শুভেন্দু সরকার
৩ জুন ১৯৪৫-এ, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছলেন রাহুল। এটি ছিল তাঁর তৃতীয় সোভিয়েতযাত্রা। দু-বছর মেয়াদি সেই সফরটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। নাৎসি বাহিনি পিছু হঠার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর পুনর্নির্মাণ রাহুল দেখলেন নিজের চোখে। সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি নানাদিকের খুঁটিনাটি খবরাখবর পাওয়া যাবে আমার জীবন-যাত্রা-র তৃতীয় খণ্ডে। বিপ্লবের পর সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কৃতিত্ব যে মূলত স্তালিনের, সে-কথাও একইসঙ্গে উপলব্ধি করলেন রাহুল
রাহুল সাংকৃত্যায়ন (১৮৯৩-১৯৬৩) ছিলেন সর্বদা অস্থির। কখনও এক জায়গায় থিতু হননি তিনি— ছোটবেলা থেকে শেষজীবন অব্দি অবিরাম ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের নানা জায়গা; সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক হিসেবে বিচার করেছেন বিভিন্ন সংস্কৃতি। বৌদ্ধিক দৃষ্টিকোণ থেকেও রাহুলের চঞ্চলতা রীতিমতো নজর কাড়ে। বৈষ্ণব ধর্ম, বেদান্ত দর্শন আর আর্যসমাজ পেরিয়ে বৌদ্ধধর্মে শরণ নেন তিনি। কেদারনাথ পাণ্ডে, রামোদার দাসের পর তাঁর নতুন নাম হয় রাহুল সাংকৃত্যায়ন। অন্যদিকে, ১৯২০-র দশকে ব্রিটিশ-বিরোধিতার সূত্রে রাহুলের মনে জাগল জাতীয়বাদী চেতনা। মার্কসবাদ নিয়েও তিনি উৎসাহী হলেন একই সময়ে। কমিউনিজম সম্বন্ধে রাহুলের আস্থা ক্রমশ বাড়ল। বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে তাঁর আগ্রহ অবশ্য বহাল থেকেছে আমৃত্যু। নিরীশ্বরবাদ, ক্ষণিকবাদ ও অনাত্ম-র পাশাপাশি বুদ্ধর চিন্তায় রাহুল পেয়েছিলেন দ্বন্দ্বতত্ত্বর ধারণা। তাঁর মতে, বৌদ্ধ দর্শন হল মার্কসীয় দর্শন বোঝার প্রথম ধাপ। তাই মার্কসবাদী হওয়ার পরও তিনি নিজেকে বুদ্ধর শিষ্য ভাবতেন (যদিও ভিক্ষুর পোশাক তিনি ছেড়েছিলেন ১৯৩৫-এ)। কিন্তু এও সত্যি, রাহুল বিশ্বাস করতেন যে, দার্শনিক বিচারে বুদ্ধর মতামত বৈপ্লবিক হলেও আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল। মার্কসবাদই রাহুলকে দিয়েছিল এক অখণ্ড প্রগতিশীল বিশ্ববীক্ষার হদিশ।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার আগেই সমাজবাদ তথা মার্কসবাদ চর্চা শুরু করেছিলেন রাহুল। রুশ বিপ্লব (১৯১৭)-এর খবর শুনে আর মার্কস-লেনিনের কিছু প্রাথমিক লেখাপত্তর পড়ে তিনি লিখেছিলেন দ্বাবিংশ শতাব্দী (১৯২৪) আর পরবর্তীকালে সাম্যবাদই বা কেন ?(১৯৩৪)। ১৯৩৫-এ প্রথমবার সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছন রাহুল। মস্কো আর বাকু শহর মিলিয়ে মোট হপ্তা দুয়েক সেখানে ছিলেন তিনি। ইচ্ছে থাকলেও লেনিনগ্রাদ যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। সোভিয়েতের হাল-হকিকৎ তাঁকে অভিভূত করেছিল।[1]
১৯৩৭-৩৮-এ বৌদ্ধ দর্শন বিশারদ ফিওডর শ্চেরবেৎস্কি-কে সহায়তা করার জন্যে লেনিনগ্রাদে রাহুলকে আমন্ত্রণ জানায় সোভিয়েত অকাদেমি। মাস দুয়েকের দ্বিতীয় সোভিয়েতযাত্রায় আরও খুঁটিয়ে সমাজবাদের প্রয়োগ দেখার সুযোগ হল তাঁর। দেশে ফিরে পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা রাহুল সেখান থেকে পেলেন।[2] সোমনাথ লাহিড়ির পরামর্শে কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টির কাজে যোগ দিলেন তিনি।[3] কাজের এলাকা হিসেবে কৃষক-মজদুর ফ্রন্টে কাজ করেন রাহুল। ১৯ অক্টোবর ১৯৩৯-এ বিহারে কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হল; তখন তিনি সদস্যপদ নিলেন। ১ আগস্ট ১৯৪২-এ পার্টি বৈধ হওয়ার পর রাহুলের দায়িত্ব আরও বাড়ল। পাশাপাশি বিদ্যাচর্চাও চলল।
