আশিস গুপ্ত
প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের সম্পর্কের গত সাত দশকের গতিবিধি বিশ্লেষণ করলে বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে শনিবার ভোররাতে হামাসের আক্রমণ আত্মরক্ষার জন্যই। আগ্রাসী ইজরায়েলের কাছ থেকে ৪৫ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় মানুষের জীবন-জীবিকা-আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই
নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে এবং প্যালেস্তিনীয় জনগণের স্ব-নিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার প্রয়োগকে অবরুদ্ধ করার প্রাচীরে মোক্ষম আঘাত হেনেছে বিদ্রোহী সংগঠন ‘হামাস’। ১৯৭৩ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পর হামাস প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে বিমান, সমুদ্র এবং স্থলপথে আক্রমণ চালিয়েছে ইজরায়েলের মাটিতে। আক্রমণ শুরু হওয়ার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, হামাসের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেন। আর কালক্ষেপ না করে ইজরায়েলের সমর্থনে এগিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সহ পশ্চিমি দুনিয়া। এঁদের সবারই এক কথা, বিনা প্ররোচনায় ইজরায়েলে বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়েছে হামাস। আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আক্রমণের অধিকার আছে তেল আভিভের। একটা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার ও বিকৃত বিশ্লেষণ নিয়ে ইজরায়েলের সমর্থনে সরব হয়েছে ইউরোপ আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানরা।
প্রকৃতপক্ষে, হামাসের পদক্ষেপ ঠিক সেই ধরনের “বিস্ফোরণ” যা প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং ইজরায়েলের ধারাবাহিক দখলদারির প্রেক্ষিতে অবশ্যম্ভাবী ছিল। ক্রমাগত বসতি স্থাপনকারী এবং দখলদার বাহিনির সন্ত্রাস, সেইসঙ্গে আল-আকসা মসজিদ এবং খ্রিস্টান ও ইসলামিক ধর্মীয় স্থানগুলিতে অভিযান সহ প্রতিদিনের উস্কানি ও আক্রমণের পরিণতি হামাসের “অপারেশন আল আকসা ফ্লাড”। ৭৫ বছরের দুর্ভোগ ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার পরে প্যালেস্তিনীয় সমস্যার সমাধানের অনুপস্থিতি, দুমুখো নীতির ধারাবাহিকতা এবং ইজরায়েলি দখলদার বাহিনির অপরাধমূলক ও বর্ণবাদী অনুশীলনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা হামাসকে আক্রমণকারী হতে প্ররোচিত করেছে। ১৯৬৭ সালের জুনে, ইজরায়েল মিশর, জর্ডন এবং সিরিয়ার সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধ করেছিল, যা ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা স্ট্রিপ, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান হাইটস দখল করে। ছয় দিনের যুদ্ধের পর, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ প্রস্তাব পাস করে, যাতে “সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতে দখলকৃত এলাকা থেকে ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনি প্রত্যাহারের” আহ্বান জানায়। প্রস্তাবে এই অঞ্চলের সমস্ত রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমানার মধ্যে শান্তিতে বসবাসের অধিকারের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে অসলো অ্যাকর্ডস ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর মধ্যে চুক্তি। এই চুক্তিগুলির লক্ষ্য ছিল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজা উপত্যকার কিছু অংশে প্যালেস্তিনীয় স্ব-সরকারের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। তারা প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষ গঠনের মঞ্চও তৈরি করে।
এরপরেও বারবার তৃতীয় রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক মঞ্চের মধ্যস্থতায় আলোচনা হয়েছে প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের মধ্যে, কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। কারণ, এই দ্বন্দ্ব দুটি সমান পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়। এটি একটি দরিদ্র, রাষ্ট্রহীন এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের বিরুদ্ধে পশ্চিমি রাষ্ট্র দ্বারা সশস্ত্র এবং সমর্থিত একটি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্রের আগ্রাসী অভিযান। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, প্যালেস্তিনীয়রা ইজরায়েলের নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুরুতর বৈষম্য এবং মারাত্মক সামরিক শক্তির শিকার হয়েছে। প্যালেস্তিনীয় শিশুদের চতুর্থ প্রজন্ম শরণার্থী শিবিরে লালিত-পালিত হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের মধ্যে। তাদের পরিবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। দশ লক্ষের বেশি প্যালেস্তিনীয় সরকারি পরিষেবা, জমি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। গাজা উপত্যকায় বহু বছর ধরে ইজরায়েলি সেনার অবরোধ সেখানকার ১৯ লক্ষ বাসিন্দাকে দারিদ্র্য এবং মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে অতিবাহিত করতে বাধ্য করেছে। গাজা উপত্যকায় বর্ণবৈষম্যমূলক প্রাচীর নির্মাণ, জর্ডন উপত্যকার সামরিক বেষ্টনী এবং পূর্ব জেরুজালেমের সংযুক্তি ইজরায়েলের স্থায়ী দখলের একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা তৈরি করছে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন হামাস বিদ্রোহীদের আক্রমণকে “অসংবেদনশীল” বলে নিন্দা করেছেন। অথচ দীর্ঘ সাত দশক ধরে ‘নিজভূমে পরবাসী’ হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের জীবনযাপন করছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, শুধুমাত্র ইজরায়েলি আগ্রাসনের জন্য। এক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ‘সংবেদনশীলতা’ হোয়াইট হাউসের চোরাকুঠুরিতে আবদ্ধ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক বলেছেন, “ইজরায়েলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামাস সন্ত্রাসীদের হামলায় আমি হতবাক।” একটা স্বাধীন জাতিকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে তার সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া শত শত বছর ধরে ব্রিটিশ শাসনের ডিএনএ-তে বিরাজমান। ব্রিটেনভিত্তিক কোম্পানিগুলো ইজরায়েলের কাছে অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করে, যা তারা প্যালেস্তিনীয় জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। যদিও ব্রিটিশ সরকার ইজরায়েলকে জবাবদিহি করতে কিছুই করে না, ইজরায়েল তার দমনমূলক শাসনকে আরও তীব্র করে চলে, ঋষি সুনক হতবাক হন না। গত ১১ আগস্ট ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অফ হিউম্যানেটেরিয়ান আফেয়ার্স-এর এক মধ্যবর্তী রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ইজরায়েলি বাহিনির দ্বারা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং ইজরায়েলে নিহত প্যালেস্তিনীয়দের সংখ্যা ১৬৭, যা ২০২২ সালে ইজরায়েলি বাহিনির হাতে নিহত প্যালেস্তিনীয়দের মোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে (১৫৫), যা ইতিমধ্যে পূর্ব জেরুজালেম সহ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সর্বোচ্চ প্রাণহানির রেকর্ড ছিল, ২০০৫ সাল থেকে। এ-খবরে হতবাক হন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ভক্তদের কাছে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে বন্দিত নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “ইজরায়েলে সন্ত্রাসী হামলার খবরে গভীরভাবে মর্মাহত। আমাদের চিন্তাভাবনা এবং প্রার্থনা নিরীহ শিকার এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে।” গাজা ভূখণ্ডে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে নিয়মিত শিশুহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইজরায়েলি সেনা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ২৮ আগস্ট প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলেছে, “ইজরায়েলি সামরিক ও সীমান্ত পুলিশ বাহিনি প্যালেস্তিনীয় শিশুদের হত্যা করছে কার্যত কোনও জবাবদিহি ছাড়াই। গত বছর, ২০২২, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্তিনীয় শিশুদের জন্য ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বছর ছিল। শিশুহত্যার ক্ষেত্রে ২০২৩ সাল ২০২২-এর সংখ্যা অতিক্রম করার পথে রয়েছে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত ইজরায়েলি বাহিনি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কমপক্ষে ৩৪ প্যালেস্তিনীয় শিশুকে হত্যা করেছে। এই নৃশংসতার জন্য ইজরায়েলের সমালোচনা করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, শুনেছেন কেউ?
আসলে প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের সম্পর্কের গত সাত দশকের গতিবিধি বিশ্লেষণ করলে বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে শনিবার ভোররাতে হামাসের আক্রমণ আত্মরক্ষার জন্যই। আগ্রাসী ইজরায়েলের কাছ থেকে ৪৫ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় মানুষের জীবন-জীবিকা-আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। ইজরায়েলের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ এবং বর্বরতায় বিশ্বের নীরবতার মুখে এ হল প্যালেস্তিনীয় জনগণের আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া।
*মতামত ব্যক্তিগত