Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিপর্যয়ের মুখে প্রবাল প্রাচীরের ভবিষ্যৎ

নুপূর রায়চৌধুরী

 


গবেষকরা অনুমান করছেন আগামী ২০ বছরের মধ্যে, বিশ্বের প্রবাল প্রাচীরের ৭০-৯০ শতাংশ মারা যাবে। হাওয়াই-এর মানোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সম্প্রতিতম গবেষণার ফলাফল অনুসারে, গ্রহের প্রায় সমস্ত প্রবাল প্রাচীরের আবাসস্থল ২১০০ সালের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে! এর পিছনে আমাদের একটা বড়সড় ভূমিকা রয়েছে, ফলে এর সমাধানের জন্যেও আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে

 

আচ্ছা আপনি কি কখনো “কোরাল রীফ” ওরফে প্রবাল প্রাচীর দেখেছেন? বাস্তব জীবনে না হোক, সিনেমা বা, টিভির পর্দায়, বা মুঠোফোনের স্ক্রিনে সাগরতলের এই অরূপরতনের ছবি নিশ্চয়ই দেখেছেন; আর এটা বলার অপেক্ষায় থাকে না যে, তার সৌন্দর্যচ্ছটায় আপনি যার-পর-নাই মুগ্ধ হয়েছেন! হতেই হবে! মহাসাগরের কাচস্বচ্ছ নীলাভ জলের গভীর থেকে বিচ্ছুরিত প্রবাল প্রাচীরের উজ্জ্বল লাল, নীল, সবুজ, কমলা, অথবা বেগুনি রঙের চোখধাঁধানো প্রতিপ্রভ (ফ্লুরোসেন্ট) আলোর ছটা কাকেই বা না আকর্ষণ করবে?

কিন্তু, যদি এমন হয়, সেই রংঝলমলে প্রবাল প্রাচীর একদিন তার সব রং হারিয়ে বিবর্ণ, ফ্যাকফেকে সাদা হয়ে গেল, আপনি কি চমকে উঠবেন? হ্যাঁ, আমরা সকলেই তাই হব। কিন্তু, এটা কোনও কল্পকাহিনি নয়, কোরাল ব্লিচিংয়ের ফলে ঠিক এরকমটাই ঘটে চলেছে।

কোরাল ব্লিচিং

ভাবছেন, কেন এরকমটা হয়?

প্রাচীর তৈরি করে এমন বেশিরভাগ প্রবাল-কোষের ভিতরে ছোট ছোট মিথোজীবী শ্যাওলা জন্মায়, যাদের বলে জুক্সানথেলা, এরা সালোকসংশ্লেষণ-এর মাধ্যমে খাদ্য বানায় এবং প্রবালকে সরবরাহ করে। সাগরের জল যখন খুব উষ্ণ হয়ে যায়, জুক্সানথেলাগুলো প্রবালের শরীর থেকে বের হয়ে যায়, তখন প্রবাল তার গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের উত্স হারায় এবং সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়। একে বলে “কোরাল ব্লিচিং”। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রবাল ব্লিচিংয়ের প্রধান কারণ। এছাড়াও নানাপ্রকার দূষণের কারণে সমুদ্র-জল যদি ঘোলাটে হয়, বা প্রবালগুলো যদি পলিতে ঢেকে যায়, তবে সূর্যের আলো জুক্সানথেলাতে পৌঁছাতে পারে না এবং তখনও এমনটি হওয়া সম্ভব। অত্যন্ত কম জোয়ার, বা খুব বেশি সূর্যালোকের কারণেও ব্লিচিং হয়ে থাকে। যখন একটা প্রবাল ব্লিচড বা বিবর্ণ হয়ে যায়, সেটা অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়লেও তৎক্ষণাৎ মরে যায় না। যদি শেওলাগুলো প্রবাল-কোষে তাড়াতাড়ি ফেরত আসে, তাহলে প্রবালটি আবার সুস্থ হয়ে ওঠে, অন্যথায় সেটা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। প্রশ্ন হল, কোরাল ব্লিচিং হওয়ার জন্য কে দায়ী? এককথায় বলতে গেলে আবহাওয়ার পরিবর্তন। এই আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার আগে আসুন ছোট্ট করে জেনে নিই প্রবাল প্রাচীরের জীবনকথা।

