সাত্যকি মজুমদার
আমরা যেন প্যালেস্তিনীয় মানুষের অভূতপূর্ব প্রতিরোধ, নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে তাঁদের অবিশ্বাস্য সাহস এবং আত্মপ্রত্যয়কে তার যথার্থ সম্মান দিতে সক্ষম হই। সংগ্রামের, বিশেষ করে দেশনির্মাণের সংগ্রামের নয়া পাঠ দিচ্ছে প্যালেস্তাইন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের থেকে সংহতি ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশিত নয়। সেই সংহতি জানানোর পথে আমরা যেন ইতিহাস-বিস্মৃত না হই। সেই সরল সত্য স্মরণ করি, বহুল-পঠিত ইতিহাস বিজেতাদেরই রচনা। পরাজিতের স্বর, তাঁদের বেঁচে থাকার উদ্দাম সংগ্রাম, আমরা যেন না ভুলে যাই
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ার সময়ে আমরা শিখেছিলাম একটি কথা— ভদ্রলোক শ্রেণির পরমুখাপেক্ষিতা। আজ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি পাশ্চাত্যের প্রতি পরমুখাপেক্ষিতার একাধিক উদাহরণ। সম্ভবত একই কারণে আজও আমেরিকার জনগণের মতামত এবং তার সমীকরণ সমস্ত পৃথিবীর ‘গণতন্ত্র-মনস্ক’ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে। বর্তমানে, পৃথিবীতে দুটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ লেগে রয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও চলছে, এর মধ্যেই ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ ভয়াবহতায় অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। আমেরিকার কিছু আলোচক এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সাজাতে পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস টেনে এনেছেন, তার আলোয় এই যুদ্ধের কারণ খুঁজে পেতে চেয়েছেন। এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত করেও দু-পাতার মধ্যে ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যদিও-বা এই চেষ্টা করা হয়, তাতে কি আদৌ কিছু প্রমাণিত হবে? এই সংঘাত তো আর বাল্যকালের শিক্ষাঙ্গনে দুই শিশুর ঝগড়া নয়, দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ মহাপরাক্রমী যুদ্ধক্ষম রাষ্ট্র। অপর পক্ষ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইউরোপের কিছু দেশের রাজনৈতিক সংজ্ঞায় দেশ হিসেবে গণ্য নয় এখনও, যদিও জাতিসঙ্ঘে বহুকাল যাবত পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত। এই সংঘাত আদিম মানবের খাদ্যসম্পদ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংঘাত নয়, শান দেওয়া পাথরের, তির-ধনুকের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধের বহু বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সেই কারণগুলির মধ্যে বিস্তর তারতম্য রয়েছে। দুঃখের বিষয়, যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেয়ে যুদ্ধের কারণ সম্পর্কিত আলোচনা অধিকতর সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত। মনে পড়ছে হ্যামলেট নাটকে নায়ক একালাপ করে চলেছেন, কিন্তু ভাষ্যের আড়ালে নিহত রাজার ভূতের ন্যায়, মঞ্চের অন্ধকার নেপথ্যে কারা অনবরত নায়কের কানে কুমন্ত্রণা পেড়ে যাচ্ছে?
এই নাটকীয় ভঙ্গিতে দেখতে হলে প্রথমেই আমাদের পক্ষ বেছে নিতে হবে, কে নায়ক, আর কে খলনায়ক। এবং সত্যিই তাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমালোচনার স্তরে। খ্যাতনামা শিক্ষাবিদেরা, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, ইজরায়েলের আগ্রাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ইহুদি অভিবাসীবৃন্দের মতামতের মেরুকরণ দেখে যে-কোনও সুচিন্তক যারপরনাই অবাক এবং হতাশ হবেন একই সঙ্গে। আমেরিকার ইহুদিদের এক অংশ অনবরত বলে চলেছেন, বিপুল পৃথিবীতে কেবল একটিমাত্র ভূখণ্ড রয়েছে, যা শুধু এবং শুধুই ইহুদিদের বাসস্থান এবং জাতীয় পরিচয়ের নথিভুক্ত আধার হয়ে থাকবে চিরকাল। যে ভূমিপরিচয়ের রক্ষার্থে যে-কোনও পর্যায় পর্যন্ত যুদ্ধ করা যায়। যে-যুদ্ধের রণকৌশল হিসেবে ধারাবাহিকভাবে বোমাবর্ষণ করা যায়, হাসপাতালের উপর নিশানা লাগিয়ে দেওয়া যায়, শিশুদের ধ্বংস করা যায় ক্ষেপণাস্ত্রের মানবতারহিত ব্যবহারে। গণহত্যাকারী ভাষার ব্যবহার করে একটি জনজাতির সদস্যদের পোকামাকড়ের সঙ্গে তুলনা করে তাঁদের সম্পূর্ণ নিধনপ্রণালী প্রস্তুত করতে পারে এক তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
