উন্মেষ মিত্র
দেবাশিসবাবু বাংলার শিক্ষক। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে মধ্যবঙ্গের একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সম্মানের সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। দেবাশিসবাবু চাকরি করার কয়েকমাস পরই রাজ্যে প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত পট পরিবর্তন হয়। ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে শাসন ক্ষমতায় আসেন “অসুরবিনাশিনী”। দেবাশিসবাবু ছাত্রাবস্থা থেকেই অর্ধ-নকশাল। ধর্মের পাশাপাশি জিরাফে চড়তেও তিনি সমান পারদর্শী। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি, গাত্রবর্ণ মাজা, শরীরের কোথাও মেদ না থাকলেও দেহের মধ্যভাগে কিছু অবাঞ্ছিত মেদ জমা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়াও দেবাশিসবাবু বাড়িতে টিউশন পড়ান, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। লোককথায় আছে, যার যত আছে, তার খাই তত বেশি। অন্যদের কথা জানা নেই, তবে দেবাশিসবাবুর ক্ষেত্রে কথাটা হুবহু মিলে যায়। পিতা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ছিলেন, মা ছিলেন ওঁর মাতা-পিতার একমাত্র কন্যা। তা-সত্ত্বেও দেবাশিসবাবু বিয়ের সময়ে ফোর হুইলার গাড়ি চেয়ে নিয়েছেন, আর না চেয়ে রেফ্রিজারেটর, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি এলইডি, শোওয়ার খাট এমনকি খাটের ওপরের গদিটা পর্যন্ত।
দেবাশিসবাবুর পিতা চাকরিজীবনে ঘুষখোর ছিলেন। কিন্তু আদর্শগতভাবে তিনি প্রগতিশীল। পুকুর বোজানোর টাকা পকেটে ভরেন আবার পরিবেশ বাঁচানো নিয়ে সভা-সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সভ্য। ইউনিয়ন বলশেভিক আর চায়ের দোকানে গো-সেবক।
দেবাশিসবাবু কলেজজীবনে মুখের বন্দুকের নল-নির্ভর রাজনীতি করেছেন। মুখে হ্যান কারেঙ্গে, ত্যান কারেঙ্গে আর তারপর সেই বিদ্রোহের আগুনে বিড়ি জ্বালিয়ে কে হবে আগামীর মৈত্রেয় থেকে আগামীর লেনিনে পৌঁছে সেমিনার শেষ হত। ব্যবস্থার পরিবর্তন ছিল তাঁর সেই স্বপ্ন যা তাঁকে রাতে ঘুমাতে দিত না, রাজ্যে পট পরিবর্তনের পর সেই দেবাশিসবাবু হয়ে গেলেন জেলার শিক্ষক সেলের হর্তাকর্তা। এখন আর সেমিনার হয় না, তবে পাঁচতারা হোটেল, পুরোটাই ভাড়া করে অনেক আলোচনা হয়। তবে এখন আলোচনার বিষয়ে আর মৈত্রেয় বা লেনিন আসেন না, এখন আলোচনা জুড়ে শুধুই নানান রঙের গান্ধিজি।
এখনও পর্যন্ত আমরা যেটুকু বুঝলাম তাতে দেবাশিসবাবু নিপাট ভালমানুষ। উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবংশের সন্তান, সমাজে সম্মান রয়েছে, মা এবং মাটির আশীর্বাদ রয়েছে। মানুষ হিসাবে দেবাশিসবাবু কেমন তা নিয়ে বিতর্ক হলেও ও-ই কথায় আছে— সফলদের পিছনে বিফলরা কূটকাচালি করেই থাকে।
