রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
লেক গার্ডেন্স দিয়ে গাড়িটা বেশ জোরেই চলছে। এ-সময়টা রাস্তা ফাঁকা থাকে। রবীন্দ্র সরোবরের সাত নম্বর গেটের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথের বিরাট মূর্তিটা মনে হয় যেন সব গতিকেই নিশ্চল করে দেয়। সৌম্য শান্ত স্থিতপ্রাজ্ঞ একটি মূর্তি। কিন্তু বর্ণমালার প্রিয় ‘প্রকৃতির প্রতিশোধের’ রবীন্দ্রনাথের সেই ছবিটা! তরুণ রবীন্দ্রনাথ কী অসম্ভব দার্ঢ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ছবিটার একটি মূর্তিও সে এই শহরেই কোথাও দেখেছে। কোথায় মনে পড়ছে না! কিন্তু মূর্তিটা দেখে সে চমকে উঠেছিল। তরুণ রবীন্দ্রনাথ যেন এখনই কথা বলে উঠবেন! কী পৌরুষ! এসব ভাবতে ভাবতেই ক্যাবটা এসে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একজন হিজড়ে এসে গাড়ির জানলায় ঠক ঠক করছে। বর্ণমালা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে! মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। ওর হাতে দশটা টাকা দেয়। হিজড়েটি মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে চলে যায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
কলেজে আজ বেশ কয়েকটা ক্লাস আছে। স্টাফরুমে বসে মনে মনে সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিল বর্ণমালা। তিথি এসে হাজির কাঁধের কাছে। কি গো, আজ কটা ক্লাস?
—আছে চারটে।
—আমারও… আর বোলো না, আজকে সকালে পিরিয়ড হয়েছে। এই অবস্থায় ক্লাস নিতে ভাল লাগে!
বর্ণমালা মাথা নাড়ে, কিছু বলে না।
তিথি বইপত্র গোছাতে গোছাতে আরও কথা বলে। বর্ণমালার কানে ঢোকে না। এই মেয়েলি ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা হলে আজও ভিতরে ভিতরে তার অস্বস্তি হয়। সবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে আজও। কোনওদিন পারবে?
মা বলেছিল, তুই নারী, আদ্যন্ত একজন নারী। শুধু তোর শরীর গড়তে গিয়ে ঈশ্বর ভুল করে ফেলেছেন। কিন্তু মন! মনটা তো তোর খাঁটি মেয়ের মন!
সেই ছোট থেকে এ-কথাগুলোই বর্ণমালা বিশ্বাস করে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তার নারী ছাড়া অন্য কিছু কখনও মনেও হয়নি। কিন্তু অসম্পূর্ণ একজন নারী। নারীত্বের কোনও অনুভবই তার জীবনে পাওয়া হয়নি। শুধু এটুকুই যে বাইরে থেকে তাকে সবাই নারী ভেবেছে। দীর্ঘ স্কুলজীবন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিজীবন…. সবখানেই সে মেয়ে। আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মায়ের! মা কি করে পুরো ব্যাপারটা ঘটাতে পেরেছিল ভাবলে আজও অবাক লাগে। জাল বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে যেসব জায়গায় লিঙ্গপরিচয়ের প্রয়োজন পড়ে মা সবখানে নারী হিসেবেই বর্ণমালাকে পরিচিত করিয়েছে। শুধু সাঁতার, নাচ এই ধরনের শরীরীবিদ্যার সঙ্গে বর্ণমালাকে কখনও যুক্ত হতে দেয়নি। গান, আবৃত্তি এসব শিখেছে বর্ণমালা। তার গলার আওয়াজ ভারী। কিন্তু তা পুরুষকণ্ঠ নয়। একটু কর্কশ বা পেলবতাহীন নারীকণ্ঠই। সেইজন্যই গানের দিদি প্রায়ই বলতেন, তোমার গলাটা ভারি তো! পুরুষের আবেদন তোমার গলায় ভাল ফোটে। ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেকদিনের পরে’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, এইসব গান দিদি তার গলায় বেশি শুনতে চাইতেন।
মা অবশ্য এসব কথাকে গুরুত্ব না-দিতেই শিখিয়েছিলেন। বলতেন, সুচিত্রা মিত্রর গলাও ভারি! তাই বলে কি উনি শুধু পুরুষের গান গাইবেন! গানের আবার পুরুষ-নারী কী!
