প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আমরা আবারও ফিরে আসব ২০০৭ সালের মার্চ মাসের বাগবাজারে। সাহেব ওরফে সপ্তর্ষি আর রোহিতাশ্ব, যাদের নাম এখনও ভগা-রাইটু জানে না, ওদের ওপর যে হামলা হয়েছে, এ-কথা বেগুনিবাবুকে জানানো জরুরি। কারণ এসব এলাকায় এমন ঘটনা ঘটলে মুখে মুখে ছড়াতে কতক্ষণ! ভগা আর রাইটুর আজ জরুরি অপারেশন। এই দুই মালকে ফলো করতে গিয়ে ফালতু দেরি হল। কোন লরিতে বসের মাল হাপিস হচ্ছে, বসের বউকে যে মালটা খিস্তি করেছে, সে কতটা খতরনাক, এসব মাপার ব্যাপার আছে। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ!
বেগুনিবাবুকে খবরটা জানাল ভগা-ই। কিন্তু তারপর যা হল, তার জন্য ও প্রস্তুত ছিল না মোটেই।
বেগুনিবাবু পুরোটা শুনে প্রথমে চুপ করে রইলেন, তারপরেই বললেন, মালদুটো কোথায়?
—ওরা তো চলে গেল, বাইকে চেপে…
—ফলো করতে পারলি না বাঞ্চোত?
—না বস, মানে ওরা তো…
—এত চোপা করিস না!
শেষ কথাটা ওদিক থেকে এল ঠান্ডা গলায়। ভগা খানিকটা চমকেই গেল। বসের এই মুড সে চেনে। সে জানে, এরপর বসের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো আরও মুশকিল। কারণ একা বস নয়, ছেনো আর বাবলু রয়েছে। বসের পেটোয়া। রাইটুদা বলে, পার্মানেন্ট। ওরা, মানে ভগা-রাইটু, পার্টটাইম। ফলে ছেনো-বাবলু কাজে যতই কাঁচা হোক, ওদের রোয়াব আলাদা। আর বসের কাজে ভগা-রাইটু যতই পোক্ত হোক, ওরা সবসময়ই সেকেন্ডারি, এটাও রাইটুর ভাষায়।
কাজেই আজকের অপারেশনটা, যেটা করলে ওদের হাতে দু-পয়সা আসত, সেটা হাতছাড়া হয়ে ছেনো-বাবলুর হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ভগা রাইটুর দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে গলায় করাত চালানোর ভঙ্গি করে ইঙ্গিত করল, আজকের অপারেশন কাঁচি।
রাইটু নির্বিকার।
কিন্তু বেগুনিবাবুর পরের কথাটাই ভগার মুখের হাবভাব পাল্টে দিল।
—তোদের আজ অপারেশন আছে। যা। এই অপারেশনে তোদের আর লাগবে না। আমি ছেনো-বাবলুকে ফিট করছি।
মনে মনে হাসল ভগা। ছেনো-বাবলু কতদূর কী করতে পারবে জানা আছে। যদিও ভগা জানত না, আগের দিনই রোহিতাশ্বর পিছু নিতে গিয়ে একেবারে ল্যাজেগোবরে হয়েছে ওরা দুজন। তাও ওদের মুরোদ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে ওর। বসের কথায় চারটে গোদা মার্ডার আর এক্সটর্শন ছাড়া আর কিছুই পারে না। তাও সেসব বেশ মোটা দাগের কাজ। বসকে বারবার পুলিশকে ম্যানেজ করতে হয়।
ভগা বা রাইটু আদৌ চেয়েছিল নাকি এই অপারেশনটা করতে? এটা অযাচিতভাবেই ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আসল কাজ তো ওই বিল্ডারকে সালটানো।
এরপরেই বেগুনিবাবুর দিক থেকে আরও একটা প্রশ্ন ধেয়ে এল।
—অ্যাটাকটা কে করেছে? দেখলি?
ভগা বোঝাল কীভাবে ঘটেছে ঘটনাটা। একথাও বলল, আসলে অ্যাটাক নাও হতে পারে গোটা ব্যাপারটা। হঠাৎ করেই কোথা থেকে একটা ছুঁচোলো জিনিস উড়ে এসেছিল। যে চায়ের দোকানের সামনে কেসটা হয়েছে, তারাই মালটাকে রেখে দিয়েছে। কাজেই ঠিক কী ছুঁড়েছিল, বলা মুশকিল, ইত্যাদি।
বেগুনিবাবু একটু চুপ। তারপর বিড়বিড় করে একটা স্বগতোক্তি শোনা গেল ফোনের ওপার থেকে।
—ওই মালটার পেছনে আবার কে পড়ল!
—কোন মালটা বস? ওই আধবুড়োটা না ছোঁড়াটা?
ভগা বলেই বুঝল, অযাচিত কৌতূহল দেখাচ্ছে।
—মাল বলতে জিনিস।
আবারও বিড়বিড়। বলেই বেগুনিবাবু ফোঁস করল ওপার থেকে।
—বিল্ডারটাকে কচুকাটা করিস।
ভগা মজা পেল। খানিক উসকে দিতেই বলল,
—আর যদি ও রাবিশ না সরায়?
