শুভদীপ ঘোষ
জোসেফ কনরাডের উপন্যাসটি আসলে ঔপনিবেশিক বয়ানের ‘কন্ট্রাপান্টাল’ (বিরুদ্ধ) পাঠ। একইভাবে ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার চলচ্চিত্র উত্তর-ঔপনিবেশিক বাতাবরণে মার্কসবাদ নামক আধিপত্যকামী বয়ানের বিরুদ্ধাচরণের ‘কন্ট্রাপান্টাল’ পাঠ। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে কি উপন্যাস কি ছবি উভয়তই এই ‘কন্ট্রাপান্টাল’ পাঠ আসলে ঔপনিবেশিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিসের প্রভুদের মন ভেজানো নিজেদেরই দুষ্কর্মের চিত্তবিনোদনমূলক আখ্যান। যার মধ্যে আফ্রিকার মানুষদের বা ভিয়েতনামের মানুষদের নিজস্ব স্বরের ছিটেফোঁটাও নেই
জোসেফ কনরাডের (১৮৫৭-১৯২৪) জন্ম হয় বর্তমানের ইউক্রেনে। পোলিশ জমিদার বংশে জন্মানো কনরাড যদিও পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক হিসেবে, কিন্তু তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন কুড়ি বছর বয়সে এসে। তার পূর্বে বিন্দুমাত্রও ইংরেজি জানতেন না। ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং ওঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘অ্যালমেয়ার’স ফলি’। এরপর একে একে কনরাডের অনেকগুলি উপন্যাস বেরোয়— ‘দা নিগর অফ নারসিসস’, ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’, ‘লর্ড জিম’ এবং ‘নস্ত্রামো’। বেশিরভাগ উপন্যাসেরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল সমুদ্র, দ্বীপান্তর, পেশাদার নাবিক চরিত্র ইত্যাদি বিষয়গুলির ফিরে ফিরে আসা। আসলে কনরাড তাঁর জীবনে একটা সময়ে নিজেই একজন পেশাদার নাবিক ছিলেন। বর্তমান আলোচ্য ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ উপন্যাসটির উৎসই হল কনরাডের নাবিক হিসেবে যাত্রার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। ১৮৯০ সালে নাবিক হিসেবে তাঁকে পশ্চিম আফ্রিকার কঙ্গো-তে যেতে হয়। বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির হয়ে তিনি ওখানে যান। কঙ্গো নদীতে মোতায়েন করা একটি স্টিমারের দায়িত্ব নিতে তাঁকে ক্যাপ্টেন করে পাঠানো হয়। বেলজিয়ামের শাসন-কর্তা দ্বিতীয় কিং লিওপোল্ড ওই সময়ে কঙ্গো অববাহিকার একটা বড় অংশকে বেলজিয়ান উপনিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। সঠিকভাবে বললে এই কাজটি করা হয় ১৮৭০ সালে। কনরাড ১৮৯০ সালে যখন ওখানে যাচ্ছেন ততদিনে অঞ্চলটি ঔপনিবেশিক বর্বরতা এবং শোষণের জন্য কুখ্যাত হয়ে গেছে। ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা ‘প্রাচ্যবাদ’ নামক বয়ানের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত কীভাবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কাছে জ্ঞানের প্রয়োজনীয় উপাদানে পরিণত হয়েছিল তা বহুল আলোচিত। আমরা এটাও জানি যে কীভাবে ঔপনিবেশিক বয়ানের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াটিকে ন্যায্যতা প্রদান করা হয়। এখন ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা ‘প্রাচ্যবাদ’ই কিন্তু একমাত্র ঔপনিবেশিক বয়ান নয়। আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সবটা যে ইউরোপের (ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি ইত্যাদি) অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বা দখলদারিতে চলে যায় ‘প্রাচ্যবাদ’-এর সঙ্গে সে-বয়ানে তফাত থাকলেও অন্তর্নিহিত যুক্তিতে তেমন তফাত ছিল না।