প্রবাল হল একধরনের জটিল, বহুকোষী সামুদ্রিক জীব। রং ও আকারের ভিত্তিতে শত শত প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। প্রবালের শারীরিক কাঠামোকে বলে ‘পলিপ’। পলিপগুলোর প্রতিটা একে অপরের সঙ্গে একটি পাতলা তন্তুর স্তর (কোয়েনোসার্ক) দ্বারা সংযুক্ত থাকে। প্রজাতির উপর নির্ভর করে, প্রবাল পলিপগুলি এক ইঞ্চি থেকে কয়েক ইঞ্চি ব্যাস-এর হতে পারে। প্রতিটি নরম দেহের পলিপ চুনাপাথরের (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) একটি শক্ত বাইরের কঙ্কাল নিঃসৃত করে, এইরকম হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিপ সমুদ্রশিলা বা অন্যান্য পলিপের মৃত কঙ্কালের সঙ্গে জুড়ে জুড়ে তৈরি করে প্রবাল প্রাচীর— যেন চুনাপাথরের সুকঠিন মেঝের উপর ভাগাভাগি করে বসবাসী প্রবাল দলের এক নরমতরম জীবন্ত মাদুর। “বাডিং” বা “কুঁড়িজ প্রজনন” পদ্ধতির মাধ্যমে, মাতৃ পলিপ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে প্রবাল পলিপরা নতুন কলোনি ওরফে উপনিবেশ গঠন করে। প্রবালের জীবনচর্যায় “ফ্র্যাগমেন্টেশন” বা “খণ্ডন” প্রক্রিয়া আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যেখানে আলাদা করে শুধু একটা পলিপ নয়, গোটা উপনিবেশটাই শাখা-বিভক্ত হয়ে গিয়ে নতুন প্রবাল উপনিবেশ গঠিত হয়। ফ্র্যাগমেন্টেশন হলেই প্রবালগুলো আগের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পায় কারণ এটা প্রবালের নিরাময় এবং বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে, যাতে হারিয়ে যাওয়া পলিপগুলো প্রতিস্থাপিত হয়।

বিশ্বের মহাসাগর জুড়ে, অগভীর এবং গভীর উভয় জলেই প্রবাল পাওয়া যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র হল এই প্রবাল প্রাচীর, একেকটি প্রাচীরে হাজার হাজার প্রবাল প্রজাতির বাস; তাছাড়াও রয়েছে কমপক্ষে ৮,০০০ প্রজাতির মাছ আর অজস্র রকমের শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি।

যদিও প্রবাল প্রাচীরগুলি পৃথিবী-পৃষ্ঠের ১ শতাংশেরও কম জায়গা দখল করে আছে, কিন্তু, সাগরের জটিল বাস্তুতন্ত্রে প্রবাল প্রাচীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; সমস্ত সামুদ্রিক প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের বেশি জীবনধারণের জন্য তাদের উপর নির্ভর করে। ঝড় এবং ক্ষয় থেকে উপকূলরেখাকে রক্ষা করে এই প্রাচীর, স্থানীয় মানুষদের জন্য জীবিকার সংস্থান করে এবং বিনোদনের সুযোগ দেয়। তারা খাদ্য এবং নতুন ওষুধের উৎসও বটে। পৃথিবীর অর্ধ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ খাদ্য, আয় এবং সুরক্ষার জন্য প্রবাল প্রাচীরের উপর নির্ভর করে।

কিন্তু এই প্রবাল প্রাচীরগুলিই আজ মহা দুর্বিপাকের মুখোমুখি। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু-পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বিশ্বের বৃহত্তম এবং দীর্ঘতম প্রবাল প্রাচীর, অস্ট্রেলিয়ার সুবিখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে প্রবালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গণ ব্লিচিং ঘটে এবং প্রবাল প্রাচীরের মোট ৫০ শতাংশ মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। প্রবাল ব্লিচিং কমানোর জন্য অনেক প্রচেষ্টা করা হলেও, প্রাচীরের পুনরায় বৃদ্ধি এবং শূন্যস্থান পূরণ করা সুকঠিন প্রমাণিত হয়েছে।

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের গণ ব্লিচিং

এখানেই শেষ নয়: ২০২২ সালে, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে জরিপ করা প্রবাল প্রাচীরের ৯১ শতাংশ-ই ব্লিচিং দ্বারা প্রভাবিত বলে জানা গেছে। একইভাবে, হাওয়াইয়ের হনলুয়া বে, প্রশান্ত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া, ক্যারিবিয়ান-এর প্রবালপুঞ্জের সামনেও দুর্দিন আগত!

গবেষকরা অনুমান করছেন যে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে, বিশ্বের প্রবাল প্রাচীরের ৭০-৯০ শতাংশ মারা যাবে। হাওয়াই-এর মানোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সম্প্রতিতম গবেষণার ফলাফল অনুসারে, গ্রহের প্রায় সমস্ত প্রবাল প্রাচীরের আবাসস্থল ২১০০ সালের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে!

কি আঁতকে উঠলেন তো কথাটা শুনে? হ্যাঁ, এরকমই একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে বিশ্বের প্রবাল প্রাচীর। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, এর পিছনে আমাদের একটা বড়সড় ভূমিকা রয়েছে, এবং এর সমাধানের জন্যও কিন্তু আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আমরা একটু আগেই জেনেছি, জলবায়ুর পরিবর্তন প্রবালদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে।

সবার প্রথমেই যে বিপদের কথা মনে আসে তা হল, সমুদ্রের ঊষ্ণায়ন। যদিও সাধারণত ৭৩°-৮৪° ফারেনহাইট (২৩°–২৯° সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় প্রবাল সর্বোত্তমভাবে বৃদ্ধি পায়, মহাসাগরের জল যখনই খুব উষ্ণ হয়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে কোরাল ব্লিচিং শুরু হয়ে যায়। প্রবাল-কোষ থেকে জুক্সানথেলাগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মাত্র ২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো জলের তাপমাত্রার বৃদ্ধিই যথেষ্ট৷ বুঝতেই পারছেন প্রবালরা কতটা নাজুক প্রকৃতির! বেশিদিনের কথা না, এবছর  জুলাইয়ের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার দক্ষিণ উপকূলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ, ফ্লোরিডা কিস-এ ঘটল সেই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনাটা। জুলাই মাসে গড় দিনে, মেক্সিকোর পূর্ব উপসাগরের ফ্লোরিডা উপকূলে জলের তাপমাত্রা ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট-এর কাছাকাছি থাকে, কিন্তু এই গ্রীষ্মে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা ধাঁ করে ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট-এ চড়ে গেছিল। এই তাপমাত্রা-বৃদ্ধি এতটাই চরম ছিল, গবেষকরা বলছেন, যে তা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওখানকার বেশ কিছু প্রবাল প্রাচীরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। কোরাল রিস্টোরেশন ফাউন্ডেশনের একজন কর্মী সদস্য বেইলি থমাসন নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, “প্রবালগুলো ব্লিচ করার সুযোগও পায়নি, সরাসরি মারা গেছে ওরা।” বলতে বলতে শিউরে উঠছিলেন ভদ্রলোক।

এবারে আসি প্রবালের জন্য ক্ষতিকর দ্বিতীয় কারণটিতে, যা কিনা হল মহাসাগরের অম্লকরণ। শিল্পবিপ্লবের সময় (১৭৬০-১৮৪০) থেকেই আমরা শক্তির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো শুরু করি, সেই থেকে আজ অবধি, বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় ৩০ শতাংশই সমুদ্র শোষণ করেছে, ফলস্বরূপ সমুদ্রের রসায়ন বদলে গেছে, সমুদ্র আরও অম্লীয় হয়ে উঠেছে। খোলসা করে বলতে গেলে, শিল্পবিপ্লবের আগে সমুদ্রের পিএইচ ছিল ৮.২; আজ সেটা ৮.১। কী ভাবছেন? এ তো একটা ছোট্ট পরিবর্তন? হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হলেও, বহু সামুদ্রিক প্রাণী, বিশেষত, বিভিন্ন ধরণের শৈবাল, ক্রাস্টেসিয়ান এবং প্রবালের মতো ক্যালসিফাইং জীবের জন্য এটা কিন্তু একটা জবরদস্ত ধাক্কা। বর্ধিত অম্লতা তাদের বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে। আমাদের প্রবালরাও এর থেকে রেহাই পায়নি, বিলুপ্তির মুখে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য প্রবাল প্রাচীরগুলো।

জানি, আপনাদের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে— এর পিছনের রাসায়নিক কারণটা ঠিক কী?

