দেবজ্যোতি রায়
বাজারের শক্তি লিটল ম্যাগাজিনগুলির সমবেত শক্তির চাইতে অনেকগুণে বেশি বলে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক-কবিরা বরাবর প্রান্তিক হয়েই থাকেন, বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে তাঁদের লেখা পৌঁছাতে পারে না। একমাত্র যাঁরা বাজারের সাহিত্যের বৃত্তের বাইরে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরাই এইসব প্রান্তিক লেখক-কবিদের খুঁজে বের করেন, যাঁদেরকে আমরা সিরিয়াস বা প্রকৃত পাঠক বলতে পারি
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অন্দরমহলে ঢুঁ মেরে জানা গেল, আমার এক অনুজ বন্ধু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম বাংলা বিভাগে অমিয়ভূষণ, আগে পড়ানো হত জানতাম, এখনও পড়ানো হয় কি না এবং পড়ালে অমিয়ভূষণের কোন বইটি সিলেবাসে আছে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন, চমকে যাওয়ার মতো কথা, আগে ‘মধু সাধুখাঁ’ সিলেবাসে ছিল। এখন সেটা সরিয়ে, না, ‘ফ্রাইডে আইল্যান্ড’ বা ‘মহিষকুড়ার উপকথা’ এমনকী নয়, ‘নির্বাস’ নামের একটি উপন্যাস, যার নাম আমি কখনও শুনিনি, ক’জন শুনেছেন জানি না, রাখা হয়েছে। অমিয়ভূষণের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলির মধ্যে এটা আদৌ পড়ে কিনা, এ প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আরও বিস্ময়কর, যে বাংলা বিভাগের সিলেবাসে একসময় কমলকুমারের ছোট গল্প পড়ানো হত। এখন কমলকুমার আর সিলেবাসেই নেই।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব তো একটাই— প্রথাবিরোধী সাহিত্যের পাঠক তৈরি করা। অন্তত তাই হওয়া উচিত। শুধুই পাশ করিয়ে দেওয়া, ছাত্রদের, নয়। অথচ আমাদের বেশিরভাগ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় সে দায়িত্ব পালন করবার কথা ভাবে না। সমসময়ের লেখার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের কোনও পরিচয় গড়ে ওঠে না অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে। যাঁরা গড়ে তুলতে সাহায্য করবেন তাঁদেরও যোগ্যতার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকেই, যদিও ব্যতিক্রম এখানেও আছে।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের নামে নামাঙ্কিত কোচবিহারের বিখ্যাত কলেজ যেটা, আগে নাম ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজ, আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর সূত্রে সেখানে প্রায় নিয়মিত আমার যাতায়াত ছিল এবং ওদের লাইব্রেরিটিকে আমি ব্যবহার করতে পারতাম। স্বভাবতই সাহিত্যের অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার একটা পরিচয় গড়ে ওঠে। অবাক লাগত, দেখে, যে, এঁদের অধিকাংশ বাংলা কবিতা বা গল্প-উপন্যাস এখন কীভাবে লেখা হচ্ছে, সেই খোঁজটাই রাখেন না। সিলেবাসেও নতুন ধারার কবি-লেখকেরা থাকেন না।
কোচবিহারে আমার পরিচিত যাঁরা বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলী রাখেন, দাবি করেন গল্প, উপন্যাস পড়েন বলে, তাঁদের অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি তাঁরা আজীবন কোচবিহারনিবাসী অমিয়ভূষণের লেখা পড়েছেন কিনা। আঁতকে উঠেছেন, ওরেব্বাবা, ওই ভাষাই তো বুঝি না।
সাহিত্যের দুটো চলমান ধারা আছে। একটা, যেটাকে আমরা বাজারি সাহিত্য বলি, যেটা নিয়ন্ত্রণ করে বাজার বৃহৎ পত্রিকা বা প্রকাশনার মাধ্যমে, যেখানে পাঠক তৈরি করা নয়, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বৃহৎ অংশের পাঠকের রুচি। তাঁরা যা পড়তে চান, যেমনটা পড়তে চান, প্রচলের প্রচলন সেখানে, গতানুগতিক, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সে ভাষাকে বাঁচায়’— এই ভাবনার কোনওই গুরুত্ব নেই, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়াটাই সহজ কার্য সেখানে। ঘুম সহজে আসে বলেই হয়তো পাঠকেরা পড়েন সেসব। এবং আরেকটি ধারা, যেটা লিটল ম্যাগাজিনগুলি করে থাকে, যেখানে বিষয়কে নতুনভাবে দেখার চেষ্টা থাকে, নতুনভাবে ভাষা সৃষ্টির প্রয়াস থাকে, এক কথায় পাঠকের সনাতনী মগজে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জগৎ ও জীবনকে নতুনভাবে দেখাবার চেষ্টা থাকে, জীবনের সত্যগুলিকে খোঁজার দিকে যাত্রা থাকে। পাঠককে সাহিত্যের বিকল্প ধারায় মগ্ন ও গড়ে তোলার কাজ করে লিটল ম্যাগাজিন।