৩ জুন ১৯৪৫-এ, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছলেন রাহুল। এটি ছিল তাঁর তৃতীয় সোভিয়েতযাত্রা।[4] দু-বছর মেয়াদি সেই সফরটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। নাৎসি বাহিনি পিছু হঠার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর পুনর্নির্মাণ রাহুল দেখলেন নিজের চোখে। সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার অর্থনীতি (বিশেষত উৎপাদন ব্যবস্থা), স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি নানাদিকের খুঁটিনাটি খবরাখবর পাওয়া যাবে আমার জীবন-যাত্রা-র তৃতীয় খণ্ডে।[5] বিপ্লবের পর সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কৃতিত্ব যে মূলত স্তালিনের, সে-কথাও একইসঙ্গে উপলব্ধি করলেন রাহুল। তিনি লেখেন:
এটা বোঝা উচিত যে, সোভিয়েত-শাসনের আর্থিক এবং শিক্ষাসম্বন্ধীয় ক্ষেত্রে যে সফলতা জুটেছে, তা কেবল অভুতপূর্বই নয়, বরং মাত্রায় তা এত বেশি যে নিরানব্বই শতাংশ সাধারণ মানুষ তাতে লাভবান। ওরা নিজদের চোখের সামনে ওই লাভ দিন দিন বাড়তে দেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতার পর সোভিয়েত শাসন লোকের মনে নিজেদের গৌরব আরও দৃঢ় করেছিল। এই কারণে সোভিয়েত জনগণের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন সোভিয়েত-শাসনের অন্ধভক্ত। স্তালিন তো তাদের কাছে জাগ্রত ভগবান, যাঁর বিররুদ্ধে ওরা একটি কথাও শুনতে রাজি নয়। এ হেন অবস্থায় ভাষণ-মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত-শাসন বা স্তালিনকে গালি দেওয়ার সাহসই বা কার হতে পারে?[6]
১৭ আগস্ট ১৯৪৭-এ রাহুল ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতে ফেরেন; লেখালেখি আর পার্টির কাজে আবার লেগে পড়েন। কিন্তু ডিসেম্বরে বোম্বাইয়ের হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে রাহুলের সভাপতির অভিভাষণ নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। তাঁর মতে: উর্দু একটি কৃত্রিম ভাষা, তাই সাংস্কৃতিক ঐক্যের স্বার্থে ভারতীয় মুসলমানদের হিন্দিকে গ্রহণ করা উচিত। আঞ্চলিক স্তরে মাতৃভাষার বহুল ব্যবহারের কথা বললেও রাহুল চেয়েছিলেন হিন্দি হয়ে উঠুক ভারতের জাতীয় ভাষা। পার্টি তাঁর মত সমর্থন করেনি। মুদ্রিত ভাষণটি অবশ্য পালটানোও সম্ভব ছিল না তখন। রাহুল লিখেছেন:
আমার ভাষণ দীর্ঘ ছিল, আমি তার কিছু অংশ পড়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে তা শেষ করলাম। ভাষণের আগে কমরেড [গঙ্গাধর] অধিকারী পার্টির তরফ থেকে আবার জোর দিয়ে লিখেছিলেন যে, আমার উর্দুসম্বন্ধীয় ভাবধারার ব্যাপারে আমি কিছু বলি এটা পার্টির মত নয়। আমি সেদিনই কমরেড অধিকারীকে লিখলাম যে, পার্টির এই নীতিকে আমি সমর্থন করি না বলে আমি নিজেকে পার্টি[তে] থাকার যোগ্য বলে মনে করি না, কিন্তু পার্টিকে আমি সবসময় আমার সঙ্গে রাখব।[7]