সমুদ্রের জল যত বেশি অম্লীয় হয়ে ওঠে, তাতে, ক্যালসিয়াম কার্বনেট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কার্বনেট আয়নের ঘাটতি হয়; প্রবাল প্রাচীরের ক্যালসিয়াম কার্বনেট উৎপন্ন করার হার ধীর হয়ে আসে; প্রবাল কঙ্কালের বৃদ্ধি অনেক কমে যায়; সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে; এবং শেষমেশ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় যে মহাসাগরের অম্লকরণ জীবন্ত প্রবালের বৃদ্ধির হার যেমন হ্রাস করতে পারে, তেমনই মৃত প্রবাল-কঙ্কালগুলোকে বেশি বেশি দ্রবীভূত করতে পারে— সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জৈব ক্ষয়ের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে।

মহাসাগরের উষ্ণতা-বৃদ্ধি এবং অম্লকরণের পিছনে অপরাধী হল বায়ুমণ্ডলের বর্ধিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। শুধু জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, তেল এবং গ্যাস পোড়ানোর দ্বারা নয়, কৃষিকাজ এবং জমি পরিষ্কার করা, বন-ধ্বংসকরণ— এসবের মাধ্যমেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে; অতিরিক্ত তাপ পৃথিবী-পৃষ্ঠে আটকে যাচ্ছে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যেমন হিমবাহ এবং বরফের চাদর গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জানতে চান, কে করছে এইসব অপকাণ্ড? কেন? আমরা, মানবকুল!

মানুষ যে শুধু  এইভাবে, জলবায়ুর পরিবর্তন ডেকে এনেই ক্ষান্ত হচ্ছে,  তা তো নয়, তাদের অন্যান্য কার্যকলাপ যেমন উপকূলীয় উন্নয়ন, নির্মাণ এবং পয়ঃনিষ্কাশন, প্লাস্টিক দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা— এসবই প্রবাল প্রাচীরের প্রাণনাশের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশি কথার কচকচি না করে একটা উদাহরণ দিই বরং। অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ সাজাতে আমরা অনেকেই দারুণ ভালবাসি। এই মাছেদের অনেকগুলোকেই  সায়ানাইড ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে ধরা হয়, কারণ তা, মাছগুলোর খলবলানি বন্ধ করে দেয় আর তাদেরকে সহজেই ধরা যায়। সায়ানাইডের ব্যবহার প্রবল প্রাচীরের জন্য খুব খারাপ, তাই এটা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ইন্দো-প্যাসিফিকের চারপাশের প্রবাল প্রাচীরের জন্য এটাই আজ অন্যতম প্রধান মৃত্যু-কল হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন জাগে, আইনকে কলা দেখিয়ে কোন মর্কটরা এই ধৃষ্টতা দেখাবার সাহস করছে?

এতক্ষণ তো আমরা প্রবাল প্রাচীরের হ্রাস ও বিলুপ্তির সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম, এবার সমাধান খোঁজার প্রয়াসে আসি। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন এই সমস্যার প্রতিকারের চেষ্টায়। মূল উপনিবেশ থেকে ভেঙে আলাদা হয়ে যাওয়া প্রবালগুলোকে সংগ্রহ করছেন তাঁরা— তা টুকরোটাকরা হোক বা একটা পূর্ণগঠিত উপনিবেশের অংশ হোক। তারপর সেগুলোকে চাষ করে সংখ্যায় বাড়িয়ে ঘন প্রবালের নার্সারি গড়ে তুলছেন এবং শেষমেশ সেগুলোকে সিমেন্ট, জিপ টাই এবং পেরেক দিয়ে মূল প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে প্রবাল প্রাচীর পুনরুদ্ধার করতে সামুদ্রিক সংরক্ষণবাদীরা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপকরণ থেকে তৈরি সরঞ্জাম দিয়ে নানাবিধ আকার এবং শৈলীর কৃত্রিম প্রাচীর তৈরি করছেন।

