জয়ন্ত ভট্টাচার্য
আমরা ক্রমাগত ঘটনার পেছনে ছুটছি। ঘটনা আমাদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পরে আমাদের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করছি। এ অর্থে আমাদের সামাজিক বা নাগরিক প্রতিক্রিয়া reactive। কিন্তু রাষ্ট্রের তরফে ঘটনার নির্মাণ করা একটি pro-active অবস্থান থেকে। এই বিচারে নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের চাইতে pro-active রাষ্ট্র কয়েক কদম এগিয়ে থাকছে। এই দাবাযুদ্ধের দান উলটে দিতে না পারলে আমরা ক্রমাগত ঘটনার পরবর্তীতে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেবল ব্যক্ত করে যাব। ভাবনা এবং সমাধানের দায়িত্ব মানুষের কাছে দায়বদ্ধ চিন্তাশীল সমাজকে নিতে হবে। এর বাইরে ভিন্ন কোনও পথ নেই
একটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের (নিউজক্লিক) ওপরে দিল্লি পুলিশের কোনওরকম রাখঢাক না করে আক্রমণ এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং আরেকজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক অমিত চক্রবর্তীকে কুখ্যাত ‘ড্রাকোনিয়ান’ UAPA আইনে গ্রেফতার (যেখানে জামিন পাওয়া যায় না) ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একযোগে ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্সের তরফে ৩০টি জায়গায় একইসঙ্গে তল্লাশি চালানো একদিকে দেশ জুড়ে মানুষকে সন্ত্রস্ত, স্তম্ভিত এবং বাকরুদ্ধ করেছে। আরেকদিকে এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া এবং বিভিন্ন স্তরের সংবাদমাধ্যম ও প্রগতিকামী মানুষের তরফে এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, বহুসংখ্যক (৪৬ জন) সাংবাদিকের ল্যাপটপ, মোবাইল এবং অন্যান্য কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের বয়ান[1] অনুযায়ী “In NewsClick case seizing devices, tagging 46 as ‘suspects’, is brazen short-circuiting of due process.” পাঠককুল এ থেকে যা বোঝার নিশ্চয়ই বুঝবেন।
প্রসঙ্গত স্মরণে রাখা যায়, তর্কযোগ্যভাবে, ভারত ভূখণ্ডের ‘imagined communities’-কে ঢোঁড়াই চরিত মানস-এর ‘মহাৎমাজীর’ মাকড়সার জালের মতো পলকা সূতোর জালে বাঁধা হয় তিনটি প্রধান শক্তির উপরে ভর করে— (১) হিন্দি সিনেমা (একেবারে হালে আমরা ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’ বা ‘আদিপুরুষ’-এর মতো ফিল্মের পৌরুষ তো জমিয়ে উপভোগ করেছি), (২) ক্রিকেট, এবং (৩) হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্ব।
এরকম এক সময়ে আমাদের মনে সুকুমার রায় একবার এসে হানা দিতেই পারেন—
(যদি) কুমড়োপটাশ হাসে –
থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে
ঝাপসা গলায় ফার্সি ক’বে নিশ্বাসে ফিসফাসে
তিনটি বেলা উপোস করে থাকবে শুয়ে ঘাসে! …
তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা,
কুমড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।
দেখবে তখন কোন্ কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে।
ঘটনার আগে ঘটনা
দিল্লি পুলিশ কেন সংবাদমাধ্যমের ওপরে এরকম আক্রমণ (যদিও ক্রমাগত হয়েই চলেছে) করল? প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে বলা হয়েছে দুটি ঘটনার কথা—
(১) আগস্ট ৫, ২০২৩ (আপডেটেড আগস্ট ১০, ২০২৩) নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে একটি নিজস্ব তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় “A Global Web of Chinese Propaganda Leads to a U.S. Tech Mogul” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে বলা হয় হয়— “In New Delhi, corporate filings show, Mr. Singham’s network financed a news site, NewsClick, that sprinkled its coverage with Chinese government talking points. China’s history continues to inspire the working classes…” রাষ্ট্রের আক্রমণের প্রথম এবং প্রধান যুক্তি এবং হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে এই রিপোর্ট।
