবচেয়ে প্রভাবিত এবং ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ দূষণ সংক্রান্ত অসুখে ভুগছে। সুকিন্দায় যে কোম্পানি দূষণে অভিযুক্ত সেই বালাসোর অ্যালয়স লিমিটেডই মণিপুরে ক্রোমাইট খননের জন্য মৌ সাক্ষর করেছে।
মণিপুরের খোলামুখ খনিতে অরণ্য উচ্ছেদ হবে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, জীবজন্তু বাসস্থান হারাবে, মাটির চরিত্র ধ্বংস হবে। জল, জমি ও বাতাস দূষিত হবে, আদিবাসীরা ভিটেমাটি হারাবে। খনির উপরের দিকের পাথর তুলে এনে জমিতে ফেলার জন্য জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হবে। সেখানকার মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যে সম্পদের উপর নির্ভরশীল খননের ফলে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বেশিরভাগ ক্রোমাইট রয়েছে পাহাড়ের তির্যক শিরার নিচে, যেখান দিয়ে অসংখ্য ছোট নদী বয়ে যায়, যা মানুষের খাবার জলের উৎস। সেই অঞ্চলে বৃষ্টি হয় বেশি, তাই ক্রোমাইট আকরিক ধোয়া জল থেকে জমিতে দূষণ হবে বেশি। সেই জলে দুটি নদী দূষিত হবে— যার জল আশপাশের গ্রামে ধানচাষে ব্যাবহার করা হয়। একইভাবে উখরুল জেলার মাকলাং, তুউং, ছাম্মু নদী দূষিত হয়ে নিচের গ্রামের মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
আদিবাসীদের প্রতিবাদ
বর্তমানে পরিত্যক্ত ফাংগ্রেই অঞ্চলে খননের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তীব্র প্রতিবাদ হয়। কামজং জেলার শিংছা গ্রামের বাসিন্দারা জরুরি মিটিং ডেকে পরিকল্পিত ক্রোমাইট খননের কাজের বিরোধিতা করবে বলে ঠিক করে। একইভাবে পরের মাসের প্রথমদিকে তেংনৌপাল জেলার রিলরাম এরিয়া মেরিং অর্গানাইজেশন সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করে যে ব্যাপক ক্রোমাইট খননের ক্ষেত্রে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ তারা মানবে না।
কিছুদিন পর মোলনোই অঞ্চলের গ্রাম প্রধানরা টেংনৌপাল জেলার ছাত্রছাত্রী এবং নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে, যদি জমি ও সম্পদের উপর মানুষের অধিকার না মানা হয় এবং তাদের অনুমতি না নেওয়া হয় তাহলে মণিপুরে খনিজ খননের বিরোধিতা করা হবে। নো অব্জেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) থাকলেও কোনও এজেন্সি বা কোম্পানিকে ক্রোমাইটের খনন করতে দেওয়া হবে না। এরপর ২৭ নভেম্বর টাংখুল নাগা লং (টিএনএল) শারীরিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উদ্বেগের কথা জানিয়ে উখরুল ও কামজং জেলায় খনন বন্ধ করতে বলে।
সংবিধানে বলা হয়েছে জনজাতিদের জমি ও অরণ্যকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। ২০০৬ সালের ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় জনজাতি ও বনে বসবাসকারী সমাজকে মুখ্য ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শিডিউলে সংযোজন করা হয়েছে যে শিল্পমালিক বা আদিবাসী নয় এমন কাউকে জমি দেওয়া যাবে না। পরবর্তীকালে কেন্দ্র ও মণিপুর সরকার আইনের সংশোধন এনে সংবিধানের এই বিধান ও ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টের অবমূল্যায়ন করে, যেন খননের, পরিকাঠামো ও শিল্পের কাজে অরণ্য ধ্বংস করে আদিবাসীদের হঠিয়ে শিল্পকে জমি দেওয়া যায়।
পাম তেল চাষ
