অংশুমান দাশ
ডঃ রিচারিয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর গবেষণার কাগজ চুরি যায়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র ছাড়াই এদেশে বিদেশি ধান পরীক্ষা শুরু করে। টাকা ঢালে রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন। কালে কালে রিচারিয়ার ধানের সংগ্রহ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে চলে যায়। এ-সবই হতে থাকে সদ্যোপ্রয়াত ডঃ এমএস স্বামীনাথনের অঙ্গুলিহেলনে
তা ক্ষিদে ছিল না এমন নয়। যাদের হাতে জমি বেশি, উদ্বৃত্ত বেশি— তাদের খাবারের বাছবিচার ছিল, এখনও যেমন আছে। কিন্তু যাদের তা নেই— তাদের ক্ষিদে ছিল বৈকি। চাষ যবে থেকে শিখেছে, জঙ্গল হাসিল করে ধান গম ভুট্টা চাষ যবে থেকে ধরেছে— ক্ষিদের শুরুও সেদিন থেকে। যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে রাম শন্না! একদিকে সভ্যতার শুরু— অন্যদিকে সেই কৃষির হাত ধরেই ভরাডুবি। বুঝতে একটু সময় লেগেছে, এই যা। ততদিনে গোলায় ধান রাখা শুরু হয়েছে। বুঝেছে যার কাছে গোলা (ধানের গোলার কথা হচ্ছে, তা সে গোলাবারুদও হতে পারে হালের হিসেবে), যার কাছে জমি— তারই ক্ষিদে থাকবে না। তাই জমি দখল, সেই জমিতে অন্যকে খাটিয়ে ফসল উৎপাদন। ক্ষিদে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ। তুমি কাজ করো, আমি তোমাকে খেতে দেব। গ্রাম, গ্রাম থেকে রাষ্ট্র। নিয়ন্ত্রণ। দুর্ভিক্ষ।
কাট। জাম্প— অনেক হাজার বছর। ভারতবর্ষ।
একধরনের স্বনির্ভরতা গ্রামস্তরে। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের জন্য একটা নির্দিষ্ট চৌহদ্দির বাইরে কাউকে যেতে হচ্ছে না। যা প্রয়োজন তা ফলিয়ে নেওয়া হচ্ছে, বুনে নেওয়া হচ্ছে। কারিগরদের প্রয়োজনীয়তা এই সমাজে অনেক। কিন্তু এই কাঠামোকে না ভেঙে দিলে উদ্বৃত্ত কোথা থেকে আসবে? কী করে চলবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা? দেশ দখল। নুন, তাঁত, রেশম, নীল সব শিল্প চৌপাট। কারণ কাঁচামাল পূব থেকে পশ্চিমে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য— চূড়ান্ত প্রোডাক্ট নয়। দুর্ভিক্ষের সময়েও গম পাচার হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের বছরেও খাজনা আদায় কম হয়নি। শিল্পী-কারিগররাও চাষকে এবং কেবল চাষকেই জীবিকার রাস্তা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। জমির উপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। কাঁচামালের বিপুল রপ্তানি আর খাদ্যশস্যের বদলে ধীরে ধীরে বাণিজ্য-ফসল যেমন পাট, তুলো, তামাকের দিকে ঝোঁক চলে যাচ্ছে। এমনকি খাদ্যফসলও পোশাক বদলে হয়ে ওঠে পণ্য। সব ভুলে গিয়ে গম ও ধান হয়ে ওঠে আরাধ্য— কারণ তাই বাজারে বিকোবে— সুতরাং ওটাই খাদ্য। বাকি সব গরিবের ঘ্যাঁট। ভারতের বৈচিত্র্যময় কৃষি ও খাদ্যভাণ্ডারের মূর্তিটির উপরের রং-মাটি খসে পড়তে থাকা শুরু হয়। সবুজ বিপ্লব তো হাল আমল।
কাট। এবারের জাম্প ছোট— স্বাধীন ভারত। কিন্তু স্ব-অধীন নয়।