(২) শাসক দল বিজেপি-র এক সাংসদ দিল্লি পুলিশের কাছে নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে একটি এফআইআর করে।
প্রাথমিক যুক্তি হিসেবে এ দুটিকে দেশদ্রোহিতা এবং অবৈধ লেনদেনের ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানী সংস্থা এদের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে। তারপরে অ্যারেস্ট এবং আনুষঙ্গিক যা ঘটেছে।
ভিন্ন কিছু কথা
১৫ আগস্ট, ২০২২-এ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবাসীকে “পঞ্চ প্রাণ”-এর ব্যাপারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন— নাগরিক হিসেবে ভারতবাসীকে তাদের কর্তব্য পূর্ণ করতে হবে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, কর্তব্য পালন করলে তবেই অধিকারের প্রশ্ন আসে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো সংবাদপত্রে তিন বছর আগে তাঁর আমন্ত্রিত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম— “হোয়াই ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড নিড গান্ধি” (অক্টোবর ২, ২০১৯)। এ লেখায় তিনি গান্ধিকে উদ্ধৃত করে লিখেছিলেন— “অধিকারের প্রকৃত উৎস হচ্ছে কর্তব্য (duty)। যদি সবাই আমরা কর্তব্য পালন করি তাহলে অধিকার কোনও দূরের বস্তু থাকবে না।” প্রসঙ্গত, গান্ধিকে নিয়ে এইচজি ওয়েলসের অভিজ্ঞতার কথা বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের লক্ষ্য-সংক্রান্ত “বিল অফ রাইটস”-এর জন্য সমর্থন চেয়েছিলেন। গান্ধি তাঁকে “বিল অফ রাইটস”-এর পরিবর্তে একটি সর্বজনীন চার্টার অফ ডিউটিজ লিখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।[2]
আরেকটি ঘটনাও উল্লেখ করার মতো। সুখ্যাত জীববিজ্ঞানী জুলিইয়ান হাক্সলে যিনি United Nations Educational and Scientific Organisation (UNESCO)-র প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছিলেন তিনি জওহরলাল নেহেরু মারফত গান্ধির কাছে ‘theoretical basis for the rights of man’-এর ব্যাপারে পরামর্শ চান। কিন্তু অধিকার নিয়ে কোনও ডিসকোর্স-কে আমল দেননি। ইতিহাস জানাচ্ছে— “In the run-up to the Universal Declaration of Human Rights by the United Nations, Dr Huxley had reached out to 150 eminent thinkers across the world for their opinions on the utility of a universal instrument of human rights and whether different conceptions of human rights could be reconciled into a single universal document. His letter went to Nehru, who regretted that he cannot find the time for any quiet consideration or writing but promised to forward it to Gandhi as desired by Huxley.[3]
এখানে এসে গান্ধি এবং বর্তমান ভারতনায়ক মিলে যান। মোদ্দা কথা হল, রাষ্ট্র এবং জাতির প্রধান নায়কদের কাছে ব্যক্তির এবং নাগরিকের অধিকার নিমজ্জিত হয়ে থাকে রাষ্ট্রের অবিমিশ্র অধিকারের মাঝে।
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সংবিধান এবং আইন মেনে নিয়মিত ট্যাক্স দেয়, সামাজিক জীবনযাপন করে, ভিন্নধর্মের প্রতি সহনশীলতা দেখায়, যাদের সন্তানেরা সামরিক বাহিনিতে উৎসর্গীকৃত, প্রশাসনকে সহযোগিতা করে, করে এসেছে, তারা কি দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করছে? তারা কি অধিকারের কথা বলবে?