সরকার আয়োজিত অয়েল পাম চাষের প্রচার ও উৎসাহের জন্য এক সেমিনারে ওই চাষ যে কত লাভজনক বোঝাতে ২০২২ সালের জুন মাসে ইম্ফলে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সভা হয়। বীরেন সিং বলেন, ভারত সবচেয়ে বেশি খাবার তেল আমদানি করে। তিনি বলেন, চিহ্নিত জমিতে অয়েল পাম গাছ লাগানো হবে, যা থেকে তেল তৈরি করা হবে। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমাদের আর তেল আমদানির প্রয়োজন হবে না। এরই মধ্যে অনেক জমিতে গাছ লাগানো হয়ে গেছে।
অয়েল পাম মিশনের উপদেষ্টা এম এস খাইদেম এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, কেন্দ্র এই উদ্যোগে সম্মতি জানিয়ে পাঁচ বছরের বাজেট ধরেছে ১১,০০০ কোটি টাকা। যার ৮০ শতাংশ দেবে কেন্দ্র, বাকিটা দেবে রাজ্য। ছটি জেলার ৬৬,৬৫২ হেক্টর জমিতে ওই গাছ লাগানো হবে। ইম্ফল পশ্চিমে ১৪,৫১৬ হেক্টর, থৌবলে ১৮,৪৭৫, বিষ্ণুপুরে ১০,৩৮৯, চূড়াচাঁদপুরে ১১,৬৬২, চ্যান্ডেলে ৬,৮০৩ এবং উখরুলে ৪৮০৮ হেক্টর। এছাড়া স্টেট লেভেল স্ট্যান্ডিং কমিটি জিরিবাম জেলায় আরও ৭,৭১৫ হেক্টর জমি চিহ্নিত করেছে যেখানে ওই গোত্রের এবং নারকেল গাছের চাষ হবে। মণিপুর হবে দেশের পাম অয়েল উৎপাদনকারী বাইশতম রাজ্য।
অয়েল পাম চাষে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ লিটার জল লাগে। তাই জমির উৎপাদনশীলতার পক্ষে এই খুবই চাষ ক্ষতিকর। দুটো গাছের মধ্যে ব্যাবধান অন্তত ৩০ ফুট হওয়া চাই। ৩০ ফুট ফাঁকা জায়গায় অন্য কোনও চাষ হবে না। এই গাছ অন্য গাছপালা বেড়ে ওঠার পক্ষে বাধা। সারা পৃথিবীতেই এই নিয়ে সমীক্ষায় দেখা গেছে মাটি পুষ্টি হারিয়ে জমি অনুর্বর হয়, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ ধ্বংস হয়। তাই এ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে বাণিজ্যিক অয়েল পাম চাষের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য ২০০৪ সালে ‘রাউন্ড টেবল অন সাস্টেনেবল পাম অয়েল’ (আরএসপিও) নামে আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি হয়েছে।
এরপর প্রশ্ন ওঠে, কে এই পাম তেল উৎপাদন করবে? অভাবী স্থানীয় আদিবাসীরা নিশ্চয়ই না। আসবে রুচি সোয় ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড (পতঞ্জলি গ্রুপ), গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড ইত্যাদি কোম্পানিরা। ওদিকে মন্ত্রী, ঠিকাদার, আমলা ও সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী চাষে লাভের ভাগ নেবে।
১৯৮০ সালের ফরেস্ট কনজার্ভেশন অ্যাক্ট (এফসিএ) সংশোধন করে ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ ফরেস্ট কনজার্ভেশন বিল আনা হয়েছিল। সংশোধনের মাধ্যমে বিলটি বনের জমিকে অ-বনজ ব্যবহারের জন্য বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। এখন আন্তর্জাতিক বর্ডার থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অরণ্য ধ্বংস করে বেসরকারিভাবে পরিকাঠামো বা কারখানা গড়ে তোলা, অয়েল পাম চাষ বা তেল উৎপাদনে বাধা নেই। উত্তরপূর্বের প্রায় কোনও জায়গাই আন্তর্জাতিক বর্ডার থেকে ১০০ কিলোমিটারের বাইরে নয়। তা থেকে বোঝা যায় আরও বেশি বেশি করে বেসরকারি কর্পোরেশন বনের জমিতে লাভ হবে এমন পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে চলেছে। তাতে বাস্তুতন্ত্র এবং আদিবাসীরা বিপন্ন হয় হোক। গরিব মানুষ ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে সরকারের চোখ শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অর্থ এবং ক্ষমতার দিকে।