জ্ঞাতার্থে বলি, ইজরায়েল, যা দাবি করে চল্লিশের দশকের ইহুদিদের গণহত্যার পর, তাঁরাই সেই ঈশ্বর-প্রদত্ত ভূমি যা ইহুদিদের পরিচয়ের সঙ্গে সমার্থক, বিগত সাত দশক ধরে একটি অতিক্ষুদ্র এলাকায় কুড়ি লক্ষ প্যালেস্তিনীয় বাসিন্দাদের গেটোর মধ্যে আটক করে রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে পানীয় জল, খাবার এবং ওষুধ যাতায়াত আটকে রেখেছে, একটি কুড়ি লক্ষ মানুষের জনজাতিকে বন্ধক রেখে দিয়েছে শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়ের অজুহাতে। ইজরায়েল পরাক্রমী দেশ, তার বন্ধুতালিকায় অ্যামেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারতের মতন বড় অর্থনৈতিক ক্ষমতাবান দেশ। সর্বোপরি, ইজরায়েলের এক কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা বহুকাল যাবত তার সামরিক শক্তির ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। একেবারে আমেরিকি কায়দায়। পরাজিত প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুরা গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক— এই দুই সামান্য ভূখণ্ডে আবদ্ধ হয়ে থাকতে বাধ্য হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসিদের নেওয়া পন্থা— গেটো, যেখানে হাজার হাজার ইহুদিদের গরুছাগলের মতন ভর্তি করে রাখা হত, ন্যূনতম মানব-প্রয়োজনগুলি ছাড়া। গাজা আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দেখলে কি মানুষের এই চিত্রের কথা স্মরণ হয়নি? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেও গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ভূমিসীমা যতটা ছিল, ইজরায়েলের ধারাবাহিক সামরিক আগ্রাসনের ফলে ক্রমাগতভাবে তা সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। কোণঠাসা হতে থাকা পালেস্তিনীয় রাজনীতির একাংশ যখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিহিংসার পথ বেছে নেয়, তা অপ্রত্যাশিত নয়। ইজরায়েল-নিবাসী সংখ্যালঘু কিছু ইহুদিসমষ্টি এই বক্তব্য প্রকাশ্যে লিখেছেন ইতিমধ্যে। আমেরিকার ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে আরেকাংশ এই মতের সমর্থন জানিয়েছেন। লক্ষণীয়, এই মত দুই ভিন্ন দেশের ইহুদি জনগোষ্ঠীর অংশের থেকে এলেও, এঁদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। তরুণ যুবক-যুবতীদের মতামত বেশিরভাগ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, এবং হামাসের সন্ত্রাস অন্যায় বলে মেনেও এক নিঃশ্বাসে তাঁরা বলছেন যে তা অকারণ নয়।
আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে-কোনও জনজাতি নিজেদের মতন করে দেশনির্মাণ করতে চেয়েছে যখন, তখনই কোনও-না-কোনও কারণ দেখিয়ে বা সাজিয়ে আমেরিকা তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার যুদ্ধে নেমে পড়েছে। বর্তমান যুদ্ধ এই পরিচিত ছকের বাইরে নয়। পুত্তলিকা-গণতন্ত্র স্থাপনের ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দীর্ঘ অধ্যাবসায় রয়েছে। যার এক নিদর্শন আফগানিস্তান, আরেক নিদর্শন ইরাক। সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া— সর্বত্র, আমেরিকার পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনে সবার আগে আক্রান্ত হন মহিলারা এবং শিশুরা। গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সমুদ্রপথে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ পৌঁছনো বন্ধ করে রেখেছে ইজরায়েল, যুদ্ধজাহাজের নাকাশি অভিযানে। যোগাযোগমাধ্যমের উপর বোমাবর্ষণ করা হয়েছে কৌশলী কারণে। বিগত তিন দিন যাবত গাজা থেকে কোনও খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে না। জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিরাই এই বক্তব্য রেখেছেন, বর্তমান পৃথিবীর নৃশংসতম যুদ্ধের শীর্ষমুহূর্তে।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আমরা আলোচনা হতে দেখেছি, জাতীয় স্তরে কাশ্মির এবং উত্তরপূর্ব ভারত প্রসঙ্গে। কিন্তু প্যালেস্তাইনের বাসিন্দাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এক অন্য মাত্রায় লঙ্ঘিত। দেশের লেশমাত্র চিহ্ন পর্যন্ত রাখতে দেওয়া হয়নি। ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকলাঙ্গ সন্তান হল ব্যালফৌর নিদান, যা ধরে স্রেফ ব্রিটেনের স্বার্থপূরণের সুবিধার্থে মধ্যপ্রাচ্যে প্যালেস্তিনীয় জনজাতিদের দীর্ঘমেয়াদি বাসস্থানের মধ্যে থেকে কেক কাটার মতন করে একটি নতুন দেশের ভূমি এঁকে দেওয়া হয় পরিবর্তিত মানচিত্রে। এবং গণহত্যা-জর্জরিত ইউরোপীয় ইহুদি সারভাইভরদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন রেখেই, সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার হাতে নিয়ন্ত্রণ রেখেই, বিগত সাত দশকের ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দ্বন্দ্ব নির্মিত হয়। এই এক পন্থা কি আমরা দেশভাগের সময়ে দেখিনি, র্যাডক্লিফ কমিশনের রাতারাতি দেশের মানচিত্র বদলের মধ্যে? দেশভাগ এবং উৎপাটনের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস কি সম্পূর্ণ বিস্মৃত? নিজ নিজ কারণ-অজুহাতে, প্রত্যেক বৃহৎ সামরিক শক্তিসম্পন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশের ভাগিদার হতে চায়, এই তালিকায় ভারত বাদ যায় না। ইজরায়েলের থেকে সামরিক বিমান, চর প্রযুক্তি, গোয়েন্দা সেবা আমদানি যে যে দেশ করে, তাদের মধ্যে আমেরিকা এবং ভারত অন্যতম। ছত্তিশগড়ে যে ড্রোন ব্যবহার করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে, সেই ড্রোন ভারত কিনেছে ইজরায়েলের থেকে।
তাই যখন আমেরিকার ইহুদি অভিবাসীবৃন্দের একাংশ বলেন, যে ‘নদী থেকে সমুদ্র, প্যালেস্তাইন উন্মুক্ত’— এই দাবি ইহুদিবিরোধী, তখন তা আমেরিকি শ্বেত-সৌভাগ্যবাদের আরেকটি আস্ফালন ব্যতীত আর কিছু বলে মনে হয় না। যখন আমেরিকা তার নিজের ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা, ধারাবাহিক মিথ্যাচার এবং গণতান্ত্রিকতার উপর বিশ্বব্যাপী আক্রমণ লোকানোর চেষ্টা করে, ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ দাবি তোলে, তখন বিচক্ষণতার বিশেষ প্রয়োজন। আমরা যেন মনে রাখি আমেরিকা আদৌ গণতন্ত্রের সমর্থক নয়, গণতন্ত্রের নামে নগ্ন ক্ষমতাতন্ত্র প্রচার এবং প্রসারের ইতিহাস তার সাক্ষী। আমরা যেন প্যালেস্তিনীয় মানুষের অভূতপূর্ব প্রতিরোধ, নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে তাঁদের অবিশ্বাস্য সাহস এবং আত্মপ্রত্যয়কে তার যথার্থ সম্মান দিতে সক্ষম হই। সংগ্রামের, বিশেষ করে দেশনির্মাণের সংগ্রামের নয়া পাঠ দিচ্ছে প্যালেস্তাইন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের থেকে সংহতি ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশিত নয়। সেই সংহতি জানানোর পথে আমরা যেন ইতিহাস-বিস্মৃত না হই। একই সঙ্গে খেয়াল রাখা দরকার, ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্নের গোলকধাঁধায় যেন হারিয়ে না যাই। সেই সরল সত্য স্মরণ করি, বহুল-পঠিত ইতিহাস বিজেতাদেরই রচনা। পরাজিতের স্বর, তাঁদের বেঁচে থাকার উদ্দাম সংগ্রাম, আমরা যেন না ভুলে যাই। সভ্যতার ইতিহাসে আমেরিকার আগ্রাসন যে শুধু বাস্তবের মাটিতে নয়, ইতিহাসের পাতায় তার ইচ্ছানুগ সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন, সেই অভ্যাস যেন আমরা স্মরণে রাখি। ক্ষমতাবান অক্ষমকে নিপীড়ন করবেই, এই সাধারণ বাক্যে আমাদের চিন্তার ইতি না টেনে, অক্ষমের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পগুলো, প্রতিবাদের, প্রতিরোধের জীবন্ত উদাহরণগুলি আমাদের পাথেয় হোক। সাম্রাজ্যবাদী লুঠতরাজ নিপাত যাক, ক্ষমতাতন্ত্রের নামে মানুষের জীবনের সঙ্গে এই ছেলেখেলা বন্ধ হোক। সভ্যতার উপর এই আক্রমণ বন্ধ হোক। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
*মতামত ব্যক্তিগত