সহজ কথা হল, ভারতবাসীকে অধিকারের পরিবর্তে প্রথমে কর্তব্যের পাঠ নিতে হবে। এরকম একটি প্রসঙ্গ কেন ঘুরে ঘুরে আসছে? সাধারণ ভারতবাসীর মনে এ প্রশ্ন আসা নিতান্ত স্বাভাবিক। ঘটনাচক্রে, ১ আগস্ট, ২০২২, ভারতের সদ্য-প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রামান্না হিদায়াতুল্লা ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির কনভোকেশনে এক বক্তৃতায় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন— “যে মানুষেরা তোমাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না তাদের কাছে যাও। যেসব সামাজিক ইস্যুগুলো রয়েছে সেগুলো বোঝো, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হও এবং তাদের স্বপক্ষে দাঁড়াও। মানুষকে তার অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য শিক্ষিত করো এবং যেখানে সম্ভব সেখানে তাদের আইনি পথ দেখাও।”[4]
কর্তব্য এবং অধিকারের মধ্যে পছন্দ করার ক্ষেত্রে ভারতের নীতি-নির্ধারকদের নতি (গ্র্যাডিয়েন্ট) এখন কর্তব্যের দিকে। এখানে দুয়েকটি অপ্রিয় বিষয় আমাদের ভাবায়। প্রথম, নতুন যে “ফরেস্ট (কনজার্ভেশন) রুলস, ২০২২” পার্লামেন্টের অনুমোদন পেয়েছে, সেখানে অরণ্যের অধিকার অনাদিকাল ধরে যে জনজাতিরা অরণ্যবাসী এবং অরণ্য সংরক্ষণ করে তাদের হাত থেকে হারিয়ে গেছে। তারা কী নিয়ে ভাববে— অধিকার কিংবা কর্তব্য? দ্বিতীয়, সংশোধিত শ্রম আইনে (২০২২) ‘মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকদের অধিকার কি সুরক্ষিত হবে? তৃতীয়, “এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২০” অনুযায়ী প্রান্তিক কৃষক এবং মহাশক্তিধর মালিকের মধ্যে কার কর্তব্য এবং কার অধিকার রক্ষিত হবে? এসব প্রশ্নের সমাধান জিডিপির বৃদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না।
বর্তমান ভারতরাষ্ট্রের কাছে এই কর্তব্যের প্রশ্ন এত জরুরি কেন? কর্তব্য আসলে বকলমে আনুগত্যের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য তৈরি করা, আনুগত্যের সমাজের প্রতিটি স্তরে চারিয়ে দেওয়া, সামাজিক মননে গ্রাহ্য এবং স্বাভাবিক করে তোলা— এগুলো এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা। নাহলে নতুন পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধনে “সেঙ্গল রাজদণ্ড” প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতিকে আপাতভাবে একীভূত করে ফেলা এবং বিশ্বের বাজারে “বিশ্বগুরু”-র তথাকথিত গণতন্ত্রের ফেরি করা, সংস্কৃত মন্ত্রের মতো মহিলা সংরক্ষণ বিলের নাম “নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম” ইত্যাদি সব একসঙ্গে করে ওঠা সম্ভব নয়। এ জন্য চাই কর্তব্য তথা আনুগত্যের অন্তহীন পাঠ ও শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাওয়া— স্কুলের সিলেবাস পরিবর্তন থেকে ইসরোর মহিলা বিজ্ঞানীদের শাড়ি পরা ছবি বিজ্ঞাপিত করা ভারতীয়ত্ব এবং ভারতীয় নারীর প্রতীক হিসেবে, ধর্মভিত্তিক লিঞ্চিং থেকে দলিত হত্যা ও ধর্ষণ, জাতি সমস্যার ক্ষেত্রে নিরুত্তর থেকে লাগাতার সশস্ত্র দমন-পীড়ন চালু রাখা— ইত্যাকার সবই আমাদের জীবনযাপনের অঙ্গ বলে ভেবে নিতে শিখে, এক নতুন সোশ্যাল সাইকির নির্মাণ নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
আরও কথা
কতকগুলো গোড়ার বিষয় আমরা পুনরায় ভাবার চেষ্টা করতে পারি। কর্তব্যের ধারণা কার্যত জড়িয়ে আছে প্রজার অস্তিত্বের সঙ্গে। প্রাক-আধুনিক সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে উত্তরণ প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে প্রজাসত্তার কর্তব্য থেকে নাগরিকসত্তার অধিকারে উত্তরণ, এবং তার স্বীকৃতি লাভ। জন রলসের মতো নীতিবাদী দার্শনিক তাঁর এ থিওরি অফ জাস্টিস গ্রন্থে বলছেন— “একটি সর্বোচ্চ প্রসারিত সকলের জন্য সমান বনিয়াদি লিবার্টির ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তির সমান অধিকার থাকতে হবে, যা অন্যের লিবার্টির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।” সমাজ আধুনিক হয়ে ওঠার ভিত্তিতে রয়েছে এ ধারণাগুলো। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দিতে জার্মান সমাজতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যায় গেমাইনশাফট (gemeinschaft) এবং গেজেলশাফট (gessellschaft)-এর মতো দুটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমটি কৃষিসমাজ তথা কৌমসমাজ এবং দ্বিতীয়টি আধুনিক শিল্পনির্ভরসমাজ বোঝায়। পার্থ চ্যাটার্জি দুটি ধারণার পার্থক্য নিয়ে বলছেন, “সমাজ ব্যক্তির আগে, সমাজের দাবিই প্রধান। সে সমাজে ব্যক্তিসত্তা স্বীকৃত হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের স্থান বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজন ও নিয়মের বশবর্তী।” আমরা কি গেজেলশাফট-এর যুগে থাকলেও গেমাইনশাফট-এর মতাদর্শকে অনুপ্রবিষ্ট করতে চাইছি?
