Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লেওন ফেলিপে

লেওন ফেলিপে | ছটি কবিতা | অনুবাদ: মহাশ্বেতা আচার্য

ছটি কবিতা

 


অনুবাদ: মহাশ্বেতা আচার্য

 

 

 

লেওন ফেলিপে (১৮৮৪-১৯৬৮) স্পেন তথা স্প্যানিশ ভাষায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মুখ্য কবি। চিরবিখ্যাত ’২৭-এর প্রজন্মের কবিদের দলটির প্রায়-সমসাময়িক কবি লেওন ফেলিপে ছিলেন বয়সের দিকে লোরকা বা দামাসো আলোন্সোর সমসাময়িকদের চেয়ে প্রায় দেড় দশক বড়। তবু লেওন ফেলিপেকে ’২৭-এর প্রজন্ম ও তাদের ভাবনার বিপ্লব, তাদের আভাঁ-গার্দ, আধুনিকতা, দক্ষিণপন্থা-বিরোধী মুক্তমনা কাব্যচর্চার ও তাদের জীবনপ্রবাহের অন্তর্গতই ধরা হয়। ঐশ্বরিক অথচ শাপভ্রষ্ট এই দলটি মাত্র এক দশকের মধ্যেই স্পেনের তীব্র গৃহযুদ্ধের আগুন ছুঁয়ে বেড়ে ওঠে। ১৯৩৫-এ ডিক্টেটর ফ্র্যাঙ্কোর অপশাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘জেদ করে’ স্পেনে থেকে যাওয়ায় লোরকাকে গুমখুন হতে হয়, মিগেল এরনান্দেজের মতন তরুণ কবিকে কিছু বছরের মধ্যে মরতে হয় জেলখানায়। অপরপক্ষে, এই সময়ের বেশিরভাগ কবি-শিল্পী ও মুক্তচিন্তককেই গা-ঢাকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয় প্রায় চিরকালের মতন। ফেলিপে প্রথমে স্পেনের গৃহযুদ্ধে সরাসরি লড়াই করেন ‘স্প্যানিশ রিপাব্লিকান আর্মির’ তরফে এবং শেষে দেশ ছেড়ে বরাবরের মতন মেক্সিকোয় প্রবাসে থেকে যেতে বাধ্য হন ১৯৩৮ সাল থেকে। তাঁর কবিতায় বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর নিজের ও তাঁদের প্রজন্মের এই ওঠাপড়া, এই দেশত্যাগ, প্রবাসজীবন, যন্ত্রণা, ভয় ও কান্না ধরা পড়ে। স্পেনের থাকাকালীন তাঁর কবিতায় যে পরীক্ষামূলক আধুনিকতা অথবা যে শব্দনির্ভর কাব্যিকতা দেখতে পাই, পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে ঘাত-প্রতিঘাতে। অন্তরঙ্গ ধার্মিকতার অনুষঙ্গে এবং বয়ানে আসতে থাকে সমাজকে আপন করে দেখা আর সেই সমাজকেই ছুঁড়ে ফেলার দোটানা। আসে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির হতাশা, আর ঘুরে-ফিরে আসে আগুন আর কান্না মোটিফের মতন। ‘ভেরসোসই ওরাসিওনেস দেল কামিনান্তে’ (১৯২০, ১৯২৯); ‘এস্পানিওল দেল এক্সোদো ই দেল ইয়ান্তো’ (১৯৩৯); ‘গানারাস লা লুজ’ (১৯৪৩); ‘পারাবোলা ই পোয়েসিয়া’ (১৯৪৪); ‘এল সিয়েরভো’ (১৯৫৮); ‘ওহ এস্তে ভিয়েখো ই রোতো ভিওলিন!’ (১৯৬৫)— সময়কাল ও দেশকাল ভেদে তাঁর কিছু কিছু কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এলে, তাঁর জীবন, বিশ্বাস ও ভাষার বিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

এখন নগর থেকে নগরে

জনপদ থেকে জনপদে এখন
জীবনের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াই,
তারপর এক দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায় যাই আকাশের ভেতর দিয়ে
দলছুট তারাটার মতন, ওই…
তারপর? … তারপর …
সেসব ওই তারাটা বলবে নিজেই,
আহ, গীতিময় সেই তারা
যে একান্ত আমার,
যে আকাশের মধ্যে দিয়ে ছোটে, ছুটে চলে আশ্রয়হীন
আমারই মতন, সারাটা জীবন।

(১৯২০, ভেরসোস ই ওরাসিওনেস দেল কামিনান্তে)

 

এ আমাদের কান্না

স্পেনের জনগণ:
এ কান্না আমাদের
আর এই ট্র্যাজেডিও আমাদেরই,
যেমন জল আর মেঘের গর্জন।
একটা নগর মরে গেছে,
কিন্তু এখনও মরে যায়নি মানুষটা।
এখনও কান্নাগুলো বেঁচে আছে বলে
মানুষটা এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে,
দাঁড়িয়ে রয়েছে যন্ত্রণা-গ্লানি কাঁধে নিয়ে
তার আদি, অকৃত্রিম আর চির-যন্ত্রণার এই ভার নিয়ে
তার অনন্ত সম্পদ নিয়ে,
পৃথিবীর জাগতিক রহস্য
দেবতাদের নৈঃশব্দ্য
আর আলোর রাজ্যপাট কিনে নিতে।
(পৃথিবীর সমস্ত আলো)
একটা অশ্রুবিন্দুর জানালা দিয়ে মানুষ একদিন
পৃথিবীর সমস্ত আলোকে দেখে ফেলবে।
হে স্পেনের জনতা,
হে এক্সোডাস আর অশ্রুর জনতা:
মাথা তোলো
ওভাবে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিও না—
ধ্বংস নয়, আমি যে আশার গান গাই

(১৯৩৯, এস্পানিওল দেল এক্সোদো ই দেল ইয়ান্তো)

 

খ্রিস্ট

তুমি এসেছিলে অশ্রুর জয়গান গাইতে…
মুছিয়ে দিতে নয়…
তুমি এসেছিলে ক্ষত-মুখ খুলে দিতে…
ঢেকে দিতে নয়।
তুমি এসেছিলে দাবানলে আগুন দিতে
নেভাতে নয়…
তুমি বলতে এসেছিলে:
কান্নাধারা বয়ে যেতে দাও,
রক্ত
আর আগুন…
যেন জল!