দ্রুত বৃদ্ধির দিকে আমাদের নেশা ছিল। আমাদের তাড়াহুড়ো ছিল। দুশো বছরের শোষণের মার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল তাগিদ ছিল। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন, উপেক্ষা, কৃষি পরিকাঠামোর অভাব, লগ্নির অভাব এই সব কারণে কৃষির অবস্থা ভাল ছিল না। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের পরিবারের নিজস্ব খাদ্য-সার্বভৌমত্বের বিষয়টির থেকেও তখন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল দেশের সামগ্রিক খাদ্যসুরক্ষার দিকে (সুরক্ষার সঙ্গে সার্বভৌমত্বের যে পার্থক্য তা অবশ্য আমরা আজও বুঝেছি কি না জানি না), অর্থাৎ বেশি বেশি করে ধান, গম ফলানোর দিকে। ফলে বড় সেচব্যবস্থা, বড় জলাধার, কৃষিসামগ্রীর বিতরণ, উৎপাদন বাড়ানোর বিদেশি মতে কৃষিশিক্ষার জন্য পরিকাঠামো।
কথা হচ্ছিল ক্ষিদের। আমাদের খাদ্যধারণা ততদিনে ঘুরে গেছে কেবল ধান ও গমের দিকে। পেট ভরানোর দিকে, পুষ্টির দিকে নয়। ছোট দানা, অচাষকৃত ফসল, সবজি, শাক— এসব কে ভাবে তখন? পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম— তারা বোঝায়, “তোমাদের জমিতে নাইট্রোজেন সার দেওয়া দরকার, তবে উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু তোমাদের দেশি ধান বড় লম্বা— নাইট্রোজেন দিলে শুয়ে পড়বে। উৎপাদন দিতে পারবে না। তাই তোমাদের বেঁটে ধান লাগবে। আমাদের ধানের বীজ নিচ্ছ না কেন?” আসলে মনে মনে বলে, ‘বিশ্বযুদ্ধের পরে এই যে এত বোমা বানানোর নাইট্রোজেন বেড়ে গেল— তা আমরা বেচব কোথায়? এই যে নর্মান বোরলাগকে দিয়ে বেঁটে নাইট্রোজেনখেকো ধান বানালাম— সেগুলো ভারতের মতো বিশাল দেশে বেচতে পারলে, দুইয়েরই সমাধান হয়।’
কাট। জাম্প— সবুজ বিপ্লব। এমএস স্বামীনাথন।
উচ্চফলনশীল ধান আমাদের কম ছিল না। আমাদের দেশের ধান, খর্বাকৃতির ধান, দেশীয় ধানের জিন নিয়ে সঙ্কর প্রজাতি— এসব নিয়ে কাজ করছিলেন ডঃ রিচারিয়া কেন্দ্রীয় ধান্যগবেষণা কেন্দ্রে। সংগ্রহে ছিল প্রায় ১২০০০ ধান। বিদেশ থেকে ধানের বীজ আনায় তাঁর আপত্তি ছিল— কারণ তা এদেশে এসে নতুন ভাইরাস ছড়াতে পারে, তেমনি এদেশের রোগ, পোকা ইত্যাদির হাত থেকে তাদের বাঁচাও মুশকিল হবে। তাছাড়া শুধু উৎপাদনক্ষমতাই তো ধান বাছার একমাত্র নিরিখ হতে পারে না। তার স্বাদ, পুষ্টি, সাংস্কৃতিক যোগ— এসবও তো আছে। ডঃ রিচারিয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর গবেষণার কাগজ চুরি যায়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র ছাড়াই এদেশে বিদেশি ধান পরীক্ষা শুরু করে। বেঁটে ধান তৈরি, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র— সবের পিছনেই টাকা ঢালে রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন। ১৯৬২-তে তার নির্দেশক রবার্ট শ্যান্ডলার যখন এদেশে আসছেন, তখন তিনি একটিও ধানগাছ চোখে দেখেননি। কালে কালে রিচারিয়ার ধানের সংগ্রহ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে চলে যায়। ততদিনে বিতাড়িত ডঃ রিচারিয়া মধ্যপ্রদেশে গড়ে তুলেছেন ১৯০০০ ধানের সংগ্রহশালা। সরকারের বিরুদ্ধে মামলা জিতে তাঁর সাধের কেন্দ্রীয় ধান গবেষণা কেন্দ্রে ফিরে আসার সুযোগ থাকলেও— সেই গবেষণাকেন্দ্রকেও শুকিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এ-সবই