এই বিষয়ে ২০০৪ থেকে মিজোরামের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। ওই রাজ্যে ২৯,০০০ হেক্টর জমিতে অয়েল পাম চাষ হয়। জমি উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে, ব্যাপকভাবে অরণ্য বিনাশ হয়েছে। ওই চাষের ক্ষেত্রে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ফলের প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজন। তার জন্য তেলকলে যাওয়ার রাস্তা থাকা দরকার, অথচ সেই পরিকাঠামো নেই, ওই ফল মাটিতে পড়েই নষ্ট হয়। চাষিরা বেকায়দায় পড়েছে, তাদের রোজগার নেই, আবার অয়েল পামের বদলে যে অন্য চাষ করবে তার উপায়ও নেই, মাটি নষ্ট হয়ে গেছে। চাষিরা আরও দরিদ্র হয়েছে। মিজোরামে যে তিনটি কোম্পানি এই চাষে জড়িত— গোদরেজ, থ্রি এফ এবং পতঞ্জলির রুচি সোয়— এই চিরস্থায়ী ক্ষতির জন্য তাদের কোনও দায় নেই। চাষিরা আরও দরিদ্র হয়েছে।
ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যে ম্যাপ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় উত্তর-পূর্বের ৯০ শতাংশ জমিই পাহাড়ি অঞ্চল, যা এই চাষের অযোগ্য। আগেই বলেছি অয়েল পাম চাষে প্রচুর জল লাগে। অথচ সেখানে বৃষ্টি হয় বছরে চার মাস, বাকি সময় জলের অভাব থাকে। ওই চাষে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সে কারণেও জমির উর্বরতা কমে।
ওই একফসলি চাষ সরকারিভাবে সমতল বা পাহাড়ের পাদদেশে করতে বলা হয়। অথচ মিজোরামের পাহাড়ে, ডাম্পা টাইগার রিজার্ভের কাছেও পাম এবং সুপারি বাদাম গাছ লাগানো হয়েছে। তাই মাটির নিচের জল নেমে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রাকৃতিক অরণ্যে, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে। ঝুম চাষের জমি এখন পরিত্যক্ত। পরিবেশ এবং স্থানীয় মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা চিন্তার কথা।
চাষিরা অয়েল পাম চাষের মতো একফসলি চাষের ঝুঁকি এবং ফল সম্বন্ধে জানে না। সরকার ও বেসরকারি কোম্পানিরা আর্থিক লাভের কথা বললেও জমির উর্বরতা খোয়ানো, পরিবেশে প্রভাব, শ্রমের খরচ, রাসায়নিকের ব্যবহার এবং মাটির নিচের জলস্তর নেমে যাওয়ার কথা বলে না।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্র ‘ন্যাশনাল মিশন অন এডিবল অয়েলস— অয়েল পাম’ চালু করে। ঠিক হয় ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে দেশের ১০ লাখ হেক্টর এবং ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে ১৬.৭ লাখ হেক্টর জমিতে অয়েল পাম লাগানো হবে। আরও ঠিক হয় চাষের জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হবে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং আন্দামান-নিকোবরে— যার মোট এলাকা ত্রিপুরা রাজ্যের সমান। মনে রাখা দরকার ওই অঞ্চলগুলোতে তিনটি গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট রয়েছে। ওইসব অঞ্চলেই সবচেয়ে ঘন বন রয়েছে যেখানে থাকে নানা বিপন্ন প্রাণী ও ওষধি গাছপালা। বেশিরভাগ পাম অয়েলের চাষ হচ্ছে ধানচাষের জমিতে।
এরই মধ্যে গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট অসম, মণিপুর ও ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে অয়েল পাম চাষের উন্নয়ন এবং ওই চাষ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী মৌ স্বাক্ষর করে। অসম এবং অরুণাচলে চাষ শুরু হয়েছে।
