Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রান্তিকতা ও শহিদ-মনস্তত্ত্ব

পার্থজিৎ চন্দ

 


কলকাতা আলাদা করে কোনও দোষ করেছে বলে আমি মনে করি না। তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী সে-সমস্ত ‘সৃষ্টিশীল’ মানুষেরা, যারা মহানগর থেকে দূরে থাকার বিষয়টিকে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন ও তার ফলে উদ্ভুত ‘গ্লোরি’কে সযত্নে লালন করে এক ধরনের অতিমানিতার মধ্যে নিজেদের স্থাপন করেন। পাঠক লেখককে লেখার প্রবণতা অনুসারে প্রান্তিক বা নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন। লেখক নিজে এ-বোধে আক্রান্ত হলে আমার অস্বস্তি শুরু হয়

 

বাংলা-কাবিতাকে শাসন করা, তার কলকাতা-কেন্দ্রিকতা, বাংলার-মুখ হয়ে ওঠা কতিপয় মানুষের— ইত্যাদি বেশ জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার শুরুতে এক চমকে ওঠার মতো বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক। সামবেদে পারিবারিক মণ্ডল হিসাবে কান্ব, গৌতম, মধুচ্ছন্দা, বামদেব, ভরদ্বাজ প্রমুখ ঋষিদের নাম পাওয়া যায়। আবার ইরিমিরি, ইরিঞ্চি, ইরিমি, মিরি, রিপু-নামে আর্যবৃত্তবহির্ভূত নামও পাওয়া যায়। এখান থেকে ধরে নেওয়া যায়, শত শত বিতর্ক থাকার পরেও ধরে নেওয়া যায়— এসব ‘অনার্য’ পরিবার সঙ্গীত রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছিল। হাজার প্রতিকূল পরিস্থিতি, আর্য-আক্রমণ ইত্যাদি যাই ঘটে থাকুক, তাঁদের সঙ্গীত কিন্তু আর্য-সৃষ্টির পাশাপাশি অবস্থান করছে। পরের অংশটি আরও আকর্ষক— ‘হোতা’ (পুরোহিত) ও তাঁর তিন সঙ্গী স্বরবিন্যস্ত আবৃত্তির পদ্ধতি যত্নের সঙ্গে শিক্ষা করতেন। পরবর্তী প্রজন্মকে সে-শিক্ষা দিতেন। আবার উদ্গাতা ও তাঁর তিন-সহগায়ক— প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা, সুব্রহ্মণ্য— আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতশিক্ষায় জোর দিতেন। শিল্পকে লালন করতে তাঁরা অতি-সতর্ক ছিলেন। এখানে শিল্প শুধু ‘শিল্প’ ছিল না; মনে রাখা জরুরি। এখানে শিল্প হয়ে উঠেছিল জীবিকা-ও[1]

শিল্প নিয়ে আমাদের বহুবিধ আদুরে ও কষ্টকল্পনা উপরের অংশটি মন দিয়ে পাঠ করার পর ঘুচে যেতে পারে। আর্য-বৃত্তের বাইরে অবস্থান করেও যে শিল্পের সঙ্গে থেকে যাওয়া যায়, কয়েক হাজার বছর নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা যায় সে-উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে। শিল্প যে তার গণ্ডি ছাপিয়ে বংশ-পরম্পরায় অন্নের সংস্থান করতে পারে, এবং সে অন্নকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যে দিনের পর দিন নিজের কাজটুকু সততার সঙ্গে করে যাওয়া দরকার— তাও জ্বলজ্বল করছে। সবচেয়ে বড় কথা— শিল্প যে আকাশ থেকে পড়ে না, সেটিও যে রীতিমতো কষ্টকর অনুশীলনের বিষয়, অন্তত একটা স্তরের পর যে আর স্বভাবশিল্প বলে কিছু থাকতে পারে না— এটা বুঝে নেওয়া অসম্ভব নয় এখান থেকে।