এহেন দেবাশিসবাবু একদিন পড়ন্ত বেলায় বিদ্যালয় চলাকালীন বিদ্যালয়ের সামনের মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন, এই মাঠটা কোনওভাবে বিক্রি করে দিতে পারলে দিয়েথুয়ে হাতে মন্দ থাকত না। এমন সময়ে সেই মাঠে কোত্থেকে এসে হাজির একটি কালো ঘোড়া। ঘোড়া দেখে চোখের চশমাটা খুলে পরনের জামা দিয়ে সেটির কাচ পরিষ্কার করে চশমাটি পরলেন। বিলক্ষণ কালো তাগড়া একটি ঘোড়া। এই বিদ্যালয়ে বিগত প্রায় বারো বছর ধরে পড়াচ্ছেন দেবাশিসবাবু। কিন্তু জীবনে কোনওদিন ঘোড়া দেখেননি। দেবাশিসবাবু বেশ কয়েকদিন ধরে ইউটিউবে ঘোড়ার ভিডিও দেখছিলেন, নানান জাতের সুন্দর সুন্দর ঘোড়া। ঘোড়ার দেহ পরিচর্যা থেকে ঘোড়ার ক্ষুরে নাল পরানো, গত এক সপ্তাহে অনবরত দেখেছেন দেবাশিসবাবু। সেরকমই একটা তাগড়া ঘোড়া বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে এখন দেবাশিসবাবুর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে। প্রথম দেখাতেই, মনে হল এটাকে বেচে দিলে ভাল দাম পাওয়া যাবে। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার জানালেন দেবাশিসবাবু। এই এক নতুন রোগ হয়েছে তাঁর, অন্যের যা-ই দেখেন বেচে দিতে ইচ্ছে করে। সেদিন ক্লাসে ঢুকে হঠাৎ মনে হল এই বিদ্যালয়গুলো বেচে দিলে কেমন হত? ভেবেই উনি জিভ কাটলেন, এই পরিকল্পনা তো ইতিমধ্যে অন্য কেউ করে ফেলেছেন, সেই কাজও চলছে। চাকরি নিয়ে আজকাল বেশি ভাবিত না দেবাশিসবাবু। পার্সেন্টেজ হিসাবে এদিকওদিক থেকে যা আসে তা তাঁর শিক্ষক হিসাবে প্রাপ্ত সাম্মানিকের থেকে অনেকগুণ বেশি।
ঘোড়া বোধহয় দেবাশিসবাবুর মনের কথা বুঝতে পেরেছে, ঘাস খাওয়া থামিয়ে কেমন বিরস মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ দেবাশিসবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর অবিকল মানুষের গলায় “পোঁদে নাই চাম, হরেকৃষ্ণ নাম” বলে ফৎ করে মুখে একটা শব্দ করে আবার ঘাস খেতে শুরু করল।
এবার দেবাশিসবাবু একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলেন। একটি ঘোড়া তাঁর মতো মান্যগণ্য মান্যবরকে অপমান করল! এই নিয়ে থানার বড়বাবুকে ফোন ঘোরানো উচিত নাকি একটি ঘোড়া অবিকল মানুষের গলায় কথা বলল বলে অবাক হয়ে বসে থাকা উচিত? দেবাশিসবাবু এসব ভাবতে ভাবতেই লোটাকম্বল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে হাজির থানার বড়বাবু। মাথা থেকে পুলিশের ঘেমো টুপি খুলে টাকমাথায় জমা হওয়া ঘাম মুছে শোনালেন ওঁর দুঃখের কথা। ওপরমহলের হুকুম অগ্রাহ্য করে চোর ধরার অপরাধে ভদ্রলোকের বদলি হয়ে গেছে। ঘোড়াটা আবার পিছন থেকে অবিকল মানুষের গলায় বলে উঠল, “বেশ হয়েছে।” এবার অবাক হয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকালেন দেবাশিসবাবু। না মানুষ না, অবিকল ঘোড়া, লম্বাটে মুখ, সারা শরীরে শ্যাম্পু করা চকচকে লোম, চারটি পায়ে চারটি পালিশ করা ক্ষুর। এদিকে ততক্ষণে বড়বাবু হাওয়া। চোর ধরা পড়ার খবর শুনলে আজকাল দেবাশিসবাবু আতঙ্কে থাকেন। বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। নিজের ঘরে দরজা আটকে শুয়ে থাকেন। দরকার পড়লে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। সে যাই হোক, দেবাশিসবাবুর বিস্ময়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ঘোড়ার পিঠে তখন স্বয়ং রবি ঠাকুর। দেবাশিসবাবু ইদানীং সভাসমিতিতে বলার জন্য গীতাঞ্জলিটা ঘাঁটছিলেন বটে, তবে একেবারে সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথ আজ তাঁর সামনে! আবেগে বিহ্বল হয়ে কবিগুরুর সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন দেবাশিসবাবু। তারপর লক্ষ করলেন রবি ঠাকুর ঘামছেন। দেবাশিসবাবু হাতকে হাতপাখা বানিয়ে হাওয়া করবেন নাকি ফুঁ দেবেন বুঝতে না পেরে ছটফট করতে লাগলেন, তক্ষুনি আবার বিশ্রীভাবে ঘোড়াটা বলে উঠল, “আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে যায় রে। পিছনে হুলো দিলেও তো মুখ দিয়ে একটা আস্ত কবিতা বের করতে পারবি না।”
