তানিয়া লস্কর
অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি সমূহ অর্থাৎ অবিসি জাতিভুক্ত মহিলা এবং মুসলিম মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের কোনও ব্যবস্থা এই বিলের মাধ্যমে করা হয়নি। তাছাড়া বিলটি বলবৎ করার কোনও নির্ধারিত তারিখও ধার্য করা হয়নি। এবস্থায় বিলটি দন্তবিহীন সর্পের মতো। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে পুরুষদের অলিখিত যে সংরক্ষণ দেওয়া আছে সেটাকে উৎখাত করে সাম্যের প্রবর্তন এই পথে কতটা সম্ভব- সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
রাজনীতিতে মহিলাদের সংরক্ষণ দেওয়া ভারতীয় গণরাজ্যের বহু পুরনো একটি প্রতিশ্রুতি। সেই ১৯৭১ সনে মহিলাদের অবস্থান সম্পর্কিত একটি কমিটি এই সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে বয়ে গেছে বহু কিউবিক লিটার জল। ১৯৯২ সনে এক ধাপ এগোনো হয়েছিল ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠানে ৩৩% সিট মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করে। কিন্তু সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল ২০০৮ থেকে বিচারাধীন রয়েছে। শেষমেশ গত ২০ শে সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এই পাশ হয়ে গেল। ৪৫৬ টি ভোটের মধ্যে ৪৫৪ টি ভোট পক্ষে পড়েছে। এরপর বিজেপির সব মহিলা মন্ত্রী আর গোদি-মেডিয়া যেভাবে ফুটেজ নিতে শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে যেন নারীর অধিকার বা সাধারণভাবে মানবাধিকারের বিকাশে বিশেষ মাইলফলক ছোঁয়া গেছে। কিন্তু সত্যি কি তাই? নাকি বিজেপির অন্যান্য পদক্ষেপগুলোর মতোই খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হচ্ছে সেটা বিলটিকে একবার ভালো করে পড়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এই বিল অনুযায়ী সবকটি রাজ্য বিধানসভাসহ দিল্লি বিধানসভা ও সংসদে মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং অনুসূচিত জাতি-জনজাতিকে যে সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে তার এক তৃতীয়াংশ অনুসূচিত জাতি-জনজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ বর্তমানে লোকসভায় মোট ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে ১৮১ টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং অনুসূচিত জাতির জন্য সংরক্ষিত ৮৪ আসনের ২৮ টি তথা অনুসূচিত জনজাতিসমূহের ৪৭ টি আসনের ১৬ টি সেইসকল জাতি-জনজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অবশ্য, বলে রাখা দরকার এই বিলটি আগামী ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পরই কার্যকরী হবে। ডিলিমিটেশন শেষ হতে অন্ততপক্ষে ২০২৯ সাল পর্যন্ত গড়াবে বলে গবেষকদের ধারণা। প্রতিটি ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার পরে আসনগুলো আবর্তিত হতে থাকবে। এবং সংরক্ষণ চালু হলে তা ১৫ বছর পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই চর্চা হচ্ছিল সেটি হল অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিসমূহ অর্থাৎ ওবিসি জাতিভুক্ত মহিলা এবং মুসলিম মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের কোনও ব্যবস্থা এই বিলের মাধ্যমে করা হয়নি। তাছাড়া বিলটি বলবৎ করার কোনও নির্ধারিত তারিখও ধার্য করা হয়নি। এ-অবস্থায় বিলটি দন্তবিহীন সর্পের মতো। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে পুরুষদের অলিখিত যে সংরক্ষণ দেওয়া আছে সেটাকে উৎখাত করে সাম্যের প্রবর্তন এই পথে কতটা সম্ভব– সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
আইন তথা রাজনীতি বিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘political will’ বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যেকোনও আইন বা পরিকল্পনার সফল হওয়ার ক্ষেত্রে এই সদিচ্ছার খুবই প্রয়োজন। বিজেপির মতো ডানপন্থী দল এই সদিচ্ছা দেখাতে কতটা সক্ষম, অন্যান্য দলগুলোই বা কতটা এগিয়ে আসবে সেটাও দেখতে হবে। বিলটির সপক্ষে বলতে গিয়ে অনেকেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীদের বিশেষ জায়গার কথা তুলেন। বিজেপির দলীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই কথাটি আপাতভাবে খুবই মধুর শোনালেও একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে ভারতীয় সংস্কৃতির উপচারিকতায় মহিলাদের ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। আমাদের সব সামাজিক অনুষ্ঠানেই মহিলাদের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের উপর এর কোনও প্রভাব পড়তে দেখা যায় না। না হলে দেশের স্বাধীনতার সত্তর বছর পরও দেশের সংসদে মাত্র ১৪%ই মহিলা সাংসদ রয়েছেন। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মনে হয় সংসদের প্রথম বিল হিসেবে নারী শক্তি অধিনয়ম নাম দিয়ে একটি দাঁতনখহীন বিল পাশ করাটা নেহাতই এক ডানপন্থী আনুষ্ঠানিকতা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-এর ভাষায় কথা বললে আরেকটি জুমলা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বর্তমান সময়ে নারীবাদের ধারণা অনেকটা এগিয়ে গেছে এবং আরও বেশি ব্যাপক হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে সমাজকর্মী গ্রেস বাণু ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার জন্য সমান্তরাল সংরক্ষণের দাবিতে লড়ছেন বহুবছর থেকেই। তাদের আন্দোলনের ফলে তামিলনাড়ুতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ১% আসন ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংরক্ষণের আলোচনায় কোনও দলই সেদিন উৎসাহ দেখায়নি। রাজনৈতিকভাবে নারীদের ক্ষমতায়ণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল intersectionality বা আন্ত:বিভাগীয়তা। সেই পরিপ্রেক্ষিতেও ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা না করে, ট্রান্সজেন্ডারদের দাবির বিষয়ে কর্ণপাত না করে শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য নারীদের অধিকারের ঝান্ডা ওড়ানো ও নারীদের রক্ষাকর্তা সাজা একধরনের ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতে মহিলাদের প্রায় ৭% মুসলিম মহিলা হলেও সংসদে মাত্র ০.৭% মুসলিম সাংসদ আছেন। তাদের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করার জন্যও ওবিসি সংরক্ষণ জরুরি। এমতাবস্থায় এই বিল এবং একে ঘিরে বিজেপির ভোটের রাজনীতি দেখে একটি বাংলা প্রবাদবাক্য-ই মনে পড়ে যায় ‘গাজনের নাই ঠিকানা শুধু বলে ঢাক বাজা না’।