হতে থাকে সদ্যোপ্রয়াত ডঃ এমএস স্বামীনাথনের অঙ্গুলিহেলনে। তখন তিনি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচার রিসার্চে। সরকারের ও কর্পোরেটের পৃষ্ঠপোষকতায় অত্যন্ত ধীমান এই বিজ্ঞানী তুখোড় রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠেন— সব সরকারের, সব দলের। ১৯৮২ সালে ক্যাবিনেটের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসরি কমিটির চেয়ারম্যান আর প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের মতো অত্যন্ত জরুরি পদ থেকে সরাসরি কর্পোরেট পরিচালিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের নির্দেশক হন তিনি। সেখান থেকে বেরিয়েই ১৯৮৮ সালে খুলছেন এমএস স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন। ৮২ থেকে ৮৮, ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসে আইআর ধান, বিদেশি গম— আর এই সময় ও তার পরে নানা রিসার্চ প্রজেক্টের নামে একে একে পাচার হয়ে যায় আমাদের যাবতীয় ধানের জিন। যাতে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের হাতে নতুন নতুন সঙ্কর তৈরির মালমশলা মজুত থাকে।
কাট। জাম্প— ক্ষিদে।
উৎপাদনের ঘাটতি ছিল না। আজও নেই। ধানের দেশীয় উচ্চফলনশীল জাত ছিল। আছে। জাত তৈরি করে নেওয়া যেত দেশীয় জাতের ভরসায়— যা কম সার খাবে, কম জল খাবে, রোগ-পোকা প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকবে বেশি। কিন্তু অদূরদর্শিতা, স্তাবকতা, হুড়োহুড়ি আর ষড়যন্ত্রের চক্করে পড়ে আমাদের চাষব্যবস্থার ধরনটাই গেল বদলে। গেল ধান আর গম-সর্বস্ব হয়ে। আমাদের বোঝানো হল— ভাত খেতে পারছ না মানে, তোমারা আসলে গরিব। ধানমাঠের উৎপাদনকে অর্থনীতিবিদরা মাপলেন কেবল ধানের উৎপাদন দিয়ে। চুলোয় গেল খড়ের হিসেব, ধানমাঠের উপকারী অচাষকৃত খাদ্যউপযোগী ছোট গাছ-লতা-পাতা, গেঁড়ি-গুগলি-চ্যাং-মাগুর-কুচো মাছ, ভুলে গেলাম ধানমাঠের মাটির তলায় জল রিচার্জ করার বিপুল ক্ষমতা। ধানের ঠেলায় উপেক্ষিত হল ডাল চাষ। মাথাপিছু ডাল উৎপাদন ১৯৫১ সালে ৬১ গ্রাম থেকে ২০০৯ সালে কমে হল ৩৭ গ্রাম। অন্যদিকে দানাশস্য ৩৩৪ গ্রাম থেকে বেড়ে হল ৪০৭ গ্রাম। কাওন, কোদো, জোয়ার, বাজরা, বাকলা, কুসুম, তিসি, হাজাররকম শাকপাতা, সবজি, রামদানা, মেটে আলু, চুনোমাছ তো ছেড়েই দিলাম। ১৯৪৭ থেকে ২০১১— জনসংখ্যা বাড়ল ৩ গুণ, খাদ্য উৎপাদন বাড়ল ৫ গুণ। ক্ষিদে কি চলে গেল? চলে কি গেল অপুষ্টি?
আমাদের ক্যালরির ক্ষিদে নয়, চাল আর আলুতেও তো ক্যালরি আছে। রেশনের চালে পেট ভরলেও— আমাদের ক্ষিদের মাত্রা এখন অন্য। আমাদের ভিটামিন-খনিজ লবণ কম, রক্তাল্পতা, প্রোটিন কম, বারবার রোগে ভুগি— এই-ই আমাদের ক্ষিদে। রুগ্ন মা— রুগ্ন শিশু— রুগ্ন কিশোরী— রুগ্ন মা। আমাদের ক্ষিদে প্রজন্মান্তরে শিকড় ছড়িয়েছে এই চক্রে, লুকিয়ে আছে অনতিক্রম্য হয়ে। কৃষিসভ্যতার শুরু থেকেই পৃথিবী আদতে ধান-গম-ভুট্টার বশ। কলোনিয়ানিজমে আমাদের পাখির চোখ হয়ে ওঠে— ধান, গম। সবুজ বিপ্লব আমাদের সুখাদ্যের কফিনে শেষ পেরেক। এই সবুজ বিপ্লবের বাপ ঠাকুরদা জ্যাঠামশাই মনিব কাকা কাকিমা— সবাই তার কফিনবাহক।
*মতামত ব্যক্তিগত