(১৯৩৯-১৯৪০; পোয়েমাস কোমপ্লেতাস)

 

আমি গান গাইতে আসিনি

আমি গান গাইতে আসিনি, তুমি গিটার নিয়ে যেতে পারো।
আমি আসিইনি আদৌ, আমি মরলে যাতে ওরা আমাকে সন্ত অভিষিক্ত করে,
নিজের সেসব হিসেবের কড়ি গুছিয়ে তুলতেও আমি আসিনি।

আমি সেই অশ্রুতে নিজের মুখ দেখে নিতে এসেছি, যে-সমস্ত চোখের জল সমুদ্রের দিকে হেঁটে যায়,
নদীর ধার ঘেঁষে যায়
মেঘের মধ্যে-মধ্যে দিয়ে যায়…
আর দেখতে এসেছি সেই অশ্রুতে, যা লুকিয়ে আছে
কুয়োর ভেতর, রাত্রির ভেতর,
আর রক্তের ভেতর…

আমি এসেছি পৃথিবীর সমস্ত কান্নার ভেতর আমার মুখ দেখতে
আর এসেছি, একটা ফোঁটা কান্নার পারদ ফেলে যেতে, মাত্র এক ফোঁটা,
আমার চোখের জলের একটা মাত্র ফোঁটা ফেলে রেখে যেতে
এই বিরাট চাঁদের আয়নার অন্তহীনতায়, যেখানে
আমার খুব কাছে এসে তাকিয়েছে যারা, তারা নিজেদের চিনে নিক।
আমি শুধু এক প্রাচীন কথন এই অন্ধকারে আবার শুনতে এসেছি:

তোমার রুজিরুটি তুমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জন করবে
আর তোমার চোখের যন্ত্রণায় লেগে থাকা আলো
তোমার চোখজোড়া কান্না আর আলোর উৎস।

(১৯৪৩, গানারাস লা লুজ)

 

নরক

নিজের নামে আমার আর কোনও দলিল-দস্তাবেজ নেই
শুধু এই ভুলে-গড়া ভুলে-পোড়া মাটি
যাকে নিয়ে কেউ গর্ব করবে না আর…
নাহ, মানুষ নয়, ঈশ্বর নয়… আর আমি নিজেও না।
অস্বীকারও করি না।
আর তাই, এই আধভাঙা কানা-ওঠা বাঁকা দেহ নিয়ে,
আলোর সামনে আসি না আর।
বরং আমি চাই আমায় তোমরা ফিরে যেতে দাও ওই আকার-আকৃতিহীন মাটির তালটায়,
ওই আদিম চাকায় ফিরে যেতে দাও,
আবার সেই হাতের মুঠোয় ঘষে-ঘষে ঘুষি খেতে থাকা,
আবার ওই চুল্লির ভেতর, অদৃশ্য কুম্ভকার।
নরকের গনগনে আগুন থেকে এভাবে
মৃত্যুদণ্ড শোনানোর মতন করে কেনই বা কথা বলো?
ধরো যদি এমনভাবেই সমস্তটা ঘটে
বীরত্ব আর গভীরতা মেশা এমন এক ইচ্ছের মতন
একটা নিশ্বাসের আর একটা আকারের বাসনা
যা এখনও খুঁজে পায়নি কেউ…
(যদি) তাদের আদরের যুগলশয্যা জ্বলে যায় আগুনেই?

(১৯৫৪, এল সিয়েরভো)

 

শব্দ

কিন্তু ওই কবিরা ওইখানে শব্দ নিয়ে কীসব বলে চলেছে?
মাপজোক করা সব আলোচনা:
আঁটোসাঁটো নাকি ঢিলেঢালা? …

আলখাল্লা হতেই পারে বা হয়তো জ্যাকেট…

শব্দ হল আস্ত একটা ইট, শুনছেন আমার কথা? … আপনি কি শুনেছেন আমার কথা, হে ধর্মাবতার?

একটা ইট। ইট, মিনার তৈরি করবার ইট… আর সে মিনার
উঁচু, উঁচু… ঊঁচু হতে হতে, অনেক উঁচু হতে থাকবে
যতক্ষণ না তার চেয়েও উঁচুতে ওঠার আর বাকি কিছু নেই।

যতক্ষণ না আমি তার
শেষ জানালার
শেষ কিনারায়
শেষ সূর্যের
চেয়ে আরও উঁচুতে না পৌঁছতে পারি।
ততক্ষণ ওই একটামাত্র ইট ছাড়া আর কিচ্ছু পড়ে নেই,

শেষ ইট… শেষ শব্দ,
যা ঈশ্বরের দিকে ছুড়ে দিতে হবে,
প্রার্থনা বা ‘ব্লাসফেমির’ তীব্রতায়…

তার কপালখানা ফাটিয়ে ফেলে… দেখতে হবে খুলির ভেতর
ভরে আছে আলো নাকি শূন্যতা

(১৯৫৮, এল সিয়েরভো)