এনগ্র্যাফটেড মডার্নিটির যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠল নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপ শতাধিক বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে যেভাবে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করেছে সামান্য কয়েক দশকে। ফলে ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজজীবনে সেকুলারিজমের যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে রাষ্ট্রিক জীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে ভারতে সেসব অনুপস্থিত। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগোলিক ভূখণ্ডে সামন্ত রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতি শ্রেণি, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭-পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতাচিহ্ন। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭-পরবর্তী ভারতবর্ষে।
শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় তিনশো বছর জুড়ে। ডেমোক্রাসির স্বর্ণযুগে সিভিল সোসাইটির সবল, জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ আত্মপ্রকাশ করে, অশ্রুত থেকে শ্রুত হয়ে ওঠে, অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমানতার স্তরে উঠে আসে। এক্ষেত্রে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ, আমেরিকায় তীব্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে “অন্য এক পৃথিবী সম্ভব”, “অক্যুইপাই ওয়াল স্ট্রিট” বা গ্রেটা থুর্নবার্গের পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি পরিসরে নাগরিক হওয়ার ধারণার সঙ্গে নাগরিক না-হওয়ার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।
কিন্তু যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্তরাজা ও এর উপযোগী মানসিকতার সঙ্গে জায়মান শিক্ষিত নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিসত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি তাহলে সবসময়েই কেন্দ্রাভিমুখী হয়। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনও ব্রাত্যও বটে। সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Truths and Lies about Nationalism, as narrated by Carvak (২০২১) গ্রন্থে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন— “The first truth is that the states came into the Indian federation in ways that were often very different … In a few cases, such as Jungadh, a plebiscite was held, although for Jammu and Kasmir it was not … I keep reminding you, the state (rājya) is not identical to the nation (raṣṭra).”[5]
এসবের মাঝে অলক্ষ্যে নাগরিক পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে তার ক্রমাগতভাবে নিরন্তর সঙ্কোচন ঘটে চলেছে, রাজনৈতিক চরিত্রের পৌরুষীকরণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলো বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম পাড়িয়েও দেওয়া হয়, যাকে বলে এথিকাল ট্র্যানকুইলাইজেশন (ethical tranquilization)।
শিক্ষকেরা হয়ে যান educational managers, যাঁরা শিক্ষাদান সংক্রান্ত নানারকমের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সামলাবেন। ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোনও জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে অবস্থান তৈরি হবে না। সিলেবাসও সেভাবে তৈরি হবে, যেমন সাম্প্রতিক দিল্লি বা জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। নতুন সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে যার ভিত্তিতে রয়েছে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকতা-নির্ভরতা, শুধুমাত্র বর্তমানকে যাপন করা। অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের লুম্পেনরা আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেওয়ার, ক্ষমতার বৃত্তের সঙ্গে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করবে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেবে “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যায়। আমাদের এতদিনের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছে না। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে এমন নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীদের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তা্দেরকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
ভিন্ন প্রেক্ষিতে সমধর্মী এক পরিস্থিতি দেখেছিলেন ফ্রানজ ফ্যানঁ (Frantz Fanon) তাঁর The Wretched of the Earth পুস্তকে। তিনি দেখেছিলেন— “The very same people who had it constantly drummed into them that the only language they understood was that of force, now decide to express themselves with force.”