এ-অংশটির দিকে তাকালে এমনিতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে; বংশ-পরম্পরায়… শুধুমাত্র স্মৃতিকে আশ্রয় করে মানুষ দিনের পর দিন শিল্পকে বহন করে নিয়ে চলেছে। এই অমোঘ কামড়ের নিরিখে যখন দেখতে হয় দু-দশ বছরের আধিপত্য কায়েম করবার লক্ষ্যে, দু-একটা পুরস্কার দেওয়া ও পাওয়ার ইচ্ছায়, ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে একটু এঁটোকাঁটা চেখে দেখার সুযোগ পাওয়ার জন্য কেউ কেউ বাংলা কবিতা শাসন করবার মতো জায়গায় নিজেকে স্থাপিত করতে চাইছেন এবং সে-দিকে তাকিয়ে রীতিমতো গদগদ হয়ে বেশ কিছু মানুষ ছুটতে শুরু করেছেন— ভেবে নিচ্ছেন মেশিয়া এসে গেছেন, এবার ইহকাল-মহাকালের কাছে অমরত্ব নিশ্চিত— তখন জীবনানন্দের কাছে হাত পেতে অসম্ভব বেদনার সঙ্গে মিশে থাকা অমোঘ আমোদের কোলে ঢলে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। বাংলা কবিতার জগতে যে মাছির উড়ে বেড়ানো তা আসলে কুশিক্ষা ও অর্থনীতি-রাজনীতির ফল। নবজাগরণ নামক কল্পিত বিষয়ে সমাজের দশমিক এক-শতাংশ মানুষের উন্নয়ন ও শিক্ষাদীক্ষাকে যখন থেকে মোক্ষ হিসাবে গণ্য করা হল তখন থেকে বাঙালির শিল্পও নিয়তি-নির্দিষ্ট হয়ে গেল। সে ‘শাসিত’ হবে। তার গায়ে ঘন হয়ে থাকবে শহিদের ছায়া।

 

নবজাগরণ, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, অসংখ্য মিথের জন্ম দিয়েছে। মিথের পর মিথ জমে উঠেছে; এমন মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে বাংলায় নবজাগরণের সবচেয়ে বড় অবদান ওই ‘মিথ’। এসব মিথ কীভাবে যে একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা ইত্যাদিকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করে তার উদাহরণ সারা-বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ পর্বের সবচেয়ে বড় মিথ মধুসূদনের কবিতা নয়; তাঁর মদ্যপান ও বেহিসাবি জীবনযাপন। একটা সমীক্ষা করে দেখা যেতে পারে— যাঁরা মধুসূদনের একটি লাইনও পড়েননি তাঁরাও মধুসূদনের মদ্যপান ও বিবিধ বিষয়ে বেশ বিজ্ঞের মতো জ্ঞান বিতরণ করে যেতে পারেন। ট্র্যাজেডির শুরু এখান থেকে।

মধুসূদনের মতো কবি, রামমোহনের মতো ছুটে বেড়ানো মানুষ, বিদ্যাসাগরের মতো অসীম সাহসী মানুষ অন্য জনগোষ্ঠীতে জন্মালে ও কাজ করলে সে-গোষ্ঠী মিথ তৈরির আগে আরব্ধ-কাজ সম্পন্ন করত। কিন্তু বাঙালির বৌদ্ধিক-সুপ্রিমেসির ধারণ তাকে মিথ তৈরিতে উৎসাহী করেছে। আর কিছু নিয়ে যখন গর্ব করার থাকে না তখন মিথ তৈরি করে তার ভেতর ঘোরাফেরা করা বেশ নিশ্চিন্ত প্রহর উপহার দেয়। এ-পথ ধরে বয়ে আসা শাসন ইত্যাদির খুব কাছেই অবস্থান করছে রবীন্দ্র রচনাবলির পা-এর আঘাতে লুটিয়ে পড়া। এ ধরনের বিপ্লব ও দ্রোহের সঙ্গে বাঙালি চমৎকার খাপ খেয়ে যায়; কারণ এখানে বড় বিপদের আশঙ্কা নেই; অনুশীলনের ব্যাপার নেই, অথচ বেশ কড়া চমক রয়েছে। আর্মচেয়ার-বিপ্লবের এহেন ক্ষেত্র বাঙালি পেলে যে লুফে নেবে তা বলাই বাহুল্য।