মণিপুরে তেল উত্তোলন, চুনাপাথর কি ক্রোমাইট খনন এবং অয়েল পাম চাষ— সবই হবে মূলত কুকি-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে। কুকিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বীরেনের চক্ষুশূল। নাগারাও এসবের বিরোধী, তবে তারা কুকিদের চেয়ে সংখ্যায় বড় এবং তাদের জন্য নাগাল্যান্ড কথা বলবে। কুকিদের জন্য বলার কেউ নেই। মনে হয় তাই কুকিরাই টার্গেট। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারের ফলে জনমনেও তাদের সম্বন্ধে নিচু ধারণা তৈরি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপত্তিতে মেইতেইদের পাহাড়ে জমি কেনা বন্ধ হলেও কুকিদের কোনঠাসা করতেই হবে। কারণ তাহলেই তেল, খনিজ তোলা এবং অয়েল পাম চাষের পথ সুগম হবে। বীরেন এবং তাঁর দলের মাথায় এসব নিশ্চয়ই ঘুরছে। এই পরিস্থিতিতে চার মাস ধরে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথা না-বলাটাও অনেক কিছু বলা। তিনি ইস্ট অ্যাক্ট পলিসির অশুভ প্রকল্প ছাঁটাই করবেন না। তাই কুকিদের কাছে লড়াই ছাড়া পথ নেই।
কুকিদের সঙ্গে মেইতেইদের সখ্যতা এখন দূর অস্ত, মণিপুরে শান্তিও তাই। শাসক দল যে খেলায় দড় তাই খেলেছে, ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার, মানুষে মানুষে শত্রুতার চাষ, পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা। মণিপুরের জনগণ তো খেলার পুতুল, তাদের হায় হায় করা ছাড়া উপায় কী! এতদিন হত্যা করেছে কুকি বলে, এখন জঙ্গি নাম দিয়ে। ৬৭ হাজার শরণার্থীর মধ্যে সিংহভাগই কুকি। ওদিকে যেহেতু ইম্ফলেই রয়েছে সবকিছু তাই কুকি ছাত্রছাত্রী, যুবকযুবতীদের পড়াশোনা, চাকরি করা, চাকরি খোঁজা, চিকিৎসা, ব্যাবসাবাণিজ্য— সবেতেই অচল অবস্থা। বেশিরভাগ জায়গায় ইন্টারনেট চালু হয়নি, যেখানে হয়েছে কাজ হয় না, তার গতি কম। এখন তাদের ভাতে মারার চেষ্টাও হয়তো চলবে।
সরকার বুঝেছে জেতার রাস্তা সহজ নয়, কুকিদের বশ মানানো কঠিন। তারা পাহাড়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের বাঁচামরা জড়িত। একমাত্র আলোচনাতেই রয়েছে সমাধান। তবে মুক্ত মনে তাই যদি করে তাহলে আবার সরকারি দলের নাম বদলে রাখতে হয়। তাই চার মাস ধরে প্রিয়জন হারিয়ে, নিঃস্ব হয়ে অসীম দুঃখ-বেদনায় কাটলেও সামনে রয়েছে আরও দুঃখের দিন। তবে মেইতেইরাও সুখে নেই। কারণ, সবাই তো আর কুকিবিদ্বেষী বা চক্রান্তকারী নয়। তাছাড়া পাহাড়ে ছিল এমন অনেক গরিব মেইতেই পরিবারও কুকি হানায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে। ওদিকে কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীর ভূমিকার অজুহাতে সরকার কুকিদের উপর দমনপীড়ণ চালাতে চাইবে। ওই গোষ্ঠীদের নিরস্ত্র করা সাধারণ মানুষের সাধ্য নয়।
পাঁচ মাস হতে চলল, ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মণিপুর কেন্দ্রিক কাজকর্ম স্তব্ধ, প্রধানমন্ত্রী মৌনী বাবা সেজে রয়েছেন। দেশের দুর্ভাগ্য।
সূত্র নির্দেশ
- ভট্টশালী, অমিতাভ। ভারতের মণিপুরে সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৪। বিবিসি নিউজ বাংলা। ৬ মে, ২০২৩।
- Varah, Franky. Mining Without Consent: Chromite Mining in Manipur. Economic & Political Weekly, Vol.49, Issue No. 25. 21 June, 2014.
