Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 


এ বছর বাৎসরিক মেগা উৎসবের পর্দা ওঠার আগে রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়বাণী ছিল, ৯০ ডেসিবেলে থেমে থাকার দিন শেষ। এবার থেকে ১২৫! এর মানে হল, যে বাজিগুলো থেকে শব্দ বেরোয়, তার ধ্বনির সর্বোচ্চ সীমা এতদিনের ৯০ ডেসিবেল থেকে আরও ৩৫ ডেসিবেল বাড়িয়ে ১২৫ ডেসিবেল করে দেওয়া হল। পুজোর মরসুমে এমন সরকারি নিদানে যাঁদের কপালে ভ্রূকুটি পড়েছিল, তাঁদের আশঙ্কা অবশ্য সত্যি হয়েছে ষোলোয় আঠেরো আনা। কালীপুজোর রাতে শব্দতাণ্ডব শুধুমাত্র কলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাজি ফেটেছে সজোরে, রাজ্যের সর্বত্র

 

কালীপুজোর রাতে আক্ষরিক অর্থেই ধুন্ধুমার কাণ্ডের সময় এক পরিচিত পরিবেশবিদ ফোন করে বললেন, “বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে মত্ত অবস্থায় এতবড় একটা সেম-সাইড গোল হয়ে গেল এ রাজ্যে, তা নিয়ে কখনও ভেবেছ?” আমি বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম। ভদ্রলোক বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। মনে হচ্ছে এ পাড়ায় চকোলেট বোমার চেন লাগিয়েছে কেউ। পরে ফোন করছি।” লাইনটা কেটে দেওয়ার আগে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শব্দব্রহ্ম।”

সকালে ঘুম ভাঙার পরেই তাঁর একটি হোয়্যাটসঅ্যাপ বার্তা পেলাম। লিখেছেন, ‘তেত্রিশ কোটির মধ্যে যদি কোনও শব্দ-দেবতা থাকেন, আমাদের রাজ্যের এ বছরের কালীপুজোর পারফরমেন্সে তিনি যে বেজায় খুশি হয়েছেন, তা হলফ করে বলা চলে। আমরা কলার উঁচিয়ে তাঁর মিনতি করেছি। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য যত উপচার লাগে, দিয়েছি তার থেকে অনেক বেশি। আশা করি তাঁর আশীর্বাদ আমাদের আগামী উৎসবে আরও মাতোয়ারা হওয়ার ইন্ধন যোগাবে।’

পশ্চিমবঙ্গে হয়তো ঢক্কানিনাদ কম পড়েছিল! এ বছর বাৎসরিক মেগা উৎসবের পর্দা ওঠার আগে রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়বাণী ছিল, ৯০ ডেসিবেলে থেমে থাকার দিন শেষ। এবার থেকে ১২৫! এর মানে হল, যে বাজিগুলো থেকে শব্দ বেরোয়, তার ধ্বনির সর্বোচ্চ সীমা এতদিনের ৯০ ডেসিবেল থেকে আরও ৩৫ ডেসিবেল বাড়িয়ে ১২৫ ডেসিবেল করে দেওয়া হল। অর্থাৎ, আরও বেশি শব্দ নিয়ে উল্লাসের মননে লাগিয়ে দেওয়া হল সরকারি সিলমোহর। পুজোয় ৭০ হাজার টাকা অনুদানের পরে এমন সুসংবাদে ক্লাবকর্তারা নিশ্চয়ই বাহবা দিয়েছিলেন। উৎসবের আসল ‘মর্ম’ উপলব্ধি করার মতো এমন সংবেদনশীল সরকার গোটা দেশে যে আর দুটি নেই!

পুজোর মরসুমে এমন সরকারি নিদানে যাঁদের কপালে ভ্রূকুটি পড়েছিল, তাঁদের আশঙ্কা অবশ্য সত্যি হয়েছে ষোলোয় আঠেরো আনা। কালীপুজোর রাতে শব্দতাণ্ডব শুধুমাত্র কলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাজি ফেটেছে সজোরে, রাজ্যের সর্বত্র। এক জেলা অন্য জেলাকে বলেছে, “আমি তোমার থেকে কম যাই না মোটে।” কোনও শহরতলির উত্তর অংশ তার দক্ষিণ অংশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে শব্দদাপটে। পরিবেশবিদরা কপাল কুঁচকেছেন যত, শব্দবাজির চিরপ্রেমিকরা তত ভেসেছেন প্রেমের জোয়ারে।