 

শুধু আজ নয়; দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যের যে কলকাতা-কেন্দ্রিকতা তার জন্য দায়ী কে? সবচেয়ে বেশি দায়ী কলকাতার বাইরে থাকা শহিদ-মনস্তত্ত্ব-বহনকারী কবি-সাহিত্যিকের দল। শিল্পর গূঢ় জগৎ ভীষণ কঠিন, ভীষণ জটিল। দিনের পর দিন মাথা খুঁড়েও তার ভেতর হয়তো কোনও কোনও সময় এক-ইঞ্চিও প্রবেশ করা যায় না। সারা-শরীর থেকে রক্তপাত হতে থাকে; নিজেকে নিঃশেষ করে, ভস্ম করে তবেই কবির শান্তি। নিষ্ঠুর শোনালেও কিছু করার নেই, শিল্পের আর কোনও ফ্যাক্টরই শেষ পর্যন্ত শিল্পীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনিবার্য হতে পারে না।

শুধুমাত্র শিল্প, সেটিই একমাত্র বিচার্য। এখানে তাঁর স্থানিক অবস্থান, পেশা, গাত্রবর্ণ— কিছুই বিচার্য হতে পারেন না। এগুলি বড়-জোর স্মৃতিকথা বা টেবিলে টেবিলে লঘু-আড্ডার উপাদান হিসাবে কয়েক বছর ঘোরাঘুরি করতে পারে, তার বেশি কিছুই নয়। অথচ, শুধুমাত্র রাজধানীর থেকে দূরে থাকার কারণে এ-যুগেও যে কেউ কেউ নিজেকে সর্ব-অর্থে প্রান্তিক মন করছে— এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে না।

আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় কোনও ক্ষমতাশালী কবি বা সাহিত্যিক মারা গেলে। ভার্চুয়াল জগতে তার সঙ্গে ছবি-স্মৃতি ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি শুধুমাত্র ছবি-পোস্ট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আসলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণার বিষয়ও হয়ে উঠতে পারে। যে সমস্ত আগুনখোর তরুণ-তরুণীকে আপনি-আমি চিনি তাদের অনেকেই যে গোপনে সে ক্ষমতাবান কবির সঙ্গে, সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন তা তার মৃত্যুর আগে আপনি-আমি জানতেই পারিনি। আর তার চেয়েও মজার কথা, এগুলিকে বহুলাংশেই ঠিক বিপরীত অবস্থান থেকে উপস্থাপিত করা হয়। এমন একটি সুর ছড়িয়ে দেওয়া হয় যার অর্থ হল— আমাদের দুজনের ‘অবস্থান’ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল; কিন্তু ‘সৌজন্য’ আমাদের কাছাকাছি এনেছিল। এ-সৌজন্য ক্ষমতাবান কবি-সাহিত্যিক বেঁচে থাকার সময় প্রকাশিত হয়নি কেন— তার কোনও উত্তর আপনার-আমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।

সম্ভবত কারণ একটিই— ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা; তার বিরুদ্ধতা করেও তার কাছাকাছি থাকা। বিষয়টা অনেকটা ‘পলিটিক্যাল’; ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’ বলে যা আমাদের অধিকাংশ সময়ে গিলতে বাধ্য করা হয় তা যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখারই পিছদুয়ার সে নিয়ে সন্দেহ না-থাকার কোনও কারণ আজ আর নেই।