- Manipur Assembly Elections 2022: Amit Shah vows to end Kuki militancy problem in five years; a look at who they are and their demands. First Post, February 24, 2022.
- Kamei, Richard & Wijunamai, Roderick. In Manipur, electoral dynamics are often disconnected from party ideology and popular concerns. Scroll.in. Mar 22, 2022
- Zaman, Rokibuz. Why Manipur’s tribes are alarmed by court push for Scheduled Tribe status for the Meitei community. Scroll.in. April 24, 2023.
- Sadokpam, Dhiren A. Unfettered by dissent or the face-off with Kuki bodies, Manipur CM has his way. The Wire. May 2, 2023.
- Pisharoty, Sangeeta Barooah. Seven reasons why the violence in Manipur cannot be considered a sudden occurrence. The Wire. May 5, 2023.
- Kulkarni, Pranita. BJP-led Govt’s Mishandling of Manipur Situation is to Blame for Deaths, Displacement: K Santa. Newsclick. May 6, 2023.
- Naqvi, Zaheena. Manipur Violence: Understanding various aspects of the Conflict. The Indian Wire. May 7, 2023.
- Manipur Needs Politics That Unites: Nandita Haksar. Newsclick. May 12, 2023
- Rokibuz Zaman, What the mobs left behind in Manipur’s hills – burnt homes, looted shops and thousands of displaced. Scroll.in. May 8, 2023.
- Thete, Rujuta. Fact-Check: This image doesn’t show a nurse ‘raped & murdered’ in Manipur. The Quint. May 10, 2023.
- Haksar, Nandita. To heal Manipur’s wounds, all groups must agree to replace identity politics with politics of peace. Scroll.in. May 10, 2023.
- Lahiri, Ishadrita. ‘Organisations on lines of RSS, Bajrang Dal have been formed in Manipur,’ says Congress. The Print, May 11, 2023.
- Manipur: All 10 Kuki MLAs, civil society groups decide against dialogue with Biren Singh government. Scroll.in. May 18, 2023.
- Chongloi, Lien. Dispelling some misleading claims about the violence in Manipur. The Wire. May 27, 2023.
- Singh, Vijaita & Karmakar, Rahul. Union Home Minister Amit Shah’ visit to Manipur to plan for peace measures. The Hindu. May 29, 2023.
- Talukdar, Sandipan. Manipur: CM’s version of killing kuki ‘Millitants’ may not be final Truth, says locals. Newsclick. May 30, 2023.
- Tiwary, Deeptiman. Home Minister Amit Shah in Manipur, to review security, hold talks with kukis, Meiteis. Indian Express. May 30, 2023.
- Leivon, Jimmy & Baruah, Sukrita. Give-and-take as Amit Shah meets Kuki groups in Manipur. Indian Express, May 30, 2023
- Situation in Manipur has got nothing to do with counter-insurgency: CDS gen Anil Chauhan. The Economic Times. May 30, 2023.
- Lakshman, Abhinay. Probe role of CM, Rajya Sabha MP in fuelling violence: Manipur tribal body. The Hindu. May 31, 2023.
- Matharu, Sonal. IDs checked, skull cracked, ‘dumped alive’ in mortuary — 3 Kuki survivors recount Manipur mob horror. The Print. June 1, 2023.
- Bhaumik, Subir. Task cut out. The Telegraph. June 1, 2023.
- Sharma, G. Amarjit. Manipur violence shows death of civil society. One ethnic group’s autonomy isn’t the solution. The Print. June 2, 2023.
