Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জল

জল | সাম্য সরকার

সাম্য সরকার

 

—সাতদিনের মধ্যে যদি না ফিরি জানবেন আমি আর নেই। তখন এই পাঁচ কোটি টাকার পুরোটাই আপনার। যদি ফিরে আসি তাহলে অর্ধেক আমার।

কত সেকেন্ডে এক সেকেন্ড হয়? দুশো বছরের দেওয়ালঘড়িটা মূর্তিমান অদ্ভুতের মতো শুধু দেওয়ালে আটকে আছে তাই নয়, পেন্ডুলামের তালে তালে একটা ভারি, মোটা কাঁটা কিছুক্ষণ পরপর গম্ভীর শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিসাবে তো বলে ওটাই, ওটাই এক সেকেন্ড, কিন্তু মনে তো তা হয় না। বাইরে ঝড় উঠেছে। পেছনের বারান্দার টিনের চালের ওপর বাতাসে বয়ে আনা এটা সেটা আছড়ে পড়ছে। মাথার ওপরে, দোতলায় দক্ষিণের কোনও জানলা বাড়ি খাচ্ছে দমাদম্। বাইরের ভাবগম্ভীর আবহ খান্ খান্ করে ভীষণই বেমানান রকম নিরুত্তাপ, নির্বিকার স্বরের কথাগুলো ঘরে পাক খাচ্ছিল। অথচ কথাটা যে বলল তার গলা আশ্চর্য রকমের স্থির। এতটাই স্থির যে তার পিঠের ওপর বিভাসের হাত মুহূর্তের জন্য থমকাল। লোকটাকে বিভাস আগে কখনও দেখেছে কি? বিভাস হাফডাক্তার। লোকে তাই বলে, আড়ালে-আবডালে। ফুলডাক্তার দেবাশিস চন্দের কাছে চৌত্রিশ বছর কম্পাউন্ডারি করছে বিভাস। একেবারে মাটির মানুষ ডাক্তারবাবু তাকে যেমন ভালবাসেন তেমন ভরসাও করেন। চেম্বারটাও ডাক্তার চন্দ তার ওপরেই ছেড়ে রেখেছেন। বিভাস সেটা দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে টুকটাক ড্রেসিং, কাটাছেঁড়া সেলাই করে থাকে বলে ওই নাম। আর কী আশ্চর্য! লোকটা তার খোঁজেই এসেছে এখানে। স্মৃতিতে চাপ দিয়ে বহুদূর গিয়েও এরকম একটা গায়ের গন্ধ, এরকম একটা মুখ বিভাস মনে করতে পারল না। এমনকি এই হাত, পিঠ সবই তার ভীষণ রকম অচেনা ঠেকল। লোকটার কথার মধ্যে একটা প্রত্যয় ছিল। সেই প্রত্যয়কে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।