রাহুল বারবার বলেছেন, ১৯৩৯-এ পার্টির সদস্য হওয়ার বহু আগে আর ১৯৪৭-এ স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার পরও তিনি মানসিকভাবে সর্বদা পার্টির সঙ্গেই ছিলেন। মার্কসবাদের প্রচার ও প্রসারের জন্যে তাঁর কলম কখনওই থামেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে রাহুলের সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে ১৯৫৫-য়। হিন্দি ভাষাকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন— তার মধ্যে রাজনৈতিক লেখাগুলির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অনেকখানি।
১৯৫৩-র রোজনামচায় রাহুল লেখেন:
৩ মার্চ থেকে কমরেড স্তালিন সংজ্ঞাহীন ছিলেন। তাঁর পুরো জীবন একটি মহৎ কাজের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লেনিনের ডান হাত হয়ে তিনি কার্যোদ্ধার করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ভার ছিল তাঁর ওপর। তিনি তাঁর জীবনের এক-একটি মুহূর্তের মূল্য চুকিয়ে নিয়েছিলেন। ৫ মার্চ রাত নটা ৫০ মিনিটে মস্কোতে তাঁর মৃত্যু হল। ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু…’— ৭৩ বছরের আয়ু নিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। তাঁর কাজ সদা অমর থাকবে। মার্কস যে সাম্যবাদের দর্শন দিয়েছিলেন এবং তা পৃথিবীতে আনার পথ দেখিয়েছিলেন, তা পৃথিবীতে আনতে লেনিন সফল হলেন। সাম্যবাদী বিপ্লবের জন্য উপকরণ সংগ্রহ করা আর সাফল্যের সঙ্গে তা প্রয়োগ করা ছিল লেনিনের মহৎ কাজ। কিন্তু সাম্যবাদী শক্তিকে আর্থিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে তাকে ফ্যাসিবাদের মারাত্মক সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ করার মহৎ কাজটি করেছিলেন স্তালিন। আমি তাঁর সময়ে দু-বছর রাশিয়ায় ছিলাম। সেখানকার প্রগতি আমি চোখের সামনে দেখেছিলাম। সেখানকার প্রতিটি ব্যাপার আমার কাছে প্রেরণাদায়ক মনে হয়। তবে স্তালিনের ব্যক্তিপূজা আমার খারাপ লাগত। বেশিদিন ধরে তা চালানো যায়নি, কেননা ব্যক্তিপূজা ছিল সাম্যবাদ-বিরোধী। যত বড়ই হোক না কেন, এই দোষটির জন্য স্তালিনের মহান কাজকে তুচ্ছ বলা যায় না। এই সময় মনে হল যে, স্তালিনের ওপর কিছু লিখি। আগে লিখেছিলাম। তাতে সন্তুষ্ট হইনি— বিশেষ করে এই ভেবে যে হিন্দিতে স্তালিনের কোনো ভাল জীবনী নেই।[8]
স্তালিন ছাড়াও একবছরের মধ্যে রাহুলের হাত দিয়ে বেরোল লেনিন, মার্কস আর মাও-র জীবনী।
কিন্তু এ-ও ঠিক যে, রাহুল সাংকৃত্যায়নের স্তালিন-কে নিছক জীবনী ভাবলে ভুল হবে। স্তালিন-এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পাঠককে সম্যক ধারণা দিয়েছেন তিনি ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে সেখানে সমান্তরালভাবে রাহুল হাজির করেছেন ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত দেশের পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচার। সামজিক-আর্থনীতিক দিক দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারত আর রোমানভ সাম্রাজ্যর বিশেষ ফারাক ছিল না। ব্রিটিশ আর জার দ্বিতীয় নিকোলাস-এর শাসনে দু-জায়গাতেই জনগণের জীবন হয়ে ওঠে অসহনীয়। উল্টোদিকে, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেখা যায় অনুরূপ নানা পদ্ধতি। কিন্তু ঘটনা হল, যে-সাফল্য ১৯১৭-য় বলশেভিকরা অর্জন করলেন, তা ভারতে অধরা থেকে গেল। তাই লেনিন-স্তালিন-এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন রাহুল। তাঁর লেখায় তুলনা হিসেবে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ল তৎকালীন ভারতীয় বাস্তবতার প্রসঙ্গ। যেমন, ওরদানিয়া নামের এক মেনশেভিক নেতার প্রসঙ্গে ভারতের মেকি সমাজবাদীদের কথা মনে করাতে ভুললেন না রাহুল।
একথা আগেই বলা হয়েছে যে, ওরদানিয়ার মতো তরুণ একসময় মার্কসবাদের বাহক ছিলেন। তিনিই ককেশাসে এই নতুন চিন্তা-চেতনাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর বিচ্যুতি ঘটে। ওরদানিয়ার মতো ব্যক্তি পৃথিবীতে সবকালে এবং সব দেশেই কিছু কিছু দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও এমন মানুষ দেখা যায়, যারা সমাজতন্ত্রর নাম এজন্যেই করে, যাতে সমাজতন্ত্র না আসে— যাতে পুঁজিপতিরা অবাধে তাদের কাজ হাসিল করতে পারে। যদি পুঁজিপতিরা ওরদানিয়ার মতো মানুষকে হাতের মুঠোয় করতে পারে, তাদের পত্র-পত্রিকাতে যদি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে তাহলে অবাক হওয়ার কী আছে? পাঞ্জাবিতে একটা প্রবাদ আছে, তারা জানে সে ‘সাচ্চা বান্দা’।[9]
এ-ও দেখার, স্তালিন-এর মার্কসবাদ ও জাতীয় সমস্যা (১৯১৩) সর্বদা আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে রাহুলের বিচারে। ভারতের মতোই সোভিয়েতে ছিল নানা জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি আর ধর্মর মানুষ। এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে আর সকলের স্বকীয়তাকে বজায় রেখে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব। শ্রমিকশ্রেণির ঐক্য গড়ে তোলায় সেসব বাধা হয়ে ওঠে না— এ-ও মনে করিয়ে দেন রাহুল। জাতি সমস্যা নিয়ে স্তালিন-এর তত্ত্ব ও প্রয়োগ রাহুলের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই গভীর অধ্যয়ন এবং পরিশ্রমের জন্যেই আমরা পাই স্তালিনের লেখা ‘মার্কসবাদ এবং জাতি সমস্যা’। যে-রচনা চিরকালের জন্যে সামন্তবাদ এবং পুঁজিবাদের কাছে আতঙ্কস্বরূপ হয়ে থাকবে। গত হাজার বছর ধরে আমাদের বিশ্বের ইতিহাসে, এ-সমস্যার সমাধানের কথা কেউ বলতে পারেননি। সেই অসম্ভব কাজকে মার্কসবাদ সমাধান করতে যাচ্ছে। মার্কসবাদ পথ নির্দেশ করছে। স্তালিন তাঁর প্রতিভা এবং অনেক জাতির সম্মিলিত স্থান— তাঁর মাতৃভূমি ককেশাসের দীর্ঘদিনের যে জটিল সমস্যা, তার প্রতিটি তন্ত্রীকে জেনেছেন-বুঝেছেন, এবং সেই কঠিন সমস্যার সমাধানের পথ বাতলেছেন। যদি বিশ্বের কোনও প্রান্তে যথার্থভাবে জাতি সমস্যাগুলির সমাধান করতে হয়, তাহলে স্তালিনের নির্দেশিত পথেই করতে হবে। রাশিয়ার মতো ষাট থেকে সত্তরটী জাতির একটি দেশ যে শক্তি এবং সামর্থ্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে— সেই দেশের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে এসে হিটলার এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মাথা ফাটিয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে জাতি-শোষণের সমাপ্তি। পিছিয়ে পড়া জাতিগুলির অর্থনীতি সংস্কৃতি রাজনীতিকে সমান্তরালে এনে দাঁড় করানো। আর তাদের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদের পৃথক হয়ে যাওয়ার যে অধিকার তা স্বীকার করা।[10]
নভেম্বর বিপ্লবের অব্যবহিত পর বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর অভ্যন্তরের প্রতিবিপ্লবী শিবিরকে দমন করতে অগ্রণী ভূমিকা নেন স্তালিন। ১৯২২-এর নয়া আর্থিক নীতির সময় সোভিয়েত যুক্ত্ররাষ্ট্রর পুননির্মাণ প্রক্রিয়াতেও তিনি ছিলেন লেনিনের সহকারী। সেইজন্যে একাদশ কংগ্রেস (১৯২২)-এ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদে স্তালিন-এর নিযুক্ত হওয়া ছিল স্বাভাবিক। আমৃত্যু তিনি সেই পদে বহাল থাকেন। সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়ন আর যৌথ কৃষিব্যবস্থা চালু করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত দেশগুলিকে দ্রুত টক্কর দিয়েছিল সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র। আবার, নাৎসি আগ্রাসনের পর বিধ্বস্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর আর্থ-সামাজিক হাল ফেরানোও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। দুটি ক্ষেত্রেই স্তালিনের কৃতিত্ব অসীম। স্বাভাবিক যে, কুৎসা রটিয়ে পুঁজিবাদী শিবির নানাভাবে তাঁর উজ্জ্বল কীর্তিগুলি খাটো করবে।
রাহুলের আলোচনায় ট্রটস্কিবাদের প্রসঙ্গও এসেছে। বলা বাহুল্য, ট্রটস্কির মতবাদকে সমর্থন করেননি তিনি। যেমন, “সর্বহারা বিপ্লব পাশ্চাত্য দেশগুলিতেই সম্ভব”— এই প্রকল্পর বিরুদ্ধে রাহুল তুলে ধরেছেন স্তালিনের সৃজনশীল মার্কসবাদী ধারণা। তারপর তিনি যোগ করেন:
এ-কথা না বললেও চলে, ট্রটস্কি, কামনেভের মতো লোকরা পুথিগত বিদ্যায় অজীর্ণ রুগিতে পরিণত হয়েছিল। তাদের চোখের ওপর এমন ভারী পর্দা পড়েছিল যে, তৎকালীন পরিস্থিতি অবলোকন করা সত্ত্বেও, তাদের শুধু বই থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। প্রতিটি পরিস্থিতির মধ্যে যে-ঘটনাগুলি সংঘটিত হচ্ছিল, সে-ঘটনাগুলি হয়তো কোনও পুরনো পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিন্তু তা সামগ্রিক রূপে সম্পূর্ণভাবে নতুন স্বরূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। এ-রকম সময়ে, সঠিক পথকে খুঁজে বের করা লেনিন এবং স্তালিনের মতো প্রতিভাবানদেরই কাজ।[11]
আবার, ট্রটস্কি ও তাঁর অনুগামীদের কর্মসূচির আড়ালে রাহুল দেখেছিলেন পুঁজিবাদকে শক্ত করার কৌশল। তাঁর পর্যবেক্ষণ:
পঞ্চদশ কংগ্রেসের পরে ট্রটস্কিপন্থীরা অতীতের মেনশেভিকদের প্রদর্শিত পথে বলশেভিকদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। ‘বিশ্ববিপ্লব সংঘটিত না করে এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়’ এই স্লোগানের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত রাশিয়ায় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার পথকে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়। ট্রটস্কি এবং তার অনুগামীরা পুনর্গঠনের সময় থেকেই সক্রিয় বিরোধিতায় ব্যস্ত ছিল। সে-সময়ে যদি তারা সফল হত তাহলে সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে কখনও কি শক্তি সংহত করা সম্ভব হত? আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করে রাখার অর্থ শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি আবার যাতে আক্রমণ করে তার জন্য আমন্ত্রণ জানানো নয় কি?[12]
আগেই বলেছি, ফাসিবাদ আর নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার আপসহীন অবস্থানকে সর্বদা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন রাহুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সকল প্রগতিবাদীর মতো তিনিও উপলব্ধি করেন, হিটলারের পরাজয় ভীষণ জরুরি। আর সে-কাজ স্তালিন যখন ১৯৪২-এ হাসিল করলেন, তখন তাঁকে ‘মানবতার রক্ষাকর্তা’ বলতে আপত্তি কোথায়? শুধু মতাদর্শ নয়, বারবার স্তালিনের সামরিক পারদর্শিতারও তারিফ করেছেন রাহুল।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৪৬-৫০) ছিল সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র পুনর্গঠনের কর্মসূচি। একাধিক জলবিদ্যুৎ শক্তি কেন্দ্র স্থাপন, খাল কেটে মরু অঞ্চলে জল সরবরাহ, বৃহৎ সেচ প্রকল্প, নতুন জলপথ তৈরি, কৃত্রিম বনভূমি গড়া ইত্যাদি অতীতের সাফল্যকেও ছাপিয়ে যায়। এছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৯৪৫-পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধ পর্যায়ে বিশ্বশান্তি আন্দোলনে স্তালিনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৫১-য় তাঁর নামে যে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার চালু হয়, তা থেকে সহজেই স্তালিনের দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে।
তাত্ত্বিক স্তালিনের অবদানও রাহুলের নজর এড়ায়নি। মার্কসবাদ ও ভাষাতত্ত্ব (১৯৫০)-এ তাঁর মৌলিক চিন্তাভাবনার ছাপ স্পষ্ট। তরুণ মার্কসবাদীদের প্রশ্নর উত্তরে স্তালিন বলেন, ভাষা উপরিকাঠামো (সুপারস্ট্রাকচার)-র পর্যায় পড়ে না। কখনও অর্থনৈতিক বনিয়াদ আর সেইসঙ্গে উপরিকাঠামোয় পরিবর্তন দেখা দিলেও ভাষা মোটের ওপর একইরকম থাকে। ভাষা কোনও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণির স্বার্থ বা চাহিদা পূরণ করে না; তার ওপর সকলের সমান অধিকার। উল্টোদিকে, স্তালিন মনে করতেন, ভাষা উৎপাদন সংক্রান্ত কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। তাই কৃষি ও শিল্পর ক্রমাগত উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাষায় যুক্ত হয় নতুন নতুন শব্দ।
মার্কসবাদী তত্ত্বর নিরিখে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রর অর্থনৈতিক সমস্যাবলি (১৯৫২) স্তালিনের আর-একটি মৌলিক রচনা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে গুণগত ফারাক— পণ্য উৎপাদন বহাল থাকলেও তা মুনাফা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না, সামাজিক চাহিদা পূরণই বরং তার একমাত্র উদ্দেশ্য। এছাড়া, স্তালিন এখানে আলোচনা করেছেন কীভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শহর-গ্রাম আর শারীরিক-মানসিক শ্রমের দ্বন্দ্ব ঘুচেছে। শ্রমিকশ্রেণি আর কৃষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ঐক্য; শিক্ষা আর চেতনার বিকাশ কমিয়েছে মানসিক-কায়িক শ্রমের মূল্যের মধ্যে কৃত্রিম ফারাক। বইটি সম্বন্ধে রাহুলের মূল্যায়ন যথার্থ:
এই পুস্তকের প্রতিটি শব্দের পেছনে আছে পুঁজিবাদী শোষণ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাশিয়ার প্রথমদিককার শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমিক-কৃষক সৈনিকদের সোভিয়েতগুলি, গৃহযুদ্ধের সময়কার ঘটনা থেকে খুনি ফ্যাসিস্টদের পরাজয় পর্যন্ত এবং গৃযুদ্ধের সময়ে যে মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ হয়, সেই দুর্ভিক্ষে কীভাবে খাদ্য সংগৃহীত হয়, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যকরী করে কীভাবে সমাজতন্ত্র নির্মিত হয় ও সেই সমস্ত অভিজ্ঞতার অতুলনীয় উপলব্ধি। এই পুস্তকে প্রতিটি শব্দের পেছনে আছে সারা বিশ্বের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকে এই পুস্তক থেকে যেমন পৃথক কওরা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি এই পুস্তক থেকে এই মহান অভিজ্ঞতার সূত্রগুলিকেও পৃথক করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের নির্মাণকাজে এই পুস্তকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেজন্যে স্তালিনের এই পুস্তক সৃজনশীল মার্কসবাদী সাহিত্যে এক শ্রেষ্ঠতম সংযোজন।[13]
রাহুল চেয়েছিলেন, সাধারণ পাঠক মার্কসবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগ সম্বন্ধে বিশদে জানুক। মার্কসবাদ কোনও আপ্তবাক্য নয়; মূল লক্ষ্যে অবিচল থেকে সাচ্চা মার্কসবাদী দেশ-কাল-পরিস্থিতি অনুসারে কর্মসূচি স্থির করেন। লেনিন আর স্তালিনের নেতৃত্বে বিপ্লব ঘটে এক অনুন্নত দেশে। ব্যক্তিমালিকানা-ভিত্তিক পুঁজিবাদের পরিবর্তে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক মালিকানা। সেইজন্যে সেখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুফল পায় গুটিকয়েক পুঁজিবাদীর বদলে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র দুনিয়ার কমিউনিস্টদের ভরসা জুগিয়েছিল। প্রেরণা পেয়ে নিজেদের দেশে মার্কসবাদের সৃষ্টিশীল প্রয়োগের চেষ্টাও চালিয়েছেন তাঁরা। লেখালেখির মধ্যে দিয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ন ঠিক তা-ই করেছেন।
[1] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আমার জীবন-যাত্রা, খণ্ড ২। রাহুল সাংকৃত্যায়ন জন্মশতবর্ষ কমিটি। ১৯৫৩। পৃ. ৩০৭-৩১৯।
[2] পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৯৩-৪১৬।
[3] সেই সময়ে বিহারে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন ছিল না। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল বেআইনি।
[4] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আমার জীবন-যাত্রা, খণ্ড ৩। রাহুল সাংকৃত্যায়ন জন্মশতবর্ষ কমিটি। ১৯৫৫। পৃ. ২০২-২০৩।
[5] পূর্বোক্ত, পৃ.১৯৮-৪০৬।
[6] পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৭।
[7] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আমার জীবন-যাত্রা, খণ্ড ৪। রাহুল সাংকৃত্যায়ন জন্মশতবর্ষ কমিটি। ১৯৫৮। পৃ. ৩৭।
[8] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আমার জীবন-যাত্রা, খণ্ড ৫। রাহুল সাংকৃত্যায়ন জন্মশতবর্ষ কমিটি। ১৯৯৫। পৃ. ১৩২-৩৩।
[9] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। স্তালিন। চিরায়ত প্রকাশন। ২০০৯। পৃ. ৫৯।
[10] পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭-৬৮।
[11] পূর্বোক্ত, পৃ. ৮০।
[12] পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৬।
[13] পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৫-৯৬।