নামটাও সেইজন্যেই মা এমন বেছেছিল, বর্ণমালা! সে শামসুর রহমান যতই ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ বলুন না কেন, বর্ণমালার তো সত্যি কোনও লিঙ্গপরিচয় হয় না। আমাদের বাংলা ভাষাতেই তো আস্তে আস্তে জেন্ডার বায়াসনেস উঠে যাচ্ছে, এখানেই তো বাংলা ভাষা হিন্দির তুলনায় অনেক এগিয়ে। বর্ণমালা খুব প্রয়োজনেও কখনও হিন্দি বলে না। ইংরেজি বলে, নয়তো বাংলা।
আজ ক্লাসে সেই ছেলেটা যথারীতি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে হাজার বকলেও ওর মনটাকে ও ক্লাসে বেঁধে রাখতে পারে না। বর্ণমালা বৈষ্ণব পদাবলি পড়াচ্ছে। অভিসারিকা রাধিকা মায়াময় জ্যোৎস্নায় কৃষ্ণের উদ্দেশে চলেছে। নীল রঙের কাঁচুলি, ওড়নায় অপার্থিব এক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি শ্রীরাধিকা। তার উদগ্রতা তাকে যেন আরও খানিকটা মোহময় করে তুলেছে। কুলের মর্যাদায় কাঁটা ফুটিয়ে, বজ্রনির্ঘোষকে উপেক্ষা করে উত্তাল যমুনা পার হচ্ছে কৃষ্ণলগ্না। বর্ণমালা পড়াতে পড়াতে ডুবে যায়। মনে হয় চোখে জল এসে যাবে! গলা ভারি হয়ে আসে। তার জীবনে তো এমন দিন কখনও আসবে না!
কিন্তু কোথায় কী! বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাসের এই ভাষার মূর্ছনায় মনই নেই ছেলেটার। বর্ণমালার রাগই হল। ওকে ডাকল। তুমি ক্লাসে এত অমনোযোগী কেন! বাইরে কী দেখছ তুমি!
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
—কী পড়াচ্ছিলাম বলো তো!
ছেলেটা একবার তাকায় বর্ণমালার দিকে। বলে, রাধার কথা।
—হ্যাঁ, রাধার কথা কী! কী বলছিলাম! কোন্ পর্যায়ের কথা বলছিলাম!
ছেলেটা চুপ।
—শোনো, তুমি ক্লাসের পর আমার সঙ্গে দেখা করবে।
বলে বর্ণমালা আবার কৃষ্ণপ্রেমে ডুব দেয়।
ছেলেটা কোরিডোরে অপেক্ষা করছিল। স্টাফরুমের ভিতর থেকে ওকে দেখতে পেয়ে বাইরে আসে বর্ণমালা। হ্যাঁ, বলো তো, তোমার সমস্যাটা কোথায়! আমি অন্যান্য প্রফেসরের কাছেও শুনেছি, তোমার ক্লাসে একেবারে মন নেই। কী সমস্যা তোমার? পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই!
ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও কথা বলছে না।
বর্ণমালা ওকে দেখছে। তেমন কোনও বিশেষত্ব নেই চেহারায়। একটু মেয়েলি গোছের জেশ্চার। হাতদুটো সামনে জড়ো করে একটু যেন গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মুখ জুড়ে অদ্ভুত বিষণ্ণতা! চোখের কোলে কালি। বড় বড় চুলগুলো একটা হেয়ারব্যান্ড দিয়ে পিছনে ঠেলে দেওয়া।
বর্ণমালার কেমন যেন মনে হয়, ওর অন্যমনস্কতার পিছনে অন্য কারণ আছে। পড়াশোনায় অনীহা যেন ঠিক নয়। বর্ণমালা ওর কাঁধে হাত রাখে।
ছেলেটা চমকে উঠেছে। আরও একটু যেন গুটিয়ে নিল নিজেকে।
—কী হয়েছে তোমার? কী অসুবিধে? তুমি আমাকে বলতে পার।
ছেলেটা বর্ণমালার দিকে তাকায়। আবার মাথা নিচু করে নেয়।
—দেখো, এভাবে ক্লাস ফলো না করলে তুমি তো ভাল রেজাল্ট করতে পারবে না। তার থেকে তোমার কী সমস্যা সেটা বললে, আমি সেটাকে সলভ করার চেষ্টা করতে পারি।
ছেলেটা তাকিয়ে আছে বর্ণমালার দিকে। ওকে দেখে মনে হয়, ও কিছু বলতে চায়! ওর চোখদুটো একমুহূর্তের জন্য যেন একটু আলো হয়ে ওঠে। তারপর আবার নিভে যায়।
বর্ণমালা ওকে ছেড়ে দেয়। মনে মনে ওর প্রতি নজর রাখবে ঠিক করে।
আজ ওরা সবাই মিলে নিউমার্কেট এসেছে। তিথি, ভামহী, বর্ণমালা, সুলগ্না। নানা জিনিস কেনাকাটা চলছে। বর্ণমালা যে খুব কিছু কিনছে তেমনটা নয়। ওর বিশেষ সাজগোজের বালাই নেই। যে-অপূর্ণতা নিয়ে ওর জীবন কাটছে এবং কাটবে তাতে সাজগোজ করা নেহাতই বাহুল্য। কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক-দুজন তাকে নানা ইঙ্গিত দিয়েছিল। তারও যে কিছু মনে হয়নি এমনটা নয়। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে মায়ের সাবধানবাণী প্রতি মুহূর্তে তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে।
—আর যাই করিস না কেন বর্ণ, কখনও প্রেম নয়! বিয়ে নয়! তুমি জানবে তুমি বিশেষ। তোমার সঙ্গে কারও মেলে না। জানাজানি হলে মানসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে না।
বর্ণমালা মায়ের সঙ্গে তর্ক করেছে। তুমি ঠিক বলছ না মা। পৃথিবীটা কোথা থেকে কোথায় এগিয়ে গেছে তুমি জানো না! ট্রান্সজেন্ডারদের, এফিমিনেটদেরও এই সমাজের বুকে বাঁচার অধিকার আছে। পৃথিবীতে এ নিয়ে কত আন্দোলন হচ্ছে তুমি জানো!