মাঠে দূর, বহুদূর, যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সোনা রং চিকচিক করছে। সোনার গা বেয়ে ঢেউ খেলে যায় হিমেল হাওয়া‌। যেন সোনার ঢেউ উঠল মাঠে। মেঠো গন্ধ বয়ে আনা সে হাওয়া নিজের চোখেমুখে স্পষ্ট অনুভব করে বিভাস। পুকুরে পাকা কাতলা ঘাই মারছে। ভবাপাগলা ছিপ হাতে পাড়ে বসে চিৎকার করে ছেলেছোকড়ার দলকে গাল পারছে। ছেলেছোকড়ার দল তাতে আরও বেশি আমোদ পায়। সবার আগে আগে বিল্টু। নাকের তলায় কচি ঘাসের মতো রেখা গজাতে শুরু করেছে তার। মা নাকে চশমা এঁটে দাওয়ায় বসে পা ছড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ক্ষুদ বাছছে। মাটির দাওয়া নিকানো, তকতক করছে। পাশে মিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে দাওয়ায় আরাম করছে। দুদিক থেকে ঘরের সামনের বারান্দা সিমেন্টে বাঁধানো। বিভাস পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে মালতীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চাঁপার মটরমালা হারটা হাতে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মালতীর মুখটা। হাসলে তার বাঁ গালে টোল পড়ে। ভারী সুন্দর দেখায় এ বয়সেও। তাকে বুকে টেনে নেয় বিভাস। কানের ঝুমকো দুলটা দুলতে থাকে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে মালতীর। গোল গোল কাচের পিছনে কুতকুতে চোখ, খাড়া নাক, প্রকাণ্ড মাথা, বিষম কালো যেন চশমা চোখে কালো ভালুক। চশমার ওপর দিয়ে শেয়ালের মতো তাকিয়ে আছে গোঁসাই। হাতে ধরা পাঁচশো টাকার তিনটে বান্ডিল। সামনে টানটান দাঁড়িয়ে বাবা, মুখে গর্ব। বটতলায় শ্যামামায়ের পাকা মন্দির। মায়ের নামে মেয়েদের স্কুল। বাবার নামে ছোট হাসপাতাল। সেখানে বিভাস ফুলডাক্তার।

—ডাক্তারবাবু?

কিন্তু বাবা তো আজ শুধুই ফটো মায়ের তক্তাপোষের সামনে। বিল্টুর দেহটা খুঁজে পাওয়া যায়নি বাওড়ে আজও।

লোকটার স্বরের আর্তিতে বিভাসের ঘোর কাটে। ক্ষততে ওষুধ লাগাতে লাগাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে বিভাস, সাতদিনের মধ্যে আমি যদি খরচা করে ফেলি আর তুমি ফিরে আসো?

শুধু পিঠেই পাঁচটা গভীর ক্ষত। বুকে, হাতে, পায়ে ছোটবড় মিলিয়ে আরও সতেরোটা কোপ। জাইলোকেন আগেই ফুরিয়েছে। এখন অবশ না করেই স্টিচ করে চলেছে বিভাস। তার কয়েক দশকের অভিজ্ঞ চোখ দেখতে পাচ্ছে লোকটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। এর দরকার ছিল ইন্ট্রাভেনাস পেইনকিলার আর জোরালো অ্যান্টিবায়োটিক। আর এক্ষুনি দরকার চার বোতল রক্ত। এর মধ্যেও লোকটা উত্তরে খালি হাসল।

—জায়গাটা কিন্তু বেশ ভাল তাই না? বেশ একটা কান্ট্রিসাইড ফিল হচ্ছে। গাছগাছালি, আশেপাশের বাড়িগুলো বেশ পশ। একটু ভিতরের দিকে হলে রাস্তাঘাট যেমন মাটির ভিতরে ঢুকে যায় তেমন না। বেশ ভাল জায়গাতেই বাড়ি কিনেছে দেবাদা।

—ঠিক এই কথাটাই গিয়ে তোমার দেবাদাকে বোলো।

বউকে চোখ টিপে পাশে ডাক্তার ভার্গবের দিকে ফিরে বললেন ডক্টর ভরদ্বাজ— কেসটা হচ্ছে মাস ছয়েক আগে আমার কাছে যখন আসে তখনই সিভিয়ার ড্রাই আইজ্। অটোলোগাস সিরাম, পাঙ্কটাল প্লাগ— আমার তরফ থেকে যা যা করবার সবই করেছি। ওর প্রধান সমস্যা হয় এসিতে আর ডাইরেক্ট উইন্ডে। এখন বলছে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, খাবার খেতে পারছি না। এসিতে ঢুকলেই নাক, গলা থেকে বুক পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে, গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ওটি-টোটি তো সব বন্ধ করে দিয়েছে। পরাশরদার কাছে পাঠালাম, সে বলল টেস্টে কিছু ধরা পড়ছে না বলে ডায়াগনোজ করা যাচ্ছে না। বিশ্বরূপদা ইএনটির অবশ‍্য বলল নাক, মুখ ভালই ড্রাই। এখন তার নাকি এমন হয়েছে যে সে কোনও টাচ্ সহ্য করতে পারছে না। জল ছুঁতে পারছে না, জলে হাত দিলেই নাকি তার হাতের ময়েশ্চার চলে যাচ্ছে। কোথায় কোন মোক্তারকে দেখিয়েছে, পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত হোয়াইটস অব্ প্যারাফিন লাগিয়ে বসে থাকে। দশ হাত দূর থেকেই আপনি টের পাবেন। এই বাড়িতে আসার পরই তার এগুলো শুরু হয়েছে বলে তার ধারণা হয়েছে এ বাড়িটা তার স্যুট করছে না।