- Tonsing, Suanmuanlian & Hangsing, Sangmuan. After Amit Shah’s visit to Manipur: What do 15 days of peace mean for the Zomi-Kuki? Indian Express. June 3, 2023.
- Anirudh, S. K. Why Manipur shouldn’t surprise us: A roundup of civil violence cases since 2014. The Wire. June 5, 2023.
- Submitted license gun used by Arambai Tenggol, says ITLF; condemns incessant attacks on Kuki-Zo villages. The Hills Journal. June 5, 2023.
- Saikia, Arunabh. Armed gangs and a partisan state: How Manipur slipped into civil war. Scroll.in, June 6, 2023.
- Roy, Esha. I worship the CM… bigger blow to come: chief of Meitei outfit at centre of Manipur clashes. The Indian Express. June 7, 2023.
- Purohit, Devadeep. Manipur violence: Seven-year-old boy, mother, relative burnt alive in ambulance. The Telegraph. June 7, 2023.
- Editor. Tribal leaders say Meitei leepun accused of attack on Kukis. Voice of 7 Sisters. June 8, 2023.
- Thete, Rujuta. Video from Myanmar falsely shared as ‘kuki terrorist’ using drones in Manipur. The Quint. June 12, 2023.
- Saikia, Arunabh. Why Manipur’s civil war is being linked to the narcotics trade. Scroll.in. June 13, 2023.
- Singh, Manvendra. Manipur is burning because of North Block’s legendary ignorance of the Northeast. The Print. June 15, 2023.
- Basak, Saptarshi. Manipur: Kuki family of BJP MLA’s driver, murdered by mob, longs to bury remains. The Quint. June 15, 2023.
- Manipur Law & Order Has ‘Totally Failed’: Union Minister Whose Home Was Attacked. The Quint. June 16, 2023.
- Manipur: After mob torches his home, Union minister flags ‘total failure’ of law and order. Scroll.in. June 16, 2023.
- Manipur is burning due to BJP’s divisive politics, allege over 500 civil society members and groups. Scroll.in. June 16, 2023.
- Matharu, Sonal. More than 6 weeks on, Manipur is still ablaze. It’s a saga of failures, from state govt to Centre. The Print. June 17, 2023.
- Manipur: Mobs attempt to torch homes of BJP leaders, loot police armoury. Scroll.in. June 17, 2023.
- Manipur violence: Meitei protesters boycott PM Modi’s Mann ki Baat, break radio sets. Scroll.in. June 18, 2023.
- Daniyal, Shoaib. From mob violence to Manipur: The past decade has weakened the Indian state. Scroll.in. June 19, 2023.
- Manipur chief minister asks Mizoram to protect Meiteis. Scroll.in. June 19, 2023.
- Haksar, Nandita. World is family: From Manipur to Myanmar, the escalating refugee crisis is a wake-up call for India. Scroll.in. June 20, 2023.
- Fernandes, Walter. A land in trouble. The Telegraph. June 25, 2023.
- Monga, Aastha. Manipur crisis: Indian Army says women protesters interfering in operations, releases video evidence. Financial Express. June 27, 2023.
- Monga, Aastha. Mizoram seeks urgent financial assistance as over 12,000 displaced individuals cross over from Manipur. Financial Express, June 29, 2023.
- Manipur: Amid ‘will he, won’t he’, Biren Singh says he’s not quitting CM’s post. Newsclick. June 30, 2023.
- Manipur violence genocide, another version of Gujarat riots: Kerala bishop Joseph Pamplany. Times of India. June 30, 2023.
- Talukdar, Sushanta. Mayhem in Manipur: The State Burns While the Centre Looks Away. Frontline. July 2, 2023.
- Hausing, Kham Khan Suan. Manipur CM Resignation Reversal: Trying to kill three birds with one stone. The Quint. July 3, 2023.
- Singh, Pragya. People say Arambai Tenggol and Meitei Leepun are RSS Creations: Kim Gangte. Newsclick. July 5, 2023.