—যত আন্দোলনই হোক না কেন সমাজ আজও তোমাকে, তোমাদের সম্মানের চোখে দেখে না। সারাজীবন তোমাকে লুকিয়ে রেখেছি, তাই। নইলে পারতে রাস্তায় রাস্তায় তালি বাজিয়ে বাজিয়ে ভিক্ষে করতে!
—সুযোগ পেলে ওরাও পড়াশোনা করে একটা সম্মানের জীবন বেছে নিতে পারত মা। সমাজ ওদের সে সুযোগ দেয়নি।
—সেটাই সত্যি। সমাজটা এখনও শত শত বছর পিছিয়ে আছে, সে তোমরা দু-চারজন যতই না কেন এগিয়ে যেতে চাও! তোমাদের পিছন থেকে টানবেই এই সমাজ।
—তাই বলে চিরজীবন এই অপূর্ণতা নিয়ে বাঁচব! শুধু সমাজের ভয়ে!
—হ্যাঁ, তাই। জীবনে সবাই সব কিছু পায় না। তুমি ধরে নাও এই অপূর্ণতাই তোমার ভবিতব্য। তবু বাইরের লোকের কাছে তুমি মেয়েমানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারছ, এটাই কি যথেষ্ট নয়!
বর্ণমালা চুপ করে যায়। অধিকারের কথায় ভাগ্যবিড়ম্বনা এনে ফেললে আর বলার কিছুই থাকে না। আজকাল মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এমন তর্কই হয়। নিজেকে অবদমিত করে রাখতে রাখতে বর্ণমালা হাঁপিয়ে উঠেছে। পুরুষবর্জিত তার এই জীবন, চূড়ান্ত একাকিত্ব তাকে যেন মাঝে মাঝে শূন্যে ফেলে দেয়। সে স্বপ্ন দেখে জলের অতলে সে তলিয়ে যাচ্ছে। কোনও অবলম্বন নেই, প্রেম নেই। প্রেমহীন একটা জীবন সে কাটাবে কেমন করে! স্নানের সময় বাথরুমের বড় আয়নাটায় নিজেকে দেখে নিজেরই তার কেমন খাপছাড়া অদ্ভুত মনে হয়। তার নিটোল স্তন, সুডৌল বাহু, গভীর নাভি কোনও পুরুষের স্পর্শ পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছে। অথচ তার নিচে চোখ গেলেই সব আকাঙ্ক্ষা, সব কাতরতা সব কিছু কী প্রবল প্রশ্নচিহ্ন হয়ে তাকে যেন ব্যঙ্গ করে। তার কতবার মনে হয়েছে সে অপারেশন করিয়ে নেবে। কিন্তু ডাক্তারকাকু বারবার নিরস্ত করেছেন। মা-বাবা ছাড়া একমাত্র ডাক্তারকাকুই জানেন সবকিছু। ছোটবেলা থেকে ডাক্তারকাকু ছাড়া অন্য কোনও ডাক্তারের কাছে মা তাকে কখনও নিয়েও যায়নি। ডাক্তারকাকু বাবার বিশেষ বন্ধু। বাবার অনুরোধেই এই সত্যি চিরকাল গোপন রেখেছেন। কিন্তু আর কতদিন! আর কতদিন সে এভাবে বাঁচতে পারবে! আর কেনইবা! সে তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এ সমাজ তাকে খাওয়ায় না, পড়ায় না। তবে শুধুমাত্র সমাজ সম্মান করবে না বলে সারাজীবন সে এই সাপ্রেশনের মধ্যে থাকবে!