—সুপারস্টিশান।
—সুপারস্টিশান না থাকলে বাড়ির উঠানে কম্পাউন্ডার ডুবে মারা গেলে ঘরদোর বেচে দিয়ে কেউ চলে আসে? হেসে বলেন মিসেস ভরদ্বাজ।
—আরে, শ্রীদেবী কেস। বাড়ির পেছনে মাছের চৌবাচ্চার জন্য গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল। ড্রাঙ্ক হয়ে সে-হাঁটুজলেই… পেটে পড়েছে পানি, জল আর কাদাজলে তফাত পায়নি। তারপর থেকেই অশুভ অশুভ করে এখানে চলে এল। এখন তো বলছে এটাও নাকি অপয়া। এই যে, এই যে, মেহগনি গাছগুলো শেষ হলেই…।

একটা বড়সড় গেটের সামনে গাড়ি এসে থামে। পাঁচিল লাগোয়া মেহগনি, সেগুনগাছের সারি পেরিয়ে দুইদিকে ফুলের বাগানের মাঝে পাথর বিছানো পথ দিয়ে গাড়ি পোর্টিকোর সামনে এসে দাঁড়ায়। দুধ-সাদা শ্বেতপাথরের সিঁড়ির দুইদিকে সাদা চিনেমাটির উপর নীল নকশা করা গামলায় বেশ স্বাস্থ্যবান লাল রঙের অ্যানথুরিডিয়াম গাছ ফুলে ফুলে ভরে আছে। ভেতরে ঢুকতেই নরম মোলায়েম কাশ্মিরি গালিচায় পা ডুবে যায়। ঘরের অন্দরসজ্জা সাবেকি আর আধুনিকতার ফিউশন্। মাথার উপর স্ফটিকস্বচ্ছ ঝাড়বাতি, কালো সেগুনকাঠের আসবাব, দেওয়ালে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং আর ঘরের কোণায় পিতলের গামলায় ইতিউতি ইন্ডোর প্ল্যান্ট। টিপয়ের উপর কালো পাথরের গামলা থেকে গুছি গুছি সাদা পদ্মফুল উঁকি মারছে। সেই গামলার গায়ে ঠেকিয়ে কোনওমতে জায়গা করে নিয়েছে ডক্টর দেবাশিস চন্দের প্যারাফিন সিক্ত চরণযুগল। ঘরের অন্দরসজ্জার সঙ্গে ডক্টর দেবাশিস চন্দের বহিঃসজ্জা খাপছাড়াভাবে বেমানান। গায়ে সাঁটা জ্যালজেলে ধুতি, সি-থ্রু ফতুয়া, মুখজোড়া চশমার আড়ালে আয়ত দু-চোখ বুজে বসেছিলেন ডাক্তার চন্দ। তাদের গলা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকালেন। ডাক্তার ভার্গবের দিকে হাত বাড়িয়ে এক গাল হেসে বললেন, বিফোর টাইম। আসুন, আসুন। কম করে আরও আধ ঘন্টা ভেবেছিলাম। কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসি শেষ হয়ে গেল। বেশ বোঝা যাচ্ছে তাকাতে, চোখ খুলে রাখতে এমনকি হাসতেও কষ্ট হচ্ছে তাঁর।

—এই যে দাড়িগুলো দেখছ শ্যাম্পু করার সময় ওতে আমার আঙুলে ঘষা লাগে। রাতের বেলায় গলায়, হাতে ফোটে। তাও কাটতে পারছি না। কেন জানো?