- Puniyani, Ram. How Does World See Indian Democracy and Nationalism? Newsclick. July 16, 2023.
- Sen, Jahnavi & Sarkar Soumashree. Narendra Modi Talked About the Manipur Violence. But Did He Really? The Wire. July 20, 2023.
- Manipur Video: CM Biren Says ‘100s of Similar Cases’ Happened; SC Takes Cognisance. The Wire. July 20, 2023.
- Singh, Vijaita. Assam Rifles files sedition case against Imphal civil society group. The Hindu. July 21, 2023.
- Yumnam, Jiten. Nuances of mining plan in Manipur. The Sangai Express. 5 Aug, 2020.
- Yumnam, Jiten. Mining MoUs & Concerns in Manipur. Imphal Free Press. 14 July, 2020.
- Themson, Jajo. Mining and fraudulent clearances in Manipur. E-PAO. Aug 23, 2021.
- CJP Research Team. Behind the violence, strip-mining hills and forests for minerals: Manipur. Sabrang. August 1, 2023.
- CJP Research Team. Behind the violence, grabbing Hill lands for palm oil manufacture: Manipur. Sabrang. July 25, 2023.
- CRA Manipur calls for advancement of indigenous people’s rights. Imphal Free Press. August 9, 2023.
- CRA raises apprehension over oil exploration and survey work done in Manipur. Northeast Today. June 11, 2020.
- Haokip, Paolienlal. Manipur violence could not be contained because of complicity of Biren Singh government. India Today. July 22, 2023.
- Manipur plans to airlift Meiteis from Mizoram after caution from ex-militant group, India Today, July 23, 2023
- Bhosale, Jayashree. Oil palm cultivation: Godrej Agrovet signs MoUs with Assam, Manipur and Tripura. The Economic Times. August 23, 2022.
- Chinai, Rupa. Oil palm plantations prove to be a disaster in Mizoram. Frontline. June 2, 2023.
- The launch of Oil Palm Project, Manipur. Mygov. 26 Nov, 2020.
- The Forest (Conservation) Amendment Bill, 2023. PRS.
- Oil exploration in Manipur, India. Atlas.
- Saikia, Arunabh. Who owns Manipur’s natural resources? News of oil exploration revives old debate in the state, Scroll.in. Sep 20, 2017.
- Singh, Atom Samarendra. Residents of Manipur Village Oppose Oil Exploration, Reject NOCs Obtained through Bribe. Land Conflict Watch. May 21, 2017.
- Piang, L. Lam Khan. Meiteis have not been ‘denied’ ST status. Exclusion was their own choice. The Wire. May 26, 2023.
- Biswal, Bijaya. Tribal villagers in Odissa’s Sukinda eat chromite dust; govt builds stadiums and playgrounds with musical fountains using mining funds. Gaon Connection. July 19, 2021.
- Padhi, Ranjana & Mohanto, Lambodar. Chromite mining in Sukinda valley in Odisha. Countercurrents. Apr 1, 2019.
- Nagaland tribal body makes oil exploration conditional. The Hindu. May 2, 2023.
- Singh, Bikash. Oil India Limited (OIL) is hopeful of starting exploration in Nagaland. The Economic Times. Aug 19, 2023.
- Thokchom, Khelen. 7 firms to start mining in Manipur. The Telegraph. 21 Feb, 2018.
[1] অস্পৃশ্য এবং প্রথাগত ধর্ম মেনে চলে
[2] পরে অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় হাইকোর্টের ওই নির্দেশকে ‘কমপ্লিটলি ফ্যাকচুয়ালি রং’ বলে জানান। কারণ ওই রায়ের ক্ষেত্রে এসটি লিস্টে নাম তোলার যে পদ্ধতি সংবিধানে খুব পরিষ্কারভাবে বলা আছে তা মানা হয়নি।
[3] এরা অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।
[4] সমতলে থাকা সম্প্রদায়, এরা ইসলাম অনুসরণ করে।
[5] উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় ওই দুই জেলার নিচু পাহাড়ে বনাঞ্চল ৮১.৭৪ শতাংশ।