কালীপুজোর আগে খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে দেখি, অনলাইন খুচরো বিপনির অ্যাপ খুললেই দেখি, লেখা আছে, ‘চলুন মেতে উঠি আলোর উৎসবে।’ তবে প্রতি বছর এই উৎসবযাপনের দিনটিতে আলোকে হেলায় হারায় শব্দ। মধ্য-তিরিশ পেরোনো জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, আলো হেরে যায় প্রতি বছরই। তবে এ বছর যেন হেরে গেল আগের থেকে অনেক বেশি। সবুজ বাজির কথা শুনি আজকাল। এমন বাজির কথা কানে আসে, যেগুলো নাকি পরিবেশবান্ধব। সত্যি কথা বলতে কি, পরিবেশের ‘বন্ধু’ বাজি নিয়ে বিভিন্ন সংজ্ঞা পেয়েছি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের থেকে। একজন বলেছিলেন, “যে জিনিস থেকে ধোঁয়া নির্গত হয় এবং আমরা জানি ওই ধোঁয়া না বেরোলেই আমাদের অতি দীর্ণ এবং জীর্ণ চারপাশটা ভাল থাকত আরও, দিনের শেষে তার কি প্রয়োজনীয়তা আছে বুঝি না বাপু।” সবুজ বাজির কথা ওঠালাম। উনি হাসলেন তির্যকভাবে। বলেছিলেন, “সব গিমিক।” কয়েকজন বাজিবিক্রেতার সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন, যাঁরা সবুজ রঙের বাক্সে সানন্দে বিক্রি করে যাচ্ছে চকোলেট বোমা। জানলাম, বিকোচ্ছে হু হু করে।

প্রতি বছর কালীপুজোর আগে চিকিৎসকরা সুস্থভাবে কালীপুজো উদযাপনের কথা বলেন। ঘাতক শব্দ এড়িয়ে চলার কথা বলেন। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম জপ করার মতো বারবার বলতে থাকেন, “প্রবল শব্দে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে হৃদরোগে ভুগতে থাকা মানুষদের। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে হতে পারে মৃত্যুও।” জানলাম, আচমকা বিকট শব্দ ক্ষতি করতে পারে গর্ভস্থ সন্তানেরও। মানসিক স্বাস্থ্যে তার ত্রুটি থেকে যেতে পারে জীবনভর। পশুপ্রেমীরা বলেন, “শব্দবাজির এমন উন্মাদ কোলাহলের থেকে সামলে রাখুন পোষ্যদের। কুঁকড়ে যাওয়া প্রাণীগুলোকে অন্য কোথাও, অন্য কোনও ঘরে রাখতে বলেন, যেখানে শব্দের প্রকোপ কম।”

ছোটবেলায় বাংলা পরীক্ষার খাতার রচনার মতো যদি ‘শব্দবাজি— আশীর্বাদ না অভিশাপ’ বলে কেউ লিখতে বলে আমাদের, তাহলে উপকারিতায় ক-লাইন লেখা যাবে জানি না, তবে অপকারিতার কথা বুলেট পয়েন্ট করে লিখতে বসলে তার তালিকা হবে অন্তহীন। কালীপুজো কিংবা দিওয়ালির রাত্রে শব্দদানবের বলি হয়েছেন— হলুদ হয়ে যাওয়া পুরনো খবরের কাগজের পাতারা আমাদের সেই তথ্যেরও সন্ধান দেয়। আমরা শিখিনি। শব্দের দাপটে পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে বধির হয়ে গিয়েছেন, খুঁজতে শুরু করলে এমন মানুষেরও সন্ধান মেলে। মৃত্যুর ঘটনায় সরকার কোনও ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল কি না, তার খোঁজ করা ভিত্তিহীন। কারণ, যে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল, অর্থ দিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করা যায় না।

শব্দবাজির এক প্রেমিককে আজ সকালে বলতে শুনলাম, “কালীপুজোর রাতে একিউআই অর্থাৎ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের সম্ভাব্য প্রবল পতন নিয়ে চারদিকে যে হল্লা হল, তার কি কোনও প্রভাব পড়ল এ শহরে? কিচ্ছু হয়নি। কেন যে লোকজন বাজি আর ধোঁয়ার গালমন্দ করে!” বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ যাত্রায় কিছুটা হলেও বেঁচে যেতে পেরেছি কারণ কালীপুজোর দিনটা শহরে হাওয়া খেলেছিল অন্য দিনের থেকে বেশি। তাপমাত্রাও বেড়েছিল কিছুটা। ধূলিকণা বাতাসে ভেসে বেড়ানোর জন্য যে ভৌগোলিক ব্যবস্থা থাকা দরকার, তার সবকটি উপাদান ঠিকমতো মজুত ছিল না। ফলে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা থেকে যতটা ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি। তবে এর সঙ্গে তাঁরা এটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন, শব্দবাজি এবং শব্দজনিত তাণ্ডবের জন্য যা ক্ষতি হতে পারে, সেগুলো সবই হয়ে গিয়েছে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোনোর সঙ্গে এর ক্ষতিগুলো আমাদের নজরে আসবে।