অর্থাৎ ঔপনিবেশিক বয়ান আফ্রিকার ক্ষেত্রেও আফ্রিকাকে নির্মাণ করে বর্বর, অজ্ঞ এবং শিশুসুলভ হিসেবে যেখানে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরণ তাদের মতে মোটেই কোনও শোষণমূলক অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, বরং এটি হল civilizing mission। যুক্তিটা খুবই স্বচ্ছ যে এই অসভ্য আফ্রিকানরা ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়ে আসলে উপকৃতই হবে। তার মানে এই ঔপনিবেশিকরণ আসলে ইউরোপিয়ানদের থেকে অনেক বেশি আফ্রিকানদের কাছে উপকারী! অন্যভাবে বললে ঔপনিবেশিকরণের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক ও সভ্য ইউরোপীয়রা প্রকৃত-প্রস্তাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে শিশুসুলভ আফ্রিকাকে যাতে তারা শীঘ্রই সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে! কনরাডের উপন্যাস ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ একদিকে যেমন ওই অঞ্চলের আফ্রিকানদের উপর অমানুষিক ঔপনিবেশিক অত্যাচার নিয়ে কথা বলে, অন্যদিকে আবার এটি ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার এই নৃশংস শারীরিক বাস্তবতা এবং ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-কেন্দ্র বা মেট্রোপলিসগুলির ভেতর থেকে সৃষ্ট ঔপনিবেশিকতার বয়ানের মধ্যেকার ব্যবধান নিয়ে একটি নিরীক্ষা, যা আসলে এই প্রক্রিয়াটিকে civilizing mission হিসাবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছিল। ঔপনিবেশিক বয়ান ও ঔপনিবেশিক পদ্ধতির মধ্যেকার এই ব্যবধানটিকে অনুধাবন করা যায় যদি আমরা উপন্যাসটির নামটির দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকাই।
উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র মার্লো নির্মিত হয়েছেন অনেকটা ঔপন্যাসিক কনরাডের আদলেই। একটি বেলজিয়ান কোম্পানি মার্লো-কে কঙ্গো অভিযানে পাঠায়। জোসেফ কনরাডের মতোই কঙ্গো নদীতে মোতায়েন করা একটি স্টিমারের দায়িত্বে তাকে ক্যাপ্টেন করে পাঠানো হয়। তার প্রধান কাজ হল কার্ৎজ নামে একজন রহস্যময় ব্যক্তিকে সনাক্ত করা। কার্ৎজ হল এমন একটি চরিত্র যাকে ধীরে ধীরে চিত্রিত করা হয়েছে এবং চরিত্রটির এই ক্রমান্বয়ে উদ্ঘাটনই হল এই উপন্যাসটির কাহিনির বিস্তৃতি। কিন্তু উপন্যাসটির সূত্রপাতে আমরা যেটা বুঝতে পারি তা হল এই কার্ৎজ আসলে ইউরোপের প্রতিনিধি যিনি ওই একই বেলজিয়ান কোম্পানির জন্য কাজ করেন এবং কঙ্গো অঞ্চলের গভীরে অর্থাৎ আফ্রিকার গভীরে বসবাস করেন। কাজেই একটা স্তরে এটা হল আফ্রিকার গভীরে মার্লো-র যাত্রা যাকে সূচিত করা হচ্ছে জার্নি টু দা ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ হিসেবে। এখন আফ্রিকা ও ডার্কনেস বা অন্ধকারের মধ্যে সম্বন্ধটা কী? বস্তুত আফ্রিকাকে ঔপনিবেশিক বয়ানে বারংবার অন্ধকার মহাদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং এই অন্ধকারের সঙ্গে সূর্যালোকের অভাবের কোনও সম্পর্ক নেই। আফ্রিকা যথেষ্ট সূর্যালোক পায়। এই অন্ধকার আসলে আফ্রিকার ব্যাপারে জ্ঞানের অভাবকে সূচিত