মোলায়েম সুরে বললেন ডাক্তার দেবাশিস চন্দ। বরের চুলের ভেতর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন সুতপা। ভয়ঙ্কর রেগে গেলে বা খুব কষ্ট হলে তবেই দেবাশিসের গলা দিয়ে এমন মধু ঝরে। দেবাশিস উঠে পাশের ঘুপচি ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে এসি চালিয়ে ষোলোতে দিয়ে রিমোটটা সুতপার হাতের কাছে দিয়ে গেলেন। চোখে জল এসে গেল সুতপার। এখন মনের সুখে কাঁদতে পারেন তিনি। সে লাক্সারি তাঁর আছে। কত দুর্ভাগা সেই সব মানুষেরা যাদের বুক ফাটে, চোখ ফাটে না। দেবাশিসের মতো আরও অনেক মানুষ আছে নিশ্চয়ই যাদের চোখ ফাটে কিন্তু চোখের জলকে বাগ মানানো শিখে নিতে হয়। জন্মানোর আগেই শুকিয়ে নিতে হয় বুকের মধ্যেই। সুতপার যা দেখে চোখে জল আসছে তা তাকে সইতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। বিছানা পিঠ দিলেই জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, উপুড় হয়ে শুলে বুক, কখনও কাত হয়ে এপাশ-ওপাশ করে, কখনও চেয়ারে বসে সামনে ঝুঁকে একটু ঝিমিয়ে নেয় দেবাশিস। ঘুমের আর কী দোষ! এভাবে কি ঘুম আসে? আজকে নিয়ে কতদিন এভাবে কাটছে ওর? ওদের? এসিতে থাকলে শরীরে আরাম হয়, অবসন্ন শরীরে একসময় ঘুমিয়েও পড়ত হয়তো, কিন্তু তার সদ্য হওয়া ভয়ঙ্কর রকমের ড্রাই আইজ সে আরামে বাধ সেধে শুষ্ক চোখকে শুষ্কতর করে তোলে। সুতপা ভাবার চেষ্টা করে, অনুভব করতে চায় মুখের ভেতরটা কতটা শুকনো হলে পরে রুটি, বিস্কুট খেতে গিয়ে গালে ঘষা লাগে, জিভ ছুলে যেতে পারে! ভোজনরসিক মানুষের খাদ্যভাঁড়ার জলীয় খাবারে সীমিত থাকলে কতটা অসহায় লাগতে পারে! সুতপার মনে হয় তার কল্পনা যেন নাগাল পাচ্ছে না দেবাশিসের প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণার। দেহের যন্ত্রণা বোধহয় দেহাতীত নয়। তাই কি? যার ব্যাথা তার মতো করে কি আর কারও বুকে বাজে না? একেবারেই না?

অথচ এখন তো তাদের সুখের সময় ছিল! ছেলে লন্ডনে পড়তে গেল। প্রিন্স কলেজ। মেয়েও যাব যাব করছে। ছবির মতো সুন্দর সাজানো-গোছানো বাগানঘেরা বাড়ি। লাক্সারি গাড়ি। অপূরণীয় আর কিছুই তো নেই। এই থাকাগুলোর এই পাওয়াগুলোর আজ এই প্রমাণ-ঘরে, নরম গদিমোড়া প্রমাণ-পালঙ্কে শুয়ে বড় অর্থহীন মনে হচ্ছে। বাড়ির আকারের সঙ্গে শূন্যতার আকারও তো বাড়ে। বেলজিয়াম গ্লাসের ঝাড়বাতি, বিলিমোরিয়ার আসবাব, চাইনিজ ক্রকারি, অ্যান্টিক কালেকশনের সাধ্য কি সে ফাঁক পূরণ করে? মনকে বোঝায় সুতপা উপরে উঠলে আশেপাশের ভিড় হালকা হতে থাকে। এটাই দস্তুর। সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা কী সবচেয়ে শূন্য? শ্মশানের মতো?

উত্তরণের সঙ্গীর নাম অবসাদ। প্রগতিশীল আধুনিক মানুষ সংগ্রাম করে, কষ্ট সয়ে খুঁজেপেতে বাড়ি বয়ে আনে তাকে। অবসন্ন দুপুরে, পড়ন্ত রোদে বোকা বাতাসটা ছাতিমের গন্ধ বয়ে আনে। সুতপা জোরে নিঃশ্বাস নেয়। অনেকটা জোড়ে, এতটাই জোরে যে নিমেষে বুক ভরে যায় টগরপিসির নাড়ুর পাকের গন্ধে। পাখির মান-অভিমান, শিস দিয়ে গান টপকে ভেসে আসে মানুষের ঝগড়া, হাসাহাসি, মান-অভিমান। সুতপা বুঝতে পারে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ঘুমের আর কী দোষ। কতক্ষণ আর না ঘুমিয়ে পারা যায়। ছাদে নাচানাচি করতে থাকে কতগুলো ছবি। পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো বাড়িগুলো, তাদের মানুষগুলো, তাদের ভাব-ভালবাসা। মানুষে-মানুষে, মানুষে-পোষ্যে না। মানুষে-মানুষে কথা বলা। চাকরবাকরকে নির্দেশ, কুকুর-বিড়ালকে আদর-ধমক না। কথা মানে পিএনপিসি, গল্প, ঝগড়া, আড্ডা। উত্তরণের পথে, প্রগতির চাপে একটা আস্ত বাড়ি, গোটা পাড়া, পাড়ার রাস্তা, দোকান, রোয়াক, শ্যামলকাকু, কাকিমা, উজ্জ্বলদা, মান্তু, টুম্পা, টগরপিসি ছবি… সব ছবি হয়ে গেল! বিভাস! তলিয়ে গেল বিভাস!

তারাপদ রায়ের কোনও একটা গল্পে পড়েছিলেন ডাক্তার চন্দ একটা লোক মারা যাওয়ার পর উঠে বসে দেখে, বেশ সুন্দর আরামদায়ক বিছানায় সে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে দিব্যি সাজানো-গোছানো ঘর দেখে নির্ঘাত স্বর্গে এসেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়। খিদে পেয়েছে কি পায়নি বোঝার আগেই রাশি রাশি ভাল ভাল খাবার হাজির। চর্বচোষ্য খেয়ে, পেট ফুলিয়ে, হাত পা ধুয়ে দেখে সময় গড়িয়েছে মিনিট দেড়েক। চোখের ভুল ভেবে সে কিছু করার না পেয়ে ঘুম লাগায়। ঘুম থেকে উঠে দেখে সময় গড়িয়েছে ওই মিনিট দুয়েক। যারাই আসে তারা সব সময় হাসিখুশি, ভব্য মার্জিত ব্যবহার। খেয়ে ঘুমিয়ে, ঘুমিয়ে খেয়ে একসময় তিতিবিরক্ত হয়ে লোকটা একসময়ে চিৎকার করে ওঠে, এর চেয়ে তো নরকই ভাল ছিল। ফিটফাট সুদর্শন মিটিমিটি হেসে বলে, এটাই নরক। কোথাও এতটুকু ময়লার আঁচড় না থাকা এই ধবধবে সাদা দেওয়াল, তকতকে মেঝে, কোথাও কিচ্ছু এলোমেলো না-থাকা, সবকিছু একেবারে পারফেক্ট করে গোছানো ঘরগুলো দেখে ডাক্তার দেবাশিস চন্দের সেই নরকের কথা মনে পড়ে যায় বারবার। একটা অভিশপ্ত বাড়ি, ব্ল্যাকহোলের মতো যেখানে ঢোকা যায়, বেরোনো যায় না। সময়ও যেখানে থেমে থাকে‌। একসঙ্গে থাকা মানুষগুলো যেখানে একা একা বাঁচে। অবসরপ্রাপ্ত মানুষদেরও আসলে অবসর বলে কিছু হয় না। অবসর থাকে শুধু মৃতদের। আলো সহ্য করতে পারেন না যিনি তাঁর জগৎ এখন আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকার। ডাক্তার ভার্গবের পরামর্শে পুঁচকে ঘরে হিউমিডিফার চালিয়ে বসে থাকেন। আবছা অন্ধকারে এখন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান নিজের অন্ধকার জীবনটা বাদে। ঝুপ করে নেমে আসা এই অন্ধকারে খাবি খাচ্ছেন যেন। চোখ বুজে আসার পর একটা সময় থেকে ছুঁয়ে দেখতে শুরু করেছিলেন তিনি। ভাত, রুটি, আসবাব, ফুলদানি, বিছানার চাদর, বউ। সেক্সের সময় যে চোখের দৃষ্টিতে সুতপা ঘায়েল হত সেই চোখ দুটোই বুজে থাকলে মানুষটাকে কখনও কামুক পশু মনে হয়নি সুতপার। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে মিলন শব্দটার অর্থলুপ্তি ঘটে অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। মধুর সে শব্দটাকে আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছিলেন দুজনে। স্পর্শের খেলায় তিনি যে বেশ দর সে সার্টিফিকেট সুতপা তাঁকে একাধিকবার দিয়েছেন। কখন, কোথায়, কতটা আলতো, কতটা গভীরভাবে ছুঁলে বউ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাবে সে বিদ্যা তাঁর ভালই আয়ত্তে আছে বলে তাঁর একটা অহঙ্কার আছে এটা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। তিনি বর, নিজের হয়ে গেলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়া বর্বর নন। স্পর্শ! ছোঁয়া চাওয়া, ছোঁয়া দেওয়া! স্পর্শ এখন অল্প হলে অস্বস্তির, অনেক হলে আতঙ্কের।

—আহ! আলো জ্বালো কেন!

নুপূরের মা একহাত লম্বা জিভ দেখিয়ে চলে গেল। হঠাৎ আলোর অভিঘাতে চোখ টনটন করে উঠল দেবাশিসের। মনে মনে শাপশাপান্ত করতে লাগলেন বিভাসকে। আমার খুব ইচ্ছে তুমি একটু বিষ খাও, বলে আবদার করলে তিনি কি কপালে দাঁত তুলে বলতেন, হেঁ, হেঁ, আপনি যখন এত করে বলছেন তখন না করি কী করে? জানিস যখন খেলে হুঁশ থাকে না, খাস কেন? দামি, বিদেশি মদের নামেই নেশা ধরে যায় নাকি? নোলা! একটু সাধলেই, পাশে বসিয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলেই খেয়ে নেয় নাকি কেউ?

ডাক্তার ভার্গব মন দিয়ে অর্কিডের শিকড় পরীক্ষা করছিলেন। গ্লাসগোর কনফারেন্স থেকে সোজা চলে গিয়েছিলেন দিল্লি। পরপর লেকচার অ্যাটেন্ড করে ফিরে আসতে আসতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল এবার। ফিলোনোপসিসের পাতাগুলো পরিচিত হাতের ছোঁয়া না পেয়ে যেন একটু মুষড়ে আছে। জলের অভাব হওয়ার কথা নয়। প্রমাণ মাপের হিউমিডিফায়ার জায়গায় জায়গায় বসানো। আসলে নরম কাপড়ে আলতো হাতে তাদের প্রতিটা পাতা যত্ন করে যে হাতটা মুছে দেয় তার স্পর্শ ওরা ঠিক চিনে নেয়। ওরা ঠিক বুঝে কার হৃদয়ে ওদের জন্য মায়া আছে। সেই ছোঁয়াটা ওরাও পেতে চায়, পেলে খুশি হয় আর সেই খুশি খুশি ভাব, আনন্দ ফুটে বেরোয় তাদের ফুলের বাহারে, টগবগে স্বাস্থ্যে। আর প্রত্যাশিত ছোঁয়াটা যখন পায় না তখন তারা হতাশ হয়, এমনই মুষড়ে পড়ে। কিন্তু না, টেবিলের তলায় ছায়ায় রাখা এই ফিলোনপসিসের চারাগুলো একেবারে নেতিয়ে গেছে। ডক্টর ভার্গব টব হাতে নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছিলেন এমন সময়ে ডক্টর ভরদ্বাজ পেছনে এসে দাঁড়ালেন নিঃশব্দে।

—এই গাছটা দেখছ অনিল, এর পাতাগুলো শুধু….
—এই জন্যেই আপনার ছাত্ররা এখনও বলে আপনি তিনশো ষাট ডিগ্রিতে দেখতে পেতেন।

মৃদু হাসলেন ডাক্তার ভার্গব— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চোখগুলো বয়স্ক মাস্টারমশাইদের গজিয়ে যায়… পাতাগুলো শুধু নেতিয়েই যায়নি, কুঁচকে যাচ্ছে। তোমার বন্ধুর ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটছে।

—ওর বায়োপসি রিপোর্ট এসেছে আজ।
—কিছু পাওয়া যায়নি তো? আমাদের ডাক্তারদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে না মিললে আমরা কেসটাকে সাইকিয়াট্রির দিকে ঠেলে দিই। নতুন জিনিস ভেবে গবেষণা করে দেখবার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
—গবেষণার জন্য তো আগে ফ্যাক্টসগুলোর উপর আস্থা থাকতে হবে।
—দ্যাটস মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। ইট হ্যাজ টু বি ট্রিটেড অ্যাজ ফ্যাক্ট। ডাক্তার খুরানা, সফদরজং হাসপাতালের। সেও অনিল, আমার খুবই স্নেহভাজন। তার এক পেশেন্ট ছিল যে একইরকম স্কিনের সমস্যা নিয়ে গিয়েছিল তার কাছে। নার্ভাস সিস্টেম হাইপার স্টিমুলেটেড হয়ে ছিল। তার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন এমিট্রিপ্লিন চার্জ করে নার্ভাস সিস্টেমকে শান্ত করা হয়েছিল। কোনওরকম স্ট্রেস হলে সমস্যা অ্যাগ্রাভেট করত। সেজন্যে তোমার বন্ধুর সাইকোলজিকাল অ্যাসপেক্টটাও খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার সঞ্জয় জানালেন ওর কোনও বিষয়েই কোনওরকম উদ্বেগ নেই। বরং বললেন হি ইজ কোয়ায়েট স্ট্রং নার্ভড। আবার এরকম বেশ কিছু কেস পাওয়া গেছে যাদের এই একইরকম সিম্পটম দেখা গেছে যেগুলোর আপাতদৃষ্টিতে কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের ক্ষেত্রে সিম্পটম ধরে ধরে চিকিৎসা চলেছে। কিন্তু তোমার বন্ধুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম মনে হচ্ছে, ঠিক এই ফিলোনোপসিসের মতো।
—কী?
—ও আক্রান্ত জলশূণ‍্যতায়। এটা মনে করা যেতে পারে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওর শরীরের সমস্ত অঙ্গে একে একে জলের অভাব ঘটছে।