শব্দ নিয়ে আমাদের এমন উল্লাসের কারণ কী? যতটুকু আওয়াজ সহ্য করার ক্ষমতা আছে আমাদের কর্ণকুহরের, তার থেকে অনেক বেশি ডেসিবেল ধ্বনিত হলে আমাদের মনের মধ্যে কি কোনও আনন্দ খেলা করে? সেই আনন্দের রূপ কেমন— মায়াময় না দানবিক? সামান্য কোনও অনুষ্ঠানে ডিজে বক্সের যে হুঙ্কার এবং সেই প্রকট আওয়াজের সঙ্গে লেপ্টে থাকা সংস্কৃতি দেখি আজকাল, ছোটবেলায় কাটানো সময়ের সঙ্গে তার কোনও মিল পাই না। উৎসব তো তখনও ছিল! ছিল আন্তরিকতাও। তা হলে? প্রবল আওয়াজে কি সুখমুহূর্ত যাপনের গায়ে গয়না পরিয়ে দিই আমরা? আমাদের মনের অন্দর নিয়ে কাজ করা এক বন্ধুর কথায়, “একটা হিংস্র জন্তু লুকিয়ে রয়েছে আমাদের কারও কারও মনের গভীর গোপন খাঁজে। প্রতি মুহূর্তে অবদমিত হতে হতে, শোষিত হতে হতে ওই জন্তুগুলো কোনও একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। নখ-দাঁত বের করার জন্য কোনও উপলক্ষ লাগে। বিকট শব্দে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য মানুষটা গায়ে পাউডার মাখে। ডিওডোরেন্ট দেয়।” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সে তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু শব্দ নিয়ে এই মাদকতা কেন?” ও উত্তর দিয়েছিল, “আমারই জন্ম দেওয়া শব্দে যদি দু-সেকেন্ডের জন্য হলেও কাঁপিয়ে দিতে পারি তামাম দুনিয়া, আমি তো আসলে ওইটুকু সময়ে জিতে গেলাম। আর জেতার স্বাদটা তো সুরার মতোই, তাই না? উৎসবের পর্দার আড়ালে কালীপুজো-দিওয়ালির রাত আমাদের সেই সুযোগ এনে দেয়। ডিজে বক্সের আওয়াজ যদি নিম্নচাপের বৃষ্টি হয়, এ যে হড়পা বান। সুযোগ কেউ ছাড়ে?”

আলোর বাজি এবং সেই বাজিকে কেন্দ্র করে আনন্দের চল রয়েছে বিশ্বজুড়ে। উৎসব যাপনের সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে রয়েছে। মিশে থাকবেও। ফেলে আসা বছরের শেষ দিনটা যখন নতুন বছরের প্রথম দিনের সঙ্গে মিশে যায়, দুনিয়াজুড়ে চলে আলোর উৎসব। টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, আইফেল টাওয়ার কিংবা সিডনি হার্বার সেতুর পিছনের কালো আকাশটাকে মুহূর্তে রাঙিয়ে আলোর রোশনাই। আন্তর্জালে জানলাম, অন্ধকার আকাশের পর্দায় যে মায়াবী আলপনা এঁকে দেয় আতসবাজির আলো, তা আমাদের মনের মধ্যে সুখ নিয়ে আসে। নিঃসৃত হয় ডোপামিন হরমোন— আমাদের সুখের চাবিকাঠি। আতসবাজি জ্বালানোর সময় থেকে আকাশে তা আলোসহকারে বিলীন হয়ে যাওয়া— এই পুরো সময়ের মধ্যে আমাদের মনে যা চলে তা হল ভয়মেশানো আনন্দ, কাকাবাবুর প্রথম উপন্যাসের নামের মতো, ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। আমরা জানি, এমন বাজিতে শুধু আলোটুকুই থাকে। সঙ্গে থাকা শব্দ, যতটুকু থাকে, তা খবরের শিরোনামে আসে না।

উৎসবে সমান মজে গিয়েও অন্য দেশের ভিন্ন যাপন, আমাদের অনেক কিছু শেখায়। অন্তত চেষ্টা করে।

শেখা কিংবা না-শেখা, কিংবা শিখেও শেখার চেষ্টা না-করা অবশ্য আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে।


*মতামত ব্যক্তিগত