অনুরাধা কুন্ডা
অধিকাংশ পাঠক ব্যাপক এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকার সঙ্গেই পরিচিত অতএব তাদের দৃষ্টি নাম এবং প্রতিষ্ঠার দিকে। অপ্রতিষ্ঠিত লেখক যারা, তাদের মূল সমস্যা হল এই যে তাদের লেখা অপঠিত থেকে যায়। অপ্রতিষ্ঠিত শব্দটি বাদও যদি দিই তাহলে কম পরিচিত লেখক যারা তাদের কথা বলতে হয়। শো-বিজের যুগে সঙ্গীত প্রোডাক্ট, নৃত্য প্রোডাক্ট এমনকি সম্পর্কও যেখানে প্রোডাক্ট সেখানে সাহিত্যও একটি প্রোডাক্ট হতে বাধ্য
আর্ট ফিল্ম বা কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে আলাদা করে কিছু হয় না। হয় গুড ফিল্ম বা ব্যাড ফিল্ম। ভাল ছবি বা খারাপ ছবি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বড় পত্রিকা বা ছোট পত্রিকা। লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তার মানে কি ভাল পত্রিকা আর খারাপ পত্রিকা? আমজনতার মনে বড় পত্রিকা অর্থাৎ কমার্শিয়াল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার কদর আলাদা বৈকি! আমজনতার কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। তথাকথিত ইন্টালেকচুয়ালদের মধ্যেও কমার্শিয়ালি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার প্রতি ঘোরতর দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যের নাসিরউদ্দিন শাহরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে আদতে ব্যাপারটা ভাল পত্রিকা বা খারাপ পত্রিকা। সামগ্রিকভাবে ভাল পত্রিকা মানে সেখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা থাকবে। সে-পত্রিকার বাণিজ্য ভাল হবে। লেখক প্রতিষ্ঠা কিসে পান? এই জনপ্রিয়তার মান বিচার করেন কারা? অবশ্যই পাঠক। এই কথা বললেই অবধারিত প্রশ্ন উঠে আসে কোন পাঠক লেখকের জনপ্রিয়তার মান নির্ধারণ করেন? দীক্ষিত পাঠক না অদীক্ষিত পাঠক? বেশ কিছুদিন হল সারা পৃথিবীতেই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শুরু হয়েছে। থিয়েটার অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শুরু হয়েছে। অর্থাৎ শুধু ফিল্ম বা থিয়েটার দেখতে গেলেই হল না। কীভাবে তাকে দেখতে হবে সেটা বোঝার কিছু নির্ধারিত উপায় আছে। এইসব কোর্স শুরু হয়েছে দর্শককে দীক্ষিত করে তোলার জন্য। সাহিত্য পাঠের কি এমন কোনও উপায় আছে? প্রথাগতভাবে যারা সাহিত্য শিক্ষা করেন, তাদের একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অবশ্য তাতেই যে সাহিত্য পাঠের বা রসাস্বাদনের সম্পূর্ণ পাঠ হয় তা নয়, কিন্তু একটা রূপরেখা তৈরি হয়। তৎসত্ত্বেও অনেক সময়ই প্রকৃত পাঠক তৈরি হয় না।
পাঠক রুচি তৈরি হয় তখনই যখন পাঠকের ক্রিটিকাল থিঙ্কিং-এর অভ্যেস হয় এবং তার ওপরেই নির্ভর করে সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তার মান। বিষয়গত দিক থেকে, ভাষাগত দিক থেকে, ন্যারেটিভগত দিক থেকে সাহিত্যজগতে মূল এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু হয়েছে দীর্ঘদিন। পাঠক তার সঙ্গে কতটা পরিচিত, তার ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং লেভেল কতখানি পরিণত, একজন পরিশীলিত এবং পাঠক হিসেবে তার এক্সপোজার কতটা, এই সমস্ত কিছুর উপরে নির্ভর করে পাঠক-লেখক সম্পর্ক। জয়েসের ইউলিসিস এবং হ্যারল্ড রবিন্স-এর উপন্যাসের পাঠক যেমন এক নন, উস্তাদ রশিদ খানের গানের শ্রোতা এবং বাপি লাহিড়ীর গানের শ্রোতা যেমন আলাদা, ঠিক তেমনি তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত লেখকের পাঠক আলাদা। দীক্ষিত পাঠক প্রতিষ্ঠিত লেখক ও অপ্রতিষ্ঠিত লেখকের পার্থক্য করেন না। প্রকৃত পাঠক সব ধরনের লেখা পড়েন। বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক সমস্তরকম পত্রিকার সঙ্গে তার পরিচিতি থাকে। প্রতিষ্ঠিত লেখক ও অপ্রতিষ্ঠিত লেখক উভয়ের লেখার স্বাদগ্রহণে তার অভ্যাস থাকে। কিন্তু বাস্তবে এইরকম দীক্ষিত পাঠক কতজন?