বাংলা কবিতা বা সাহিত্যের ক্ষমতাকেন্দ্র, শাসন ইত্যাদি অনেক সময়েই রক্ত দিয়ে রক্ত ধুয়ে ফেলার মতো সরলমতি বালকবালিকার দর্শনের দ্বারা চালিতে হয়ে এসেছে। একটি-দুটি গোষ্ঠী বা প্রকাশনাকে ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে বিবেচনা করে ছোট ছোট যে ক্ষমতাবৃত্তগুলি তৈরি হতে শুরু করে, টিকে থাকে তাদের দীনতা মাঝেমাঝে লজ্জা দেয়। শিল্পের সাধনার পরিবর্তে সে-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধতা করাতেই তাদের প্রাণশক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। শুধুমাত্র বিরুদ্ধতা করার মধ্যে যে শিল্পের কোনও উদ্দেশ্যই সাধিত হয় না সেটি বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। যে ক্ষমতা, বাজার, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে আমি গুরুত্ব দিই না, অবিরাম তার নিরিখে নিজের অবস্থানকে জাস্টিফাই করে যাওয়া চরম অস্তিত্ব-সঙ্কট বা ভীতির লক্ষণ। কোনও প্রতিষ্ঠান বা সিস্টেমের বিরোধিতা করা আমার কম্পালশন নয়, স্বাধীনতা। আনন্দ। বেছে নেওয়া পথ। সবচেয়ে বড় কথা, এ-পথ বেছে নিতে আমাকে কেউ বাধ্য যেহেতু করেনি তাই কোনওভাবেই নিজেকে শহিদ ভাবার কোনও পথ খোলা নেই। যে অঙ্গার ও কাচ ছড়ানো পথে আমি চলতে মনস্থির করেছিলাম, সে-পথে চলার কারণে আমার পায়ের পাতায় আগুন তার সমস্ত ক্ষত তৈরি করে গেছে— তা আমার অহঙ্কার। এ কোনও নাকি-সুরে গেয়ে যাওয়া কান্না হতে পারে না। সবচেয়ে বড় ভুল হয় এখান থেকেই; ক্ষমতা ও কলকাতাকেন্দ্রিকতার হাত শক্ত হতে শুরু করে। কলকাতা এখানে একটি শব্দ মাত্র; তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। যে-মুহূর্তে সে-কান্না শুরু হয় সে-মুহূর্ত থেকে আমরা আসলে অজান্তেই ক্ষমতার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে শুরু করি। করুণা করার উপাদান তুলে দিতে শুরু করি তাদের হাতে। শিল্প যে করুণা-অতীত এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর সত্য বুঝতে বুঝতে সারাজীবন কেটে যায় কারও কারও।

 