একটা বহুল প্রচলিত জেন গল্পে অধ্যাপক গেছেন জেনকে জানতে জেনগুরুর বাড়িতে। গুরু তাঁকে আপ্যায়ন করে চা খেতে বললেন এবং অধ্যাপকের কাপে চা ঢালতে শুরু করলেন। কাপ উপচে চা যখন টেবিল থেকে গড়িয়ে নিচে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে, ক্ষিপ্ত, অপমানিত অধ্যাপককে তখন জেনগুরু বললেন, জেনকে জানতে হলে আপনাকে আগে আপনার মাথা থেকে পুরনো যা কিছু চিন্তা-ভাবনা সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে আসতে হবে। নইলে উপচানো চায়ের মত জেন-ও আপনার মাথা থেকে উপচে পড়ে যাবে। ক্ষমতা তার নানাস্তরীয় ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আমাদের মগজে আমাদের জন্মের পর থেকে একের পর এক মিথ্যে ভাবনা, জীবন সম্পর্কে, ঢোকাতে থাকে, আমাদেরকে ‘ভাবা’ প্র্যাকটিস থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। একটা মিথ্যের মধ্যে তখন আমাদের আজীবন বসবাস। লিটল ম্যাগাজিন তার পাঠককে এখান থেকে বের করে আনতে চায়, নতুনভাবে সত্যের খোঁজে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং এভাবেই একটা বিকল্প চলমান সাহিত্যের জন্ম দেয়।
কিন্তু বাজারের শক্তি লিটল ম্যাগাজিনগুলির সমবেত শক্তির চাইতে অনেকগুণে বেশি বলে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক-কবিরা বরাবর প্রান্তিক হয়েই থাকেন, বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে তাঁদের লেখা পৌঁছাতে পারে না। একমাত্র যাঁরা বাজারের সাহিত্যের বৃত্তের বাইরে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরাই এইসব প্রান্তিক লেখক-কবিদের খুঁজে বের করেন, যাঁদেরকে আমরা সিরিয়াস বা প্রকৃত পাঠক বলতে পারি।
একটা অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী ব্যাপার এই সময়ে ঘটে চলেছে। তবে তার আগে বলি, যুগে যুগে এটাই ঘটেছে যে, “The centre cannot hold/ Things fall apart”. পাশাপাশি এটাও সত্যি, প্রতিষ্ঠান কখনও সহজে হার মানে না। মানুষের বিদ্রোহী সত্তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবার কাজে সে নিয়ত সচেষ্ট থাকে।
যে পরস্পরবিরোধী ব্যাপার এই সময়ে ঘটে চলবার কথা বলছিলাম, সেটা হল একদিকে প্রযুক্তির বিশাল উল্লম্ফন যেমন বিশ্বসাহিত্য ও সাহিত্য ভাবনাগুলিকে পাঠকের দুয়ারে এনে দাঁড় করিয়েছে, আপনি বোতাম টিপলেই বিশ্বের যে কোনও জায়গার সাহিত্যসৃষ্টির নিকটে পৌঁছে যেতে পারেন, আপনি বিশ্বের কোথায় কী, কীভাবে লেখা হচ্ছে, তার স্বাদ ঘরে বসেই পেতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে আপনার নিজের সৃষ্টিকেও অন্য-নিরপেক্ষ পৌঁছে দিতে পারেন আকাঙ্খিত পাঠকের কাছে, তেমনি বিপরীত দিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যবে থেকে লিটল ম্যাগাজিনের পিঠে হাত রেখেছে লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে, বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিন তার চরিত্র হারিয়ে ক্রমশ বৃহৎ আকারের সাহিত্য পত্রিকায় পরিণত হয়েছে, লিটল ম্যাগাজিন আর থাকছে না। ফলে সেইসব পত্রিকার পাঠকদের বৃহদংশের কাছেও একজন অমিয়ভূষণ, একজন কমলকুমার, একজন সন্দীপন, একজন নবারুণ, একজন উদয়ন ঘোষ, একজন অজিত রায়, কিংবা একজন শৈলেশ্বর, অরুণেশ, মলয় রায়চৌধুরী, বারীন ঘোষাল ও আরও অনেকেই প্রান্তিকই থেকে যাচ্ছেন। ভাষা এবং বিষয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানগুলি নিয়ে ওইসব সাহিত্য পত্রিকার বৃহদংশের পাঠক আর ভাবিত নন। ওইসব পত্রিকার বেশিরভাগ লেখকের লেখাতেও, তাঁরা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখতে চান, ভাষাকে আক্রমণ করে নতুন ভাষা সৃষ্টির কাজটা যে একজন লেখক বা কবির একটা বড় দায়িত্ব ও কাজ, সেই জায়গাটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপুলভাবে। অতি সাধারণ পাতি লেখাতেই ভরে উঠছে সেইসব সাহিত্য পত্রিকার পাতাগুলি। হারিয়ে যাচ্ছে বিষয়কে নতুনভাবে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিটিও। একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও অনেকগুলি গ্রন্থের রচয়িতাকেও দেখেছি সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত হতে, অথচ উত্তরবঙ্গেরও অনেক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ও লেখকের খোঁজের মধ্যে থাকে না সুরজিৎ বসুর ‘অবতামস’ উপন্যাসটির কথা।
শেষে, পুনরুক্তি ন দোষায় হবে যে, যতদিন না আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিকল্পধারার সাহিত্যের নতুন পাঠক তৈরির কাজকে একটা দায়িত্ব হিসেবে পালন করছে, ওপরে যেসকল কবি-লেখকদের নামোল্লেখ করেছি, তাঁরা বৃহত্তর পাঠক সমাজে প্রান্তিকই থেকে যাবেন, কিছু করার নেই। কেন্দ্র টলে গেছে বা যায় বারবার যদিও। কিন্তু তার বিষদন্ত থেকেই যায়।