এখানেই রাষ্ট্র, পার্টি ও প্রচলিত আখ্যানের বাইরে গিয়ে জরুরি হয়ে পড়ে একটি তৃতীয় পরিসর গড়ে তোলা। জরুরী অবস্থার সময়ে ভারত জুড়ে পার্টি অস্তিত্বকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপী তৃতীয় পরিসর জন্ম নিয়েছিল। এই তৃতীয় বা নাগরিক পরিসর নতুন চিন্তন, সৃষ্টিতরঙ্গ, নাগরিকদের মাঝে পারস্পরিক নতুন বন্ধনকে বাস্তবের মাটিতে জীবন্ত চেহারা দিয়েছিল। এই তৃতীয় তথা নাগরিক পরিসরের সজীব উপস্থিতি জেলে অবরুদ্ধ কংসারী হালদারকে নির্বাচনী লড়াই জিতিয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ বা ১৯৮৮-৮৯-এর পশ্চিমবঙ্গে বন্দিমুক্তি আন্দোলনকে সফল করেছে। নন্দীগ্রামের নরহত্যার পরে লাখো লোকের দৃপ্ত পদচারণা পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। নাগরিক পরিসর না থাকা বা ক্রম-সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য আজ দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের চিত্র ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র এখনও খানিকটা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে।
বর্তমান সময়
আজকের কঠোর নিষ্করুণ বাস্তবের প্রেক্ষিতে আমাদের কতকগুলো বিষয়ে অবশ্যই গভীরে ভেবে দেখা দরকার।
(১) আমাদের মস্তিষ্কে নিউরোনের পাশাপাশি রয়েছে গ্লায়াল কোষ। নিউরোনের কাজ প্রধানত তাৎক্ষণিক আবেগ, ক্রোধ ইত্যাদির জন্ম দেয়। গ্লায়াল কোষ গভীরে গিয়ে ভাবা, সৃজনশীল কাজ ইত্যাদির উৎস। টিভির ‘সোপ সিরিয়াল’, বিজ্ঞাপনের কুহকী মায়া— সুকুমার বাচ্চা কিংবা সুন্দরী মহিলাদের জন্য হরলিক্সের অসীম প্রয়োজনীয়তা, সাবানে মুখের ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে প্রেমের আকর্ষণের বান ডাকানো, ‘ঘন্টা খানেক’-এর সুগম্ভীর তাৎক্ষণিক আক্রমণের শরীরী ভাষায় আলোচনা ইত্যাদি সবই সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়কেও কাজে লাগায় এই নিউরোনগুলোকে সবল সজীব রাখার জন্য। পণ্যদুনিয়ার বাজার আরও প্রসারিত হয়। কিনতে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! এরকম অবস্থায় শীতঘুমে চলে যায় গ্লায়াল কোষ, এবং এসবের মাঝে কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে গভীরে ভাবার চেষ্টা।
এই মানুষেরাই সামাজিকভাবে আমাদের সঙ্গে বসবাস করে। এ ধরণের চিন্তাহীন, তাক্ষণিকতা-নির্ভর মানুষেরা স্বাভাবিকভাবেই পার্টিরও সম্পদ। আবার বহুলাংশে একই ধরনের মস্তিষ্কগত ক্রিয়াকর্মে আমরাও তো মজে থাকি। এভাবেই শাসকদের তরফে তৈরি হয়ে যায় এক ধরনের মানসিক hegemony— হুবহু গ্রামসির মতো না হলেও।
(২) বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের, জাতীয় খবরের সঙ্গে স্থানীয় সংবাদের সংযোগ তৈরি করে। ভারতের স্থান আন্তর্জাতিক World Press Freedom Index 2023-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে থাকা বিপজ্জনক— আমরা এ-নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারি, প্রচুর লেখালেখিও। কিন্তু গভীরতর ভাবনার বিষয় হল— সংবাদ পরিবেশনের স্বাধীনতা যদি চলে যায় কিংবা অবরুদ্ধ হয় তাহলে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের বা জাতীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে স্থানিক খবরের পারস্পরিক সংযোগ থাকবে না। প্রবাহ পথগুলো (conduits) কেটে দেওয়া হচ্ছে যাতে এরা ধীরে ধীরে শুকিয়ে এবং বন্ধ হয়ে যাবে। হিন্দি সিনেমা, ক্রিকেট (সাময়িকভাবে এশিয়ান গেমস বা ফুটবল) আর হিন্দি ভাষা একমাত্র সংযোগ মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে।
পশ্চিমবাংলার কুড়মি আন্দোলনের সঙ্গে দিল্লিতে ধর্নায় বসা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদকজয়ী কুস্তিগীরদের আন্দোলনের কোনও যোগাযোগ নেই। যে যার নিজের পথে হাঁটছে, আমরা দর্শক হিসেবে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। মজার ব্যাপার, বিষয়গুলোকে যদি পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডার খোরাক করে তোলা যায় তাহলে নিজের নিয়মেই পরদিন বিস্মৃতিতে চলে গিয়ে আবার নতুন বিষয় নিয়ে মশগুল হবে। সবসময় দৃশ্যে, শ্রবণে, মননে, চিন্তনে শুধু মস্তিষ্কের উপরিতলের নিউরোনগুলো কাজ করে যাবে। সবমিলিয়ে একটি অতল সামগ্রিক সামাজিক বিস্মরণের পর্যায় (numbing of collective consciousness) চলবে। একে কি “memory famine” বলা যাবে?