তার মনে পড়ে যায় সুজয়ের কথা। সুজয় যেন পাগল হয়ে উঠেছিল তার জন্য। খাওয়া নেই, ঘুম নেই ছেলেটা কেমন উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা পর্যন্ত বর্ণমালাকে নানাভাবে অনুরোধ করেছিল।
—সুজয় খুব ভাল ছেলে বর্ণ। ও তোকে জেনুইনলি ভালবাসে। তোর এত আপত্তি কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তোর যদি অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকত, তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু তুই তো সিঙ্গেল। তাহলে? সুজয়কে তোর পছন্দ নয়!
বর্ণমালা কোনও জবাব দিতে পারেনি এসব কথার। এই নিয়ে মনোমালিন্য হয়ে দু-একজন বন্ধু বর্ণমালার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। সুজয়ও সরে গেল। কিন্তু এই চল্লিশ বছর বয়সেও বিয়ে করেনি। ও বোধহয় আজও মনে মনে অপেক্ষা করে আছে বর্ণমালার জন্য।
আর বর্ণমালা! সেও কি সুজয়কে তার সবটুকু উজাড় করে দিতে চায়নি? তার গোপন সত্যিটুকু বলে ফেলে উন্মুক্ত পাখির মতো সুজয়কে নিয়ে আকাশে উড়তে চায়নি! কতবার কতবার যে সে মনস্থির করে এগিয়েও পিছিয়ে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যাখানের ভয় তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। সমাজ-সংসার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু সকলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
কিন্তু গোটা পৃথিবীতে এত এত মানুষ যে লড়ছে নিজেদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে! তাদের মধ্যে একটু জায়গা করে নিতে পারত না বর্ণমালা? তারা সংখ্যায় কম, কিন্তু ভরসায় অনেক বেশি। তাদের সঙ্গে থেকে একই লড়াইয়ের ময়দানে দাঁড়িয়ে সে যদি নিজের প্রকৃত পরিচয় বেছে নিতে পারত, তাহলে সেই জীবনটাই কি অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে উঠত না? এ সে কার জীবন বাঁচছে? এ তো সে নয়! নারী হয়েও যে অপূর্ণতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে তার থেকে মুক্তি কোথায়! সে সুজয়কে চায়, তার নিজের সন্তান চায়! কিন্তু এসব তো অলীক কল্পনা তার জন্য! তার জীবন তো আসলে গোপনীয়তা ছাড়া আর কিছু নেই। সেই ছোটবেলা থেকে সে তো এই ভয়েতেই সময় পার করে ফেলল যে, যেন কেউ তার সত্যিটা না যেনে যায়! এই উদ্বেগ আর অবদমন তার জীবনের শেষ সত্য হয়ে থাকল! আর সব শূন্য।
সেদিন লাস্ট ক্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে কোরিডোর দিয়ে স্টাফরুমের দিকে এগোচ্ছিল বর্ণমালা। দুপাশে ফাঁকা ফাঁকা ক্লাসরুম। হঠাৎই চোখ আটকে গেল একটা ক্লাসরুমের দিকে। সেই ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে। ওর মোবাইলে খুব মৃদু স্বরে বাজছে, ‘বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা’। বর্ণমালা আস্তে আস্তে ওর কাছে এগিয়ে যায়। ওর কাঁধে হাত রাখে। ছেলেটা চমকে উঠে তাকায়। বর্ণমালা দেখে ওর চোখে জল। দু-গাল বেয়ে জলের ধারা!
এক সেকেন্ডের মধ্যে বর্ণমালার চোখ জ্বলে ওঠে। হঠাৎই যেন ছেলেটার মেয়ে-মেয়ে হাবভাব, বিষণ্ণ চাহনি, আর এই গান ও মিলিয়ে নেয়।
—এইজন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছ? নিজেকে প্রকাশ করতে পারছ না! তাই তুমি এত অমনোযোগী! তাই তুমি ক্লাসে কারও সঙ্গে মেশো না! এতদিন আমাকে বলোনি কেন! এতদিন ধরে এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ!
বর্ণমালা হাত বাড়িয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটি খুব অবাক হয়। কিছু বলতে চায়! কিন্তু বর্ণ ওকে বেঞ্চ থেকে টেনে তুলে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। গোটা কলেজে তখন দু-একজন আছে হয়তোবা। কোরিডোর নিস্তব্ধ। কিন্তু পশ্চিমের আলোয় আলো হয়ে উঠেছে কোরিডোরের একাংশ। সে আলো যেন ঝলসে দিচ্ছে সবটুকু স্থিতবস্থা। বর্ণমালা ছেলেটির হাত ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় সেই আলোর সামনে! ছেলেটির বিষণ্ণ চোখে সেই আলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।