এই অসভ্য, এঁচোড়-পাকা, বহিরাগত ঘোড়াটির ওপর এবার খুব রাগ হল দেবাশিসবাবুর। প্রাণীসম্পদ ভবনে একবার ফোন করবেন কিনা ভাবতে ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। গুরুদেবকে কাঁদতে দেখে আবার দৃষ্টি ঘোরালেন দেবাশিসবাবু। গুরুদেব এবার ঘোড়ার ওপর বসে বিলাপ করতে লাগলেন, “আমার ঘর আর আমার রইল না গো! আমার ঘরের নামফলকে আজ আমার নাম নেই। এত বছরের শান্তি ভাঙিয়ে আজ এরা আমাকে উদ্বাস্তু ভূত করে দিয়ছে রে, আজ আমি বলে গেলাম, এতদিন কলম ভেঙেছি, এই অনাচার বন্ধ না হলে এবার ঘাড় মটকাব।”
রবীন্দ্রনাথের মুখে এরকম হুমকি শুনে ব্যোমকে গেলেন দেবাশিসবাবু। তারপরই আচমকা উনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া ছুটছে, ঘোড়ার পিঠে রশি হাতে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর কোমর জড়িয়ে দেবাশিসবাবু। রবীন্দ্রনাথের কোমর জড়ানোর সুযোগ পেয়ে গর্ববোধ হলেও এরকম পাগলা ঘোড়ার দুর্দম গতিতে তিনি শঙ্কিত হলেন। রবি ঠাকুরের শ্বেতশুভ্র দাড়ি হাওয়াতে উড়ছে, এমন সময়ে দেবাশিসবাবু হঠাৎ চমকে উঠলেন, কোথায় শ্বেতশুভ্র দাড়ি? এ তো সাদাকালো মেশানো কোঁকড়াচুলো দাড়ি! নবাগত অশ্বারোহী মুখ ঘোরাতেই চিনতে পারলেন দেবাশিসবাবু। ইনি তো মার্ক্স সাহেব! কলেজজীবনে এঁর ছবি পিছনে টাঙিয়ে কত সেমিনার, আলোচনাসভা করেছেন দেবাশিসবাবু। ছবিতে এতদিন বুঝতে পারেননি, তবে মার্ক্স সাহেবের দাড়িতে বড়ই বোঁটকা গন্ধ, সাহেব মানুষ স্নানটান অত পছন্দ করেন না বোধহয়। তবে একই দিনে দুই বিখ্যাত মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে রোমাঞ্চিত হলেন দেবাশিসবাবু। হেল্লো স্যার, মাইসেল্ফ দেবাশিস ব্যানার্জি, এক্স লিডার অফ মার্ক্সবাদী ছাত্র দল (আগুনখেকো)। বিগ ফ্যান স্যার, বিগ ফ্যান… বলতেই পিছনে ক্যাঁৎ করে লাথি। দেবাশিসবাবু পপাৎ ধরণীতল। ঘোড়াটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে, ঘোড়ার হাসি যে এরকম হয় তা দেবাশিসবাবুর জানা ছিল না, ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতেই অবিকল মানুষের গলায় বলছে, “ওঠ শালা, এটা কি তোর মামাবাড়ি নাকি যে বেলা পর্যন্ত ঘুমাবি?”
ঘোড়ার মুখের বদলে এবার দেবাশিসবাবু দেখতে পেলেন জেলরক্ষীর মুখ। জেলখানায় দেবাশিসবাবুর সেলের ভিতর ঘুলঘুলি দিয়ে তখন দিনের প্রথম সূর্য কিরণ লুটিয়ে পড়েছে। দেবাশিসবাবু দুর্নীতি মামলায় বিচারাধীন বন্দি গত তিন মাস ধরে। আজ ভাবছেন আইনজীবী মারফত ফ্রয়েডের ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিম বইটা আনিয়ে রাখবেন। পড়ব পড়ব করেও কোনওদিন পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে আজ বইটি দেবাশিসবাবুর আশু প্রয়োজন।