—তাও সালটাবি। ওর মুখ বড্ড বেড়েছে।
ভগা আরও মজা পেল। এই বিল্ডারটার সঙ্গে নিশ্চয়ই পুরনো বাওয়াল বসের। তার মধ্যে রাইটুদা বসের বউয়ের নাম করে যা লাগিয়েছে!
কলকাতা আর তার আশপাশে অত চট করে মার্ডারের সুপারি কোনও বিল্ডার বা প্রোমোটার দিতে চায় না। প্রফেশনাল লোচা হলে তো হার্গিস নয়। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, বেগুনিবাবু ব্যাপারটা বেশ পার্সোনালিই নিয়েছে। তাছাড়া এরকম আনখা বিল্ডার দুম করে বেশি বাজার গরম করলে তখনও একই রাস্তা। মোদ্দায়, খুনখারাপি কম হলেও, একেবারে যে হয় না, তাও আবার নয়।
ভগা ফোন রেখে রাইটুকে একটা চোখ মারল।
রাইটু এখনও নির্বিকার।
বনি এখনও হজম করে উঠতে পারেনি সেদিন বিকেলের কেসটা। বলেও উঠতে পারেনি কাউকে। বাপ্পাকে, তার দাদাকে তো নয়ই। গাঁজা বাপ্পা খায় বটে, বনি তো কোনওদিন ছুঁয়েও দেখেনি। কিন্তু এই কথা বনি বললে, অবধারিত একটা নেশার সন্দেহ কি ও এড়াতে পারবে?
কাকে বলবে তবে বনি কথাটা?
বাপ্পার মতো যখনতখন বাড়ি থেকে বেরোনো সম্ভব নয় বনির পক্ষে। তাও ওর মনে হচ্ছে, বাড়ি থেকে বেরোনো ওর প্রয়োজন। বাড়িতে আরও দমবন্ধ লাগছে বনির। এবং কিছুতেই বনি সঠিকভাবে ভেবে উঠতে পারছে না, ঠিক কী করা উচিত ওর। সবচেয়ে বড় কথা, ওর কাছে ব্যাখ্যাও নেই সেদিনের ঘটনাটার। আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবা প্রয়োজন, সত্যিই কী ঘটেছে। ও যা ভাবছে, তাই সত্যি? না কি অন্য কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে এই ঘটনার? ওর কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
ও আর অপেক্ষা করতে পারল না। বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে বাবা-মাকে বলে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে ও বুঝতে পারল, ওর এখনও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর।
এই অবস্থাতেই গলি থেকে বেরিয়ে বড়রাস্তায় এসে পড়ল বনি।
ঠিক এই সময়েই অ্যাকসিডেন্টটা ঘটল।
বনির বোধহয় দশ সেকেন্ড জ্ঞান ছিল না, কিন্তু ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গেছে ওর আশপাশে।
বনি চোখে প্রথমে আবছা দেখছিল। এবার একটু স্পষ্ট হল।
আবছা চোখেই ও দেখতে পেল একটা মাঝবয়সি কাঁচাপাকা চুলের লোককে। আর পাশে ওটা…
চিনতে পারল বনি। সাহেব ওরফে স্যাপি। পাড়ায় জিম করিয়ে ছেলে হিসেবে বেশ নামডাক ওর।
বনি কোনওক্রমে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচটা লোক এসে ঘিরে দাঁড়াল ওকে। ওকে ধরার জন্য।
ততক্ষণে ওই কাঁচাপাকা চুল আর জিম করা সাহেবকে ঘিরে এই মারে তো সেই মারে অবস্থা পাবলিকের। সাহেব পাড়ার ছেলে বলে সামলানোর খানিক চেষ্টা করছিল। শেষমেশ বনিই সামলাল। ওইই বোঝাল, দোষটা ওর। রাস্তায় না দেখে চলা ওর উচিত হয়নি মোটেই।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, রোহিতাশ্ব অন্যদিনের চেয়ে খানিকটা জোরেই বাইক ছুটিয়েছে। একটু আগে গঙ্গার ধারের ঘটনাটা ওকে বেশ কিছুটা অগোছালো করে দিয়েছে যেন। বড়রাস্তায় পড়তে না পড়তেই বনিও পড়েছে ওদের বাইকের সামনে। বনির পায়ে ধাক্কা লেগেছে। আর রোহিতাশ্বর তাৎক্ষণিক সাবধানতায় চাকাটা থেমে গেছে বনির মাথা প্রায় ঘেঁষে। কিন্তু ঘটনাচক্রে বনির কিছু হয়নি।
তাও রোহিতাশ্ব আর সাহেব ওকে ছাড়ল না। ওরা নিজেরাই খানিক জেদ ধরে ওকে পাড়ার অজিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
তখনও কেউই জানত না, এই পরিস্থিতি থেকে কোনদিকে মোড় নেবে ঘটনা।
[আবার আগামী সংখ্যায়]