অধিকাংশ পাঠক ব্যাপক এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকার সঙ্গেই পরিচিত অতএব তাদের দৃষ্টি নাম এবং প্রতিষ্ঠার দিকে। অপ্রতিষ্ঠিত লেখক যারা, তাদের মূল সমস্যা হল এই যে তাদের লেখা অপঠিত থেকে যায়। অপ্রতিষ্ঠিত শব্দটি বাদও যদি দিই তাহলে কম পরিচিত লেখক যারা তাদের কথা বলতে হয়। শো-বিজের যুগে সঙ্গীত প্রোডাক্ট, নৃত্য প্রোডাক্ট এমনকি সম্পর্কও যেখানে প্রোডাক্ট সেখানে সাহিত্যও একটি প্রোডাক্ট হতে বাধ্য।
হর দয়াল চিন্তা করল একই টেবলে বসে অন্যের টেবল ম্যানার্স নিয়ে আলোচনা করা ইংরেজ আভিজাত্য কিনা ঠিক তার জানা নেই যদিও ও ছোকরার ইংরেজিটা উচ্চারণে ও শব্দ বাছাইতে ভালো কিন্তু তার কোনো কোনো চিন্তা জিহ্বায় ধারালো না হয়ে চোখের কোণে ঝকঝক করে।
অথবা
শেক্সপিয়ারের ব্যাকরণ আর বানান এখনকার কোনো ছাত্র ব্যবহার করলে সে সব প্রশ্নেই কি জিরোর বেশি পাবে? কিংবা এদেশের কৃষকের ধর্মজ্ঞানের কথা ভাবো এক অক্ষর পড়তে লিখতে জানে না কিন্তু শুন দেখি তার কথা। মূর্খ বলবে? অথচ কলকাতার ভাষাবিজ্ঞানের নিরিখে তারা মূর্খের অধম।
–রাজনগর। অমিয়ভূষণ মজুমদার
অমিয়ভূষণের এই ঝকঝকে সাবলীল ভাষা, সপ্রতিভতা, বিষয়ের গভীরতা এবং ন্যারেটিভের কাটাকাটা তীক্ষ্ণতা কতিপয় পাঠকের কাছে সীমাবদ্ধ থাকল। বহুল জনপ্রিয়তায় পৌঁছাতে পারল না। অমিয়ভূষণের মতো বাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখেননি এমন বহু লেখক অপঠিত থেকে গেলেন পাঠকের কাছে।
গোষ্ঠীবদ্ধতা মানবধর্ম। অথচ এই ধর্মটি সাহিত্যজগৎ ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে থাকেন ব্যবসায়িক স্বার্থে, পিআর-এর খাতিরে। পিআর আধুনিক জীবনে একটা বেজায় জরুরি জায়গা দখল করে থাকে। পার্সোনাল রিলেশন।
তার মানে এই নয় যে পিআর ছাড়া বৃহত্তর সাহিত্য পরিমণ্ডলে জায়গা মেলে না। বহু মেধাবী লেখক স্বীয় দক্ষতায় পাঠকের কাছে যেতে পেরেছেন। অতএব তার মানে দাঁড়ায় এই যে স্রেফ পিআর-এর জন্য অনেক ভুষি লেখা পাঠকমহলে ছড়িয়ে যায়। তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে। নামোল্লেখের প্রয়োজন নেই। অথচ অনেক প্রকৃত লেখক প্রান্তিক থেকে যান। অপঠিত থেকে যান। ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘হিরণ্যরেতা’ কখনও ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’-র ধারেকাছে পৌঁছাতে পারল না পাঠকসংখ্যার নিরিখে। যেমন অনেকাংশে অপঠিত দেবেশ রায় বা অভিজিৎ সেন। এঁরা বোধকরি সেই শরৎচন্দ্রীয় ভাষায় ‘লেখকদের লেখক’ হয়ে থেকে গেলেন। অধিকাংশ বাঙালি পাঠকের কাছে এঁদের এবং আরও অনেক প্রকৃত লেখকের লিখন তো দূরের কথা, নামটুকু পর্যন্ত অচেনা থেকে গেল।