(৩) এ-সময়েই জীবনের প্রতি স্তরে কোনও নির্দেশনা ছাড়া নিরন্তর সামাজিক সংলাপ চালানোর কথা। আমাদের যাপিত ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনের আনাচে-কানাচে panopticon সংগঠনের নজরদারির বাইরে সংলাপের জন্ম হবে।
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয় …
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।
(৪) নজর করার বিষয় হল ইতিহাস, জীবনযাপনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, স্মৃতির এক বিপুল পুনর্নিমাণ যজ্ঞ চলছে। এর বিপরীতে আমাদের নিজের নিজের সংস্কৃতি-স্মৃতি-যাপনের মাঝে প্রবাহিত স্মৃতির counter-construction করা একান্ত প্রয়োজনীয়, সময়ের দাবি। এবং একই সঙ্গে সমাজের প্রতিটি পরতে, অন্দরমহলে, মানুষের ভাবনার মাঝে একদিকে পারস্পরিক ঘৃণার চাষকে সফল করা, অন্যদিকে হিংসা/হিংস্রতাকে সামাজিক মান্যতা দেওয়া। জরুরি অবস্থার সময়ে রাষ্ট্রের প্রবল থাবা শ্বদন্ত সবাইকে বিক্ষত করেছিল, কিন্তু এরকম লাগাতার ঘৃণার চাষ করেনি।
(৫) তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, আমরা ক্রমাগত ঘটনার পেছনে ছুটছি। ঘটনা আমাদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপরে আমাদের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করছি। এ অর্থে আমাদের সামাজিক বা নাগরিক প্রতিক্রিয়া reactive। কিন্তু রাষ্ট্রের তরফে ঘটনার নির্মাণ করা একটি pro-active অবস্থান থেকে। এই বিচারে নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের চাইতে pro-active রাষ্ট্র কয়েক কদম এগিয়ে থাকছে। এই দাবাযুদ্ধের দান উলটে দিতে না পারলে আমরা ক্রমাগত ঘটনার পরবর্তীতে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেবল ব্যক্ত করে যাব। পৌঁছব কোথায়?
ভাবনা এবং সমাধানের দায়িত্ব মানুষের কাছে দায়বদ্ধ চিন্তাশীল সমাজকে নিতে হবে। এর বাইরে ভিন্ন কোনও পথ নেই। নিরন্তর সামাজিক সংলাপ এর একটি মাধ্যম।
নাহলে— ‘কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।’ ওমনি বেড়ালটা বলে উঠবে— ‘মুশকিল আবার কী? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।’
নাগরিক থেকে অন্তরীণ হয়ে যাওয়া, এই ছিলাম পরমুহূর্তে নেই, এই শান্ত আবার অজানা কারণে ভয়ানক অশান্ত, এই নাগরিক একটু পরে না-নাগরিক— এ তো হামেশাই ঘটবে। ঘটে চলেছে। এ সময়ে কেন হিংসা হচ্ছে— এ প্রশ্ন বারংবার করা কার্যত অর্থহীন। কারণ সামাজিকভাবে আমাদের বৌদ্ধিক ও মানসিক অস্তিত্ব এরকম চিন্তার পরিসরের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে আছে।
[1] ৪ অক্টোবর, ২০২৩, রাত ৮.১৪ মিনিট।
[2] হরিজন, ১৩.১০.১৯৪০।
[3] Gandhian Approach to Duties and Rights. Chintan. 30 Jan 2021.
[4] হিন্দুস্তান টাইমস, “কন্সটিটিউশন মেন্ট ফর এভরি সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া”, আগস্ট ১, ২০২২
[5] পৃঃ ২২৩-২২৪।
*মতামত ব্যক্তিগত