একথা সুবিদিত যে, প্রবালের মতো ক্লোনাল প্রাণীরা প্রায়ই নিজেদের কলোনিগুলো জুড়ে জুড়ে একটা বড় উপনিবেশ গড়ে তোলে। প্রবালের জীবন-ইতিহাসে এই “কলোনি ফিউশন” হল স্থিতিস্থাপকতা রক্ষার মূল উপাদান। এর মাধ্যমে তারা বাসস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করা, সূর্যালোক, ও জীবনধারণের অন্যান্য রসদ নিজেদের ভাগে বেশি করে উপলব্ধ করা এবং ঘরে-বাইরের নানা চাপ থেকে নিজেদের পুনরুদ্ধার করার কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে। ‘’ফিউশন’’ দুই ধরনের হতে পারে: “আইসোজেনিক” বা জিনগতভাবে অভিন্ন তন্তু-ধারী প্রবালের সংমিশ্রণ, আর ‘’অ্যালোজেনিক’’ অথবা একই প্রজাতির জিনগতভাবে ভিন্ন প্রবালের সংমিশ্রণ। এই সব তথ্য মাথায় রেখে, হাওয়াই ইনস্টিটিউট অফ মেরিন বায়োলজির বিজ্ঞানী ডক্টর ফোর্সম্যানের নেতৃত্বে গবেষক দল বেশি জায়গা জুড়ে প্রবাল আবরণ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য মাইক্রো-কলোনি-ফিউশন কৌশল বেছে নিয়েছেন। সিরামিক টাইলসের উপর নিয়মিত ব্যবধানে একই ধরনের (আইসোজেনিক) প্রবাল উপনিবেশ থেকে ছোট ছোট (∼১ থেকে ৩ বর্গ সেন্টিমিটার) টুকরো নিয়ে তাঁরা প্রবালের জলজ চাষ করেছেন এবং আশ্চর্যভাবে তাঁরা লক্ষ করেছেন যে এতে প্রবালের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন যে আইসোজেনিক ফিউশন থেকে এইভাবে প্রবাল-আবরণ প্রতি মাসে অনায়াসেই দশ বর্গ সেন্টিমিটার বিস্তৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই কৌশলটি ব্যবহার করে, ফোর্সম্যানের দল বেশ কয়েক ধরনের প্রবাল যেমন অরবিসেলা ফাভিওলাটা, সিউডোডিপ্লোরিয়া ক্লিভোসা এবং পোরাইটস লোবাটার বৃদ্ধি লাভ করিয়েছেন। এই তিনটি প্রবালের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে যথাক্রমে ৬৩, ৪৮ এবং ২৩ বর্গ-সেন্টিমিটার পর্যন্ত জীবন্ত প্রবাল-তন্তু দ্বারা আবৃত এবং আচ্ছাদিত এলাকার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের সুদৃঢ় ধারণা, এই কৌশল প্রবাল প্রাচীর পুনরুদ্ধারের কাজে তাঁদের প্রভূত সাহায্য করবে।

এ তো গেল প্রবালের সংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা, নতুন প্রবাল সংযোজনের প্রয়াস। চলুন দেখি, ইতিমধ্যে বিদ্যমান প্রবাল প্রাচীর ভেঙে যাওয়া রোধে গবেষকরা কী পরিকল্পনা করছেন? হ্যাঁ, এ-নিয়েও অনেক চিন্তাভাবনা চলছে বৈকি!

এই প্রসঙ্গে মনে আসছে দুই সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীর কথা। ওঁরা হলেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবাস্টিয়ান হেনিজ এবং হেরিওট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের উয়ে উলফ্রাম। প্রকৌশল নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে অম্লীয় সমুদ্রে প্রবাল কঙ্কালের দ্রুত দ্ৰৱীভূতকরণ বা ‘’কোরালপোরোসিস’’-এর সঙ্গে অস্টিওপোরোসিস আক্রান্ত মানুষের হাড়ের বিচ্ছিন্নতার একটা দারুণ মিল খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যাবস-এর প্রত্যন্ত মাছ ধরার গ্রামে অবস্থিত তাঁদের সামুদ্রিক-গবেষণাগারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রবালদের রক্ষা করার জন্য হাড় নিয়ে গবেষণার ফলাফল ব্যবহারে করেছেন এঁরা। প্রবাল-দ্রবীভূত হওয়ার হার নিরীক্ষণ করতে এই জুটি এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যানের মতো চিকিৎসাপ্রযুক্তির সুবিধা নিতেও পিছপা হননি। তাঁরা এমন একটা অভিনব সতর্কীকরণ মডেল তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং ঠান্ডা জলের একটা প্রবাল কখন সঙ্কটপূর্ণ ভাঙনের ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, তা সুনিদ্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়েছে।

সবার শেষে বলি, এই প্রবাল প্রাচীর রক্ষার দায় কেবলমাত্র পরিবেশবিদ বা গবেষকদের নয় আমি, আপনি, আমাদের প্রত্যেকের। সেইজন্য পরিবেশ দূষণের ব্যাপারটা মাথায় রেখেই, ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে যে সামুদ্রিক আবর্জনা প্রবাল প্রাচীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক এবং তাই আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সঠিকভাবে আবর্জনার নিষ্পত্তি ও রিসাইক্লিং, কৃষিজমিতে সার ব্যবহারের হ্রাসকরণ, পরিবেশবান্ধব পরিবহণের ব্যবহার, রান-অফ স্টর্ম-ওয়াটার-এর পরিমাণ হ্রাস, বাড়িতে এবং কর্মক্ষেত্রে শক্তি সঞ্চয়, এবং অ্যাকোয়ারিয়াম-এর মাছ কেনার সময় সচেতনতা— এসবই প্রবাল প্রাচীর রক্ষার সহায়ক হবে।

 

তথ্যসূত্র: