Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আবার আধার তথ্য চুরির অভিযোগ, আমরা কি বিপদটা আদৌ বুঝতে পারছি?

সুমন সেনগুপ্ত

 


আবার আধার তথ্য চুরি হয়েছে। সেই নিয়ে আবার হইচই শুরু হয়েছে। যথারীতি সরকার, গোটা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন যে তেমন কিছু হয়নি, কোনও চিন্তা নেই। সব সুরক্ষিত আছে। কোনও বায়োমেট্রিক তথ্য চুরি হয়নি। ডেমোগ্রাফিক কিছু তথ্য চুরি হলেও হতে পারে। এইখানেই আসল মজা। সাধারণ মানুষ কি এই সব বায়োমেট্রিক তথ্য বা ডেমোগ্রাফিক তথ্য এই সব শব্দবন্ধ বোঝে? নাকি আদৌ তারা তাদের তথ্য চুরি নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত?

 

আবার আধার তথ্য চুরি হয়েছে। সেই নিয়ে আবার হইচই শুরু হয়েছে। যথারীতি সরকার, গোটা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন যে তেমন কিছু হয়নি, কোনও চিন্তা নেই। সব সুরক্ষিত আছে। কোনও বায়োমেট্রিক তথ্য চুরি হয়নি। ডেমোগ্রাফিক কিছু তথ্য চুরি হলেও হতে পারে। এইখানেই আসল মজা। সাধারণ মানুষ কি এই সব বায়োমেট্রিক তথ্য বা ডেমোগ্রাফিক তথ্য এই সব শব্দবন্ধ বোঝে? নাকি আদৌ তারা তাদের তথ্য চুরি নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত? যারা এই লেখাটা পড়ছেন, তাদের কতজনই বা এই ‘তথ্য’ বিষয়টা বোঝেন, আমার আপনার তথ্য, আমার আপনার কাছে মূল্যহীন হলেও, যারা এই তথ্য হাতে পাচ্ছেন, তাদের কাছে যে তা কত মহার্ঘ্য, তার কোনও আন্দাজ কি আমাদের আছে?

একটা সময় ছিল, যখন খনিজ তেল ছিল, বিশ্বের বেশিরভাগ পুঁজিপতিদের স্বপ্ন। তারপর তারা দেখলেন, তেল তো উদ্বায়ী বস্তু, উড়ে যায় একদিন, এমন কোনও জিনিসে তাদের প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে, যা প্রতিদিন টাকা জোগাবে এবং আজীবন ধরে। ততদিনে বিশ্বায়ন হয়ে গেছে, কম্পিউটার এসে গেছে, ইন্টারনেট এসে গেছে, সুতরাং প্রতিটি মানুষের শুধু ঠিকানা ছাড়াও একটা আন্তর্জালের ঠিকানা হয়েছে। বেশ কিছু সার্চ ইঞ্জিন এসে গেছে, যা ধীরে ধীরে বিশ্বকে পড়ার ঘরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তারপরে প্রযুক্তি এগিয়েছে, বাড়িতে রাখা কম্পিউটার আস্তে আস্তে চলমান ল্যাপটপ হয়ে আজ স্মার্টফোনের মধ্যে দিয়ে বসার ঘরের দরজা খুলে, শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে সামাজিক মাধ্যম এসে গিয়ে, বিষয়টা এখন জলভাত। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি তথ্য এখন বিশ্বের কতিপয় মানুষের মুঠোবন্দি। আমাদের তথ্য নিয়েই তারা আজ কোটিপতি। কী করে তারা এই বড়লোক হয়েছে, তা যদি সহজ করে বলতে হয়, তা হলে কয়েকটি কথা বলা উচিত। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভাল লাগা-মন্দ লাগা সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়, এখন সামাজিক মাধ্যম এবং ইন্টারনেট দিয়ে। শুধু তাই নয়, আমাদের কখন মন খারাপ থাকে, কখন মন ভাল থাকে, তাও প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এই প্রযুক্তির সংস্থাগুলো শুধু বুঝতে পারে না, নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। আমরাই জেনে অথবা না জেনে সমস্ত তথ্য এই ‘আগফা’ বা AGFA অর্থাৎ আপেল, গুগল, ফেসবুক এবং অ্যামাজনকে দিয়ে দিয়েছি, এখন আমরাই ওদের হাতের পুতুল। ওরা যেভাবে চাইবে, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।

এখন অনেকে বলতে পারেন, আধার তথ্য চুরি হওয়ার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? তথ্যের গুরুত্ব বোঝাতে এই কথাগুলো বলা হলেও, আমাদের দেশের আধার তথ্যের যে অসীম গুরুত্ব, তা আমাদের সরকার জানে এবং প্রতিটি মানুষ এবং তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর বা ঠিকানা যে কতটা দামি, তা আমাদের সরকার জানে। তাই সমস্ত কিছুর সঙ্গে তারা আধারকে যুক্ত করে দিতে চেষ্টা করেছে, যবে থেকে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এতে দুটো সুবিধা।

১। প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখা সম্ভব। একজন ব্যক্তি কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, কোন ব্যাঙ্কে তার সঞ্চিত অর্থ আছে, সেখান থেকে তিনি কী প্রয়োজনে কাকে টাকা দিচ্ছেন। সরকারি কোনও সুবিধা তিনি পাচ্ছেন কি না, এই সমস্ত তথ্য যদি সরকারের কাছে থাকে, তাহলে যে কোনও ব্যক্তি কি আর নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে অনুযায়ী বাঁচতে পারবেন?

২। এই সমস্ত তথ্য যদি বেসরকারি কোনও সংস্থার হাতে তুলেও দেওয়া যায়, তাহলে সেই বেসরকারি সংস্থা এই তথ্য লুফে নেবে। শুধু তাই নয়, তারা সেই তথ্য আরও বৃহৎ সংস্থাদের আবার বিক্রি করতেও দ্বিধা করবে না। আমরা ধীরে ধীরে বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থার হাতের পুতুলে পরিণত হব।

এবার আসা যাক সাম্প্রতিক ঘটনার প্রসঙ্গে। খবরে প্রকাশ কোভিডের সময়ে যে পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিংবা কোভিডের সময়ে যে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল, বাজারে বিজ্ঞাপন দিয়ে কমবেশি সাড়ে আট লক্ষ মানুষের তথ্য ৮১০০০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বাজার বলতে এখানে ডার্ক ওয়েবের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বলেছে, এটা শুধুমাত্র নমুনা, ইচ্ছে করলে, তারা ভারতের ৮১ কোটি মানুষের আধার তথ্যই এইভাবে বিক্রি করে দিতে পারে। খোঁজ করতে গিয়ে জানা যাচ্ছে, আইসিএমআরের (ICMR) তথ্যভাণ্ডার থেকে এই তথ্য বেরিয়ে গেছে। ভারত সরকারের Indian Computer Emergency Response Team (CERT-In) কম্পিউটার এমারজেন্সি রেসপন্স টিমের পক্ষ থেকে আইসিএমআরকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা দেখেশুনে বলবেন, আদৌ তথ্য চুরি হয়েছে কি না, হলেও তার জন্য ক্ষতি কতটা হয়েছে। এসব তো গেল, কী হয়েছে বা না হয়েছে, তা নিয়ে কথা, কিন্তু এই ধরনের তথ্য যদি চুরি হয়, তাহলে কোনও আন্দাজ করা যায়, একজন ব্যক্তিমানুষের কী ক্ষতি হতে পারে? সেই ক্ষতির পরিমাণ বোঝানোর জন্যেই এই লেখার শুরুতে এত ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হয়েছে।

সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগ করার ফলে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি পুরো ইন্টারনেট জুড়ে ভারতীয়দের ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে রেখেছে। এতবড় তথ্যভাণ্ডার, পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে এমন অবহেলায় ফেলে রাখা আছে, তার কোনও উদাহরণ পাওয়া যাবে না। আজকের এই আধার তথ্য চুরি সরকার যদি অস্বীকারও করে, তাও কিন্তু তারা একটা কথা মেনে নেবে, যে এই তথ্য মোটেই সুরক্ষিত অবস্থায় নেই, এবং বারংবার যে অভিযোগ উঠছে, তাতে আঙুলটা তাদের দিকেই উঠছে। এই যে কিছুদিন আগে, সারা দেশের নানান প্রান্ত থেকে খবর আসছিল, আধার নম্বর এবং বায়োমেট্রিক তথ্য নকল করে, মানুষের ব্যক্তিগত টাকা চুরি হচ্ছিল, তা কীভাবে হচ্ছিল তার উত্তর কি সরকারের কাছে আছে? সেই আধার তথ্যকে সুরক্ষিত রাখার দায় কি একজন ব্যক্তি-নাগরিকের? নাকি সরকারের? সেদিন যে বলা হয়েছিল, বায়োমেট্রিক লক করলে সমাধান মিলবে ওই সমস্যা থেকে, আজকে সরকার কী নিদান দেবে?

আমেরিকার সাইবার সুরক্ষা সংস্থা আপাতত, এই আধার তথ্যের চুরি থেকে কোনও রকম আর্থিক অনিয়ম হতে পারে কি না, তা নিয়ে তদন্ত করছে। অথচ ভারত সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সবচেয়ে বড় বিষয়, ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমে এই নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই। কোনওদিনই অবশ্য ছিল না, যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে লঙ্ঘন করে, প্রতিটি মানুষকে কার্যত ঘাড় ধরে, আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক, ফোন-সহ সমস্ত কিছুকে সংযোগ করতে বাধ্য করানো হয়েছিল, সেদিনও ছিল না, আজও নেই। অনেকে বলতে পারেন, তথ্য সুরক্ষা আইন ২০২৩ বলবৎ হলে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য অনেকটা সুরক্ষিত থাকতে পারে, কিন্তু সেটাও পুরোপুরি হওয়ার নয়, কারণ যে আইনে বলা আছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান আধার রাখতে পারে, সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই যে তথ্য বাইরে বেরিয়ে যাবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?

সারা পৃথিবীতে অক্টোবর মাসকে, ‘সাইবার সুরক্ষা সচেতনতা’র মাস হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু আমরা তথ্য বিষয়টা নিয়েই সচেতন নয়, আমরা তো যেখানে সেখানে যখন তখন যে কেউ চাইলেই আমাদের ফোন নম্বর দিয়ে দিই, আমাদের তো গোপনীয়তার কোনও ধারণাই নেই, তাহলে আমরা কি এই আধার তথ্য চুরি আটকাব? আমরা যদি সচেতন হতাম, তাহলে সবার আগে সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগের বিরোধিতা করতাম, কিন্তু তা কি আমরা করেছি? আমরা তো ভেড়ার পালের মতো সরকারের নির্দেশ পালন করেছি।

একজন মানুষকে অনেককে অনেকভাবে চেনেন। তিনি কারও বাবা, কারও কাকা, কারও বন্ধু, কারও কর্মচারী, কারও মালিক, কখনও তিনি ব্যাঙ্কের গ্রাহক, কখনও তিনি অন্য যে-কোনও কেউ হতে পারেন। তাকে একটা পরিচয়ে কেউই বাঁধতে পারবেন না। আধার যেটা করেছে, একজন মানুষের সমস্ত পরিচয়কে একটা সংখ্যায় পরিণত করে তার অন্য সমস্ত পরিচয় শেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষের সমস্ত পরিচয়কে শুধুমাত্র একটা সংখ্যায় পরিণত করে দিলে, অন্য সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্যের সঙ্গে তার সংযোগ করলে— ভয়টা কোথায়? ধরা যাক, কোনও ব্যক্তির কাছে, যার নাম ধরা যাক ক-বাবু, তাঁর কাছে দশহাজার টাকা আছে, তিনি সেই টাকাটা তাঁর বাড়ির নানা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন। তাঁর এক বন্ধু, খ-বাবুর কাছেও মোট দশহাজার টাকা ছিল, খ-বাবু সেই টাকাটা এক জায়গায় করে, একটি ঘরেই রাখলেন। এবার একদিন দুজনের বাড়িতেই ডাকাত পড়ল। ডাকাত ডাকাতি করে চলে যাওয়ার পরে দেখা গেল, ক-বাবুর কাছে তখনও এদিক ওদিক করে আটহাজার টাকা রয়েছে, ডাকাতেরা মাত্র দু-হাজার টাকা খুঁজে পেয়েছে। আর অন্যদিকে, খ-বাবু সর্বস্বান্ত হয়েছেন। সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্যের সঙ্গে আধার যুক্ত করলে, এক লহমায় একজন নাগরিককে, বেনাগরিক বানিয়ে দেওয়া কি সরকারের পক্ষে কোনও বড় ব্যাপার হবে? আজকে যে আধার তথ্য চুরি হওয়ার খবর আসছে, তার মধ্যে দিয়ে আসলে যে একজন ব্যক্তিমানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, তার কোনও আন্দাজ কি আমাদের আছে? যদি থাকত তাহলে আমরা আধার সংযুক্তিকরণের খবর পেলে মাথায় হাত দিয়ে চাপড়াতাম, প্রতিবাদ করতাম। এখনও অবশ্য চাপড়াচ্ছি, তবে মাথা নয়, বুক, এই ভেবে যে আমাদের দেশে একজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি সমস্ত কিছু থেকে আমাদের সুরক্ষা দেবেন। ওই যে কথায় আছে না, ‘অবোধের গোবধে আনন্দ’, আমাদের অবস্থা খানিকটা সেইরকম।


*মতামত ব্যক্তিগত