ঠিক এখানে এসে আমি আজকাল ‘প্রান্তিক’ শব্দটিকে সন্দেহ করতে শুরু করেছি। কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্রের রাজধানীতে চলে আসা, শিল্পের বেশি উপভোক্তার সন্ধানে, বাণিজ্যের সন্ধানে চলে আসা বিরল কিছু নয়। শেক্সপিয়র থেকে জেমস জয়েস— উদাহরণ দিয়ে তালিয়ে দীর্ঘ করার দরকার নেই। প্রশ্নটা অনেক বেশি ‘অবস্থানের’। ফলে কলকাতা আলাদা করে কোনও দোষ করেছে বলে আমি মনে করি না। তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী সে-সমস্ত ‘সৃষ্টিশীল’ মানুষেরা, যারা মহানগর থেকে দূরে থাকার বিষয়টিকে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন ও তার ফলে উদ্ভুত ‘গ্লোরি’কে সযত্নে লালন করে এক ধরনের অতিমানিতার মধ্যে নিজেদের স্থাপন করেন। পাঠক লেখককে লেখার প্রবণতা অনুসারে প্রান্তিক বা নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন। লেখক নিজে এ-বোধে আক্রান্ত হলে আমার অস্বস্তি শুরু হয়। একজন লেখক প্রান্তিক বা নাগরিক কিছুই নন শেষ-পর্যন্ত। শুধুমাত্র টেক্সট ছাড়া যখনই অন্য কোনও বিষয় বিচার্য হবে তখনই আমাদের মনে মনে ‘সিস্টেমের’ বা ‘সিস্টেমের বাইরে থাকা’ লাল-তরমুজের পাশাপাশি সাদা-তরমুজ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হতে হবে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধুমাত্র কলকাতায় (পড়ুন ‘ক্ষমতার কাছাকাছি’) থাকার কারণে বা মহানগরের কর্দমাক্ত অলিগলিতে নিশিকুটুম্বের মতো ঘোরাঘুরি করার কারণে কিছু অক্ষম-লেখকদের এই যে ‘হয়ে ওঠা’… এই যে আলোক-সম্পাত তাদের প্রতি, কই একজন অমিয়ভূষণ বা একজন শৈলেশ্বরের দিকে তো তেমন আলো ছুটে আসেনি। এখানে আরেকটি প্রমাদ ঘটে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। এ-দুজন সাহিত্যিক দুটি নাম মাত্র; বাংলার বহু কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন যাঁদের আরও বেশি খ্যাতি ও পরিচিতি হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল বাংলাভাষার সাহিত্যের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলি তাঁদের বাড়ি বয়ে গিয়ে দিয়ে আসা। হয়নি, ক্ষমতার জটিল বিন্যাসের কারণেই হয়নি। ক্ষমতার বিপন্নতা থেকেই হয়নি। কিন্তু যাঁরা ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি না-করে নিজেদের কাজটুকু করে গেছেন, প্রান্তিক আর নাগরিক অবস্থানের টানপোড়েনের ঘাতক-অতিমানিতায় না-ভুগে কাজ করে গেছেন দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে তাঁদের পাঠক-সংখ্যার প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে কি? আমার মত, মহানগরের (একটি প্রবণতা মাত্র) কাঁদা ঘেঁটে সারাজীবনে সভাসমিতি অলঙ্কৃত করা অনেক সাহিত্যিকের চেয়ে কিন্তু তাঁদের পাঠক-সংখ্যা বেশি-ই। এর একমাত্র কারণ, তাঁদের সৃষ্টির মান। খালি চোখে যে ঝলক খেলা করে পাঠকের নিরিখে তা ফানুসের মতো উড়ে যায়।

আর বাকি রইল কিছু আইটেম-শিল্পীর বাড়বাড়ন্ত— এটি একটি উপসর্গমাত্র। কয়েক বছর পরপর আইটেমশিল্পীদের নাম ও চেহারা বদলে বদলে যায়; নিজে চোখে দেখা। তার থেকেও বড় কথা, যে সমস্ত মহাজনদের নাম আমাদের সামনে ভেসে উঠছে এ-মুহূর্তে, যাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলি করে গেছেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় বর্জন করেছিলেন এই আইটেম-শিল্পী হয়ে ওঠার হাতছানি। এতটাই বিশ্বাস ও আস্থা ছিল তাঁদের নিজেদের কাজের প্রতি। আর একটা কথাও মনে রাখা জরুরি, কলকাতা থেকে তিরিশ-কিলোমিটার দূরের একটি জায়গায় অনলাইনে শাকসবজি কেনার সুবিধা নেই; কারণ সেখানে উপভোক্তার সংখ্যা কম। অথচ, কলকাতা থেকে দেড়শো-কিলোমিটার দূরের একটি জায়গায় সে-সুবিধা রয়েছে, মানুষ রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে এ-সিস্টেমে। অভিজ্ঞতা এমনই বলছে। ফলে কোনটি যে প্রান্ত আর কোনটি বা যে কেন্দ্র অথবা কেন্দ্রের অধিকতর কাছের— সেটি-ই ধূসর হয়ে আসছে। শিল্পের উপভোক্তাদের কাছে আরও বেশি বেশি করে পৌঁছে যাওয়ার কারণেই একমাত্র যে-কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্রের রাজধানীকে গেরিলা-কায়দায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এর বেশি একটি মাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন শিল্পীর এই বোধ থাকা জরুরি। সম্ভবত, সমস্ত উঁচু মানের শিল্পীই সে বোধ দ্রুত রপ্ত করে নেন।


[1] ভট্টাচার্য, সুকুমারী। ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য।