অথচ প্রকৃত লেখক পিআর করতে পারেন না। তাঁর কাজ শুধু লিখে যাওয়া। তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব প্রকাশকের, সম্পাদকের। এইখানেই ব্যবসায়িক চক্র কাজ করে। কাজ করে পিআরের খেলা। দর্শক খাওয়ানো বলে একটা টার্ম আছে।
সেই খাওয়ানো এবং পরিবেশনের সঙ্গে প্রকৃত লেখনী কম্প্রোমাইজ করে না।
মনিয়াড়ি আশ্রমে গাড়ি গ্যারেজ করে, দুর্ভেদ্য গহীন জঙ্গল চিরে চিরে পাহাড়ের দিকে হাঁটা। বিনোদবাবুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। পাহাড়ে চড়ার অভ্যেস কখনো করেননি ফলে খানিকটা হেঁটেই হাঁপ ধরে যায় তার। প্রেম প্রকাশের কাঁধে হাতের ভর রেখে তবু কোনোক্রমে হাঁটা জারি রেখেছেন তিনি। “আর কেতোটা দূর?” জানতে চান। প্রকাশ আঙুল তুলে পাহাড়ের সুদূর চুড়ো দেখায়। মুখে বলে “এইতো আস্যে গেল আগুর চড়াইটো পির হালেই পৌঁছে যাইবেন।” অরুণের শরীর বেশ শক্ত সমর্থ। তবে গল গল করে ঘামছে। অথচ বাতাসে শীতের আভাস এবং নানা রকম পোকামাকড় খিদেতে পেটও চুঁই চুঁই করছে। জিজ্ঞেস করে ফুরোবে হে এই চড়াই?
–হিরণ্যরেতা। অজিত রায়
এই ইতিহাসের সঙ্গে যদি পাঠক পরিচিত না হন, তবে সে তার দুর্ভাগ্য।
বাণিজ্যিক সাফল্য এবং শিল্পসৃজন সর্বদা সমান্তরালে চলে না। ইন ফ্যাক্ট, খুব কম চলে।
একথা তো সর্বজনবিদিত, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবির দর্শক সংখ্যা এবং রাজ চক্রবর্তীর ছবির দর্শকসংখ্যা ভিন্ন। মণি কাউলের ছবির দর্শক আরও কম। আমির খানের শ্রোতা এবং নচিকেতার গানের শ্রোতাও আলাদা হবেন, এটাও জানা কথা। শ্রুতি সিডোলিকারের নাম অশ্রুত। তাই বলে কি রাজকন্যা কম পড়েছে?
আলগা চটক এবং গ্ল্যামারের একটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। তার সঙ্গে সৃষ্টির বিশেষ যোগ নেই।
বাণিজ্যিক কাগজে অনেক ভাল লেখার সঙ্গে অনেক ভুষিলেখা থাকে। পুনরাবৃত্তিমূলক লেখা থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে দুর্বল লেখা জায়গা পেয়ে যায়, জনসংযোগের পারিপাট্যে দুর্বল লেখনী প্রচারের আলোতে এসে দুর্বলতর অশ্বডিম্ব প্রসব করে। গুড লিটারেচার অ্যান্ড ব্যাড লিটারেচর শেষ পর্যন্ত বিচার্য। গোষ্ঠী, ব্যবসা আর প্যাকেজিং-এর চাপে শেষ পর্যন্ত দুর্বল লেখা আলোতে চলে আসে। পাঠকের বিভ্রান্তির কারণ ঘটায়।
কিন্তু লেখক নিজের মতো লিখে যান। এতে তাঁর কতটুকু এসে যায়!