করে। ইউরোপীয়দের কাছে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত আফ্রিকার অভ্যন্তর ছিল অপ্রকাশিত এবং সেহেতু ম্যাপবিহীন অঞ্চল। ফলে ইউরোপীয়দের কাছে তদানীন্তন জানা পৃথিবীর যে ম্যাপ উপলব্ধ ছিল সেখানে এই অজানা অপ্রকাশিত আফ্রিকা ছিল খালি অঞ্চল। ফলে একে চিহ্নিত করা হত অন্ধকার মহাদেশ হিসেবে। কিন্তু আফ্রিকার বিষয়ে যে ঔপনিবেশিক বয়ান সেখানে অন্ধকার এবং আলো আসলে নৈতিক অবস্থানকেও নির্দেশ করে। এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা অন্ধকার যেহেতু একে বিবেচনা করা হয় বর্বর, আদিম এবং শিশুসুলভ হিসেবে যে নৈতিকভাবে ভাল-খারাপের মধ্যে তফাত করতে পারে না। এর বৈপরীত্যে ইউরোপ হল আলোকিত, জ্ঞান ও সভ্যতার পীঠস্থান। ফলে ইউরোপ বিবেচিত হবে সেই শক্তি হিসেবে যারা তাদের উপনিবেশগুলিতে সভ্যতার আলো নিয়ে আসার জন্য নিবেদিত! এখন এই আলো-অন্ধকারের দ্বৈতকেই কনরাড তাঁর উপন্যাস ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-এ পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন।
উপন্যাসটির শুরুতে আমরা দেখতে পাই মার্লো তার যাত্রাপথে প্রথম যেখানে গিয়ে পৌছায় তাকে বলা হয় আউটার স্টেশন। এরকম একাধিক স্টেশনের কথা আছে উপন্যাসটিতে। যেরকম আউটার স্টেশন, সেন্ট্রাল স্টেশন, ইনার স্টেশন। এই স্টেশনগুলি কী সূচিত করে? এগুলি আসলে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক কার্যকলাপের বিভিন্ন স্থান। অর্থাৎ এগুলি হল ইউরোপীয় উপনিবেশকারী ও নেটিভ আফ্রিকানদের মধ্যে যোগাযোগের অঞ্চল। এবং ঔপনিবেশিয়ানের যুক্তি অনুযায়ী এগুলি হল প্রগতি ও সভ্যতার অঞ্চল। বলাবাহুল্য কনরাডের এই উপন্যাসে বাস্তবে মার্লো যা দেখতে পায় তা সম্পূর্ণ আলাদা। সে-কথায় আমরা ধীরে ধীরে আসব। এখন কনরাডের উপন্যাসের এই কাঠামোটিকেই ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা (১৯৩৯-) ব্যবহার করেছেন ভিয়েতনাম সংক্রান্ত তাঁর ছবি ‘অ্যাপকালিপ্স নাউ’ (১৯৭৯) নির্মাণে। কাপোলা উপরন্তু তাঁর ছবিতে নিয়ে এসেছেন লিবারেশন থিওলজি, ষাটের দশক-উত্তর প্লেবয় পত্রিকার পর্নোসাংস্কৃতিক চিহ্নায়ন এবং অন্ধ-জাতিগর্বিতার গৌরবায়নে নিটশীয় অতিমানবের ধাঁধা। ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-র ডার্কনেসকে কাপোলা শয়তানের হৃদয়ের প্রতিলিপি হিসেবে দেখলেও যারপরনাই মহিমান্বিত করেছেন গোটা ব্যাপারটিকে। উত্তর-ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিসের মানুষদের কাছে যা অতিশয় উপভোগ্য।
উপন্যাসের মার্লো-র আদলে নির্মিত হয় অ্যাপকালিপ্সের ক্যাপটেন উইলার্ড। উপন্যাসের কঙ্গো নদী অ্যাপকালিপ্সে ভিয়েতনামের নাং বা মিকং নদী। কার্ৎজ, উপন্যাসের মতো এখানেও আছেন। ছবিতে উইলার্ড-কে (মার্টিন শিন অভিনীত) নাং নদী পারি দিতে হয় “(to) Pick Up Col. Kurtz’s (মার্লন ব্র্যান্ডো অভিনীত) path at Nu Mung Ba… follow it, learn what you can along the way. When you find the colonel, infiltrate his team by whatever means available and terminate the Colonel’s command.” ছবির শুরুর দিকে মানবচিত্তে যৌক্তিক-অযৌক্তিক শুভ-অশুভের যে দ্বন্দ্ব চিরকালীন সে প্রসঙ্গ আসে এবং বলা হয় যাকে লিঙ্কন বলেছিলেন ‘মনুষ্যপ্রকৃতির তিক্ত ফেরেশতা’ অর্থাৎ মানবচিত্তের অন্ধকার দিক কার্ৎজ তাতে উপনীত হয়েছেন! কার্ৎজ-কে নু মুং বা-র অধিবাসীরা ঈশ্বর বলে মনে করে এবং তারা কার্ৎজ-এর সমস্ত নির্দেশ, তা যত অদ্ভুতই হোক, নির্দ্বিধায় পালন করে! নাহ ট্র্যাঙের মার্কিন কমসেক ইন্টেলিজেন্সের কাছে কার্ৎজ এদিকে ক্রমপরিণতিতে উন্মাদ। শুধু কার্ৎজ নয় এই উন্মাদনা এ ছবির এবং কনরাডের মূল উপন্যাসেরও অন্যতম চালিকাশক্তি। কনরাডের ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ যদি কঙ্গোয় বেলজিয়ামের ঔপনিবেশিক উন্মাদনার প্রতিন্যাস হয় তাহলে কাপোলা ‘অ্যাপকালিপ্স নাউ’-এ সেটিকে সংস্থাপিত করেছেন ভিয়েতনামে হো চি মিন ও গেরিলা যোদ্ধাদের পার্টি ভিয়েতকঙের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে মার্কিনি উন্মাদনার দ্বারা। মনে রাখতে হবে আমেরিকানরা পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনামে যাওয়ার আগে তা ফরাসি কলোনি ছিল।
এ-তথ্য আমাদের জানা যে লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে স্যাচুরেশান বম্বিং করা হয়। অর্থাৎ দেশগুলির সামান্যতম অংশও যাতে অক্ষত না থাকে তা নিশ্চিত করা হয়। ছবিতে আউটার স্টেশনে এই ঘটনা দেখানো হয়েছে।
উপন্যাসে আউটার স্টেশন হল রেলপথ নির্মাণ নামক ঔপনিবেশিক সুকীর্তির সর্বজনীন স্মারক। ঔপনিবেশিকতার কৈফিয়তদানকারীরা ঔপনিবেশিকতার আশীর্বাদ হিসেবে এই রেলকেই সারা পৃথিবীতে তুলে ধরেন। কিন্তু এখানেই গোলমাল। মার্লো দেখেন রেলপথ নির্মাণ কিছু হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলি সবই পরিত্যক্ত। চারপাশে ইতিউতি রেলপথ নির্মাণের জন্য বিস্ফোরণও ঘটছে কিন্তু নির্মিত রেলপথ জঙ্গলের আগাছায় হারিয়ে গেছে। উপরন্তু ঔপনিবেশিক বয়ান অনুযায়ী যে সমৃদ্ধি ওই অঞ্চলে রেলের আনার কথা ছিল তার ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই। যেন রেল নামক ইউরোপীয় একটা জিনিসকে গায়ের জোরে আফ্রিকার ভূপ্রকৃতিতে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। রেল, নেটিভ আফ্রিকানদের সুবিধে না করে তাদের পায়ে পরিয়েছে লোহার শিকল! সারি সারি কালো মানুষকে পায়ে শেকল পরিয়ে বেত্রাঘাত করতে করতে নিয়ে যাওয়া ও তদুপরি অমানুষিক অত্যাচার— এই ছিল মার্লো-র আউটার স্টেশনের অভিজ্ঞতা! অর্থাৎ যুগ ও সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিবেশের ভিন্নতায় কনরাড ও কাপোলার আউটার স্টেশনে তফাত থাকলেও সারমর্মের দিক থেকে গভীরে মিল আছে দুটিরই। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ মার্কসবাদের ভয় থেকে এ-কথা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, কারণ পুঁজিবাদ-মার্কসবাদের দ্বিমেরুকৃতাবস্থান, তেমনি এর অন্য এক ধরনের চিন্তাকৌশলও আমরা মার্কিনদের পরবর্তীকালের কার্যকলাপ থেকে পেতে পারি। তাদের ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল লিবারেশন থিওলজিকে সমূলে উৎখাত করা। এই থিওলজির চৌহদ্দিতে ইসলাম ঢুকে পরে, ঢুকে পড়ে ক্যাথলিক চার্চ। এ এক অদ্ভুত সত্য যে, যে-ধর্মে ধর্মীয় গোঁড়ামি যত বেশি সেই ধর্মের মানুষ তত বেশি এককাট্টা। কিন্তু এটা যদি পশ্চিম-দুনিয়ায় র্যাডিকাল ইসলামের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের অন্যতম নৈতিক শক্তি হয় তবে আবার অন্যদিক দিয়ে ইসলাম-খ্রিস্টানের যে বৈরিতা (ক্রুসেড ও তৎপরবর্তী) ঐতিহাসিক তাও অপর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। এখন এই লিবারেশন থিওলজি নিচু শ্রেণির মানুষের অগ্রাধিকারে সোচ্চার, যেমন ক্যাথলিক চার্চ, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলিতে। আর এখানেই এক ধরনের সন্দেহ যেহেতু মার্কসবাদও এ-ব্যাপারে সোচ্চার এবং অবশ্যই তাত্ত্বিক ভিত্তিতে ক্যাথলিসিজমের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্কই নেই। সাধারণত কোনও কীর্তিকে আমরা পরে নাম প্রদান করি, ফলে তাদের যে লিবারেশন থিওলজি তা মার্কসবাদের ভয়ের ক্রমপরিণতি হতে পারে। তাদের মানসপটে এ চিন্তাকৌশল খুব অমূলক বলে মনে হয় না। আবার আরেকভাবে ভাবলে আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধ আসলে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ঘটা একপ্রকার ছদ্ম-উপনিবেশায়ন।
আউটার স্টেশন ত্যাগ করে এগোতে থাকে উইলার্ডদের স্টিমার। উইলার্ড ও তার সঙ্গীরা একটা উড়োজাহাজ দেখতে পায় যেটার গায়ে একটা খরগোশের মাথা আঁকা রয়েছে। এটি জনপ্রিয় মার্কিন পর্নোপত্রিকা ‘প্লেবয়’-এর লোগো। তথ্যানুযায়ী, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় যাতে মারিলিন মনরোর একাধিক ছবি বেরোয়। হিউগ হফনার যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারিতে যোগদান করেন এবং কিছুদিনের মধ্যে বিতাড়িত হন, পরবর্তীকালে ইনিই এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই খরগোশের মাথা বিনোদনবিশ্বে প্রায় একটি কাল্টে পরিণত হয়েছিল। হফনারের ভাষায় “I selected a rabbit as the symbol for the magazine because of the humorous sexual connotation, and because he offered an image that was frisky and playful.” এবং অন্যত্র “I never intended to be a revolutionary, my intention was to create a mainstream men’s magazine that included sex in it, that turned out to be a very revolutionary idea.” এই ‘প্লেবয়’কে কাপোলা ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্রে উড়োজাহাজের গায়ে স্থান দেন। ল্যান্স (স্যাম বটম অভিনীত) এক রমণীর সঙ্গে এখানে যৌনতা করে এবং ক্লিন (লরেন্স ফিশবার অভিনীত) বাইরে বৃষ্টিতে অপেক্ষা করে সুযোগ পাওয়ার জন্য। সেন্ট্রাল স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে ঘটা এইসবের কোনওকিছুই কনরাডের উপন্যাস থেকে নেওয়া নয়। কাপোলা যৌনতাকে এখানে নিয়ে এসেছেন সাদা মানুষের অবসর বিনোদনের অনুকল্পে। খামখেয়ালি, উদ্দেশ্যবিহীন ও অদ্ভুত এক যুদ্ধযুদ্ধ খেলা যেন, যেখানে ক্ষমতা ও শক্তি উদ্বৃত্ত! উপন্যাসে আছে মার্লো ষাটজন সঙ্গীকে নিয়ে সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে রওনা দেন। স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারেন তাঁর স্টিমবোটটি দুর্ঘটনার জন্য ভেঙে গেছে। মার্লো স্টিমবোটটি সারাইয়ের ব্যবস্থা করেন কিন্তু যন্ত্রপাতির অভাবের জন্য প্রায় এক মাস সময় লেগে যায়। ইতিমধ্যেই তিনি জানতে পারেন কার্ৎজ অসুস্থ এবং মিলিটারি হাইকম্যান্ড তাঁর ব্যাপারে যারপরনাই বিরক্ত।
মার্লো ইনার স্টেশনের দিকে যত এগোতে থাকেন ঔপনিবেশায়নের উদ্দেশ্য ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক তাঁর চোখে তত ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। এই অসমতা সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রতিভাত হয়েছে মার্লো-র কার্ৎজ আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মার্লো এমনকি ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার আগেই তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন। একজন গুণী ব্যক্তি হিসেবে তাকে প্রশংসিত হতে শুনেছেন মার্লো। শুনেছেন কার্ৎজ একজন উঁচু মাপের মানুষ যিনি ইউরোপের সমস্ত সভ্যতাগত গুণগুলিকে ধারণ ও প্রকাশ করেন। কার্ৎজ প্রারম্ভে উপস্থাপিত হয়েছেন একজন আইকনিক ইউরোপীয় হিসেবে। এবং কার্ৎজ-কে সবচেয়ে দক্ষ এজেন্টদের মধ্যে একজন হিসেবে দেখা হয়, যিনি ইউরোপে পাঠানোর জন্য আফ্রিকার অভ্যন্তর থেকে প্রচুর পরিমাণে হাতির দাঁত সংগ্রহের কাজ করেন। এই হাতির দাঁত ছিল ইউরোপীয়দের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বা ঘর সাজাবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান যা তারা আফ্রিকা থেকে আহরণ করে নিয়ে যেত। মার্লো ইনার স্টেশনে কার্ৎজের সঙ্গে শেষাবধি যখন দেখা করেন তখন আবার তাঁকে সেই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয় যা কার্ৎজের ব্যাপারে এতদিনের শোনা ভাবমূর্তির থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। মার্লো প্রথমবার যখন নদীর পারে কার্ৎজের বাড়ি দেখতে পান, দূরবীনে লক্ষ করেন বাড়ির চারপাশে কাঠের খুঁটিগুলির উপরে সুসজ্জিত নবের মতো কী যেন সব রয়েছে। একটু ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে মার্লো শিউরে ওঠেন কারণ ওগুলো হল স্থানীয় আফ্রিকান অধিবাসীদের মাথার খুলি! স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য এটা করা হয়েছিল। এই ভয়ঙ্কর কাজটি করা হয় যাতে স্থানীয়রা বিনা প্রতিবাদে ভয়ে কার্ৎজের হয়ে হাতির দাঁত সংগ্রহের কাজ করে দেয়! প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল ঔপনিবেশিক দালাল হিসেবে কার্ৎজের দক্ষতার রহস্য। এই পুরো ব্যাপারটাই কাপোলার ছবিতে আছে, তফাত হল হাতির দাঁত সংগ্রহের বদলে সেখানে আতঙ্ক ছড়ানোর কারণ হল মার্কসবাদের বিস্তারকে রোধ করা!
‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ বা ‘অ্যাপকালিপ্স নাউ’ শিরোনাম দুটি এইখানে এসে যেন অনুমিত তাৎপর্যটি গ্রহণ করে। শয়তানের অন্ধকার হৃদয়ের দিনলিপি হয়ে ওঠে উপন্যাসটি ও ছবিটি। নির্দিষ্টভাবে উপন্যাসটি ঔপনিবেশিক বয়ানের মাথাটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে প্রকৃত অর্থে ঔপনিবেশিক নির্মম বাস্তবতার বিরুদ্ধে স্থাপন করা civilizing mission নামক মিথকে বে-আব্রু করে দেয়। কিন্তু কাপোলার ছবি যেহেতু উত্তরঔপনিবেশিক বাতাবরণে নির্মিত এবং প্লটটিও সামাজিক-ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন তাই তাঁর কার্ৎজ ও কনরাডের কার্ৎজ-এ তফাৎ আছে।
গভীর অর্থে কাপোলার কার্ৎজ বশীভূত ডায়োনিসিয় (Dionysus) প্রাণশক্তির কাছে। আসলে কাপোলা কার্ৎজকে গড়ে তোলেন নীটশীয় (ফ্রেডরিক নীটশে) বাচনে থুড়ি Übermensch (অতিমানব)-র আদলে। মুণ্ডিত মস্তক কার্ৎজের ম্যানারিজামে সেই ব্যাপারটাই প্রবল। অন্ধ-জাতিগর্বিতার এ আরেক চেহারা।
ডায়োনিসাস ও অ্যাপোলো (Appolo) গ্রিক পুরাণের দুই দেবতা। অস্তিত্বের দুই মৌল ও বিপরীত প্রবণতার প্রতীক হিসেবে নিটশে এই দুই দেবতাকে মনে করেছিলেন। ডায়োনিসাস প্রবণতা যেখানে শক্তির ও ক্ষমতার আদি অন্তহীন প্রবাহ, অ্যাপলো প্রবণতা সেখানে যুক্তিনিষ্ঠতা, প্রশান্তি ও স্বচ্ছতা। আসলে নিটশের সমগ্র দর্শনের প্রাণকেন্দ্রে ছিল শক্তি। শক্তিলাভের জন্য প্রয়োজন হলে সমস্ত ন্যায়নীতিও বর্জন করতে হবে। অর্থাৎ ন্যায়নীতি যা বিচার (Judgement) করতে প্রণোদিত করে তা শক্তিলাভের পথে এক ধরনের বাধা। এভাবেও বলা যায় যে ডায়োনিসাস প্রবণতাই অস্তিত্বের চিহ্ন হিসেবে প্রকট হবে (নিটশের অতিমানবে এ প্রবণতাই প্রবল) এবং এর জন্য যা চাই তা হল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। এখন বিচার (Judgement) যদি অবরুদ্ধ হয় তাহলে হত্যারও তত্ত্বায়ন (Theorisation) সম্ভব। করুণা, মৈত্রী, ভালবাসা নিটশের মতে মানবিক দুর্বলতা এবং সেহেতু অবশ্য বর্জনীয়। এগুলো দাসসুলভ (Slaves) নৈতিকতা! পৃথিবীতে যে দু-চারজন বিরল ব্যক্তিত্ব যুদ্ধকে বরণীয় বলে মনে করেছেন, নিটশে তাদের মধ্যে একজন। আসলে যুদ্ধ ক্ষমতার লড়াই এবং পরিশেষে অধিকতর ক্ষমতার জয়। ফলে যুদ্ধান্তে উন্নততর মূল্যের জগৎ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যেখানে সাহস, আত্মোৎসর্গ, মহত্ব প্রভৃতি সৎ গুণ বিকশিত হয়। আসলে এ ব্যাপারে নিটশে যতটা আদর্শবাদী বা কাল্পনিক সে অনুপাতে বিন্দুমাত্রও বাস্তব অর্থে মনুষ্য-চরিত্রানুগ নয়। শক্তির আদিম অন্তহীন প্রবাহ প্রকট হলে এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেলে ভিয়েতনাম হয়। ক্ষমতার যে বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ উইলার্ডরা তাদের যাত্রাপথে অবলোকন করেছে, তা উন্মাদ মানবমনের এক অন্তহীন অন্ধকার। অথচ ভাবা যায় একটি গোটা দর্শন এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে! একদা মার্কসবাদের ভয়ে যারা আদর্শের যুদ্ধ করে তারাই যেন নাৎসিবাদের হাত ধরে! তাই যখন ছবির চিত্র সাংবাদিক কার্ৎজের উদ্দেশ্যে বলে, “The man is clear in his mind but his soul is mad,” তখন এটাই ছবিটির মূল স্পিরিটটাকে ধরে।
বোঝা যাচ্ছে জোসেফ কনরাডের উপন্যাসটি আসলে ঔপনিবেশিক বয়ানের ‘কন্ট্রাপান্টাল’ (বিরুদ্ধ) পাঠ। একইভাবে ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার চলচ্চিত্র উত্তর-ঔপনিবেশিক বাতাবরণে মার্কসবাদ নামক আধিপত্যকামী বয়ানের বিরুদ্ধাচরণের ‘কন্ট্রাপান্টাল’ পাঠ। কাপোলা তত্ত্বায়ন করে এর মধ্যে উপরন্তু নিয়ে এসেছেন দর্শনের চমক যা উপরের অধ্যায়ে বলা হয়েছে। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে কি উপন্যাস কি ছবি উভয়তই এই ‘কন্ট্রাপান্টাল’ পাঠ আসলে ঔপনিবেশিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিসের প্রভুদের মন ভেজানো নিজেদেরই দুষ্কর্মের চিত্তবিনোদনমূলক আখ্যান। যার মধ্যে আফ্রিকার মানুষদের বা ভিয়েতনামের মানুষদের নিজস্ব স্বরের ছিটেফোঁটাও নেই। ফলত সুধী পাঠক ও অধম এই প্রাবন্ধিকের কাছে প্রকৃত-প্রস্তাবে পরিশেষে এত কিছুর পরেও ভাবনার জন্য পড়ে থাকে খোদ উপন্যাসটিরই এবং ছবিটিরই ‘কন্ট্রাপান্টাল’ বা বিরুদ্ধ পাঠ।